"মা, মা, আমি পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছি!"
মা তখন পুত্রের মুখে হাত বুলাতে বুলাতে বলেন, "আজ যদি তোর বাবা বেঁচে থাকতো...!"
নেপথ্যে বেজে উঠে বিরহী সুর! মাতা-পুত্রের মুখ করুন হয়ে যায়। ইমোশনাল দৃশ্য। দর্শকের চোখ অশ্রুতে ভিজে।
বাংলা সিনেমার শিওর শট ফর্মুলা। এর আগে হিন্দি সিনেমায় দেদারসে ব্যবহৃত হতো। এখন বাংলা সিনেমার কথা জানিনা, তবে হিন্দিতে আর চলে না। এর মানে, "ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট" হওয়া নায়কদের যুগের অবসান ঘটেছে। যদিও আমদের দেশে এখনও হাওয়া বদল ঘটেনি।
একটা সময়ে বোর্ড পরীক্ষার ফলাফলের দিন পত্রিকায় কিছু উজ্জ্বল ছাত্রছাত্রীর ছবিসহ ইন্টার্ভিউ ছাপা হতো।
"দিনে কয় ঘন্টা পড়াশোনা করতে?"
"ষোলো থেকে আঠারো ঘন্টা।"
"তোমার এই রেজাল্টের পেছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশি?"
"আমার কোন গৃহশিক্ষক বা প্রাইভেট টিউটর ছিল না। আমার স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকা ও বাবা মার কারনেই আমার এই সাফল্য।"
"তোমার প্রিয় বই কী?"
"পবিত্র কোরান শরিফ।"
"প্রিয় ব্যক্তিত্ব?"
"হজরত মুহাম্মদ(সঃ)।"
"বড় হয়ে কী হতে চাও?"
"ডাক্তার হয়ে গরিব অসহায় মানুষের সেবা করতে চাই।"
একঘেয়ে প্রশ্ন এবং তারচেয়েও একঘেয়ে উত্তর। তবুও দেশবাসী পরম আগ্রহে সেইসব ইন্টার্ভিউ মন দিয়ে পড়তেন।
এবং অভিভাবকরা তাঁদের ছেলে মেয়েদের দিকে এমনভাবে তাকাতেন যেন তাঁরাও তাঁদের সন্তানদের থেকে এমন রেজাল্টই আশা করছেন। খারাপ রেজাল্ট মানেই জীবন শেষ। ফল, ছেলে মেয়ের মন ভেঙ্গে যাওয়া, ডিপ্রেশন, ড্রাগস এবং কোথাও কোথাও আত্মহত্যার ঘটনা।
এখন দেশে সবাই পাইকারী হারে গোল্ডেন জিপিএ পাচ্ছে। এটি না পেলেই যেন ফেইল।
"ভাবি আমার ভাইয়ের ছেলেতো গোল্ডেন এপ্লাস পেল, আপনার ছেলে কেন পেল না?"
এইধরনের মহিলাকে থাবড়ানোর জায়গায় মা উল্টা ছেলে মেয়েদেরই ঝারি দেন, "তোর জন্য আজকে এই দিন দেখতে হলো!"
ফল, আবারও ডিপ্রেশন, ড্রাগস এবং সুইসাইড।
রিল্যাক্স! আপনি যেমন দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি, আপনার ছেলেও সেভাবে গোল্ডেন জিপিএ পায়নি। সবাইকে দিয়ে সবকিছু হয়না। আর ফোনে ফাজলামি করা ভাবির কথা বলছেন? তিনি আপনার সংসারের পিছনে কয়টা টাকা খরচ করেন যে তার কথায় নিজের সন্তানকে দূরে ঠেলে দিচ্ছেন?
