একটা ছোট উদাহরণ দিয়ে শুরু করি।
একবার এক ফান্ড রেইজিং ইভেন্টে যেখানে অন্যান্য সাহাবীরা বিশাল বিশাল পরিমান সম্পদ দান করছিলেন, এক সাহাবী সেখানে মাত্র কয়েকটা খেজুর এনে দান করলেন। এটা দেখে মুনাফেকরা (যারা বাইরে দিয়ে মুসলিম পরিচয় দিত, কিন্তু অন্তরে ছিল মুশরিক) হাসাহাসি করতে লাগলো। "এইটুকু খেজুরে কী হবে? এই, এটা তুমি নিয়ে যাও। বাড়িতে বসে, আরামসে খাও। ওতে শুধু তোমারই পেট ভরবে। হিহিহি।"
বেচারা গরিব সাহাবী দারুন মুষড়ে পড়লেন। কিন্তু তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালেন স্বয়ং নবীজি হজরত মুহাম্মদ (সঃ)। তিনি বললেন, "আমার সাহাবীদের নিয়ে কখনো বাজে মন্তব্য করোনা, কারন তোমরা যদি সমস্ত ওহুদ পাহাড় পরিমান সোনাও দান কর, তবুও তোমরা তার সমকক্ষ হতে পারবে না যে কেবল এক মুঠ পরিমান দান করেছে।"
ঘটনার ব্যাকগ্রাউন্ড হচ্ছে, সেই সাহাবী সারারাত কাজ করে যে পরিমান খেজুর পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন, তিনি সেটারই অর্ধেক দান করে দিয়েছিলেন। হ্যান্ড টু মাউথ এক ভদ্রলোকের নেট ওয়েলথের ফিফটি পার্সেন্ট। মুনাফেকরা এর মূল্য না বুঝলেও নবীজি(সঃ) এবং তাঁর মালিক ঠিকই বুঝেছিলেন।
এখন আসি মূল কথায়।
"আব্বু! ফজলুরা এইবার ইয়া বড় একটা গরু কিনেছে, আমরাও এইবার বিশাল একটা গরু জবাই দিব।"
এই কথাটা যদি কোন বাচ্চা বলে থাকে তাহলে ঠিক আছে, কিন্তু বাচ্চার বাপ যদি এই ফাজলামি করে থাকে, তাহলে তার গালে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে বলা উচিৎ, "এই ফাজিল! খবরদার! তুই কোন গরু জবাই দিবি না এইবার।"
এদের জন্যই ঈদ এখন শোঅফ ইভেন্ট হয়ে গেছে।
আল্লাহ বলেছেন যার যার সামর্থ্য মতন কোরবানী দিতে। কেউ উট দিবে, কেউ গরু, সেই গরুতে আবার সাতজন মিলে ভাগ বসাবে, কেউবা একা একটা খাসি। যার সামর্থ্য নাই, সে কিছুই দিবেনা। সমস্যা আছে? সমস্যা থাকলে আবার গালে থাপ্পড়।
এই গেল কোরবানির পশুর কথা। এখন যাই আরেকটু বেসিকে।
"এইবার বাজারে তেমন বড় গরু উঠে নাই। মাত্র পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে গরু জবাই দিতে হলো।"
"সেকি ভাই! মাত্র পাঁচ লাখ দিলেন? আমার গরুর দাম পড়ছে সাড়ে সাত লাখ টাকা। এত সস্তায় গরু পাইলেন কই?"
