নিতান্তই ব্যক্তিগত এলোমেলো ভাবনা
.
সতর্কীকরন: অধিকাংশ পাঠকের জন্য বিরক্তির কারন হতে পারে!
.
শৈশবে গান বাজনার প্রতি তেমন কোন ভালোবাসা ছিলোনা। খেলাধুলা ছেড়ে গানবাজনা মানেই বিরক্তিকর এক ব্যাপার ছিলো।
কিছু ছড়াগান, বাড়ির বড়দের বাজানো কিছু রক গানের তালে মাথা নাড়ানো পর্যন্ত বেশীটা সীমাবদ্ধ ছিলো। আর স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানসহ সংগঠনের শিখা বিভিন্ন শিশুতোষ গান।
কৈশোরে এসে নির্দিষ্ট কিছু ঘরানার গান ভালো লাগলেও সঙ্গীত ভূবনের বিশাল একটি অংশকে নিতান্তই প্যানপ্যানানি মনে হতো। রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুলগীতি আর মশার গুনগুনানির মাঝে কোন ফারাক ছিলোনা সেসময়।
এক সময় "মোরা ঝন্ঝার মতো উদ্যাম মোরা ঝর্ণার মতো চন্চল" টাইপের কিছু গান পছন্দ হলেও এই বিশাল ভান্ডারের অধিকাংশ অপাংক্তেও মনে হতো। মান্নাদে আর হেমন্তের গান বাজলে দুকান হাতে ঢেকে ছুটে বেড়িয়ে যেতাম। তবে কবিতা "আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে", "বিদ্রোহী", অথবা "নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ" ভালো লাগতো। আরো ছিলো, লিচু চোর আর খাদু দাদু- এসব ঠোটস্থ!
একমাত্র দেশাত্মবোধক গানে কোন অরুচী ছিলোনা। "প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ" অথবা আব্দুল হাদীর "সূর্যদোয়ে তুমি সূর্যাস্তে তুমি" রক্তে আনন্দে বন্যা বইয়ে দিতো।
ভাইয়ের ঘর থেকে ভেসে আসা কুমার বিশ্বজিতের একটিগান খুব পছন্দ হয়েছিলো, "একটা গল্প তোদের বলি..." খুব সম্ভবত তাঁর প্রথম দিকের এ্যালবামের কোন গান, ছোটদের জন্য। বিশ্বজিতের আরেকটিগান প্রবাসে এসে একবার শুনেছি, আর খুঁজে পাইনি "তোমরা একতারা বাজাইওনা, দোতারা বাজাইও না..." - অসাধারন!
হোস্টেলে পড়াশুনার সময় এক অদ্ভুত পরিবর্তন আসে। গ্রাম গ্রাম আবহের মাঝে বাসের জন্য না পরিবার, প্রযুক্তি থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হবার কারনে ছাত্রীদের গেয়ে যাওয়া "আমি পথ মন্জুরী ফুটেছি আঁধার রাতে", "আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ" ধরনের গান ভালো লাগতে শুরু করে। এই সময়টায় " ওরে ওরে আমার মন মেতেছে", "যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলোরে", "শাওনও রাতে যদি স্মরনে আসে মোরে", "আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে" ধরনের কিছু গানও গ্রহনযোগ্য হবে উঠে। তবে সবচেয়ে বড় স্থান করে নিয়েছিলো লালনগীতি। টিভিতে ফরিদা পারভীনের "মিলন হবে কতোদিনে" বাজলে ছুটে বেড়িয়ে যাওয়া আমার কাছে এপর্যায়ে এসে "বাড়ির পাশে আর্শি নগর" মুগ্ধ করে। ভালো লাগে "সবাই বলে লালন কি জাত সংসারে"।
