টিভি স্ক্রিনে কিছুক্ষণ পরপর ভেসে উঠছে আইএসের নৃশংসতার ঘটনা। এছাড়াও অন্য আরেকটা অশান্ত দেশের ঘটনা দেখানো হচ্ছে। পোশাক দেখে বুঝা যায় মুসলিম কোন দেশ!
আরেকটা খবরও মনে হয় গতরাতে টিভিতে দেখলাম, "সন্ত্রাসী হামলার আশংকায় নিউইয়র্ক শহর।"
কারা এই সন্ত্রাসী, কী তাদের ধর্ম, এইটা সবাই জানে।
বুকটা হুহু করে কেঁপে উঠলো। সাথে সাথে মনে পড়ে গেল সেই অ্যামেরিকান বৃদ্ধার কথা, যিনি দারুন আত্মবিশ্বাসের সাথে একদিন আমাকে বুঝাচ্ছিলেন, "ইসলাম একটি সন্ত্রাসী ধর্ম। ওদের ধর্মে মানুষ হত্যার কথা বলে, ওদের ধর্ম বলে সন্ত্রাসের কথা.....। তুমি নিশ্চই প্র্যাকটিসিং মুসলিম না। তাহলে তুমি এইভাবে চিন্তা করতে পারতে না।"
নবীজির জীবনী মনে পড়ে গেল। আল্লাহর কিছু বাণীর কথাও মনে পড়ে গেল। মনে পড়ে গেল বিশ্বে শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যেই ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছিল!
শান্তি!
মনে মনে ভাবলাম, আহারে ইসলাম! আহারে মুসলিম! আহারে!
আজকে সকালে জানলাম দেশে একজন লেখককে তাঁর স্ত্রীসহ কুপিয়ে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় লেখক মারা গেছেন। স্ত্রীর অবস্থা এখনও আশংকাজনক।
কোথায় ঘটানো হয়েছে এই ঘটনা? টিএসসিতে!
যেখানে বিদেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস মুখরিত থাকে ভবিষ্যতের আইনস্টাইন, হকিংদের কোলাহলে, সেখানে আমরা আমাদের দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের ক্যাম্পাসে কুপিয়ে মানুষ মারি!
এই ঘটনা এর আগেও ঘটানো হয়েছে। এই ঘটনা ভবিষ্যতেও বহুবার ঘটানো হবে।
আবারও আফসোস করে ভাবি, আহারে স্বদেশ! আহারে আমার প্রিয় মাতৃভূমি! আহারে!
লোকটার অপরাধ কী ছিল? আমার জানা নেই। তিনি যেহেতু মুক্তমনা লেখক ছিলেন, তার মানে তিনি যা বিশ্বাস করতেন, তাই লিখতেন। তিনি নিজের মতের সাথে মিল রেখে সমাজ বদলাতে চাইতেন।
আমি কখনও তাঁর লেখা পড়িনি। আমি কখনও তাঁর নামও শুনিনি। কিন্তু কী এক আশ্চর্য বন্ধন টের পেলাম আমার নিজের সাথে! আমিও যে নিজের বিশ্বাসের কথাই ফুটিয়ে তুলি। আমিও যে আমার মতের সাথে মিল রেখে সমাজ বদলাতে চাই। লেখকের মতন আমিও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। এবং আশ্চর্য্যের এখানেই শেষ না, লেখকের এক বন্ধু দেখি আমারও বেশ ভাল বন্ধু! আজকেই তার সাথে আমার দেখা হবার কথা!
কী কারনে তাঁকে হত্যা করা হলো আমি জানি না। তবে হত্যার ধরণ দেখে মনে হচ্ছে খুব সম্ভব তাঁর লেখালেখির কারনে এই ঘটনাটি ঘটেছে। হয়তো তিনি এমন কিছু লিখেছেন যা "মুসলমানদের" মনে আঘাত দিয়েছে। এবং যার ফল, সস্ত্রীক চাপাতির কোপ!
ঘটনাটি নতুন নয়। এর আগেও বহুবার ঘটেছে। ব্যপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আল্লাহকে কেউ অপমান করলেই কোপ! নবীজিকে(সঃ) কেউ অপমান করলেই কোপ!
