হযরত উমার (রাঃ) তখন খলিফা, আমিরুল মু'মিনীন। তিনি হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যাঁকে হজরত আবুবকর (রাঃ) খলিফা নির্বাচন করে যখন অন্যান্য সাহাবীদের কাছে জানতে চান, কারও কোন আপত্তি আছে কিনা, তখন আরেকজন বিখ্যাত সাহাবী তালহা (রাঃ) বলেন, "তিনি মুসলিমদের প্রতিই ভীষণ কঠোর।"
আমরা সবাই জানি ন্যায়ের সাথে তিনি কখনও আপোষ করেননি, এবং অন্যায়কারী মুসলিম হলে তাঁর শাস্তি হতো দ্বিগুন। একে অপরাধী, তার উপর মুসলিম হয়ে অপরাধী - ডবল শাস্তি।
এবং অন্যায়কারী যদি নিজের সন্তান হতো, তাহলে শাস্তির পরিমান বহুগুন বেড়ে যেত।
"খলিফার পুত্র হয়ে তোমরা অন্যায় করার সাহস পেলে কোথায়?"
তাঁর নিজের ভাষায়, "আমি তোমাদের এমন শাস্তি দিব যে তোমরা আফসোস করে ভাবতে বাধ্য হবে যে, কেন তোমরা খলিফার সন্তান হয়ে জন্মেছিলে!"
প্রমান, আবু শাহমার মৃত্যু।
আর আমাদের দেশে এইচ.বি.এম ইকবালের মতন দুই পয়সার সন্ত্রাসী এমপির ভাতিজা মদ খেয়ে গাড়ি চালিয়ে মানুষ মেরে বহাল তবিয়তে বিদেশে পালাবার ধান্দা খুঁজে! আর আমরা চোখ বন্ধ করে তালি বাজাই।
তা একদিন সেই হযরত উমারের (রাঃ) কাছে এক বৃদ্ধ এসে উপস্থিত। কিছুক্ষণ ইতস্তত করার পর বৃদ্ধ বললেন, "হে বিশ্বাসীদের নেতা, আমি আমার মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছি। পাত্র মাশাল্লাহ ভাল। কিন্তু আমার মেয়ের অতীতে একটা দাগ আছে। প্রথম যৌবনে এক ছেলের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল এবং একদিন ভুলবশত....."
বৃদ্ধের কন্ঠ রোধ হয়ে গেল।
"জেনা (ব্যভিচার) করে ফেলেছে?" উমার (রাঃ) কথাটা শেষ করলেন।
বৃদ্ধ উত্তরে কেবল উপর নিচ মাথা নাড়লেন। তাঁর দুই চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝরলো।
খলিফা বিরবির করে বললেন, "লা হাওলা ওয়ালা কু ওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।"
আক্ষরিক মানে হচ্ছে "আল্লাহ ব্যতীত কোন শক্তি বা ক্ষমতা নেই।"
ভাবানুবাদ করলে, "আমি স্বীকার করে নিচ্ছি আল্লাহর সাহায্য ছাড়া আমি কোন কাজ বা বিচার করতে অক্ষম।"
উমার (রাঃ) জানতে চাইলেন, "তোমার মেয়ে কী নিজের অপকর্মে অনুতপ্ত?"
