এক পোস্টে এক ভাই তর্ক শুরু করলেন, "ইব্রাহিমকে (আঃ) ইহুদি খ্রিষ্টান ও মুসলিমদের জনক বলা হয়। তাহলে মক্কার মতন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের হজ্ব করার রেকর্ড নেই কেন? মক্কায়তো পেগানরা (পৌত্তলিক) হজ্ব করতো।"
খুবই বেসিক নলেজ। কিন্তু প্রশ্নকর্তা নিজেকে পন্ডিত মনে করে বিরাট প্যাঁচে ফেলে দিয়েছেন ভেবে পুলকিত হচ্ছিলেন। সমস্যা বাঁধলো যখন দেখলাম অনেক মুসলিমই এই বেসিক প্রশ্নেরই উত্তর জানেনা।
সমস্যার সমাধান কমন সেন্সে।
তবে আগে কিছু সাধারণ জ্ঞান বিতরণ করি। প্রতিটা মুসলিমই জানেন, তারপরেও ঝালাই করার জন্যই বলা।
ইব্রাহিম (আঃ) যখন ধর্ম প্রচার করেন, তখন বলেন "এক আল্লাহর উপাসনা করতে হবে, আর কারোর না।" মানে হচ্ছে, একেশ্বরবাদী ধর্মের প্রচার।
কিন্তু ঐ প্রশ্নকারী ভাইয়ের কমেন্ট পড়ে মনে হলো যে তিনি মনে করেন যে ইব্রাহিম (আঃ) একটি জাতিকে তিনভাগে ভাগ করে লাইনে দাঁড় করিয়ে বলেছেন, "আজকে থেকে তোমরা ইহুদি, তোমরা খ্রিষ্টান এবং তোমরা মুসলমান।"
ধারণাটা বেয়াক্কেলের মতন শোনাচ্ছে না? কিন্তু কমেন্টকারীর ধারণা বোধয় এটাই। কারন যতই তাঁকে বুঝানো হোক না কেন, উনি একই ত্যানা প্যাঁচায় যাচ্ছেন, "ইহুদি খ্রিষ্টানরাতো হজ্জ্বে আসার কোন রেকর্ড নেই, ওখানে আসতো শুধু পেগানরা।"
মুসলিম ঘরে জন্মে ইসলাম সম্পর্কে এত সাধারণ জ্ঞানটাই নেই, তা নিয়ে লজ্জাবোধতো দূরের কথা, উল্টো সেটা নিয়েই অহংকার করছে। বেহুদা প্রশ্নের উত্তর বারবার লিখতে গেলে মেজাজ খারাপ হয়না?
তা ইহুদি ধর্ম এসেছে কিভাবে?
ইব্রাহিম নবীর (আঃ) দুই ছেলে ছিল। ইসমাঈল (আঃ) এবং ইসহাক (আঃ)। ইসহাকের (আঃ) পুত্র ইয়াকুব (আঃ)। এই ইয়াকুবেরই (আঃ) আরেক নাম ইসরাঈল (আঃ)। যার পুত্র ছিলেন "রূপকুমার" ইউসুফ (আঃ), এবং তাঁর অন্যান্য ভাইয়েরা। এই ভাইয়েরা ও ইউসুফ (আঃ) নবীর বংশধরদেরই বলা হতো "বনু ইসরাঈল" (ইসরাঈলের গোত্র/পরিবার/সম্প্রদায়/বংশধর)। যারা এক সময়ে মিসরে স্থায়ী হন, এবং ফেরাউন বংশ তাঁদের উপর জবরদস্তি করে তাঁদের দাস বানিয়ে ফেলে। চলতে থাকে অকথ্য নির্যাতন। ওদের উদ্ধার হয় মুসা (আঃ) নবীর মাধ্যমে, যার ভাই হারুনও (আঃ) ছিলেন একজন নবী। এই উম্মতরাই (জাতি) ছিল "ইহুদি" - যাদেরকে আল্লাহ তখন পৃথিবীর অন্যান্য সব জাতির তুলনায় শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছিলেন। যা ওদের অহংকারের কারন হলো। এক পরিবারে প্রতি জেনারেশনে একটা করে নবী জন্মালে আমরাও অহংকারী হতাম। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করেছেন।
