আইডি কার্ড আমি বানাতেই চেয়েছিলাম। যদিও ইতোমধ্যে আইডি কার্ড পেয়েছেন এমন দু’চারজন যখন তাঁদের কার্ড দেখাতে গেছেন, বা দেখতে চেয়েছি, কাউকেই বিশেষ উদ্দীপ্ত দেখিনি। এরকম গুরুতর একটা জাতীয় পর্যায়ের অর্জনে যে ধরনের উদ্ভাসিত তাঁদের থাকবার কথা, খুব একটা কাউকেই সেরকম পর্যায়ে খুঁজে পাইনি। পরে নানাবিধ গবেষণা শেষে আমি নিশ্চিত হতে পেরেছিলাম যে এই অভূতপূর্ব রাষ্ট্রীয় দলিলটি পেয়ে তাঁরা যে মাত্রারই খুশি হয়ে থাকুন না কেন, কার্ডের উপর মুদ্রিত তাঁদের স্বীয় স্বীয় ছবিখানিই সকলের হতোদ্যম হবার মুখ্য কারণ। বিজ্ঞান ও উন্নতির এহেন হৈচৈয়ের কালে লোকজনের চেহারা ওই কার্ডে এরকম পীড়িত, রুগ্ন ও ভ্যাবাচ্যাকা হবার কোনো ব্যাখ্যা মুখের মালিকদের পক্ষে ছিল না। জাতীয় পরিচয়পত্রে নিজেকে চিনতে অক্ষম কিংবা নারাজ এমন অনেক কার্ডমালিকের সঙ্গেও আমার পরিচয় হয়েছিল।
তবে চেহারার বিষয়ে আমার বোঝাপড়া খুবই ভিন্ন। আমার চেহারা আমার নিজের পক্ষে যে চিনবার পরীক্ষা দিতে হবে না সেটা ধারণা থাকার কারণে আমার নিজের প্রায় কোনো ধরনের ছবিতেই আমার সমস্যা হয় না। তবে চেহারার এই বিপর্যয়ের রহস্য আর পাঁচজনের মতো আমাকেও আচ্ছন্ন করেছিল। ওদিকে লোকজনের মুখে শুনতাম ভোটার কার্ড। এমনকি ২০০৭ এর বাংলাদেশে, আমার মতো যৌবনোর্ধ্ব এক পেশাজীবীও অনেকদিন চক্করটা ধরতেই পারিনি যে পরিচয়পত্রই ভোটারকার্ড। এমন না যে আমি ভোটারকার্ড একখান পাবার জন্য আদৌ ব্যাকুল ছিলাম। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্রই যে ওই বস্তু সেটাও বিশেষ বুঝিনি। কিন্তু ক্রমবর্ধমান দাপ্তরিক আক্রমণে কার্ড যে একটা আমার লাগবেই সেটা বুঝতে পেরেছিলাম।
তারপরও যে আমার কার্ডটা ২০০৭ সালের ওই বিতরণকালে হলো না তাতে আমার নিজের বিশেষ দোষ নেই। মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা হিসেবে আমি অন্তত দুদিন কোনো একটা স্কুলের মাঠে নির্দেশমতো গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম। তখন জরুরি অবস্থার কাল। যতটা মনে পড়ে, সেনাশাসন বলা শাসকরা অত পছন্দও করতেন না। তো জরুরি অবস্থার মধ্যে স্কুল মাঠে শয়ে শয়ে লোকজন ওরকম একটা ছবিওয়ালা কার্ড জোগাড় করার জন্য দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তাঁদেরই মধ্যে একজন আমিও দাঁড়িয়ে আছি। এরকম ধরনের জায়গায় মানুষজন যে উত্তেজিত হয়ে লাইন সোজা রাখবেন না, বারংবার ঠেলাঠেলি করবেন সেসব বাংলাদেশের সাধারণ চিত্রই বটে। কিন্তু দেশের শাসকদের যে মাঠপর্যায়ের কর্মীরা দিগ্বিদিক ছড়িয়ে ছিলেন তাঁরা কিছুতেই এসব বেয়াড়া বিশৃঙ্খল ব্যাপার-স্যাপার বরদাশত করতে রাজি ছিলেন না। তাছাড়া সেটা হলো জরুরি অবস্থার কাল। দেখি যে, রাইফেলের নল দিয়ে গুঁতিয়ে গুঁতিয়ে এই মনুষ্যসারিকে সোজা করার চেষ্টা করছেন। পয়লা দিন এই দৃশ্য কয়েকবার দেখার পর নলের স্পর্শের আতঙ্কেই হোক, আর একটা সম্ভাব্য ঝগড়া বাধিয়ে বসতে পারি সেই সম্ভাবনাতেই হোক মাথার তীব্র ব্যথা নিয়ে আমি ঘরে ফিরি। ভেবেছিলাম আরেকদিন হয়তো নলবাগানো কোনো সৈনিক থাকবেন না, হয়তো তাঁর হাতের ব্যবহার নলগুঁতানির থেকে আরামদায়ক লাগবে, আর আমারও অমিত শক্তিধর পেশাজীবীদের সঙ্গে কোনো বিবাদে আসতে হবে না। ক’দিন পর আরো বিশ্রি অনুভূতি নিয়ে আমি বাসায় ফিরি। কার্ড আর আমার হয় না।
