এক নারী বাজারে এসেছেন দোকান থেকে দুধ কিনবেন বলে। দোকানদার তাঁর পাত্রে দুধ তুলে দিচ্ছেন। ঠিক তখনই ভিড় থেকে এক মহিলা তেড়ে আসলেন, "খবরদার! এই দুধ তুমি বেঁচতে পারবেনা! এখুনি এই মহিলাকে তাঁর টাকা ফেরত দাও!"
ক্রেতা বেচারী হতভম্ব হয়ে গেছেন। আর দোকানি ক্রুদ্ধ।
"তুমি পাগলের মতন কী সব বকছো?"
মহিলা বললেন, "তুমি দুধে পানি মেশাও। এখন হয় এই দুধ তুমি নিজের পরিবারকে খাওয়াবে, নাহলে ফেলে দিবে। কিন্তু বাজারে বিক্রি করতে পারবে না।"
দোকানি এইবার রেগে উঠলো।
"তুমি আমাকে হুকুম দেয়ার কে?"
সাথে সাথে পেছন থেকে গুরু গম্ভীর স্বর শোনা গেল।
"সুবহানাল্লাহ! প্রথমে অপরাধ করো, তার উপর গলাবাজি!"
সবাই ফিরে তাকিয়ে দেখেন আমিরুল মু'মিনীন দাঁড়িয়ে আছেন। হজরত উমার (রাঃ), ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা। মুসলিম বিশ্বের সম্রাট। যিনি কঠোরভাবে আইন প্রয়োগের জন্য বিখ্যাত।
দোকানি আমতা আমতা করে বলল, "হে আমিরুল মু'মিনীন। আমি বরাবরের মতই আমার দোকান খুলে ব্যবসা করছিলাম। আজকে হঠাৎ করে এই মহিলা বলছে, আমি দোকানে দুধ বেঁচতে পারব না। আমি নাকি দুধে ভেজাল মেশাই। কে এই মহিলা! তার কী অধিকার আছে?"
উমার (রাঃ) জনতার উদ্দেশ্যে বললেন, "এই মহিলাকে চিনে নাও। এ হচ্ছে শিফা বিনতে আব্দুল্লাহ। আমি একে বাজার নিয়ন্ত্রনের কাজে নিয়োগ দিয়েছি। তোমরা যাতে কেউ দুর্নীতি করতে না পারো সেজন্য সে তোমাদের সব লেনদেনের উপর নজর রাখবে। আর যদি তোমরা তাঁর হাতে ধরা পড়ো, তাহলে সে যা বিচার করবে সেটাই উমারের (রাঃ) বিচার হবে।"
এইবার তিনি শিফার (রাঃ) দিকে ফিরে বললেন, "তা তুমি একে কী শাস্তি দিতে চাও?"
শিফা বললেন, "সে আপাতত নিজের দুধ ফেরত নিয়ে এই মহিলার টাকা ফিরিয়ে দিক। তারপর সে হয় নিজের পরিবারকে এই দুধ খাওয়াক, নাহলে ফেলে দিক। এবং ওয়াদা করুক, ভবিষ্যতে কখনই এমন কাজ সে করবেনা। যদি দ্বিতীয়বার ধরা পড়ে, তাহলে তাঁকে আর ব্যবসা করতে দেয়া হবেনা।"
উমার (রাঃ) বললেন, "আমি বিচার করলে এখনই তাঁর ব্যবসা বন্ধ করে দিতাম। তবু তোমার কথাই সই, তোমার বিচারই কার্যকর করা হোক। ওকে আরেকটা সুযোগ দেয়া হোক।"
এই শিফা বিনতে আব্দুল্লাহ(রাঃ) একজন ক্বুরায়শি আরব। সেই জাহেলি যুগেই যিনি একজন নারী হয়েও লেখাপড়া জানতেন। তিনি কিছুটা চিকিৎসা বিজ্ঞানও জানতেন। নবীজি (সঃ) ইসলাম প্রচার শুরু করলে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। নবীজি(সঃ) তাঁর যোগ্যতা দেখে নিজের স্ত্রীকেই (মা হাফসা (রাঃ), উমারের (রাঃ) কন্যা) এই মহিলার কাছে লেখাপড়া সেখান। তারপর তাঁকে নির্দেশ দেন, অন্যান্য সাহাবীদের তাঁর চিকিৎসা বিদ্যাও শিখিয়ে দিতে। এই মহিলার যোগ্যতার কারনেই হজরত উমার(রাঃ) মদিনার বাজারের নিয়ন্ত্রণভার তাঁকে দিয়ে দেন। আজকের সমাজে নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ হচ্ছে বাজার এবং এস.ই.সি হচ্ছে শিফা বিনতে আব্দুল্লাহ(রাঃ)। তাহলে বুঝা যাচ্ছে তাঁর পদের গুরুত্ব কতখানি ছিল?