তা এই ইহুদি বংশেই জন্মগ্রহন করেন মারইয়াম পুত্র ঈসা (আঃ)। ততদিনে ইহুদিদের অনেকখানি পরিবর্তন ঘটেছে। পার্থিব লালসা ওদের দুর্নীতিবাজ বানিয়ে দিয়েছিল। বিস্তারিত অন্যদিন লিখবো ইন শা আল্লাহ। তা ঈসা (আঃ) নবীও একই বাণী প্রচার শুরু করলেন যা তাঁর আগে ইব্রাহিম(আঃ), মুসা (আঃ), ইউসুফ(আঃ), দাউদ(আঃ), সুলাইমান(আঃ) তথা সব নবীই প্রচার করেছেন, "আল্লাহ এক, এবং তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নাই।"
সমস্যা হলো এতে ক্ষমতাবান ইহুদিদের স্বার্থে আঘাত লাগলো। ওরা ঈসাকে (আঃ) সরিয়ে দেয়ার মতলব করলো। আল্লাহ নিজের পরিকল্পনায় ওদের কুমতলবকে নস্যাৎ করে দিলেন। কিভাবে কি করলেন সেটার বর্ণনা কুরআনে বা হাদিসে নেই, তবে স্কলারদের ধারণা, যে লোকটা ঈসাকে (আঃ) ধরিয়ে দিতে এসেছিল, আল্লাহ তাকেই ঈসার (আঃ) রূপ দিয়ে দিলেন, এবং ঈসাকে নিজের কাছে তুলে নিলেন। লোকে ঐ বিশ্বাসঘাতককে ঈসা (আঃ) মনে করে ক্রুশবিদ্ধ করে। আসলেই কিভাবে আল্লাহ ঈসাকে (আঃ) রক্ষা করেছেন সেটা তিনিই ভাল জানেন, তবে এইটাই মুসলিমদের বিশ্বাস যে ঈসা (আঃ) নবীর কিছুই হয়নি, তিনি এখনও আল্লাহর কাছে জীবিত আছেন এবং কেয়ামতের আগে আবার পৃথিবীতে আসবেন। তখন স্বাভাবিক জীবন যাপন শেষে স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করবেন।
কিন্তু ঘটনার সময়ে না কোন মুসলিম ছিল, না কোন খ্রিষ্টান ছিল। ইহুদি ছিল কেবল, এবং স্বাভাবিকভাবেই ওদের কিছু বিরোধীও ছিল।
এই সময়েই একদল বিশ্বাস করতে শুরু করে ঈসা বা যীশু (আঃ) মৃত্যুবরণ করেছেন, এবং কয়েকদিন পরে পুনরুত্থিত হয়ে ফিরেও এসেছেন। এই বিশ্বাসকারীদের থেকেই খ্রিষ্ট ধর্মের উৎপত্তি। ইব্রাহিমীরা আগে ছিল ইহুদি, এখন হলো ইহুদি এবং খ্রিষ্টান।
খ্রিষ্টানদের মধ্যেও ধীরে ধীরে বিভক্তি শুরু হলো। একদল বিশ্বাস করতো যীশু ছিলেন আল্লাহর মিরাকেল, অন্যান্য নবীর মতোই আজ্ঞাবহ দাস, যার কাজ ধর্ম প্রচার করা, এবং আরেকদল বিশ্বাস করতে শুরু করলো যীশু হচ্ছেন আল্লাহর সন্তান, যীশুও গড, এবং তিনশো বছরের বিবর্তনে ট্রিনিটিও যুক্ত হলো। আচ্ছা, এখানে একটা কথা বলে রাখি। অনেকেই মনে করেন, কোন নবীকে, মানে আমাদের নবীজীও ইনক্লুডেড, "আল্লাহর দাস" বললে বুঝিবা বিরাট অসম্মান করা হয়ে যাবে। তাই আমাদের দেশে সবাই প্রিয় নবীজিকে (সঃ) আল্লাহর দাস বললে ক্ষেপে উঠে। "বলেন আল্লাহর বন্ধু! উনি দাস কেন হবেন?"
