নবীজির (সঃ) ছোট ছেলেটি যেদিন মারা গেল তাঁর চাচা আবু লাহাব সেদিন মক্কায় মিষ্টি বিতরণ করতে করতে হাসিমুখে বলছিল, "শুনেছ, মুহাম্মদের (সঃ) ছেলেটা মারা গেছে। সে নির্বংশ হয়ে গেছে! হাহাহা।"
সন্তান যে বয়সেরই হোক, তাঁর মৃত্যু কোন বাবা মাই মেনে নিতে পারেননা। আমাদের মুহাম্মদ (সঃ) আল্লাহর নবী হলেও আল্লাহর সিদ্ধান্তে তাঁর বুক ফেটে গিয়েছিল। পিতা হিসেবে তিনিও কাঁদছিলেন। তার উপর নিজের পরিবারেরই এক লোকের এমন আচরণ তাঁর বুক ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল। তবুও তিনি একবারের জন্যও তাঁর কোন সাহাবীকে বলেননি আবু লাহাবের মাথাটা কেটে আনতে।
আল্লাহ শুধু এই ঘটনার জন্যই নাজিল করে দেন একটি আস্ত সুরা, সুরা কাউসার।
এর কিছুদিন আগেই তিনি কাবা ঘরে নামাজ পড়ছিলেন, তখন শুধুই তাঁর সাথে মজা করার জন্য আবু জাহেল নিজের সঙ্গীদের জিজ্ঞেস করলো, "তোমাদের মধ্যে কে গিয়ে ওর গায়ে মরা পশুর পঁচা গলা নাড়িভুড়ি ঢেলে দিতে পারবে?"
একজন পরম উৎসাহের সাথে "ডাস্টবিন" থেকে নিজের হাতে করে পঁচা গলা নাড়িভুড়ি নিয়ে আসল এবং যেই তিনি সিজদায় মাথা নোয়ালেন, তাঁর উপর সব আবর্জনা ঢেলে দিল। আবু জাহেল ও তার সঙ্গীরা হাসিতে ফেটে পড়ল।
তখনও কোন সাহাবী এসে আবু জাহেলের গায়ে হাত তুলেনি। তাঁরা তখন তাঁর কন্যা ফাতিমাকে ডেকে আনলেন, এবং ছোট ফাতিমা এসে কাঁদতে কাঁদতে তাঁর পিতার শরীরের উপর থেকে আবর্জনা পরিষ্কার করলো।
আবু জাহেলের দুষ্টামি শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ ছিল না। মক্কায় নবীর উপর যত অত্যাচার হয়েছে, সবকিছুর নেতৃত্বে ছিল সে। সুমাইয়া-ইয়াসির (রাঃ) দম্পতিকে নৃসংশভাবে হত্যা করেছিল সে। মুসলিমদের সামাজিকভাবে তিনটা বছর বয়কট করার ইন্ধন দাতা সে। নবীজিকে (সঃ) হত্যার পরিকল্পনাকারি সে। মুসলিমদের নিশ্চিহ্ন করার মিশন নিয়ে বদর যুদ্ধে কুরাইশদের নেতৃত্বও এই আবু জাহলই দিয়েছিল।
নবীজি কী আর সাধে বলেছিলেন, "প্রতিটা যুগেই একটা মুসা এবং তার একটা ফেরাউন থাকে। আমার যুগের মুসা আমি এবং আমার ফেরাউনের নাম আবু জাহেল।"
অথচ এই আবু জাহেলের ছেলে যেদিন ইসলাম গ্রহণ করলো, এই মুহাম্মদই (সঃ) তাঁর সাহাবীদের নির্দেশ দিলেন, "তোমরা কেউ আবু জাহেলকে গালাগালি করো না। এতে ইকরিমা (রাঃ) মনে কষ্ট পাবে এবং মৃতেরা কোন কথা শুনতে পায় না।"
এবং নবীজির পথে কাটা বিছানো সেই বুড়ির কথাতো সবাই জানেন। যে একদিন কাঁটা বিছাতে না পারায় নবীজি(সঃ) তাঁর খোঁজ নিতে তাঁর বাড়ি চলে এসেছিলেন, এবং সে অসুস্থ জেনে তাঁর দ্রুত আরোগ্য কামনা করলেন। বুড়ি অবাক হয়ে ভাবলো কোন লোকটাকে সে শুধু শুধু কষ্ট দেয়!
এবং এও সবাই জানেন যে মক্কায় নিজের শত্রুদের হাতের মুঠোয় পেয়েও যিনি উদার কন্ঠে ঘোষণা দিয়েছিলেন, "হে কুরাইশ বংশীয় নর ও নারীগণ! আজকে তোমাদের সবাইকে ক্ষমা করা হলো।"
এইবার আরেকটা মোটামুটি আনকমন ঘটনা শোনাই।
নবীজিকে মকারী করার লোকেদের অভাব কোন কালে কোন যুগেই ছিল না। তিনি স্বয়ং যেখানে আবু জাহেলদের থামাতে পারেননি, সেখানে আমরা কারা? তো একদিন তাঁকে (সঃ) কয়েকটা বিধর্মী সরাসরিই গালাগালি করছিল, এবং তিনিও তাঁর স্বভাব মতন একদম চুপ করে ছিলেন।
কিন্তু তাঁর সাহাবী তাঁর অপমান সহ্য করতে না পেরে পাল্টা জবাব দিতে শুরু করেন। এতে নবীজি উল্টা সেই সাহাবীর উপরই বিরক্ত হয়ে স্থান ত্যাগ করেন।
সাহাবী এসে তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, "হে আল্লাহর দূত! আপনি কেন আমার উপর বিরক্ত হলেন?"