বৃদ্ধ বললেন, "সে নিজের ভুল বুঝতে পেরে খুব কেঁদেছে।"
খলিফা বললেন, "আল্লাহ গাফুরুর রহিম, পরম ক্ষমাশীল। তিনি নিশ্চই তাঁকে ক্ষমা করবেন।"
বৃদ্ধ বললেন, "এখন আমি বুঝতে পারছি না, বিয়ের আগে কী ছেলেকে জানাবো সেই সম্পর্কের ব্যপারে? তাহলে আমার মেয়ের বিয়ে ভেঙ্গে যাবে।"
খলিফা সাথে সাথে গলা চড়িয়ে ধমক দিলেন, "আল্লাহ যে ব্যপারটাকে চেপে রেখেছেন, তুমি কোন সাহসে সেটাকে সবার সামনে তুলে আনার চেষ্টা করছো? যা হবার হয়েছে, অতীতকে নিয়ে এত ঘাটাঘাটি করোনা। মেয়ের বিয়ের প্রস্তুতি নাও।"
কথা হচ্ছে, আমাদের দেশের এবং সেই সাথে আপামর বিশ্বের মানুষের ধারনা ব্যাভিচারের ব্যাপারে ইসলাম ভয়াবহ রকমের কট্টর। সৌদি এবং ইরানসহ বিশ্বের নানান শরিয়া আইন প্রধান দেশগুলোতে ব্যভিচারের কারনে চাবুকের শাস্তি, পাথর মেরে মৃত্যুদন্ড একটি নিয়মিত ঘটনা। আমাদের দেশেও গ্রামের দিকে মোল্লারা ফতোয়া জারি করে মেয়েদের শাস্তি দিয়ে থাকে, এবং সেই শাস্তির ভিডিও ইউটিউবে নিয়মিত আপলোডও হয়।
সেখানে খলিফা উমারের(রাঃ) মতন একজন লোক কিভাবে মেয়েটির ব্যপারে এত নরম থাকলেন? উমারের (রাঃ) চেয়ে ইসলাম বেশি বুঝে এমন লোকতো পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। এবং যতদুর তাঁকে চিনি, তিনি সামাজিকতা রক্ষা করতে আল্লাহর নির্দেশের বিরুদ্ধে যাবার লোক নন।
চিন্তার বিষয়, তাই না?
তাহলে আইনের একটু গভীরে যাওয়া যাক।
ইসলামি আইনে কাউকে শাস্তি দেয়ার প্রথম শর্তই হচ্ছে চাক্ষুষ সাক্ষী থাকতে হবে। অর্থাৎ, "অপকর্ম" করার সময়ে আপনাকে একদম ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকতে হবে।
"আমার সামনে তারা রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে" - ধরনের সাক্ষ্যও কিন্তু গ্রহণযোগ্য নয়।
ভাই বোনও পারিবারিক বিষয় নিয়ে গোপন আলোচনা করতে চাইলে রুমের দরজা বন্ধ করে দিতে পারে। "রুদ্ধদ্বার বৈঠক" নামে একটা টার্মই আছে ডিকশনারিতে। আপনি কী ওদের সেই কাজ করতে দেখেছেন? তাহলে আপনি কিভাবে নিশ্চিত হচ্ছেন?
এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে, সেটা কিভাবে সম্ভব? এটাই exact পয়েন্ট। এটা কোন পরিস্থিতিতে সম্ভব? যখন কেউ পাবলিক সেক্স করবে, তখন!
এবং পাবলিক ইনডিসেন্সির ব্যপারে খোদ অ্যামেরিকাতেই স্টেটভেদে কী কী আইন আছে একটু গুগল করে জেনে নিন প্লিজ। ইসলামের দিকে আঙ্গুল তুললেই হবেনা, সমাজ রক্ষায় সব দেশের সব আইনই "কট্টর।"
প্রশ্ন উঠবেই, তাহলে সৌদিতে এরকম হচ্ছে কেন? ইরানে হচ্ছে কেন? ব্লা ব্লা ব্লা।
উত্তর হচ্ছে, আইনের মিস ইউজ কী আমাদের দেশেও হচ্ছে না? বিনা দোষে ফাঁসিতে ঝুলার ঘটনাও আমাদের দেশে হয়েছে। আমার নিজের এক নানা পুলিশ অফিসার ছিলেন এবং তিনি নিজে বলেছেন কিভাবে মন্ত্রীর চাপে পরে তাঁরা বাধ্য হয়েছিলেন "ডলা" দিয়ে নির্দোষ দুইটি ছেলেকে দিয়ে একটি খুনের মামলার স্বীকারোক্তি দিতে। আসল খুনি ছিল মন্ত্রীর শ্যালক!