অথচ এরাই কলিমা শাহাদাতে বলে "....আব্দুহু ওয়া রাসূলুহু।" আরবি "আব্দ" শব্দের মানেই "দাস" - মানে হচ্ছে, "তিনি আল্লাহর দাস ও রাসূল।" নবী (সঃ) চিরজীবনই বলে গেছেন তিনি আল্লাহর আজ্ঞাবহ দাস। আল্লাহ নিজেই কুরআনে বলেছেন তাঁর কাজ হচ্ছে আল্লাহর নির্দেশ পালন করা। কিন্তু লোকে তা মানলেই না। ওদের দৃষ্টিতে "আল্লাহর দাস" হয়তো অসম্মানের হয়ে যাবে, তাই ঈসার (আঃ) উম্মতরা তাঁকে আল্লাহর পুত্রই ঘোষণা দিয়ে বসলো।
আল্লাহ কুরআনে ঈসা (আঃ) সম্পর্কে নিজে বলেছেন "আল্লাহর দাস" মোটেই অসম্মানের পদ না বরং সবচেয়ে সম্মানিত পদের একটি। মানে হচ্ছে, এই আয়াতটি যেকোন নবী রাসূলের জন্যই প্রযোজ্য। এরপরেও আমরা তর্ক তুলি।
যাই হোক, যীশুকে (আঃ) আল্লাহর আজ্ঞাবহ বার্তাবাহক বিবেচনা করা প্রথম দলকে বলতো জুডিও খ্রিষ্টান, মানে ইহুদি ধর্মের আপডেটেড ভার্সন। ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী ওরাই ছিল সঠিক, সত্য পথে চলা জাতি, যারা এক আল্লাহ ছাড়া আর কারোরই উপাসনা করতো না। ওটাই "ইসলাম" কারন ইসলাম মানেই যে আল্লাহর নির্দেশের সামনে আত্মসমর্পণ করে। যে করবে, যে যুগে করবে, সেই মুসলিম। ইহুদি, খ্রিষ্টান বা মুসলিম যে নামেই আলাদা করার চেষ্টা করেন না কেন, কিছুই যায় আসেনা। এই একই যুক্তিতে অনেক মুসলিমই বাস্তবে মুসলিম না, কারন ওরা আল্লাহর নির্দেশের সামনে আত্মসমর্পণ করেনা।
যাই হোক, খ্রিষ্টানদের পরের ধারা স্পষ্টতঃই শিরকে লিপ্ত ছিল। "পিতাই ঈশ্বর, ঈশ্বরই পুত্র (যীশু), ঈশ্বরই পবিত্র আত্মা।" এক আল্লাহকে ওরা তিনের এক বানিয়ে ফেলে। তা যাই হোক, খ্রিষ্টানদের উপর নানান অত্যাচার চালিয়েছে রোমান সম্রাটরা। উন্মাদ সম্রাট নিরো খ্রিষ্টানদের আগুনে পুড়িয়ে সড়কবাতি হিসেবে ব্যবহার করতো। এবং একটা সময়ে রোমান পৌত্তলিক সম্রাট কন্সট্যান্টিন খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করে, এবং তখন এক বৈঠক করে খ্রিষ্টান ধর্মের নিজস্ব সংস্করণ তৈরী করে। এই বৈঠকেই অনেক পৌত্তলিক প্রথা খ্রিষ্টান ধর্মে ঢুকে যায়। কন্সট্যান্টিন নিশ্চিত করে, রোমে বাস করতে হলে ওর সংস্করণের খ্রিষ্টান হতে হবে, নাহলে ভয়াবহ শাস্তি। কাজেই একটা বিরাট সংখ্যার পৌত্তলিক খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে। অনেক জুডিও খ্রিষ্টান নিজ ধর্ম পালনের জন্য দেশ ত্যাগ করে (সালমান আর ফারিসি (রাঃ), নাজ্জাশী (রাঃ) প্রমুখ ছিলেন এমনই জুডিও খ্রিষ্টান)। অনেকে কন্সট্যান্টিনের ধর্মীয় রীতিই গ্রহণ করে।
রোম সম্রাট খ্রিষ্টান হয়ে গেছেন, তাহলে খ্রিষ্টানদের শক্তিতো বাড়বেই। এইবার ওরা ইহুদিদের উপর বদলা নেয়া শুরু করে। নানান অত্যাচার অনাচার চলে। সবচেয়ে বড় অত্যাচার হয়তো এই ছিল যে ওদের মহাপবিত্র বায়তুল মাকদিসকে ওরা আবর্জনা ফেলার স্থানে পাল্টে ফেলে।
