দীর্ঘদিন ধরে ভেবেছিলাম আমেরিকার জীবন যাত্রার দৈনন্দিন জীবনে যখন খুব বেশী বাংলাদেশের কথা মনে পড়ে তা লিপিবদ্ধ করে রাখবো, বিশেষ করে যেসব ক্ষেত্রে দুদেশের পার্থক্য ভীষণভাবে প্রকট হয়ে উঠে...
বেশ কিছু বছরের পুরনো ইচ্ছে হলেও শুরুটা হলো আজ এমন এক দিনে....
যুক্তরাষ্ট্রে এখন নির্বাচনের মৌসুম। এখন আসলে প্রায় এই মৌসুমের শেষ প্রান্তে যার শুরু হয়ে এক বছরেরও বেশি সময় আগে। বিভি্ন্ন দল প্রথমে গণতান্ত্রিক উপায়ে নিজ দলের প্রতিনিধি নির্বাচিত করে মূল নির্বাচনে অন্যান্য দলের সাথে প্রতিদ্বন্দিতা করার জন্য। এসময়টায় তাঁদের যেতে হয় এক কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে। নিজের দলের লোকেরাই থলের বিড়াল বের করে অপছন্দের ক্যান্ডিডেটকে পিছে ফেলে নিজেকে অথবা নিজের পছন্দের জনকে সামনে এগিয়ে নিতে।
দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আমাদের বাংলাদেশের এই প্রক্রিয়াটিও তেমন স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক নয়। শুধু পরিবার তোষন, আত্মীয় তোষণ নয়, তার সাথে জড়িত থাকে কোটি কোটি টাকার নোংরা খেলা এমন কি অনেক ক্ষেত্রে দু চারজনের হত্যাকান্ডও ঘটে!
আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রধান দুটি দল ডেমোক্র্যাটিক আর রিপাবলিকানরা তাদের নিজ নিজ প্রতিনিধি নির্বাচিত করার পর শুরু হয় আসল লড়াই! এই সময়টা জনগণের জন্য অত্যন্ত ক্রুশিয়াল হলেও অত্যন্ত উপভোগ্য, বিশেষ করে দুজন প্রতিদ্বন্দী ক্যান্ডিডেট যখন ডিবেট আসরে নিজে কেনো অ্ররের চেয়ে বেশি যোগ্য তা প্রমাণের লড়াইয়ে মেতে উঠে! গত এক দশকের বেশী সময় ধরে এই ডিবেট ভারত পাকিস্তানের ক্রিকেট ম্যাচের(বালংদেশের ম্যাচ নয় কারন বাংলাদেশের ম্যাচের সময় প্রচন্ড উত্তেজনার সাথে সাথে প্রার্থণাও চলতে থাকে :-) মতো উত্তেজনা নিয়ে উপভোগ করছি। অনেকে পরিবার পরিজন, বন্ধুবান্দবদের সাথে মুখরোচক খাবার নিয়ে আয়োজন করে বসে এসব বিতর্ক দেখার জন্য!
ডিবেটের কয়েকদিনের মাঝে বোনাস হিসেবে থাকে ডিবেটের স্পুফ। ডিবেটের চুম্বক অংশ হাইলাইট করে সমালোচনার লক্ষ্যে দুজন ক্যান্ডিডেটকে পরিহাস করা হয় কমেডি শোগুলোতে! যে মানুষটা দু দিন পর রাষ্ট্রপ্রধান হতে যাচ্ছেন তাঁকে যে কি সব অপমানকর ভাষায় সমালোচনা করা হয় তা আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে অকল্পণীয়! দুঃখজনক হলেও এমন সমালোচনার শত ভাগের একভাগ আমাদের কোন গণমাধ্যমে ঘটলে ক্ষমতায় আরোহনের সাথে সাথে সেই মিডিয়া হাউজ বন্ধ আর গ্রেফ্তারের হিড়িক পড়ে যাবে। স্পুফ বা ব্যঙ্গ দূরের কথা, সাধারন সত্য তুলে ধরার কারনে গত নির্বাচনের পর পর বেশ কিছু মিডিয়া হাউজ বন্ধ ও এদের কর্ণধারদের গ্রেফ্তার, নির্যাতন আর নাজেহাল করার নোংরা ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেছে।
এসব ডিবেটের একটিতে সাধারন মানুষ সরাসরি প্রশ্ন করবে ক্যান্ডিডেটকে, জবাব পছন্দ না হলে তাঁর বলার অধিকার আছে জবাবটি সন্তোষজনক নয়। সবচেয়ে বড় কথা সেসব জবাব কেমন হয়েছে তা নিয়ে বড় বড় সব গণমাধ্যম চুল চেরা বিশ্লেষনে নেমে যায়। অর্থাৎ বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতিকে তার নাগরিকদের কাছে প্রতি মুহুর্তে জবাবদিহী করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। যেকোন কন্ট্রোভার্সিয়াল ঘটনা ঘটলে জনগনকে জবাব দিতে তাঁরা বাধ্য।
বাংলাদেশের সবচেয়ে নির্মম হত্যাযজ্ঞ, ২০০৯ এর ২৫ শে ফেব্রুয়ারির পিলখানা ম্যাসাক্যারের পর এক সভায় যে কজন সামরিক কর্মকর্তা প্রধানমন্ত্রীকে নিজেদের সহকর্মীদের নির্মম হত্যাকান্ড নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন তাঁদের সকলকে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছিলো, এমন স্পর্ধা এমন ধৃষ্টতা এদেশে অকল্পনীয়!