তাহলে কী ইংল্যান্ড প্রবাসী ছাগলটার মতন দেশের সংবিধানে আগুন ধরিয়ে দিতে হবে?
কেউ কেউ ম্যা ম্যা করে বলবে, "নবিজি (সঃ) নিজেও একজনকে শাস্তি হিসেবে পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যু দিয়েছেন।"
এবং একারণেই আগেভাবেই ছাগল বলে নিলাম। কারণ ঘটনার পুরোটা না বলে তারা শুধু শেষাংশ বলে। ফলাফল উস্কানি এবং কাটাকাটি মারামারি।
নবীজির (সঃ) ঘটনাটা হচ্ছে, এক সাহাবী এসে তাঁকে বললেন, "আমি ব্যভিচার করেছি, আমি শাস্তি চাই।"
নবীজি (সঃ) কিছু না বলে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। যেন ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন "সেটা তোমার আর আল্লাহর ব্যপার। এখন বিদায় হও।"
লোকটা অন্যপাশে এসে তাঁকে বললেন, "আমি ব্যভিচার করেছি, আমি শাস্তি চাই।"
তিনি আবারও কিছু না বলে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।
লোকটা আবারও একই কাজ করলেন। নবিজিও একই কাজ করলেন।
এইভাবে লোকটা চারবার নিজের বিরুদ্ধেই সাক্ষ্য দিল।
নবীজি (সঃ) হতাশ স্বরে বললেন, "তুমি কী উন্মাদ?"
লোকটা বললেন, "না।"
"তুমি বিবাহিত?"
"জ্বী।"
তখনই কেবল তিনি লোকটিকে মৃত্যুদন্ডের শাস্তি দিলেন। কারন? লোকটাই চাইছিল না আল্লাহ তাঁকে পরকালে শাস্তি দিক।
এবং নবী হয়ে তিনি শাস্তি ডিনাই করতে পারেননা। নবীদের স্বভাবে "স্বজনপ্রীতি" ব্যপারটা ছিল না।
কেউ কেউ আবার মনে করতে পারেন, যাক ইসলাম যেহেতু পাবলিক সেক্সের শাস্তির কথা বলেছে, মানে প্রাইভেট সেক্সে (নিজের লিগাল সঙ্গী/সঙ্গিনী ছাড়া অন্যের সাথে) আপত্তি নেই।
জ্বিনা, সেটার শাস্তি আরও ভয়ানক। পৃথিবীতে পার পেয়ে গেলেও পরের জন্মে ঠিকই ধরা খেতে হবে, এবং সেই শাস্তি আরও ভয়ংকর।
এখন জেনার শাস্তি একশো ঘা বেত এইটা আমরা জানি। তবে আশি ঘা বেতের শাস্তি কোন অপরাধের জন্য জানেন? যারা ইচ্ছা করে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় অপরের নামে। এবং সেটা যে বিচারকের সামনেই হতে হবে এমন নয়।
"জানো, কালকে না অমুককে তমুকের সাথে দেখেছি ফার্মেসির সামনে - বুঝতেই পারছো কী কিনতে গিয়েছিল! হিহিহি।"
তারা ফার্মেসিতে ইয়ে কিনতে যাক বা ওরস্যালাইন কিনতে যাক, তোর বাপের কী? লাগিয়ে দিলিতো গিট্টু?
ব্যস, এখন বাঙালি সমাজে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে যেতে সময় লাগবে না একটুকুও। আমি জানার আগেই সমাজ জেনে যাবে অমুক মেয়ের সাথে আমার প্রেম! কত সংসার যে ভাঙ্গে এদের কারনে!