আচ্ছা, এখানে বলে রাখা ভাল, খ্রিষ্টান ধর্মের অনেক শাখা প্রশাখায় ভাগ হতে থাকার শুরুটাও ঐ শুরু থেকেই। আমেরিকায় এসে দেখেছি খ্রিষ্টান কতপ্রকার ও কি কি। ক্যাথলিক, অর্থোডক্স এবং প্রটেস্ট্যান্ট এবং ওদেরও বহু উপবিভাগ আছে। রাস্তার এই পাড়ে একটা গির্জা, ওপারে আরেকটা, ঐ কোণায় আরেকটা। তিন গীর্জার মেম্বাররা একে অন্যের গীর্জায় যায় না। কারন "আকিদা" ভিন্ন। কেউ ট্রিনিটিতে বিশ্বাসী, কেউ না।
তা জেরুজালেম বরাবরই ছিল ইহুদিদের জন্য পবিত্র ভূমি (প্রমিস্ড ল্যান্ড)। "পবিত্র ভূমি" কনসেপ্টের মানে হচ্ছে, আল্লাহ একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলকে পবিত্র ঘোষণা করেছেন, সেটা। আমি সিলেটকে "পুণ্যভূমি" ঘোষণা করলাম, কারন এখানে হজরত শাহজালাল (রঃ), শাহপরান (রঃ) সহ তিনশো ষাট আউলিয়া চিরনিদ্রায় শায়িত, এবং আধ্যাত্মিক শহর ইত্যাদি ইত্যাদি যে কারণই থাকুক না কেন, বাস্তবে এর মূল্য শূন্য। আল্লাহ ঘোষণা না করলে সবই সাধারণ। সিলেট যা, ঢাকাও তা। বেহুদা বাস ভরে ভরে বাবা শাহজালাল(রঃ) শাহ্পরানের (রঃ) মাজার জিয়ারত তাই নিছক সিলেট ভ্রমন ছাড়া কিছুই না। আধ্যাত্মিক মূল্য শূন্য।
আল্লাহ যদি জেরুজালেমকে পবিত্র ভূমি না বলে নেত্রকোনাকে পবিত্র ভূমি বলতেন, তাহলে এখানেই তিন ধর্মের লোক জড়ো হতেন।
তা আল্লাহ ইহুদিদের জন্য পবিত্র ভূমি হিসেবে ঘোষণা দিলেন জেরুজালেমকে। খ্রিষ্টানদের জন্যও এটি মহাপবিত্র নগরী হয়ে গেল। কারন, ঈসা (আঃ) নবীর জন্ম এই শহর থেকে মাত্রই কয়েক মাইল দূরে। তাঁর ক্রুশবিদ্ধ হবার স্থান এবং মৃত্যু (ওদের বিশ্বাস) এই শহরেই। তাঁর কবরও এখানেই। তাছাড়া ওরা যেহেতু ইহুদিদেরই আপগ্রেডেড ভার্সন, কাজেই এমনিতেও এই নগরী ওদের কাছে "প্রমিস্ড ল্যান্ড।" মুসা (আঃ) ওদেরও নবী, ইব্রাহিম (আঃ) ওদেরও পিতা।
তা যাই হোক। এই যে একদিকে ইব্রাহিমের (আঃ) একেশ্বরবাদী ধর্মের অনুসারীরা ইহুদি হয়ে খ্রিষ্টান ধর্মে ভাগ হয়ে গেল, অন্য ছেলে, মানে ইসমাঈলের (আঃ) বংশধরদের ঘটনা কি? ইসহাকের (আঃ) ("আইজ্যাক" নামে পরিচিত) বংশে একের পর এক নবী এসেছেন বলেই সবাই একেশ্বরবাদী থাকতে পেরেছিলেন, ইসমাঈলের বংশধরে কোন নবী ছিল কি? না। হাজার বছর ধরে কেউ ছিল না যে ওদের গাইড করবে। ইসমাঈল (আঃ) মক্কায় থেকে যান, সেখানেই সংসার করেন, এবং সেখানেই তাঁর বংশধররা কাবা ঘর হেফাজত করেন। এখন স্বাভাবিকভাবেই, এক ভাইয়ের বংশে একের পর এক নবী জন্মাচ্ছে, সভ্য জনগোষ্ঠী ওরা। আরেক ভাই জনশূন্য মরুভূমি মক্কায় পরে আছে, প্রথম ভাইয়ের বংশধরদের অহংকারতো আসবেই। এই যুগে আমাদের দেশেই বড়লোক ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা গরিব ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের তাচ্ছিল্যের চোখে দেখে, দেখে না? এটাই স্বাভাবিক মানব আচরণ।
