জুন মাসের ২০ তারিখ সকাল নয়টা, ২০০১।
৯১১ অপারেটর একটি অদ্ভূত কল পেলেন।
ওপাশ থেকে এক মহিলা হিমশীতল কন্ঠে বললেন, "আমার একজন পুলিশ অফিসার লাগবে।"
অপারেটর বললেন, "অবশ্যই ম্যাম, but what's your emergency?"
অ্যামেরিকায় ৯১১ কল করে পুলিশ চাইলেই পুলিশ পাওয়া যায় এবং দুই মিনিটের মধ্যেই পুলিশী সাহায্য এসে হাজির হয়। এটা এদের চ্যালেঞ্জ। তবে তার আগে অবশ্যই কারন এবং ঘটনার বর্ণনা বিস্তারিতভাবে বলতে হবে। নাহলে দেখা গেল গ্যাং ওয়ার হচ্ছে, এবং ৯১১ অপারেটর মাত্র একজন অফিসার পাঠিয়ে বসলেন। বেচারা সেখানেই ইন্তেকাল করবে। আবার উল্টোটা হলেও ঝামেলা। স্বামী স্ত্রীর ঝগড়া চলছে, দেখা গেল এক ব্যাটালিয়ন পুলিশ সোয়াট টিমের সাথে হেলিকপ্টার নিয়ে হাজির, এফবিআইও এই পথেই আছে।
কাজেই কল পাবার পর অপারেটর একদম বিস্তারিতভাবে জেনে নেন কেন পুলিশ লাগবে, যার বিরুদ্ধে লাগবে তার সাথে অস্ত্র আছে কিনা, ওরা সংখ্যায় কতজন, মারমুখী কিনা ইত্যাদি।
মহিলা আবার বললেন, "আমার একজন অফিসার লাগবে।"
অপারেটর যতই জিজ্ঞেস করেন কেন লাগবে, মহিলার একই জবাব, তাঁর একজন অফিসার লাগবে।
অপারেটর মহিলার ঠিকানা নিয়ে বললেন, "ঠিক আছে আমি পুলিশ পাঠাচ্ছি।"
মহিলা ৯১১ কল রেখে নিজের স্বামীকে ফোন দিলেন। ভদ্রলোক নাসায় কাজ করেন। সকাল নয়টায় মাত্র অফিসে এসেছেন। স্ত্রীর ফোন রিসিভ করে শোনেন তিনি বলছেন, "তোমাকে এখুনি বাড়ি ফিরে আসতে হবে। এখুনি।"
ভদ্রলোক কোন কথা বাড়ালেন না। বুঝলেন কোন একটা সমস্যা হয়েছে। তিনি বাড়ির দিকে রওনা হলেন।
বাড়ি এসে দেখেন তাঁর পুরো বাড়ি পুলিশ, মেডিক্যাল ডাক্তার এবং সরকারী লোকজনে গিজগিজ করছে। কাউকে ভিতরে ঢুকতে বা বেরুতে দেয়া হচ্ছে না। তিনি নিজের পরিচয় দিয়ে ঘটনা কী জানতে চাইলেন।
পুলিশ জানালো তাঁর স্ত্রী তাঁর পাঁচ সন্তানকে মেরে ফেলেছে।
ভদ্রলোক শোকের ধাক্কা সামলাতে সামলাতেই দেখেন তাঁর স্ত্রীকে হাতকড়া পরিয়ে পুলিশ বাড়ি থেকে বের করে এনে গাড়িতে উঠাচ্ছে। মহিলার চেহারায় কোন অভিব্যক্তি নেই। তিনি হাউমাউ কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।
পুরো অ্যামেরিকা ফুঁসে উঠলো। তাঁরা সবাই পাঁচ সন্তান হত্যাকারী মায়ের সর্বোচ্চ শাস্তি চায়।
পুলিশ অফিসার সাক্ষ্য দিতে গিয়ে কেঁদে ফেললেন।
"প্রথমে আমার মনে হয়েছিল মেঝেতে পুতুল পড়ে আছে। গায়ে হাত দিয়ে দেখি এটা মানব শিশু। নিথর। নিষ্পলক আমার দিকেই যেন তাকিয়ে আছে। তারপর আসামী আমাকে দেখালো আরও চারজন বিছানায় শুয়ে আছে। একটা তিনবছরের ছেলের কোলে ছয়মাস বয়সী একটি বাচ্চা মেয়েকে দেখলাম। সবাই মৃত। আমার ক্যারিয়ারে এত কঠিন সময় আমাকে কখনই দেখতে হয়নি।"
অদ্ভূত শোনালেও সত্য, মহিলার পাশে এসে দাঁড়ালেন তাঁর স্বামী। তিনি বারবার মিডিয়াকে এবং আদালতকে বলতে থাকলেন, "আমার স্ত্রী মানসিকভাবে অসুস্থ। সে তাঁর সন্তানদের অত্যন্ত ভালবাসতো। তাঁর মতন মা হয় না। সে একজন চমৎকার স্ত্রী। সে সুস্থ মাথায় এই হত্যাকান্ড কিছুতেই করতে পারেনা।"
