নিখাদ ভালোবাসার শক্তি অনুভবের তীব্রতার চেয়েও বহুগুন বেশি!
এই জাদুকরী শক্তি বড় বড় পাহাড় গুড়িয়ে দিতে পারে সেখানে সাধারন মানুষ পরাজিত হতে বাধ্য!
হঠাৎ দেখা কোন দৃশ্য, হঠাৎ কোন মুহুর্ত মাঝে মাঝে স্মৃতির অতলে টেনে জন্ম দেয় গভীর বোধের!
দীর্ঘজীবনে হয়তো খুব আটপৌঢ় ভাবে যে বাস্তবতা জেনেছি বা মেনেছি জীবনের কয়েক দশক পাড়ি দিয়ে অণুধাবন করি সে জানার মাঝে কি ভীষণ এ ফোকর ছিলো, মেনে নেয়াটা ছিলো আরো বড় ভুল!
বাংলাদেশের বাইরে প্রথম বেড়াতে গিয়ে বেশ কিছু জিনিসের মাঝে একটি বিশেষ ব্যপার লক্ষ্য করি।
প্রথম দিকে বিষয়টি তেমন ভাবে নাড়া না দিলেও যখন প্রবাসে পাড়ি জমাই তারপর তা আরো প্রকট হয়ে উঠে, নিজের দেশের রহস্যটা আজও ভেদ সম্ভব হয়নি।
প্রবাসে বিশেষ করে উন্নত বিশ্বে পার্কিং একটি মহা ব্যাপার। দেশগুলো সুন্দর ছিমছাম পরিপাটি রাখার পিছনে তাদের পথঘাট দোকান পাট, হাসপাতাল, অফিস আদালতের সুশৃংখল আর সুনির্দেশিত পার্কিং ব্যবস্থার এক বিরাট ভূমিকা আছে। ছোট বড় প্রায় সব পার্কিং লটে মূল ফটক/লিফটের সবচেয়ে কাছে সবচেয়ে কনভেনিয়েন্ট পার্কিং স্পেসগুলো হ্যান্ডিক্যাপ/বিকলাঙ্গদের জন্য বরাদ্দ। এমনকি ফাস্টফুড রেস্টুরেন্টেও হুইল চেয়ার ফ্রেন্ডলী টেবিলগুলো সাইন দেয়া থাকে, যদি দোকানে কোন হুইল চেয়ারে বসা কাস্টমার আসে আর সুস্থ কেউ টেবিলটি দখল করে বসে থাকে তাকে সাথে সাথে স্থান ছেড়ে দিতে হবে।
এই হ্যান্ডীক্যাপ বা বিকলাঙ্গ শুধু জন্মগত ত্রুটির সমস্যাগ্রস্থদের জন্য নয়, বয়সের ভারে ন্যূয বৃদ্ধ, বৃদ্ধা থেকে শুরু করে শারিরিক অক্ষমতা সম্পন্ন মানুষদের জন্য।
প্রশ্ন হলো শারিরিকভাবে অক্ষম এই মানুষেরা, বার্ধক্যে জর্জরিত এই বৃদ্ধবৃদ্ধারা গাড়ি চালিয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াবে, এটা কেমন ব্যাপার...... অন্তঃত আমাদের উপমহাদেশের মন মানসিকার প্রেক্ষিতে বিষয়টি খুব স্বাভাবিক নয়।
শুধু পার্কিং বা রেস্টুরেন্টের বিশেষ স্থান নয়, এই দেশে চলতে ফিরতে পথে ঘাটে, দোকানে, অফিস আদালতে চোখে পড়বে হ্যান্ডিক্যাপ মানুষদের জন্য বিশেষ সুযোগ সুবিধার পাশাপাশি তাঁদের সর্বত্র সহজ সাধারন বিচরন। সুস্পষ্টভাবে জন্মগত ত্রুটি/বিকলাঙ্গতা নিয়ে জন্মানো, আবার কারো অসুস্থতা বা দুর্ঘটনায় অঙ্গহানী হয়েছে, তাঁরা আর দশজনের মতো কাজ করে যাচ্ছে। দল বেঁধে মলে যাচ্ছে শপিং করছে, আড্ডা দিচ্ছে, দোকান পাট অফিস আদালতে কাজ করছে।
এসব দেখে ভীষণ কৌতুহল হতো আমাদের দেশে এমন মানুষ শুধু পথে ঘাটে ভিখেরী রূপে দেখা যায়, কোন সামাজিক অণুষ্ঠান বা মলে চোখে পড়েনা। এমনকি শিশুদের খেলার পার্কে কজন বিকলাঙ্গ শিশু দেখা যায়না।
এমনতো নয় যে এধরনের সন্তান শুধু হত দরিদ্রের ঘরে জন্মে!