এখন ইসলামে বলা আছে, মহিলাদের পর্দা করার কথা। অথেন্টিক ইসলামের নিয়মানুযায়ী মহিলাদের ঘর সামলানোর কথা বলা হয়েছে, এবং পুরুষদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে সেই সংসার চালাতে যা উপার্জন করতে হবে, সেটার ব্যবস্থা করতে। কিন্তু কোথাও বলেনি, মহিলারা একদমই কাজ করতে পারবেন না। যদি বলা হতো, তাহলে হজরত উমার(রাঃ) শিফাকে(রাঃ) সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান বানাতেন না। যেখানে তিনি ভালভাবেই জানতেন এই ভদ্র মহিলাকে অসৎ পুরুষ দোকানদের সাথে রীতিমতন ঝগড়া করতে হবে। উমারকে (রাঃ) যতদুর আমরা চিনি তিনি নিজে হাজারবার মরে যাবেন, তবু আল্লাহ এবং নবীজির(সঃ) নির্দেশের বাইরে এক চুল পরিমান সরে আসবেন না। মানে মহিলাদের বাইরে কাজ করার ব্যপারে নবীজিরও আপত্তি ছিল না। ওয়ান কন্ডিশন এপ্লাইড, "ইসলামী নিয়ম ভঙ্গ না করে।"
সেদিন জানলাম দেশে এক আপু ডিএমসিতে ভর্তি হয়ে মাঝপথে পড়ালেখা ছেড়ে দিয়েছেন, কারন ইসলামে নাকি মেয়েদের ডাক্তারি করা হারাম। তিনি এখন ঘরে বসেই আল্লাহর ধ্যান করবেন।
কথা এগুনোর আগে একটা প্রশ্ন।
একজন পর্দানশিন মুসলিম মহিলা প্রেগন্যান্ট হলেন। এখন তিনি মহিলা গাইনোকলজিস্ট ছাড়া দেখাবেন না। মহিলাদের ডাক্তারি পড়া যদি শরীয়তে নিষিদ্ধ থাকে, তাহলে এই মহিলা ডাক্তার পাবেন কই?
কেউ বলতে পারে, "ঠিক আছে। মহিলারা শুধুই গাইনোকলোজি পড়তে পারবে। আর কিছু নয়।"
তাহলে সেই পর্দানশিন নারীর যদি আরও অন্য কোন রোগ হয়, তখন?
"ঠিক আছে, মহিলারা শুধু ডাক্তারি পড়তে পারবে আর কিছু নয়।"
"কিন্তু সেই পর্দানশিন নারীর জীবনে ডাক্তারি ছাড়াও আরও অনেক কিছুর প্রয়োজন হতে পারে। তিনি সেই ক্ষেত্রে লেডি প্রফেশনাল খুঁজতেই পারেন। তখন?"