তা ইব্রাহিমকে (আঃ) দিয়ে কাবা প্রতিষ্ঠার পর আল্লাহ নির্দেশ দেন আজান (ইবাদতের জন্য আহ্বান, আমাদের প্রচলিত আজান না) দিতে। জনশূন্য প্রান্তরে ইব্রাহিম (আঃ) কাকে আজান দিবেন ভেবে পেলেন না। তবু যেহেতু রবের নির্দেশ তিনি দিলেন।
ইব্রাহিমের(আঃ) কাজ ছিল আজান দেয়া, সেটা ইব্রাহিম করেছেন। আর আল্লাহর কাজ ছিল মক্কায় হজ্জে মানুষ আনা, সেটা তিনি করেছেন। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ ইব্রাহিমের (আঃ) সেই আহ্বানেই সাড়া দিতে প্রতিবছর কাবায় যায়। ইসমাঈলের বংশধররা, এবং যারা তাঁর থেকে ইব্রাহিমী একেশ্বরবাদী ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, তাঁরাই তখন মক্কায় হজ্ব করতেন।
এখন দেখা গেল, ইব্রাহিমের (আঃ) অনুসারীদের একাংশ সেই মিশর হয়ে জেরুজালেমে গিয়ে স্থায়ী হলো। আরেকদল রয়ে গেল মক্কা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায়।
কাহিনী আরও অনেক বিস্তারিত আছে, তা না বলে মূল কথায় আসি। সেটা হচ্ছে, একটা সময়ে মক্কার অধিবাসী এক নেতা শাম অঞ্চলে গিয়ে দেখেন ওদের অধিবাসীরা মূর্তি পূজা করছে। মক্কাবাসীর চাইতে শামবাসির সবদিক দিয়েই অবস্থা ভাল ছিল। নাইজেরিয়ার কোন মানুষ হঠাৎ নিউইয়র্কে আসলে যেমনটা হবে, সেটাই হয়েছে। ও মনে করলো সিরিয়াবাসী যাই করে, সেটাই হয়তো ওদের এই উন্নতির কারন। যেমন আমাদের দেশের অনেকেই মনে করে পশ্চিমা সমাজের সবই বুঝি কল্যাণকর, এবং ওসব অনুকরণ করলেই আমরাও উন্নত হয়ে যাব। ওরা যে উন্নত হয়েছে নিজেদের শিক্ষা দীক্ষা, জ্ঞান চর্চা, ন্যায় বিচারের নিশ্চয়তা, সততা পরিশ্রম ইত্যাদির কারনে, সেটা অনুকরণ না করে বেয়াক্কেলগুলি অনুকরণ করে ওদের নাইটক্লাব, স্ট্রিপক্লাবের সংস্কৃতি, জুয়া, মদ্যপান ও মাদকের অভ্যাস এবং ইত্যাদি ইত্যাদি - যার সাথে অর্থনৈতিক বা জাতীয় উন্নতির কোনই সম্পর্ক নেই।
তা আমর ইবনে লুহাই (শাম ভ্রমন করা সেই ব্যক্তি) ধরে নেয়, হুবাল নামের ঐ মূর্তির পূজা করার কারণেই হয়তো শামবাসী এত উন্নত। যেহেতু সে নেতা শ্রেণীর লোক, সে কাবা ঘরে মূর্তি স্থাপন করায় কেউ কিছু বলে না। তাছাড়া ওদের বংশে শত শত বছর ধরে এমন কেউ জন্মায়নি যে বলবে এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর সামনে মাথা নত না করতে। আমাদের সমাজেই দেখেন না, মাজারে গেলেই দেখবেন লোকজন কেমন "মুসলমান।" সেখানে ওদের কি হাল হবে সহজেই অনুমেয়।
এই হুবালের পাশাপাশি ধীরে ধীরে মূর্তি আসতে লাগলো। তিনশো ষাট মূর্তি জমা হয়ে গেল কাবায়। এককালে একেশ্বরবাদী ইব্রাহিমের (আঃ) ধর্মের অনুসারীরা পুরোদস্তুর পৌত্তলিক হয়ে গেল। যদিও ওদের "ঈশ্বর" আল্লাহই রইলেন।
তারপরে এলেন আমাদের নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মাত্র তেইশ বছরে গোটা আরব পাল্টে গেল। পৌত্তলিকতার অন্ধকারে নিমজ্জিত আরব উপদ্বীপ থেকে মূর্তি পূজা চিরতরে বিদায় নিল। সেই পৌত্তলিকরাই, যাদের পূর্বপুরুষরা একেশ্বরবাদী ছিলেন, তারপরে পৌত্তলিক হলেন, এখন আবার তাঁরাই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলো। ইব্রাহিমের হানাফী বা একেশ্বরবাদী ধর্ম তৃতীয়ভাগে ভাগ হলো, যার নাম হলো মুসলিম। অথবা বলা ভাল, ইব্রাহিমের প্রচার করা আসল ধর্মেই ফেরত গেল।