তাহলে এরা কোথায় যায়?
নিশ্চিত নই তবে ধারনা করতে পারি এই শিশুদের কোন বিশেষ কারনে পরিবার আড়াল করে রাখে। হতে পারে আমাদের সমাজের স্থূল মানসিকতার জন্য, হতে পারে শিশুকে বাইরে সামাল দেয়া সহজ নয় এমনটা ভেবে।
একজন মা যে ভালোবাসা আর নির্যাস দিয়ে একজন সুস্থ সুন্দর শিশুর জন্ম ও লালনপালন করেন তার চেয়ে এই শিশুদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা কোন অংশে কম নয়, হয়তো বেশিই। তাহলে?
আমরা নিজেদের শিক্ষিত, আধুনিক মনে করি অথচ আমাদের মন মাসনিকতা যে কি পরিমানে প্রাচীন আর অভব্য তা শুধু এই একটি বিষয় ভেবে দেখলে স্পষ্ট হয়।
পাশের বাড়িতে এমন কোন শিশুর আগমন ঘটলে ফিসফিসে গুন্জন শুরু হয়ে যায়। নিজের আপাতঃ দৃষ্টিতে সুস্থ সুন্দর সন্তানটিকে সেই শিশুর কাছ থেকে আগলে রাখার চেষ্টায় মেতে উঠে অনেকে। আর পাড়ার বন্ধুরা একজন ডাউন সিন্ড্রোমে আক্রান্ত, একজন বিকলাঙ্গ সমবয়সীর সাথে আগ্রহ নিয়ে খেলবে এমনটা আশা করাই যেনো ধৃষ্টতা!!!
এই মানুষদের, এই শিশুদের অক্ষমতা সেখানে শুধু কটাক্ষ আর পরিহাসের বিষয়!
নিজের সন্তানের মন একটু খারাপ হলে আমরা অস্থির হয়ে পড়ি, কখনও ভেবে দেখেছি এই শিশুরা কি পরিমান বিষন্নতায় ভুগে! কবিতা আর সঙ্গীতের মূর্চ্ছনায় বিলাসী একাকিত্বে ভোগা এই আমরা কখনও একবার অনুভব করেছি কি ভীষণ একাকিত্ব গ্রাস করে রাখে আশৈশব এ ঘরে করে রাখা এঁদের!
আমেরিকায় এঁদের বলে স্পেশাল চিলড্রেন। স্পেশাল অবশ্যই- মহান সৃষ্টিকর্তা অধিকাংশ মানুষদের এক ছাঁচে গড়ে এই বিশেষ কিছু মানুষদের স্পেশালি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি কর্তা যেখানে এঁদের অসাধারন করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন সেখানে এই সাধারন আমরা এঁদের হেলাফেলা করার কে?