আল্লাহর কসম, আমার যদি ক্ষমতা থাকতো, অন্যের হাড়ির খবর নেয়া দেশের এইসব ফাজিল লোকজনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইন জারি করতাম। যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড। দেশের প্রতিটা সংসারের অশান্তির জন্য এইসব মিষ্টিমুখের ইবলিসরাই দায়ী।
এইবার কিছু অনুপ্রেরনাদায়ী উদাহরণ দেয়া যাক।
শচীন টেন্ডুলকার যখন বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে তাঁর নিরানব্বুইতম সেঞ্চুরি করলেন, তখন তাঁর প্রশংসা করতে গিয়ে এক ধারাভাষ্যকার বলেছিলেন, "অবাক হয়ে ভাবতে হয় এখনও তাঁর রান ক্ষুধা মিটেনি।"
অবাক হবার কী আছে? তিনি জীবনের প্রথম দুই ওয়ানডে ইনিংসে গোল্লা মেরেছিলেন। তিনি জানেন ব্যর্থতার জ্বালা কাকে বলে। এবং সেই ব্যর্থতাকে ভয় পেয়েই ঘন্টার পর ঘন্টা নেটে ব্যাটিং প্র্যাকটিস করে তিনি শচীন টেন্ডুলকার হয়েছিলেন। শচীনের তখনকার দিনের সবচেয়ে নিকটতম প্রতিদ্বন্দী ছিলেন সাঈদ আনোয়ার। শচীন একটি সেঞ্চুরি করলে ঐদিক দিয়ে সাঈদও আরেকটা করেন। দুইজনের মধ্যে দুর্দান্ত প্রতিযোগিতা চলছিল কে আগে ডেসমন্ড হেইন্সের সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির রেকর্ড ভাঙ্গে। সেই সাঈদ আনোয়ারেরও টেস্ট ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল চশমা পড়ে। মানে দুই ইনিংসেই শুন্য। যেদিন তিনি খেলা ছাড়লেন, পাকিস্তানের ইতিহাসের সর্বকালের সর্বসেরা ওপেনার তিনি। এখনও তাঁর স্থানে আসার যোগ্যতা কোন পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানের হয়নি।
ইমরান খানকে ভুলে গেলে কিভাবে চলবে? স্যার গ্যারি সোবার্সের পরেই যাকে ধরা হয়ে থাকে সর্বকালের সর্বসেরা অলরাউন্ডার, সেই ইমরান শুরুর দিকে ছিলেন ভীষণ নড়বড়ে একজন ক্রিকেটার। মানুষ ধরেই নিয়েছিল এই ছেলেকে দিয়ে বেশিদিন খেলানো সম্ভব হবেনা। এবং ঠিক তখনই সবাই দেখলেন ছয় ফুটি যুবক ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে নেটে ব্যাটিং-বোলিং প্র্যাকটিস করছে। নিজের সতীর্থরা যখন হাপিয়ে উঠতেন, তখন রাস্তার ছেলেদের দিয়ে বোলিং করাতেন। তাও বাইশ গজ নয়, পনের-ষোল গজের উইকেটে। যাতে বিশ্বমানের বোলারদের 'পেসটা' হালকাভাবে হলেও উপলব্ধি করতে পারেন।
আর ক্যালিস? তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম দশ বারো টেস্টের ব্যাটিং গড়ের কথা মনে আছে? কে ভেবেছিল এই ছেলেই রিটায়ার করার সময়ে সবাই তাঁকে "কিং" ক্যালিস ডাকবে?
প্রথম জীবনে ব্যর্থতা ছিল বলেই তাঁরা সফলতার স্বাদ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। বিনোদ কাম্বলি, রিকার্ডো পাওয়েল, ইয়াসির হামিদ.....শুরুতেই হইচই ফেলে দিয়ে এখন স্রেফ হারিয়ে গেছেন। আমাদের তামিমের নুডলসের কাহিনী এই সেদিনের ঘটনা। তামিম ফর্মে ফিরলেন, এবং দাপটের সাথেই ফিরলেন। তাঁর ব্যর্থতা নিয়ে আমরা খুব হাসাহাসি করেছিলাম। আমাদের সেই দাঁত ভাঙতেই তিনি পাকিস্তানিদের কাঁদিয়ে ছাড়লেন।