এক প্রবাসী ছেলে হয়তো দেশে গিয়ে বিয়ে করেছে। ইমিগ্রেশনের কারনে বউকে আনতে দেরী হচ্ছে। অমনি একদল অশিক্ষিত মূর্খ্য আত্মীয়স্বজন এসে কানে কথা লাগাবে, "এতদিন হয়ে গেল বিয়ের, তোমার স্বামী তোমাকে নিচ্ছে না কেন?" তারপর ইনিয়ে বিনিয়ে বলবে, "আমার এক আত্মীয়ের সাথে এমন হয়েছিল, বিদেশে বউ রেখে দেশে আরেকটা বিয়ে করে গেছে। আশা করি তোমার স্বামী অমনটা হবে না।"
কিংবা বলবে, "বিদেশে গার্লফ্রেন্ডট্রেন্ড নেইতো? বলা যায়না, আমাদের দেশের ছেলেরা আবার ফর্সা রান দেখলে মাথা ঠিক রাখতে পারেনা।"
এমনটা ঘটছে না? দেশেইতো এমনটা ঘটে।
"ভাই, কালকে ভাবিকে দেখলাম নিউ মার্কেটে শপিং করতে। সাথে ফর্সা মতন লম্বা একটা ছেলেও ছিল, উনি কী আপনার শ্যালক? হেহেহে।"
বাস্তবে হয়তো মেয়েটির সাথে স্কুল জীবনের কোন এক বন্ধুর দেখা হয়ে গিয়েছিল। হাই হ্যালো শেষে বিদায়ও নেয়া হয়ে গেছে। বাকি মশলা এই ভদ্র(!?)লোকের।
ভুক্তভোগী যে কেউ স্বীকার করবেন, এইসমস্ত ফকির-ফকিরনীদের শাস্তি আশি ঘা বেত নয়, বরং মৃত্যুদন্ড হওয়া উচিৎ ছিল। শাস্তিটা বড্ড শিথিল হয়ে গেল।
ইসলামি আইনে কেবল সেইসমস্ত শাস্তির বিধান এসেছে, যা সমাজের ক্ষতি করে। যেগুলো করে না, সেগুলো পরকালের জন্য তোলা আছে।
"সমাজের ক্ষতি" নিয়ে যখন কথা উঠলোই, তখন আরেকটা কমন ইস্যু নিয়ে ঝটপট কিছু কথা বলে ফেলা যাক।
"ইসলামে চুরি মানেই হস্ত কর্তন!"
খুবই ফালতু ধারনা।
পৃথিবীর আর অন্যান্য সব দেশের মতন ইসলামেও চুরির বিভিন্ন লেভেল আছে। অ্যামেরিকার আইনেই যেমন চুরির বিভিন্ন শ্রেণীবিভাগ এমন,
Theft under $50 Class C Misdemeanor 0-$500 fine
Theft $50-$500 Class B Misdemeanor 0-$2,000 fine and 0-180 days in jail
Theft $500-$1500 Class A Misdemeanor 0-$4,000 fine and 0-1 year in jail
Theft $1,500-$20,000 State Jail Felony 0-$10,000 fine and 180 days-2 years prison
Theft $20,000-$100,000 3rd Degree Felony 0-$10,000 fine and 2-10 years in prison
Theft $100,000-$200,000 2nd Degree Felony 0-$10,000 fine and 2-20 years in prison
Theft over $200,000 1st Degree Felony 0-$10,000 fine and 5-99 years/or life.
ইসলামী আইনেও ব্যপারটা তাই। কাউকে শাস্তি দেয়ার আগে অনেক কিছুই বিচারাধীন রাখতে হয়।
"কী চুরি করলো? কেন চুরি করলো? কত টাকার মাল চুরি করলো? চুরি করার সময়ে মাল কি সুরক্ষিত ছিল? নাকি মালিকের খামখেয়ালিপনা ছিল? চোর কী তালা/সিকিউরিটি ভেঙ্গে চুরি করেছিল? নাকি ফেলে রাখা জিনিস তুলে নিয়ে গেছে? চোরের কী এটাই প্রথম চুরি? নাকি সে পেশাদার চোর?"