এই শিশুদের আর দশজনের মতো সামাজিক সুবিধা আর পরিবেশ দিলে তাঁরাও হাসি মুখে এগিয়ে আসতে পারে, পরিবারের সবচেয়ে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর পর এক ফিজিশিয়ানের ক্লিনিকের(আমাদের দেশে ডাক্তারের চেম্বার হিসেবে যা পরিচিত) লবিতে এক দৃশ্য দেখে প্রথমে অবাক হয়েছিলাম। আর সব রুগীদের সাথে বসে আছে একঝাঁক স্পেশাল মানুষ। কেউ সোজা হয়ে বসতে পারছেনা, ২৫/২৬ বছরের যুবকের মুখ দিয়ে অনর্গল লালা পড়ে যাচ্ছে, কেউ বা একটানা গোঙ্গানীর মতো শব্দ করে যাচ্ছে। কারো মুখ শরীরের তুলনায় বেঢপ বড় আর কারো বিশাল দেহে ছোট্ট একটা মাথা.... অবাক হয়েছিলাম এই সব মানুষদের সাথে আর দশজন সাধারন রুগী খুব স্বাভাবিক ভাবেই বসে আছে! কেউ আঁৎকে উঠছেনা, কেউ সরে যাচ্ছেনা। অভিভূত হয়েছিলাম ওঁদের সাথে আসা দুজন ভদ্রমহিলাকে দেখে, কি পরম মমতায় সেই মুখ থেকে গড়িয়ে পড়া লালা বার বার মুছে দিচ্ছে, কারো অকারন অযৌক্তিক প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাচ্ছে হাসি মুখে। এতোটুকু বিরক্তি নেই..... সেদিন নিজেকে, নিজদের কেমন ছোট মনে হয়েছিলো!
আমি জানিনা এই পোস্টের পাঠকদের পরিবার বা আত্মীয় মহলে কোন বিকলাঙ্গ বা হ্যান্ডিক্যাপ সদস্য আছে কিনা, যদি থাকে তাঁদের দিকে ভালোবাসা আর বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিন। আর দশজনের মতো তাঁদের সামিল করুন আপানর পারিবারিক, সামাজিক অণুষ্ঠানে।
পথে ঘাটে কোন বিকলাঙ্গ শিশু বা মানুষ দেখে আঁতকে না উঠে বরং আর দশজনের মতো তাঁদের সাথে স্বাভাবিক আচরন করা জরুরী, তাঁদের কোন প্রয়োজনে এগিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া যায়।
প্রতিবেশীর বিকলাঙ্গ শিশুর সাথে আপনার হৃষ্টপুষ্ট সন্তানকে খেলতে দেয়া উচিৎ, এতে শুধু সেই শিশু নয় বরং নিজের সন্তান অনেক বেশি উপকৃত হবে। সে শৈশবেই মানবিকবোধের এক অমূল্য সম্পদের মালিক হবে। শুধু তাই নয়, একজন শিশু শৈশব থেকে নিজের অবস্থায় সন্তোষ্ট আর অপরকে শ্রদ্ধা করার ক্ষমতা নিয়ে বড় হবে।
সৃষ্টি কর্তার এই স্পেশাল সৃষ্টি ঘরের অন্ধকারে আড়াল করে না রেখে সূর্যের আলোয় আলোকিত হতে দিন। তাঁদের সন্মান আর ভালোবাসায় সিক্ত করে আপনার আমার সমাজকে সমৃদ্ধ করুন।
এই ভিডিওটি দেখে কারো পক্ষে চোখ শুষ্ক রাখা সম্ভব কিনা জানা নেই। এই পৃথিবীর মানুষের নিষ্ঠুরতাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে যে পরম ভালোবাসা আর মমতায় ছবির এই সৃষ্টি একজন ডাউন বেবীর সাথে গায়ে পড়ে, অণুনয় বিনয় আর চেষ্টা করে বন্ধুত্ব গড়ে তুলে তা মন ছুঁয়ে যায়। শিশুটি একসময় এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আর বন্ধুত্বের ভালোবাসার কাছে পরাজিত হতে বাধ্য হয়।
এই প্রানীটিও জানে একটু ভালোবাসা, একটু নিখাদ বন্ধুত্ব কি ভীষণ শক্তি নিয়ে ভালোবাসা আর আস্থায় জড়াতে -সক্ষম এমন শিশুদের!