মিডিয়া তার স্বভাবমতন রসিয়ে রসিয়ে ঘটনাটাকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করলো এমনভাবে যে আসলে ভদ্রলোক নিজেই খুনি। নাহলে পাঁচ সন্তান হারাবার পর একজন বাবা কিভাবে মিডিয়ার সামনে হাসিমুখে কথা বলতে পারেন? কেন তিনি নিজের খুনি স্ত্রীকে বাঁচাবার চেষ্টা করছেন? কেন? কেন?? কেন???
সত্য ঘটনা হচ্ছে আন্দ্রিয়া ইয়েটস আসলেই একজন মানসিক রোগী ছিলেন। সাইকোলজিতে একে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন বলে। শিশু জন্মের পরে প্রায় সব মায়েরই এমনটা হয়ে থাকে। অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি ঘটনা। শরীরে ম্যাসিভ হরমোনাল চেঞ্জের জন্য এমনটা ঘটে।
আমাদের দেশের বেশিরভাগ লোকই যা জানেনা।
এই সময়ে মায়েরা স্বামীদের খুন করে ফেলতে চায়, অথবা আত্মহত্যা করতে চায়। অথবা এমন কিছু করতে চায় যা সুস্থ মাথার মানুষ কল্পনাও করতে পারেনা। বিদেশে এই রোগের ভাল চিকিৎসা আছে। এরা সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যায়, কাউন্সেলিং করে, ওষুধ খায় - সুস্থ্যও হয়ে যায়।
আমাদের দেশে প্রথমেই মেয়েকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। শ্বাশুড়ি ননদরা মুখ বাঁকিয়ে বলবেন, "আমরা আর মা হই নাই। সবই ঢং আর ফুটানি!"
মেয়ের মা ও বোন বলবেন, "মানিয়ে নে মা.....মানিয়ে নে।"
স্বামিতো কিছুই শুনতে চাইবে না, বুঝাতো বহুদূর।
"দ্যাখো, নানান টেনশনে এমনিতেই আমার মাথা গরম থাকে। তোমার এইসব ফালতু ঢং শুনতে ইচ্ছা করছে না।"
আর পাড়াপ্রতিবেশির কথা বাদ। এদের মতন খচ্চর শ্রেণীর প্রাণী আসল খচ্চরও না।
"জানেন ভাবি, তিনতলার ভাবিটা না (ফুসুর ফুসুর ফুসুর).....হিহিহিহি।"
গৃহিনী আন্দ্রিয়া ইয়েটসের তৃতীয় সন্তান জন্মের পর থেকেই তাঁর মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। তিনি পাগলের মতই সন্তানদের ভালবাসতেন। কিন্তু একই সাথে তাঁর পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন তাঁকে খেয়ে ফেলছিল। নিজের সন্তানদের যাতে ক্ষতি না করতে পারেন, সেজন্য তিনি আত্মহত্যা করতে চাইলেন দুইবার - দুইবারই তিনি ব্যর্থ হলেন। ডাক্তার তাঁকে এন্টি ডিপ্রেশন ওষুধ দিলেন। তিনি কিছুদিন খেলেন। তারপর সুস্থ হয়ে গেছেন ভাবে খাওয়া বন্ধ করে দিলেন।
স্বামী ভাবলেন আরেকটা সন্তান আসলে হয়তো স্ত্রী সুস্থ হয়ে উঠবেন। উল্টোটা ঘটলো। চার সন্তাদের পর অবস্থা আরও বাজে হলো। এরমধ্যে ডিপ্রেশনের ওষুধ মাঝ পথে বন্ধ করে আবার শুরু করায় ব্রেনও এলোমেলো হয়ে গেল।
পঞ্চম সন্তানের জন্ম পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুললো। ডাক্তারের কাউন্সেলিং, হাই ডোজের ওষুধ বা পরিবারের সাহচার্জ্য, কিছুই কাজে এলো না। তিনি একে একে পাঁচটা বাচ্চাকেই বাথটাবের পানিতে চুবিয়ে মারলেন।
ছোট চার বাচ্চা কিছুই বুঝেনি, তারা চুপচাপ মরে গেছে। বড় ছেলেটা ভেবেছিল মা হয়তো তাঁকে কোন দুষ্টামির জন্য শাস্তি দিচ্ছেন। বাথটাবের পানিতে চুবানি খেতে খেতে সে কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, "I'll be good. I'll be good."