এরপরে সবাই যখন বলাবলি করতে থাকল সিভিল শাসকের কাছে দেশ চলে এসেছে, তখন আমার প্রথম মনে হলো হয়তো পরিচয়পত্রের গুরুভার প্রয়োজন আগের মতো থাকবে না। কিন্তু পরিস্থিতি একদম তা রইল না। লোকজন যতই আমাকে জানাক না কেন যে সিভিল শাসনে আছি আমরা, আমি লাগাতার আগের মতোই টাইট কড়া একটা ব্যবস্থা দেখতে থাকলাম। আর পদে পদে এই আইডি-কার্ডের গুরুত্ব দিনে দিনে বাড়বে সেই অবস্থাও আন্দাজ করলাম। এইসব চলতে চলতে কয়েক বছর কেটে গেল। সম্ভবত ২০১২ চলে এলো।
উত্তরার বাসিন্দা তখন আমি শুনলাম, কীভাবে যেন, যেসব হতভাগারা এই দুর্মূল্য বস্তুটি তখনো পাননি তাঁদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। বস্তুটিকে আমি দেখেছিলাম বটে। আর আমার মনে পড়ে মফস্বলের স্কুলে যাঁরা স্কাউট বা রেডক্রস করতেন তাঁদের আইডিকার্ডও এই স্থাপত্যের তুলনায় আকর্ষণীয় ছিল। কিন্তু দুর্মূল্যতা এর রূপ বা রূপহীনতা দিয়ে নির্ধারণ করা ঠিক হবে না, করতে হবে এর গুণগত উপযোগিতা দিয়ে। সর্বোপরি, এই বস্তুটি প্রদান করার সাবকন্ট্রাক্ট যাঁদের হাতে ন্যস্ত ছিল (ও আছে) তাঁদের গুরুত্বও সমাজে (ও রাষ্ট্রে) এতটুকু কম করে দেখা ধৃষ্টতার সামিল হবে। আমি উত্তরা ঘুরঘুর করি, আর ভাবি কীভাবে এই কানকথাকে বাস্তব জ্ঞানে রূপ দেয়া যায়। পাড়ার লন্ড্রি বা বিদ্যুৎসামগ্রির দোকান, কিংবা চারপায়া সিগারেটওয়ালা---এঁদের উপর আমার অগাধ আস্থা। আলাপ শুরু করে দিলাম। শুরুতেই তিরস্কার শুনতে হলো যে মাইকে করে জানানোর পরও আমি শুনিনি কেন। আমার মহান পেশার বরাত দিয়ে সেটাও উৎরানো গেল। একজন মুদিখানার দোকানদার আরো কার্যকরী পরামর্শ দিলেন। তিনি বললেন, আমি যাতে নামায় নেমে যাই আর সেখানে প্ল্যাস্টিকের চেয়ারে সন্ধ্যাবেলা যিনি বসে থাকেন তাঁর হাতেপায়ে ধরি। পরে অবশ্য তিনি শুধরেও বললেন যে আমার পেশা জানলে আসলে হাতেপায়ে ধরার দরকার হবে না। তিনি নিজেই উদ্যোগী হয়ে ব্যবস্থা করবেন বলে আমাকে সান্ত্বনাও দিতে ভুল করলেন না দোকানদার।
উত্তরার ১২, ১৩, ১৪ সেক্টরসমূহে ‘নামায় নামা’ বিশেষ কঠিন কোনো অর্থ না। তেমন গুরুতর কোনো পতনও এতে আপনার হবে না। যদ্দুর মনে পড়ে ১২ নম্বরের দিকে, বা হয়তো অদ্যাবধি-মনুষ্যবিরল ১৫ নম্বরের দিকে কোনো এক খালের পাড় বোঝায় সেটা। ব্যবসায়িক কিছু কারণে জায়গাটি গুরুত্বপূর্ণ, হয়তো রাজনৈতিক কারণেও। আর যে প্ল্যাস্টিকের চেয়ারধারী জানা গেল, তিনি একজন ওয়ার্ড কমিশনার। দোকানদারের হিসাব নিখুঁত ছিল, এসব কাজে এলাকার কমিশনাররাই সাহায্য করতে পারেন। উপরন্তু একটা নির্বাচনী আবহাওয়ার প্রাক্কাল সেটা। আর আমি যতই ভোটার কার্ড আর জাতীয় আইডি নিয়ে ভেজাল বাধিয়ে থাকি না কেন, আসলে বস্তুটির মহাগুরুত্ব ভোটচর্চায় রয়েছেই। অবশ্য ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারা নিয়ে যেসব আলোচনা লোকজন করে থাকেন, আমি সেই চর্চায় যাব না বলে ঠিক করেছি। এই টীকার পাঠকদের স্বীয় স্বীয় উপলব্ধি, কিংবা উপলব্ধির বাইরে মিথ্যাচারমূলক প্রপাগান্ডা বলবৎ আছে বলে ধরে নেয়া যায়। তো সম্ভবত সেই নেতাই, আন্তরিকভাবে, আমাকে বুঝিয়ে দিলেন আমার যেতে হবে কত তারিখ যেন, বালিয়াঝুড়ি/বালিয়াঝরিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, যেটা উত্তরার ১৩ নম্বরেই অবস্থিত। আমি ওই সেক্টরেরই বাসিন্দা।