এবং এসব তথ্যের উপরই তাঁর শাস্তি নির্ভর করে। হস্তকর্তন হচ্ছে একদম শেষ পর্যায়ের শাস্তি।
এবং এখানেও ক্যাপিটাল পানিশমেন্টের জন্য চারজন চাক্ষুষ সাক্ষীর প্রয়োজন আছে। যাকে বলে beyond reasonable doubt.
গত জুলাই মাসের পনের তারিখে ক্যানভাসে রনিয়া রহিমের একটি পোস্ট (যা সে অনলাইন থেকে সংগৃহিত করেছে, মূল লেখক খেয়াঘাট) হুবহু কপি পেস্ট করে দিচ্ছি, উদাহরণ হিসেবে কাজে লাগবে।
"ইউফ্রেটিস নদীর উত্তর দিকে অবস্থিত সিরিয়ার একটি শহর রাকা।(Ar Raqqah) । সেখান থেকে খলিফা হারুন উর রশীদের দরবারে একটি চিঠি আসলো। চিঠিতে লিখা- শহরের বিচারক একমাস যাবত অসুস্থ। বিচারকাজ স্থবির হয়ে আছে। খলীফা যেন খুব দ্রুত ব্যবস্থা নেন।
খলীফা ফেরত চিঠি পাঠালেন। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে নতুন বিচারক শহরে আসছে।
ঠিক এক সপ্তাহের মধ্যেই রাকা শহরে নতুন বিচারক এসে কাজে যোগ দিলেন।
বিচার কাজ শুরু হয়েছে। প্রহরীরা একজন বৃদ্ধা মহিলাকে হাজির করলো। মহিলার অপরাধ-সে শহরের রেস্তোরা থেকে একঝুড়ি রুটি আর এক শিশি মধু চুরি করতে গিয়ে একেবারে হাতেনাতে ধরা পড়েছে।
বুড়ি কি জানেনা , খলীফা হারুনের রশীদের রাজ্যে চুরি করা কতবড় অন্যায়। এ জন্য আইনত চোরের হাতকাটা যাবে, জরিমানা হবে, জেলদন্ড হবে।
বিচারক জিগ্গাসা করলেন-
আপনি চুরি করেছেন?
জ্বি হুজুর আমি চুরি করেছি।
আপনি কি জানেন, চুরি করা কতবড় অপরাধ? কত বড় পাপ?
জ্বি জানি। অনেক বড় অপরাধ। ক্ষমার অযোগ্য।
জানেন,এজন্য আপনার কতবড় শাস্তি হতে পারে?
জ্বি জানি। আর্থিক জরিমানা, জেলজরিমানা এমনকি আমার হাতও কাটা যেতে পারে।
তবে এসব জেনেও কেন আপনি চুরি করেছেন?
কারণ, আমি গত এক সপ্তাহ ধরে অভুক্ত। শুধু আমি অভুক্ত হলেও কথা ছিলো। সাথে আমার এতিম দু নাতিও না খেয়ে আছে। তাই চুরি করেছি। আমার আর কোনো উপায় ছিলোনা হুজুর।
বিচারক এবার পুরো দরবারঘরে চোখ বুলালেন। তারপর বললেন- কাল যেন নগর প্রধান, খাদ্যগুদাম প্রধান, শরিয়া প্রধান , পুলিশ প্রধান, সমাজ হিতৈষি সহ গন্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকেন। যথাসময়ে রায় দেয়া হবে।
বিচারকের নির্দেশ পেয়ে পরদিন সকালে সবাই হাজির। বিচারকও যথাসময়ে উপস্থিত হলেন। রায় ঘোষণা হলো-
চুরি করার অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণীত হওয়ায় মোট ৫০টি চাবুক, ১০০ দিনার রৌপ্যমুদ্রা জরিমানা আর অনাদায়ে ১ বছরের কারাদন্ড ধার্য্য করা হলো। তবে বৃদ্ধা মহিলা কোন চলচাতুরীর আশ্রয় না নিয়ে অকপটে সত্য কথা বলার জন্য হাত কাটা মওকুফ করা হলো।
এবার বিচারক প্রহরীকে চাবুক আনার নির্দেশ দিয়ে নিজে বিচারকের চেয়ার থেকে নীচে নেমে এসে বৃদ্ধা মহিলার পাশে দাঁড়ালেন।