বাঙালি বাচ্চা হলে যে বলতো, "আমি আর করবো না মা, আর করবো না।"
মাকে যখন জিজ্ঞেস করা হয় কাজগুলো তুমি কেন করলে? তিনি বলেন, "আমার এক ছেলে বড় হয়ে সিরিয়াল কিলার হতো, আরেকটা ড্রাগ অ্যাডিক্ট। আর মেয়ে হতো বেশ্যা।"
"তোমাকে এই কথা কে বলেছে?"
"শয়তান।"
"শয়তান তোমাকে নিজে বলেছে?"
"হু।"
রাস্টি ইয়েটস ট্রায়ালের শেষ দিন পর্যন্ত স্ত্রীর পক্ষে ছিলেন। অ্যামেরিকান আদালত আন্দ্রিয়াকে সন্তান হত্যার দায় থেকে মুক্ত ঘোষণা করলো। তবে তাঁকে মানসিক রোগের চিকিৎসার নির্দেশ দিল। মহিলা এখনও মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হয়তো আজীবন তাই থাকবেন।
রাস্টির সাথে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। রাস্টি আবার বিয়ে করে এখন নতুনভাবে জীবন শুরু করেছে। তাঁর নতুন সংসারে এখন একটি শিশু। তবে এখনও সে প্রায়ই আন্দ্রিয়ার খোঁজ নিতে হাসপাতালে যায়।
হিউস্টনের একটি কবরস্থানে বিরাট একটা ফলকে লেখা আছে "ইয়েটস," এবং তার নিচেই নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে পাঁচ ভাইবোন।
হিউস্টনের ঘটনাটা কী আমাদের দেশে ঘটেনা? প্রায়ই দেখা যাচ্ছে মায়ের হাতে সন্তান খুন। স্ত্রীর হাতে স্বামী খুন। প্রেমিকের সাথে পালিয়ে গেছে নবজাতকের মা। কিংবা, মায়ের আত্মহত্যা।
আমরা তখন কী করি? কথা ছাড়া মেয়ের দোষ দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলি।
এই এক ঘটনার পর পুরো অ্যামেরিকা নড়েচড়ে বসেছিল। পোস্টপার্টেম ডিপ্রেশনকে এরা হাইয়েস্ট প্রায়োরিটি দিয়ে চিকিৎসা করে। এরা শিক্ষিত জাতি। এরা বুঝে যে মানসিক রোগ মানেই পাগল নয়। সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো মানেই উন্মাদ নয়। পাগল হলেই কেবল কাউন্সেলিং করতে হয়না। বরং রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা করানোই বুদ্ধিমানের কাজ।
সেদিন ডিপ্রেশনে আক্রান্ত এক মেয়ের আত্মহত্যার ঘটনা শুনে এই ঘটনা মনে পড়ে গেল। এবং আমি নিশ্চিত, আমরা আমাদের স্বভাব মতন সবাই মিলে মেয়েটিকে নিয়ে ছিঃছিঃ করছি।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে কেবল সুশিক্ষাই নয়, বরং খানিকটা সুবুদ্ধিও দান করুন।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:৩৪