এই ইতিহাস যেকোন মুসলিম জানে। বিস্তারিত যদি নাও জানে, সংক্ষেপে হলেও জানে। এইটা বেসিক থেকে বেসিকতর নলেজ। এখন কমন সেন্স থাকলেই বুঝার কথা পেগান আরবরাই এককালে ইব্রাহিমী ছিল, পরে পেগান হয়েছে, এবং পরে মুসলিম। এবং ওরা হাজার বছর ধরে মক্কায় হজ্ব পালন করে এসেছেন। এবং ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা জেরুজালেমকেই পবিত্রভূমি জ্ঞান করে এসেছে, কারন ওদেরকে আল্লাহ সেটাই বলেছেন। মক্কায় আসার নির্দেশ ওদের দেয়া হয়নি, কাজেই ওরাও মক্কায় আসেনি।
মুসলিমদেরও প্রথম কেবলা ছিল জেরুজালেম। মুসলিমরা সেদিকে ফিরেই নামাজ পড়তো। আমাদের নবীজিও (সঃ) তাই করতেন। কাবাকে কেবলা বানানো হয়েছে আমাদের নবীকে (সঃ) সম্মান দিয়েই। সূরা বাকারার একদম মাঝের দিকের আয়াতগুলোতে আল্লাহ সেটাই বলেছেন। এবং এটাই মূল বিষয়, আল্লাহ বলেছেন, তাই মুসলিমদের কাছে মক্কা পবিত্র হয়েছে। আল্লাহ যদি না বলতেন, তাহলে এখনও আমরা জেরুজালেমকে কেবলা বানিয়েই নামাজ পড়তাম। তাই বলে জেরুজালেমের সম্মানও আল্লাহ কমিয়ে দেননি। ওটাও আমাদের অতি সম্মানিত, পবিত্র ভূমি। গোটা বিশ্বে মুসলিমদের ইবাদতের জন্য তিনটিই পবিত্র ভূমি নির্ধারিত, মক্কা, মদিনা এবং জেরুজালেম। এ ছাড়া কেউ যদি আজমীর, সিলেট, বাগদাদ, তুর পাহাড়, ওহুদ পাহাড়, জাবালে নূর ইত্যাদিকে ধর্মীয়ভাবে পবিত্র মনে করে কিংবা ভাবে ওসব স্থানে ভ্রমনে পুণ্যার্জন হবে কিংবা মনোবাসনা পূরণ হবে ইত্যাদি, তবে সে ভুল। এই ভুল শুধু ভুল না, শিরক পর্যায়ের পাপ।
আবার বলি, আল আকসা মসজিদ কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে না হয়েছে, সেই মসজিদ থাকবে, নাকি ভেঙ্গে নতুন মসজিদ গড়া হবে ইত্যাদি কোনটাই ব্যাপার না, জেরুজালেম "এলাকাটা" তিন ধর্মের অনুসারীদের জন্যই পবিত্র। যেমনটা কাবা নয়, কাবার এলাকা মুসলিমদের জন্য পবিত্র। কোন কারনে যদি কাবা ঘর সেখানে নাও থাকে, তারপরেও সেই এলাকাটা আমাদের জন্য মহাপবিত্র। কেন? কারন আল্লাহ বলেছেন ওটা পবিত্র, ওদিকে ফিরে নামাজ পড়তে, ওখানে গিয়ে হজ্ব করতে।
যদি তিনি তা না করে বলতেন ব্রাজিলের রেইন ফরেস্টে বিশেষ এলাকাকে ঘিরে তাওয়াফ করতে, তবে আমরা সেটাই করতাম। যেমন ফেরেস্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল আদমকে (আঃ) সিজদাহ দিতে, তাই ফেরেস্তারা দিয়েছিল। আদমকে(আঃ) "প্রভু" বানাতে নয়, বরং আসল প্রভুর নির্দেশ মান্য করতেই সেটা দেয়া। কারন আমাদের কাছে আল্লাহর নির্দেশই হচ্ছে শেষ কথা, কি বা কেন সেটা কোন বিষয় না।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০২২ রাত ১০:৫৪