কথা হচ্ছে, সবকিছু নিয়তের উপর নির্ভরশীল। আমি যেই প্রফেশনেই থাকিনা কেন, ইচ্ছা করলেই পারভার্ট হতে পারবো। আবার ইচ্ছা করলেই নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে পারবো। মাদ্রাসার শিক্ষকও শিশু ধর্ষণের মতন জঘন্য অপরাধ করেছে। এমন উদাহরণ কিন্তু আছে।
কিছুদিন আগেও ক্যারলটন মসজিদ থেকে বেরুবার সময়ে এক হিজাব পড়া আরব মহিলাকে মাঝে মাঝে দেখতাম টেক্সাসের ভয়াবহ রোদে একটি শিশুকে ছায়ায় বসিয়ে নিজে প্ল্যাকার্ড হাতে দাড়িয়ে থাকতেন। প্ল্যাকার্ডে লেখা, "চাকরি নেই, তিনটি শিশুকে নিয়ে বিপদে আছি। অনুগ্রহ করে সাহায্য করুন।"
পৃথিবী এমন একটি স্থান যেখানে নারীকে জামা খুলতে দেখলেই পুরুষ লাইন ধরে পকেট উজার করে দান করে। অথচ বোরখা পড়া নারী তাঁর শিশুদের জন্য সাহায্য চাইলে কেউ এগিয়ে আসতে চায়না।
আমি টাকা দিতে গেলে মহিলা নিজের থলে এগিয়ে দিলেন। আমি সেখানে দান করলাম। মহিলার হাতে আঙ্গুলের স্পর্শ লাগলো না।
হিজাবে মুখ ঢাকা থাকলেও বুঝা যায় মহিলা যথেষ্ট রূপসী, ইচ্ছা করলেই ভিন্নপথে অনেক টাকা আয় করতে পারতেন। অ্যামেরিকানরা আমাদের বাংলাদেশীদের মতন "সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি"(মাশরুফের থেকে ধার নিলাম) নন। এই সমাজে তিনি আরামসেই থাকতে পারতেন। কিন্তু মহিলা কুপথে যাননি। হয়তো এখন চাকরি করেন কোথাও। আল্লাহ তাঁকে ভাল রাখুন। এবং আমাদের কাউকেই তাঁর মতন বিপদে না ফেলুন।
তা যা বলছিলাম। নবীজির (সঃ) সময় থেকেই ইসলামের নানা যুদ্ধক্ষেত্রে নারী সাহাবীরা উপস্থিত থাকতেন আহত সাহাবীদের সারিয়ে তোলার কাজে। উদাহরণ খন্দকের যুদ্ধ। সা'দ ইবনে মু'আদ খন্দকের যুদ্ধে মারাত্মক আহত হলেন। তাঁকে সুস্রুশার দায়িত্ব কে পেলেন? রুফাইদা(রাঃ)। রুফাইদার (রাঃ) "ক্লিনিকে" সা'দ অ্যাডমিটেড ছিলেন প্রায় এক মাস। ইসলামে মেয়েদের "ডাক্তারি পড়া" নিষিদ্ধ থাকলে নবীজি (সঃ) প্রথম ব্যক্তি হতেন যিনি নিষিদ্ধ করতেন।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, পরপুরুষের নার্ভ চেক করতে গিয়ে তাঁকে স্পর্শ করতে পারেন। এইটাতো ইসলামে নিষেধ।
আপনি ভুলে যাচ্ছেন কেন ইসলামে সবাই ভাই বোন। আপনি প্রথমেই রুগীর সাথে ভাই বোনের সম্পর্ক স্থাপন করে ফেলুন না। রুগীও তাহলে আপনার দিকে পারভার্টের দৃষ্টিতে তাকাবে না। আর তাকালে সেটা তার স্বভাব, আপনিতো ঠিক ছিলেন নিজের দিক থেকে।
এবং আপনি যদি সুন্দর রোগীর গা স্পর্শ করে নিজেই বিগরে যান, তাহলে আপা সেটা আপনার সমস্যা। আপনি জানেন কিভাবে একে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এর সাথে ইসলামের সম্পর্ক নেই।
আরেকটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা বলি। কাজে লাগতে পারে।
হজরত আমর ইবন আস (রাঃ) মাত্রই ইসলাম গ্রহণ করেছেন। নবীজি (সঃ) তাঁকে জেনারেল বানিয়ে ধাত আল সালাসিল অভিযানে পাঠিয়ে দিলেন। তখনকার নিয়মানুযায়ী, নেতাকেই জামাতে ইমামতি করতে হতো।
এখন রাতে ঘুমাতে গিয়ে আমরের (রাঃ) স্বপ্নদোষ হয়ে গেল। ইসলামে স্পষ্ট বিধান আছে স্বপ্নদোষ হলে গোসল না করা পর্যন্ত কেউ পবিত্র হয়না। তাঁর কোন ইবাদত তখন পর্যন্ত কবুল হয়না। কিন্তু আমর (রাঃ) দেখলেন এখন মরুভূমির রাতের এই হাড় কাঁপানো শীতে গোসল করা আর আত্মহত্যা করা একই ব্যপার। তাই তিনি বালু দিয়ে তায়াম্মুম করে জামাতে ইমামতি করলেন।
সাহাবীরা স্বাভাবিকভাবেই আমরের(রাঃ) নামে বিচার দিলেন রাসুলুল্লাহর(সঃ) কাছে। এবং আমাদের নবীজি (সঃ) তাঁর স্বভাবমতই কেবল এক পক্ষের কথা শুনেই বিচার জারি না করে আমরকে(রাঃ) ডেকে পাঠালেন।
"তোমার নামে এই অভিযোগ শুনেছি। তুমি কী এমনটা করেছ?"
"জ্বী, হে আল্লাহর দূত(সঃ)!"
"কেন? তুমি কী আল্লাহর নির্দেশ শোননি যেখানে তিনি স্পষ্ট বলেছেন শরীর অপবিত্র হলে গোসল করে পবিত্র হতে হবে?"
"জ্বী। আবার আমি এও শুনেছি, আল্লাহ বলেছেন '....হে মুমিন বান্দারা! তোমরা আত্মহত্যা করনা। অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের প্রতি করুনাময়।'(সুরাহ নিসা, আয়াত ২৯)"
নবীজি (সঃ) আমরের (রাঃ) কথা শুনে হেসে দিলেন, এবং তারচেয়ে বড় কথা, তিনি তাঁকে আর কিছু বললেন না।
ইসলাম ধর্ম আপনাকে সবকিছুর জন্য আইন দিয়ে দিয়েছে। কিভাবে চললে জীবন সুন্দর হয়, সহজ হয়, পুণ্যময় হয়। সব আইনের মূল কথা হচ্ছে পুণ্য যা, তার সাথে থাকো। দুষিত যা, সব এড়িয়ে চলো। পাপ-পুন্যের হিসেবে অবশ্যই পুন্যের পাল্লা যেন ভারী হয়।
একজন বেগানা পুরুষের রোগ নির্ণয় করতে গায়ে আপনি তাঁকে স্পর্শ করে ফেলেছেন, তা থেকে যা পাপ হবে, আমার বিশ্বাস আল্লাহর দরবারে অনেক বেশি পুণ্য কামাবেন আপনি যদি সেই পুরুষটির প্রাণ বাঁচিয়ে তুলেছেন সেই কাজের জন্য।
বাকিটা আল্লাহ ভাল জানেন। তিনি পরমকরুনাময়। অসীম দয়ালু।
আমার এই লেখাটা সম্পূর্ণ আমার নিজস্ব বুদ্ধি দিয়ে লেখা। যা ঘটনা বললাম, সব ১০০% সত্যি।
কারও কোন প্রশ্ন থাকলে, দ্বিধা থাকলে অবশ্যই স্কলারদের সাথে পরামর্শ করুন। ইন্টারনেটের যুগে নিজেও রিসার্চ করতে পারেন। এটি এখন খুবই সহজ কাজ।
সবাই ভাল থাকুন।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ১২:৪৪