আরো একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটে, দূর থেকে ভেসে আসা গান আমরা গুন গুন করতে শুরু করি। বিশেষ করে বাতাসের শীতের ছোঁয়া লাগার সাথে সাথে এসব গান বাজতে শুরু করে দেয় আর এক সময় দেখা যেতো আমরা বুঝে না বুঝে কোরাসের মতো গাইছি বাংলা সিনেমার গান আর অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছি সবাই। সমসাময়িক, আদিকালের সব রকমের সিনেমার গান ভেসে আসতো; সেসব গানের ভাব আবেগ কিছুই তেমন বোধগোম্য হতোনা তবে নিজেরা দল বেঁধে "পিন্জ্ঞর খুলে দিয়েছি" আর "আমাকে পোড়াতে যদি..", "আমার মনের মধ্যে খানে, মন যেখানে" টাইপের গান নিয়ে হাসি মজা করে সময় কাটাতাম। এসব ছিলো কৌতুকপ্রদ ব্যাপার।
এইচ এস সি'র শেষ দিকে বিশেষ করে পর পর বড় পরিবর্তন আসে গানের রুচীতে। 'কফি হাউজের আড্ডার" মাধ্যমের মান্নাদে আর "আয় খুকু আয়" দিয়ে হেমন্ত ঠাঁই করে নেয়। এই পরবর্তনের বড় একটি কারন হতে পারে সেসময় আমি প্যানপ্যানানি গানের রাজা গজলের মাঝে ডুব দিয়েছি। পঙ্কজ উদাস দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছদ্য অংশ হয়ে উঠে। আর বান্ধবীদের প্ররোচণায় জগজিৎ সিং এর আগমন হলেও এক সময় প্রায় নেশাসক্তের মতো এসব গজল শোনা হতো। এই পরিবর্তনের সুযোগে ঘনিষ্ঠ বন্ধু বান্ধবেরা "তোমাকে চাই" আর "হিমালয় আল্পসের সমগ্র জমাট বরফ" গছিয়ে দেয়।
রবীন্দ্র সঙ্গীতের ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে যখন বাবার পরিচিত একজন তাঁকে কয়েক কার্টুন "দুজনে দুজনায়" এ্যালবামটি গিফট করেন। এতো এতো গান শুনছি, এসবও নাহয় শুনে দেখি..... এই ভেবে শুনতে শুরু করে প্রথমেই মুগ্ধ হয়ে যাই "সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে" শুনে। একে একে প্রায় প্রতিটি গান আচ্ছ্ন্ন করে রাখে, আধুনিক বাদ্য যন্ত্রের কারনে অথবা রেজওয়ানা চৌধুরী আর সাদি মুহম্মদের গায়কির গুনে অসাধারন মনে হয় এই এ্যালবামটি- ভালো লাগতে শুরু করে রবীন্দ্র সঙ্গীত। তার কিছুদিন আগেই নজরুল গীতিও আচ্ছন্ন করতে শুরু করেছে "মোরা আর জনমে হংস মিথুন ছিলাম" দিয়ে।
সেসময় আমার গজল ফিভার চলছিলো। জগজিৎ সিং থেকে রুচী পরিবর্তনের জন্য বন্ধু বান্ধবেরা অনুপ জালোটা আর গুলাম আলী শোনাতে শুরু করে। একজন সঙ্গীত প্রেমী মুরুব্বী একদিন বেশ বড় এক বাক্স এনে হাজির করেন। মা বাবার কাছে আমার গজলের প্রতি ভালোবাসার ক্ষোভ শুনে তিনি মনে মনে উৎসাহিত হয়ে ২-৩ ডজন এ্যালবাম নিয়ে আসেন- মেহেদি হাসান, পারভীন সুলতানা, বেগম আখতার, বড়ে গুলাম আলী। তাঁর বক্তব্য মতে গজল শুনতে হলে এঁদের জানা জরুরী কারন তাঁরা এক রকম গজলের জনক জননী। বলতে দ্বিধা নেই সেসব গান আমাকে আপ্লুত করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয় তবে হঠাৎ কোথা থেকে নুসরাত ফতেহ আলী খানের গানের প্রতি ভালো লাগা প্রায় সব কিছুকেই ছাড়িয়ে যায়।
একটা সময় যে আমি রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল গীতি, হেমন্ত, মান্নাদে শুনলে কানে হাতে দি্য়ে ছুটে বেড়িয়ে যেতাম, সেই আমার ঘরে গজল আর নুসরাত ফতেহ আলী বাজতে থাকে নন স্টপ। আর সেই সাথে ইন্সট্রুমেন্টাল। রবি শংকর, আনন্দ শংকরের সুরের মুর্চ্ছনায় বাইরের মুষল ধারার বৃষ্টির আবেদন যেনো আরো হাজার গুন বেড়ে যেতো। এবার সমবয়সী আত্মীয় আর বন্ধু বান্ধবদের পালা আমাকে নিয়ে মজা করার!