উত্তরার একটা সেক্টরে একটা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম ‘বালিয়াঝরিয়া’---এই তথ্যই নাড়া দেবার জন্য যথেষ্ট। গ্রামগুলো কীভাবে ‘শহর’ হয়ে ওঠে, আর হয়ে ওঠে ‘বহিরাগতদের’ আক্রমণে, সেই গল্প ভুলে গেলে কিছুতেই বোধগম্যও না। কিংবা তথাকথিত জলাভূমি আর হাওড় আর তথাকথিত উন্নয়ন আর স্থাপত্য। এসবও আপনার ভোলা চলবে না। আমি ভুলিনি, কিন্তু স্কুলটা খুঁজে পাওয়া সুলভ ছিল না। আমি রাস্তায় রাস্তায় দোকানগুলোতে জিজ্ঞাসা করি। যিনি জানেন না, তিনি নিস্পৃহ; যিনি জানেন তিনি সম্ভবত বিরক্ত।
আশেপাশের বহুতল ভবনগুলোর মাঝে এত্তটুকু একটা উঠান সমেত, টিন আর ইঁটের দেয়ালে ফিকে-হতে-থাকা হলুদ নিয়ে যে স্কুলটি দাঁড়িয়ে, তার প্রবেশদ্বারে একখানা সাইনবোর্ড আছে। সেখানে নামও আছে। কিন্তু অতগুলো বাচ্চার জন্য উঠোনটা অতি অপ্রতুল। এই বাচ্চারা যে বহুতল ভবনগুলো থেকে আসেনি, তা বোঝার জন্য একটা সার্ভে করতে হয়নি আমার। তবে উঠানখানা কখনো এর থেকে বড় ছিল কিনা, একটা নিবিড় গবেষণা ছাড়া তা জানার উপায় আমার ছিল না। এই কৌতূহল আমি চেপে যাই। আমার আশু আইডি-প্রয়োজনকে বড় করে দেখতে থাকি। প্রথম যে শিক্ষিকা আমার রূপ আর বেশভুষাতে বিচলিত হয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন, আমার প্রয়োজন জেনে, তিনিই মিমি ম্যাডামের কাছে নিয়ে গেলেন। মিমি ম্যাডাম একটা সম্ভাব্য তারিখ বলতে পারলেন না যে কবে তাঁর স্কুলের অন্যতম অংশগ্রহণে নির্বাচন কমিশন আমার সেই চেহারাটি বানাবে যেটা নিয়ে সকলে পেরেশান। কিন্তু আলাপের একটা পর্যায়ে মিমি ম্যাডাম আমার পেশা-পরিচয় জেনে ফেললেন। তিনি তখন আমাকে চা আর বিস্কুট খাওয়াবেনই। আমার দ্বিধার মধ্যে তিনি নিশ্চিত করলেন, এই চা-বিস্কুট চাঁদা তুলে-কেনা হয়ে থাকে, বাচ্চাদের কোনো ফান্ড থেকে নয়। আমিও মৃদুস্বরে সংশয় প্রকাশ করলাম যে বাচ্চাদের জন্য আর কতই বা ফান্ড আসে আমাদের রাষ্ট্র থেকে। হয়তো আইডি-কার্ড ব্যবস্থাপনার জন্য না-জানা তারিখটাতে যে খরচ হবে তার থেকেও কম!
মিমি ম্যাডাম সম্ভবত প্রধান শিক্ষিকা। তিনি ও অন্যরা আন্তরিকভাবে যে চা ও বিস্কুট দিলেন তা আমি মুচমুচ করে খেলাম। আমার ফোন নম্বর তিনি রাখলেন, আমিও তাঁরটি রাখলাম। তারিখটা পাকা হলে তিনি জানাবেন এই আশ্বস্তির পর, আর এত্তগুলো বাচ্চার উঁকিঝুঁকির মাঝে আমি স্কুলটির প্রবেশদ্বার দিয়ে বেরিয়ে এলাম। আমার আইডি কার্ডের চিন্তার সঙ্গে তখন কোনো এক লুপ্তগ্রামের আইডি নিয়ে মাথা আচ্ছন্ন হতে থাকল। ‘বালিয়াঝরিয়া’!
পুনশ্চ: এই মনে পড়ে যাওয়া কাকতাল নয়। একটা বিরাট ‘আধুনিকায়ন’ এলাকার মধ্যে, হাইওয়ের পাশে আছি আমি। যদি আলসেমিতে বাধা না দেয়, আরো একটা টীকাতে তা লিখব।
(রচনাকাল: ডিসেম্বর ২০১৯।। পটভূমি ও ঘটনাকাল: ২০০৭-২০১২)
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে অক্টোবর, ২০২০ দুপুর ২:১১