প্রহরীকে বললেন- যে নগরে একজন বুভুক্ষু মহিলা না খেয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণায় চুরি করতে বাধ্য হয়-সেখানে তো সবচেয়ে বড় অপরাধী সে দেশের খলীফা। আর খলীফার প্রতিনিধি হয়ে আমি বিচার করতে এসেছি।-তাঁর অধীনে আমি যেহেতু চাকরী করি। তাই ৫০ চাবুকের ২০টি আমার হাতে মারাই হোক। আর এটাই বিচারকের আদেশ। আদেশ যেন পালন করা হয়। বিচারক হিসাবে চাবুক মারতে আমার ওপর যেন বিন্দুমাত্র করুনা অথবা দয়া না দেখানো হয়।
বিচারক হাত বাড়িয়ে দিলেন।দুহাতে পরপর ২০টি চাবুক মারা হলো। চাবুকের আঘাতে হাত থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। এরপর বিচারক পকেট থেকে একটা রুমাল বের করলেন।
একজন রুমালখানা দিয়ে বিচারকের হাতে বাঁধার জন্য এগিয়ে গেলে-বিচারক নিষেধ করেলেন।
এরপর, বিচারক বললেন- যে শহরে নগর প্রধান, খাদ্যগুদাম প্রধান সহ অন্যান্য সমাজ হিতৈষীরা একজন অভাবগ্রস্থ মহিলার ভরণ পোষণের ব্যবস্থা করতে পারেনা। তারাও অপরাধী। তাই বাকি ৩০ টি চাবুক সমানভাবে তাদেরকেও মারা হোক।
এরপর বিচারক, নিজ পকেট থেকে বের করা রুমালের ওপর ৫০টি রোপ্য মুদ্রা রাখলেন। তারপর উপস্থিত সবাইকে বললেন- যে সমাজ একজন বয়স্ক মহিলাকে চোর বানায়, যে ঘরে এতিম শিশু উপবাস থাকে সে সমাজের সবাই অপরাধী। তাই এখানে উপস্থিত সবাইকে -১০ দিনার রোপ্য মুদ্রা জরিমানা করা হলো। এবার মোট ৫০০ দিনার রোপ্য মুদ্রা থেকে ১০০টি রোপ্যমুদ্রা জরিমানা বাবদ রেখে বাকি ৪০০ রোপ্যমুদ্রা থেকে ২০টি চুরি যাওয়া দোকানের মালিককে দেয়া হলো। আর বাকি ৩৮০ টি বৃদ্ধা মহিলাকে দিয়ে বিচারক বললেন- এগুলো হলো আপনার ভরণপোষনের জন্য। আর আগামি মাসে আপনি বাগদাদে খলিফা হারুন উর রশীদের দরবারে আসবেন, খলীফা আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।
পরের মাসে বৃদ্ধা মহিলা খলীফার দরবারে গিয়ে দেখেন- খলীফার আসনে বসা লোকটিকে যেন কেমন চেনা চেনা মনে হয়। তারপর ভয়ে ভয়ে খলীফার আসনের দিকে এগিয়ে যান। একেবারে কাছে গিয়ে বুঝতে পারেন, লোকটি আর কেউ না, এতো সেদিনের সেই বিচারক।
খলীফা চেয়ার থেকে নেমে এসে বলেন-
আপনাকে আর আপনার এতিম দু নাতিকে উপোস রাখার জন্য সেদিন বিচারক হিসাবে ক্ষমা চেয়েছিলাম, আর আজ দরবারে ডেকে এনেছি- প্রজা অধিকার সমুন্নত করতে না পারা একজন অধম খলীফাকে ক্ষমা করে দেয়ার জন্য। আপনি আমাকে ক্ষমা করুন বুড়ীমা।
এ মহান খলীফা মাত্র ৪৬ বছর বয়সে ৮০৯ সালে ইরানের খোরাশান প্রদেশের তোস শহরে ইন্তেকাল করেন।
ইতিহাসে যিনি "The Just " হিসাবেই পরিচিত।"
কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, সামান্য চুরির শাস্তি এত কঠিন কেন হলো? এক দুই কোটি টাকা চুরি করলেই বা কি! একজনের হাত কেটে ফেলতে হবে?