তিনি বললেন, "যতক্ষণ ওরা আমাদের গালাগালি করছিল, ততক্ষণ আমাদের পাশে ফেরেশতারা ছিল। যেই তুমি মুখ খুললে, অমনি তাঁরা চলে গেল, এবং শয়তান এসে সেই স্থান নিয়ে নিল।"
খুবই গুরুত্বপূর্ণ ম্যাসেজ। যতক্ষণ তুমি সঠিক থাকবে, ততক্ষণ কেউ তোমার ক্ষতি করতে পারবেনা। যেই তুমি ভুল পথে পা বাড়াবে, তখন তোমার নিজের ক্ষতিই সবচেয়ে বেশি হবে।
কেউ যদি আমার সাথে তর্ক করে, বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে শুধুশুধু সেই তর্ক না বাড়ানো। এতে ক্ষতি ছাড়া লাভ কিছুই হবেনা। যদি আমি ভুল থাকি, আমি নিজেকে শুধরে নিব। সে যদি ভুল থাকে, এবং ভুল স্বীকার করতে না চায় - তাহলে সেটা তার ব্যপার। মাঝে দিয়ে আমি নিজের ব্লাড প্রেসার বাড়িয়ে, পিটাপিটি মারামারি করে, সম্পর্ক নষ্ট করে, একদম শেষে খুন করে ফাঁসিতে ঝুলে যাওয়ার কী মানে হয়?
আজকাল মানুষ "ইসলাম" "মুসলিম" শব্দগুলো শুনলেই আহাম্মকের মতন মুখ বাকায়। ওদের দোষ নেই, আমাদের একদল রামছাগলের কারনেই ব্যপারটা ঘটেছে।
আহাম্মক বলায় অনেকে মাইন্ড করতে পারেন। ব্যাখ্যা করি - হিটলারের জন্য যদি কেউ পুরো জার্মান জাতিকে, স্তালিনের জন্য পুরো রাশানদের এবং ক্লু ক্লাক্স ক্ল্যান, আরিয়ান ব্রাদারহুড কিংবা হালের গুয়াতেমালা কারাগারের জন্য গোটা অ্যামেরিকানদের সন্ত্রাসী-খুনি ইত্যাদি কমন নামে ডাকা শুরু করে, সেই মহাজ্ঞানী আঁতেলকে আহাম্মক না বলিয়া আর ভিন্ন কী নামে ডাকা যায় তাহা আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের শব্দ ভান্ডারে তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়াও কোন যুৎসই শব্দের সন্ধান পাই নাই।
সে যাক, আমি শুধু নবীজির দীর্ঘ জীবনের মাত্র কয়েকটা ঘটনার উদাহরণ টানলাম। ইসলাম যিনি প্রচার করেছেন, যিনি স্পষ্টভাবে উদাহরণসহ শিখিয়ে গেছেন কিভাবে কোন পরিস্থিতিতে কিভাবে রিএক্ট করতে হবে, আল্লাহ তাঁর কোরানে বারবার নির্দেশ দিয়ে গেছেন, তারপরেও আমাদের বঙ্গ দেশ ও বঙ্গ দেশের বাইরের এক বিরাট আহাম্মক জনগোষ্ঠী সেটাকেই সবসময়ে ওভারট্রাম্প করার চেষ্টা করে। ওদের ভাবখানা এমন যেন তারা হজরত মুহাম্মদ (সঃ) ও আল্লাহকে সরাসরিই বলছে, "আপনারা সাইডে যানতো - আমরা জানি আমাদের কী করতে হবে। ঝামেলা করবেন না, আমাদেরকে আমাদের মত কাজ করতে দিন।"
কেউ যখন আমাদের নবীকে অপমান করে, আমাদের আল্লাহকে গালাগালি করে আমাদের মনে আঘাত করার চেষ্টা করবে, তখন ২০১৫ সালের মুসলিম হিসেবে আমাদের রিয়েকশন কী হওয়া উচিৎ জানেন? একটুও বাড়িয়ে বলছি না, নবীজির শেখানো তরিকাতেই আমাদের রিয়েকশন হওয়া উচিৎ এমন যে আল্লাহর কাছে হাত তুলে আমরা দোয়া করবো, "হে আল্লাহ, আমাদের উপর থেকে কখনই তুমি রহমত বর্ষণ বন্ধ করো না। এবং এমন কোন ব্যবস্থা করো যাতে তসলিমা নাসরিন এবং আসিফ মহিউদ্দিনরা বেহেস্তে আমার প্রতিবেশী হয়।"
আশা করি দোয়াটি ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন হবেনা।
কথা হচ্ছে, এই দোয়া করতে যে বিশাল কলিজা থাকা প্রয়োজন, সেটা কয়জনের আছে?
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১:২৬