ছবি: নির্বাচনের দিন বাংলাদেশ
নির্বাচনের দিন.... নির্বাচনের দিন বাংলাদেশেও নিঃসন্দেহে একটি বিশেষ দিন। অগুনিত মানুষ অত্যন্ত সখ করে ভোট কেন্দ্রে ভোট দিতে যায়, যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কেন্দ্র পৌঁছে আবিস্কার করেন তিনি পৌঁছানোর অনেক আগে কোন ?হৃদয়বান তাঁর ভোটটি দিয়ে গেছেন। আবার অনেকে ব্যালট বাক্সের কাছে পৌঁছানোর আগে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে প্রার্থীদের পদলেহী ক্রীতদাস মাস্তানদের চোখ রাঙ্গানী আর হুমকী হজম করেন। তবে আরো একটি বড় অংশ ভোট কেন্দ্রে পৌছানো না পৌঁছানয় কিছু এসে যায়না কারন সেই পদলেহী পঙ্গপাল ব্যালটবাক্সটা্ দলের সম্পত্তি দাবী করে কেন্দ্র থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়!
ছবি: নির্বাচনের দিন যুক্তরাষ্ট্রের ভোট কেন্দ্র
আমেরিকায় নির্বাচনের দিন বলতে যে বিশেষ তারিখটিকে বুঝায় তা আসলে নির্বাচনের শেষ দিন, অর্থাৎ ভোট প্রদানের ডেডলাইন। ভোটিং পদ্ধতি শুরু হয় প্রায় ২-৩ সপ্তাহ আগে। ভোটগ্রহনের শেষ দিন সকলের অভিন্ন হলেও ভিন্ন ভিন্ন স্টেটে তাদের নিজস্ব ভোটিং শুরুর তারিখ আর পছন্দমতো উপায় আছে।
কোন কোন স্টেটে বাংলাদেশের মতো ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়ে আসা যায়।
ছবি: যুক্তরাষ্ট্রের ভোট কেন্দ্র
আবার কোন কোন স্টেটে এমন কোন কেন্দ্রের বালাই নেই। সেখানে অনলাইনে অথবা পোস্ট করে ভোট দিতে হয়। জ্বী, ভুল পড়েননি পোস্ট অফিসের চিঠির মতো ব্যালট পেপার পোস্ট করে ভোট দেয়া যায়!