আমার একটি ব্যাপার নিয়ে সমবয়সীরা মজা করতো। নাটক, সিনেমা মোটেও দেখা হতোনা হুমায়ুন আহমেদ ছাড়া, তাও অধিকাংশ সময় তাও বাদ যেতো। ভারতীয় চ্যানেল গুলোও মুগ্ধ করতে অক্ষম আমাকে অথচ বিটিভির সান্ধ্য অধিবেশন শুরুর পর পর বাঁশরী আর মরমী ধরনের পল্লীগীতির অনুষ্ঠান চালিয়ে বসে থাকতাম। এমন নয় এসব আমায় আপ্লুত করে রাখতো তবে কোথায় যেনো একটা অদৃশ্য টান ছিলো। উচ্চবাজনার গানের চেয়ে এসব বেশী ভালো মনে হতো।
এর মাঝে বন্ধুবান্ধবদের কল্যানে "যদি হিমালয় আল্পসের সমগ্র জমাট বরফ", "তোমাকে চাই" ভালো লেগেছে। তবে আমাদের দেশের কুমার বিশ্বজিৎ, শুভ্রদেব, তপন চৌধুরী আর ভারতের বাপ্পি লাহিড়ির বেশ কিছু বাংলাগান অসাধারন!
একদিন পরিচিতজনের সাথে চ্যাট করার সময় বিরক্ত হয়ে উঠে যাচ্ছিলাম। অনেক অনুনয় বিনয় করার পরও যখন সাইনআউট করতে চাইছি হঠাৎ লতা মুঙ্গেশকরের "লাগ যা গলে " গানটার কথা উল্লেখ করে। সেসময় জাগজিৎ, নুসরাত ফতে্হ আলীর সাথে সাথে ইন্সট্রুমেন্টাল আর ইংলিশ গানে মগ্ন আমি চমকে যাই। এমন ভয়াবহ এক গানের কথা উল্লেখ কেনো করছে(কখনও শোনা হয়নি আগে) যাইহোক, কয়েক মিনিট সময় বাড়িয়ে দিয়ে নেট থেকে এই গান শুনতে চেষ্টা করি, অনেক কষ্ট করে দুতিন লাইন কোন রকমে শুনে শুধু প্রচন্ড বিরক্ত হই! আর্থিক অর্থে ভুরু কুঁচকে আরো দুএক মিনিট পর সাইন আউট করি এবং ধরেই নেই এর সাথে আলাপ করাটাই ভুল হয়েছে। মহা বিরক্তিকর সেই গান দিয়ে শুরু করলেও সেই পরিচিতজন পরবর্তীতে স্লোপয়জনিং এর মতো আমার মগজে পুরনো হিন্দী গান প্রবেশ করিয়ে দিতে সফল হয়! কিশোরকুমারের "পাল পাল দিল কে পাস....." শুনলে আজও ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠে!
একদিন হঠাৎ কানে ভেসে এলো "তুমি আমার প্রথম সকাল", কোন এক অনুষ্ঠানে তপন চৌধুরী একা গাইছিলো- শুনে মনে ছুঁয়ে যায়। আমার মুগ্ধতা জানাতেই আমার গান শেয়ারের সাথী জানালো এটা বেশ পুরনো গান আর ডুয়েট, আমি সলো শুনেই মুগ্ধ হয়ে বসে আছি।
প্রবাসে পাড়ি জমানোর পর একদিন লক্ষ্য করি এক সময়ের প্রচন্ড বিরক্তির উদ্রেককারী "কান্দো কেনে মন রে" শুনে চোখ ভিজে উঠছে। মনে হয় "বড় ভুল করেছি" ধরনের এক অনুভূতি স্পষ্ট করে দেয় এই গান, শুনলেই মনে হতো দেশ ছেড়ে এসে ভুল করেছি। শুধু বাংলা নয়, দেশে শোনা বাংলা, হিন্দী, ইংলিশ যেকোন গানের আবেদন এখানে তীব্র কষ্টের অনুভূতি নিয়ে আসে। দেশে যা শুনেছি তার বাইরে নতুন কিছু শোনা হয়না, শুনতে ইচ্ছেও করেনা।
তারপর উল্লেখযোগ্য একটা সময় গান, বিশেষ করে বাংলাগান শোনা হতোনা। একদিন ইমেইলে ভেসে আসা "দিন গেলো" শুনে চমকে যাই! অসাধারন গায়কী আর টোটাল কম্পজিশন ভিষণ ভালো লাগে। নতুন করে আবার গান শোনা শুরু.... হাবিবের গান আর কম্পোজিশনের পাশে ভারতীয় গানগুলো ম্লান মনে হয়।।।।
***ব্যক্তিগত এলোমেলো ভাবনাগুলো লিখে রাখছি কিছুদিন হলো, আজ মনে হলো পোস্ট করি।
নিতান্তই পাগলের মতো ভাবনা, সময়টা ব্লগে ধরে রাখা মাত্র! দীর্ঘ লেখা, সবটা একবারে প্রকাশ করতে ইচ্ছে করছেনা।***
*ছবি সুত্র- ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মার্চ, ২০১৭ দুপুর ১২:৩৫