শাহরুখ খানের কথাও ধরা যাক। বেচারা প্রতিদিন বন্ধুর কাছ থেকে ধার নিয়ে ফিল্মসিটিতে যেতেন অডিশনের জন্য। আজকে সেই তাঁরই কথায় বলিউড উঠে বসে। অভিনয়ে তাঁর আদর্শ দিলীপ কুমার ছিলেন একজন ফল বিক্রেতা। ফিল্মে এসে প্রথম ছবিই ফ্লপ। অথচ তাঁকেই বলিউড ডাকে 'অভিনয় সম্রাট' হিসেবে। প্রথম হিট ছবির জন্য শাহেনশাহ অমিতাভ বচ্চনকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল দীর্ঘ দশটি ছবি পর্যন্ত। টানা দশটি ছবির ব্যর্থতা যে কী, সেটা একজন অভিনেতাই ভাল বুঝতে পারবেন।
বাংলা ছবিতে অভিনয়ের শেষ কথা উত্তম কুমারেরও একই দশা। প্রথম দিকে ফ্লপের পর ফ্লপ। অথচ একদিন তিনিই হলেন মহানায়ক। এখনও তাঁর মত করে অমন অভিনয় করার ক্ষমতা নিয়ে বাঙ্গাল মুল্লুকে কেউ জন্মায়নি।
এখন, উপরে উল্লেখ করা গ্রেটদের কেউই এইচএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন জিপিএ পাওয়া ছাত্র ছিলেন না। এমনকি একাডেমিক্যালি যেসব ছাত্র রবীন্দ্র-নজরুলের কবিতা পড়ে বাংলায় মাস্টার্স করে, সেই রবীন্দ্র-নজরুলেরও জীবনে এইচএসসি পাশ করা হয়নি।
তাঁদের কারোই ইন্টার্ভিউতে বলা হয়নি, "আমি দিনে সতের আঠার ঘন্টা পড়তাম এবং আমার কোন গৃহশিক্ষক ছিল না।"
আমরা অত্যন্ত নিষ্ঠুর একটি পৃথিবীতে বাস করি। এরা শুধু বিজয়ীদেরই জয়গান গায়। বিজয়ের ভিত্তিতে তাঁর যে ব্যর্থতা জড়িয়ে আছে, সেটা কেউ মনে রাখেনা।
বিল গেটস একবার বলেছিলেন, "আমার কোন কলেজ ডিগ্রী নেই।"
সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করলেন, "আর আপনার যে কলেজ বন্ধুটি ডিগ্রী নিয়ে পাশ করেছে?"
তিনি হেসে বললেন, "তাঁকে আমি আমার অফিসে চাকরি দিয়েছি।"
জীবন একদম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সুন্দর। একটি পরীক্ষায় ব্যর্থতা, দশটা পরীক্ষায় ব্যর্থতা, একশটি পরীক্ষায় ব্যর্থতা কিছুতেই সেই জীবনের চেয়ে মহান হতে পারেনা। হয়তো একটি পরীক্ষাতে এ প্লাস পাবার যোগ্যতা তোমার আছে। এখন খুঁজে বের করতে হবে, সেটি কোনটি।
পড়ালেখা করতেন না বলে বাবা তাঁকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলেন। জেদ করেই ছেলে বাংলা ব্যান্ড সংগীতের ইতিহাস পাল্টে দেয়। তাঁকে আমরা নগর বাউল হিসেবে চিনি। যদি তিনি গিটার ছেড়ে কলম ধরতেন, তাহলে আজকে কোন সাধারণ অফিসে তার চেয়েও সাধারণ কোন এক বসের ঝারি খেতেন।
"ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হওয়া" ছেলেদের নিয়ে বাংলা সিনেমা বানানো হয়। জীবনের আসল হিরো ঐসব ব্যাকবেঞ্চের ছাত্ররাই যারা নিজেদের শ্রম ও মেধার জোরে ইতিহাস পাল্টে দেন।
থ্রি ইডিয়টস ছবিতে আমির খান একটি চমৎকার পরামর্শ দেন। ছাত্রছাত্রীদের রেজাল্ট বোর্ডে ঝুলানোর সিস্টেমটাই পাল্টে দেয়া উচিৎ। যার যার ব্যক্তিগত ব্যপার।
হাসির ছবি ছিল, আমরা হেসেই উড়িয়ে দিয়েছি। মোটেও গুরুত্ব দেইনি। বিদেশে কিন্তু এটাই নিয়ম। কে কত জিপিএ নিয়ে পাশ করলো, কেউ জানেনা। কেউ মাথাও ঘামায় না। মাস্টার্স ডিগ্রী পাশ এক ছেলের বস হয়তো কোনদিন হাইস্কুলও পাশ করেনি, এমন ঘটনা নিয়মিত এই অ্যামেরিকাতেই ঘটে। এবং এরাই বিশ্বের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক।
অথচ বিল গেইটস বা স্টিভ জবস বা স্পিলবার্গ যদি আমাদের দেশে জন্মাতেন, তাহলে পড়ালেখা শেষ না করার ব্যর্থতায় শুভাকাংখী আন্টির কথা শুনে মায়ের বকুনি খেতে খেতে ডিপ্রেশনে পড়ে ড্রাগস নেয়া শেষে আত্মহত্যা করে বসতেন।