তাহলে ব্যপারটা অন্য পয়েন্ট অফ ভিউ থেকেও বলি।
ধরুন, একটা লোক ঘন্টায় আট ডলার কামিয়ে বহু কষ্টে সংসার চালান। তাঁর কাছে আটশো ডলার মানে একশো ঘন্টার কাজ। এই টাকা জমাতে তাঁর কয়েকমাস লেগে যায়। তারপরেও তিনি বহু কষ্টে সঞ্চিত এই টাকা দিয়ে একটি মোবাইল ফোন কিনলেন। আপনি করলেন কী, একদিন সেই আই ফোনটা চুরি করে ফেললেন।
আপনি কী বুঝতে পারছেন যে আপনি এই ফোন চুরির সাথে সাথে তাঁর জীবন থেকে একশোটা ঘন্টাও (চার দিনেরও বেশি সময়) চুরি করে ফেলেছেন?
এখন যদি টাকার অংকটা কোটিতে হয়, তাহলে লোকটার জীবনের কয়টা দিন আপনি চুরি করলেন? সালমান এফ রহমানের মতন চোরেরা যখন শেয়ার মার্কেট লুটের মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষের সারাজীবনের সঞ্চয় চুরি করে ফেলে, কিংবা কোন রাজনৈতিক প্রভাবশালী ভূমি দস্যু কোন সাধারণের চৌদ্দপুরুষের শেষ সম্বল ভিটে বাড়ি দখল করে তাঁদের রাস্তায় নামিয়ে আনে, সেগুলোকে মার্ডার না বললেও মার্ডার থেকে কমই বা বলবেন কোন যুক্তিতে? এদের শাস্তি কী স্রেফ জরিমানা হওয়া উচিৎ? "হস্ত কর্তনও"তো অনেক লঘু হয়ে যায়।
শরিয়া আইন নিয়ে এত ফালতু ফালতু কমেন্ট শুনতে হয়, কারন পৃথিবীর আর অন্যান্য সব দেশের আইনের মতন সেসব দেশেও শাসকেরা নিজেদের ইচ্ছে মতন আইনের অপব্যবহার করে থাকে। এবং সাধারন মানুষেরও এই ব্যপারে স্পষ্ট কোনই ধারনা নেই।
বটম লাইন হচ্ছে, বাঁদরের হাতে তলোয়ার এবং মুর্খ্যের হাতে বিচার ক্ষমতা তুলে দেয়া একই। নেগেটিভ ছাড়া রেজাল্ট কখনও পজিটিভ আসবে না।
ফুটনোট: কেউ কেউ দাবি তুলবেন, অ্যামেরিকায় শরিয়া আইন প্রনয়ন করা হোক।
কেন ভাই? কোথায় পেলেন যে কোন মুসলিম মাইনরিটি দেশে শরিয়া আইন প্রনয়ন করতে বলা হয়েছে? সুখে থাকতে ভুতে কিলায়? আবি সিনিয়ায় হিজরতের নির্দেশ দেয়ার পর নবীজি (সঃ) কী বলেছিলেন সেই দেশের প্রচলিত আইন পাল্টে শরিয়া আইন জারি করতে? তাহলে তুমি কেন মাতবরি ফলাতে আসো? নবীর চেয়ে ইসলাম বেশি বুঝো?
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ ভোর ৫:০২