আমার ধর্ম নিয়ে কারও কিচ্ছু বলার অধিকার নেই। কেউ কিছু বললেই কোপ!
কিন্তু আসলেই কী ইসলাম এমন?
তাহলে সুরাহ বাকারার একশো এগারো নম্বর আয়াতটিতে ইসলাম বিরোধীদের প্রতি আল্লাহ কেন বলেন, "তোমরা সত্যবাদী হলে প্রমাণসহ সামনে এসো"?
কাউকে যুক্তিতর্কের জন্য এরচেয়ে স্পষ্টভাবে আর কিভাবে আহ্বান করা সম্ভব?
আল্লাহ এও বলেছেন "যার যার ধর্মের জন্য সে সে দায়ী।" (সুরাহ কাফিরুন)
একে ফ্রীডম অফ রিলিজন না বললে কাকে বলবেন?
এত এত কুরআন হাদিস ঘাটলাম, কোথাওতো খুঁজে পেলাম না কেউ আল্লাহ-রাসূল বিরোধী কথা বললেই কুপিয়ে মারতে হবে। ওরা তাহলে কোথায় খুঁজে পায়? আমাকে কী ওরা দেখাতে পারবে?
নাহ। উল্টা এই প্রশ্ন করায় আমার ঘাড়ে কয়েকটা কোপ বসিয়ে দিবে। কে জানে, হয়তো টিএসসি মোড়েই কোন এক চায়ের দোকানের সামনে। আমি রক্তাক্ত হয়ে পড়ে থাকবো, লোকজন মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় আমার ছবি তুলবে। চায়ের দোকানের মানুষগুলো পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে আমাকে কোপ খেতে দেখবে। কেউ এগিয়ে আসবে না ওদের বাঁধা দিতে। কেউ না!
আমি অবাক হয়ে ভাবি সন্ত্রাসীরা সংখ্যায় কতজন ছিল? পাঁচ? দশ? এরবেশিতো হওয়া সম্ভব না।
আমি বাজি ধরে বলতে পারি ঐ সময়ে রাস্তায় কমসেকম এক দেড়শ মানুষ ছিল। প্রত্যেকে একটা করে মোক্ষম কিল দিলেই ওরা ভর্তা হয়ে যাবার কথা। আমরা বীর বাঙ্গালিরা পাউরুটি চুরি করতে গিয়ে ধরা পরা পাঁচ বছরের শিশুটিকে পিটিয়ে পঙ্গু করে দিতে পারি, কিন্তু এইসব জানোয়ারগুলিকে ঠিকই বীরদর্পে পালিয়ে যেতে দেই।
বাঙ্গালির বীরত্ব এখন ফেসবুক এবং টক শোতে নিন্দা জানানো পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। এর বেশি আমাদের কোন দৌড় নেই।
কুলাঙ্গারগুলি ইসলামী চেতনায় এমনই অন্ধ, এমনই বধির যে তারা আল্লাহর নির্দেশকে পর্যন্ত অস্বীকার করে! বারবার এবং প্রতিবার!
কোন নাস্তিকের লেখায় বা বানানো সিনেমায় নয়, এইসব মূর্খ জানোয়ারদের কারনেই ইসলাম আজকে সবচেয়ে বেশি কলঙ্কিত! এদের কারনেই আজকে বিদেশীদের মুখে আমাদের শুনতে হয়, "ইসলাম একটি সন্ত্রাসী ধর্ম। ওদের ধর্মে মানুষ হত্যার কথা বলে, ওদের ধর্ম সন্ত্রাসের কথা বলে!......."
ওদের কারনেই আমাদের নবীজিকে (সঃ), আমাদের আল্লাহকে বারবার অপমানিত হতে হয়। ওদের কারনেই আজকে আমরা "মৌলবাদী" "সন্ত্রাসী!"
বারবার, প্রতিবার মন থেকে আফসোস বেরোয়, আহারে মুসলমান! আহারে ইসলাম! আহারে শান্তির ধর্ম!