ছবি: আমেরিকার ড্রপঅফ ব্যালট বাক্স
পোস্ট অফিস বা ডাকবাক্সও যদি সুবিধাজনক মনে না হয়, খোন অসুবিধা নেই.. দিন রাত ২৪ ঘন্টার যেকোন সুবিধামতো সময় নির্দিষ্ট স্থানে রাখা ব্যাল বাক্সে ব্যালটটি ফেলে আসা যায়। এমনকি ড্রাইভথ্রু ব্যালট ড্রপ অফ বাক্স আছে, গাড়ি থেকে নামার কষ্টের প্রয়োজন নেই। মেয়রের অফিস, লাইব্রেরীর সামনে, পথের পাশে ভোট বাক্স ফেলে রাখা হয়, জনগণ তাদের সুবিধা মতো সময় ভোট দিয়ে আসবে।
ছবি: লাইব্রেরীর সামনে পথের পাশে ফেলে রাখা ব্যালট বাক্স
আমাদের দেশে এমন একটি বাক্স কোথাও রাখার কথা কল্পণাতীত! হাজার পাহারা আর পুলিশের হেফাজত থেকে দেশপ্রেম বর্জিত ক্লিব সম দলীয় ক্যাডাররা ব্যালটবাক্স চুরি করে নিয়ে যায়! এমন ভাবনা এদেশের মানুষের দুঃস্বপ্নেও আসেনা।
ছবি: বাংলাদেশের ব্যালট বাক্স!
যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৬ নির্বাচন শেষের দিকে। সমগ্র দেশ রুদ্ধ শ্বাসে অপেক্ষা করছে ফলাফলের জন্য। অতীতের সকল সময়ের চেয়ে এবারের নির্বাচন বেশী উত্তেজনাকর কারন এবার মুখোমুখি হয়েছে একজন স্বঘোষিত বর্ণবাদী আর একজন নারী নেত্রী। আট বছর আগের নির্বাচনের উত্তেজনা ছিলো আমেরিকা একজন কৃষ্ণাঙ্গ নেতার জন্য প্রস্তুত কিনা সেই পরীক্ষার ফল জানতে, তবে তাঁর বিপরীতে ছিলেন একজন সন্মানিত জনপ্রিয় নেতা যিনি জয়ী হলে শুধু একটি দল হেরে যেতো। এবার নারী নেত্রীর বিপরীতে অত্যন্ত বিতর্কিত, সমালোচিত এবং নিন্দিত ব্যবসায়ী, যার নেতৃত্বের ভাবনা আমেরিকার বৃহত্তর জনগোষ্ঠিকে হতাশ করে।
বিপুল ভাবে সমালোচিত আর নিন্দিত ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দী আর সব বছরের মতো যেকোন ডেমোক্র্যাট হলে প্রায় চোখ বন্ধ করে বিজয় নিশ্চিত ছিলো, এবার ঘটনা তেমন নয়! একজন নিন্দিত ব্যবসায়ীর বিপরীতে একজন সুযোগ্য, অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিলারি ক্লিনটন যিনি প্রাক্তন সিনেটর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন তার পরও এ সংশয় শুধুমাত্র একটি কারনে, তিনি নারী।
আর এখানে এসেই বাংলাদেশের মাথা উঁচু হয়ে যায়। শুধু বাংলাদেশ নয়, অত্যন্ত রক্ষণশীল হিসেবে পরিচিত দক্ষিন এশিয় অণ্চল- এমন অন্চলের মুসলিম অধ্যুসিত একটি রক্ষণশীল দেশ বাংলাদেশ মাত্র ২০ বছরের তারুণ্যে বিপুল ভোটে জয়ী করে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করেছিলো একজন নারী বেগম খালেদা জিয়াকে।
আর সকলের মতো রুদ্ধশ্বাসে আমরা অপেক্ষা করছি দেখতে......বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি রক্ষণশীল দেশ ২০ বছরের সদ্য তারুণ্যে যে প্রগতিশীলতা আর ঔদার্য্যের স্বাক্ষর রেখেছে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশটি ২৩৯ বছরে এসে সেই ঔদার্য্য্ আর ভালোবাসায় নারী নেতৃত্বকে আলিঙ্গন করতে পারে কিনা!!!!!!!!!!!
****** বাংলাদেশে নির্বাচনের দিন শুধুমাত্র পোস্টের ছবির দৃশ্যের অবতাড়না হয়না। সুশৃংখল সারিবদ্ধ ভাবে ভোটারগণের শান্তিপূর্ণ ভোট প্রদানের সংখ্যা নিঃসন্দেহে কম নয়, তবে পোস্ট লেখা হয়েছে প্রকট হয়ে উঠা দুদেশের অসঙ্গতি আর অমিল সম্পর্কে! আরো দুঃখজনক, বাংলাদেশের ইলেকশন লিখে ছবি সার্চ করে নেতিবাচক ছবির সংখ্যাই বেশি পাওয়া যায়*****
ছবি সুত্র:- ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই নভেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:২১