কারো কাছে যদি পাঁচ দশ লাখ টাকা "মাত্র" হয়ে থাকে, তবে অবশ্যই সে এই দামে গরু জবাই দিতে পারে। সে ইচ্ছা করলে টেক্সাস থেকে ব্রামিন কাউ বা লং হর্ন গরু দেশে উড়িয়ে নিয়ে জবাই দিতে পারে। সে ইচ্ছা করলে জেদ্দা থেকে রেড ক্যামেল উড়িয়ে নিয়ে জবাই দিতে পারে। শর্ত একটাই, যে টাকা সে উপার্জন করেছে, সেটা হালালতো? অমুকের ফাইল আটকে রেখে, তমুকের জায়গা দখল করে "মাত্র" পাঁচ লাখ টাকার গরু জবাই দিবা....তোমাকে বাটা চপ্পল দিয়া থাবড়ানো দরকার।
ফুটনোট, দেশের মানুষের একটা অত্যন্ত বাজে মেন্টালিটি হচ্ছে, বড়লোক মানেই ঘুষখোর, চোর, বাটপার মনে করা। কারো সাথে কোন কোটিপতির পরিচয় হলে এরা প্রথমেই কুকুরের নাক দিয়ে গন্ধ শোকার মতন স্বপ্রনোদিত হয়ে তদন্তে নেমে পড়ে "এ এত টাকা কামালো কিভাবে?" - অনুসন্ধানে। কেন ভাই, হালাল উপায়ে, সৎ থেকে কোটিপতি হওয়া যায় না? আমাদের উসমান (রাঃ) কী পরিমান ধনী ছিলেন আইডিয়া আছে? ফাজিলের মতন কথা বলা তাহলে বন্ধ করেন।
"ও ভাই, এইবার এত চিকন গরু দিলেন যে? এ যে দেখছি বাছুর! হেহেহে।"
"কী করবো ভাই? বেতনের টাকায় এরচেয়ে বড় গরু কিনতে পারিনা।"
ব্যস, খেল খতম। এরপরও কেউ মকারী করতে আসলে জুতিয়ে বিদায় করবেন। কারন আপনি কোরবানী দিচ্ছেন আল্লাহর জন্য, প্রতিবেশীর জন্য না। ঐ ফাজিলের কিছু বলার অধিকার নাই।
গেল হালাল হারামের কথা। এখন যাই আরেকটু বেসিকে।
গরু জবাই যে দিলেন, রক্ত, ময়লা ইত্যাদি পরিষ্কার করেছেনতো? নবীজির(সঃ) একটা সহিহ হাদিস আছে, "যে মানুষের চলার পথ থেকে একটি কাঁটা সরিয়ে দেয়, সে জান্নাতি। আবার যে মানুষের চলার পথে, অথবা বিশ্রামস্থলে ময়লা আবর্জনা ফেলে, সে জাহান্নামী।"
মদিনা সনদের সময়ে বর্ণিত হয়েছিল এই হাদিস।
ইসলামে স্পষ্ট নির্দেশ দেয়া আছে নিজেকে পরিষ্কার পরিছন্ন রাখতে হবে। এবং সেই সাথে প্রতিবেশীর যাতে কোন অসুবিধা না হয় সেটাও খেয়াল রাখতে হবে। প্রতিবেশী কোন মহিলা হয়তো রক্ত-মাংস দেখলে ভয় পান, প্রতিবেশী হিন্দু ভদ্রলোক "গোমাতা" হত্যায় যথেষ্ট ব্যথিত হন - এইসব কিছুই আমার মাথায় রাখতে হবে। কী হতো যদি কোন খ্রিষ্টান আমার বাসার সামনে রমজান মাসে শুকরের মাংস বারবিকিউ করতো? সেটা যদি আমার ধর্মানুভূতিতে আঘাত দিয়ে থাকে, তবে আমারও উচিৎ এমন কিছু না করা যাতে অন্য কেউ মনে কষ্ট পায়। নাহলে আমারই আল্লাহ আমার উপর ক্ষেপে যাবেন।
এবং তারপর আসে ভাগ বাটোয়ারার বিষয়টা। একভাগ নিজের, একভাগ আত্মীয়ের, এবং শেষ ভাগ গরিবের। ব্যপারটা এমন নয় যে এটা আমার অপশন। ব্যপারটা এই যে এতে ওদের অধিকার আছে, আমাকে শুধু বুঝিয়ে দিতে হবে। এখন আমি নিজে যে মাংস খাই না, শুধু সেটাই গরিবদের দিলাম, এবং আত্মীয়দেরও এভাবেই ঠকালাম, তাহলে ভাই আমার ভাগ বাটোয়ারা করারই দরকার নাই। ভিতরের খবরতো আল্লাহ জানেন, আমি কাকে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করছি?
ওরা সারাবছরের মাত্র এই কটা দিনে মাংস খেতে পারে। এবং এই মাংসে তাঁদের হক আল্লাহ নিজে নির্ধারন করে দিয়েছেন। আর আমি কিনা তাঁদের সেই হক মেরে দেই?
এখন উপরের সবকিছু মাথায় রেখে কোরবানী দিয়ে দেখেন, বুঝতে পারবেন স্পিরিচুয়াল পাওয়ার, ফিলিংস অফ এক্সটেসি কাকে বলে। নাহলে আপনার আর কসাইর মধ্যে কোনই পার্থক্য নাই। সে বেচারা জীবিকার্জনের জন্য পশু জবাই করে, আপনি লোক দেখানোর জন্য। আসলে, এই ক্ষেত্রে সেও আপনার চেয়ে মহান।
সবাইকে আরেকবার ঈদের শুভেচ্ছা। ঈদের আনন্দ সবাইকে ছুঁয়ে যাক। সবার জীবন আনন্দময় হোক।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৩:৩৭