কেউ কেউ মনে করেন নিজ পরিবারের বিকলাঙ্গ বা জন্মত্রুটি সম্পন্ন সদস্য সম্পর্কে জানলে আপাতঃ সুস্থ সন্তানদের ভবিষ্যতে বিয়ে দিতে সমস্যা হতে পারে! মনে রাখতে হবে জন্মগত ত্রুটি বা অসুস্থতা যে সমাজে ট্যাবু সে সমাজ কখনও সুস্থ বা সভ্য মানুষের সমাজ হতে পারেনা। তাই প্রত্যেকের নিজ পরিবারের সকল সদস্যের হাত ধরে "এই আমার ভাই/বোন, আত্মীয়, এটাই আমার বাস্তবতা" বলতে পারআর সৎসাহস আর শিক্ষা থাকা জরুরী।
স্পেশাল চাইল্ডরা আমাদের কাছে কিছু আশা করেননা। আমাদের কাছে তাঁদের কোন চাওয়া পাওয়া নেই তবে আমাদের একটু ভালো ব্যবহার আর মনুষত্ব তাঁদের মুখে ফোটাতে পারে এক অমূল্য হাসি, তাঁদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে সক্ষম হয়। একটু সহযোগিতা আর সন্মান পেলে তাঁরা অনেকেই দেখিয়ে দিতে পারে তাঁরা আর কারো চেয়ে কোন অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ বা প্রয়োজনীয় নন।
আমেরিকার নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যে "টিম'স প্লেস" নামের রেস্টুরেন্টের মেনুতে একটি স্পেশাল আইটেম আছে যে কারনে আর দশটি রেস্টিরেন্টের চেয়ে এটা বিশেষ ভাবে পরিচিত।
আইটেমটির ব্যাখ্যায় বলা আছে, "এই আইটেমে কোন ক্যালোরি, কোন অপরাধবোধ নেই অথচ তোমার জীবনকে আরেকটু আনন্দময় করে তুলবে"...... এই বিশেষ আইটেমটির নাম "হাগ" বা "আলিঙ্গন" যা কোন প্রেম বা রিপুর আলিঙ্গন নয় বরং বন্ধুত্ব আর সহমর্মিতার প্রতিক। গত ছয় বছর ধরে সুপ্রতিষ্ঠিত এই রেস্টুরেন্টের ২৬ বছর বয়সী মালিক গত দু বছর ধরে নিঃশর্ত ভাবে তার সকল কাস্টমারদের(যাদের আপত্তি নেই) দিয়ে যাচ্ছে। এমনকি সেখানে টিমকে শুধু জড়িয়ে ধরতে নিয়মিত ভাবে অনেকে এসে থাকে।
২৬ বছরের টিম হ্যারিস জন্মগত ত্রুটি ডাউন সিন্ড্রোমে আক্রান্ত। হাজার প্রতিকুলতার মোকাবেলা করে তাঁর মা বাবা তাঁকে স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে শিখিয়েছেন বলেই শুধু রেস্টুরেন্টের ব্যবসায় সাফল্য নয়, টিম গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছে, প্যারা অলিম্পিকে অংশগ্রহন করেছে এমনকি টিম একজন দক্ষ নাবিক। আর হাই স্কুলে টিম হ্যারিস অর্জন করেছিলো "স্টুডেন্ট অফ দ্যা ইয়ার" এর খেতাব।
আমাদের দেশের আনাচে কানাচে লুকিয়ে রাখা হাজারও টিমদের্ আমরা উদ্বুদ্ধ করতে পারি আলোকিত জীবন যাপনের। তাঁরাও পারেন নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, দেশের জন্য নিজেকে বিশেষ সম্পদ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে।
এই বিশেষ মানুষদের দেখে আঁৎকে উঠা বা তাঁদের অবজ্ঞা করার সময় মনে রাখা জরুরী, এঁদের কম বেশি কিছু শারিরিক ত্রুটি হয়তো আমাদের চোখে পড়ছে তবে দুর্ভাগ্যবশত এর চেয়ে অনেকগুন বেশি বিকলাঙ্গতা আর ত্রুটিগ্রস্থ আমাদের মানসিকতা আর মনন।
আমাদের একটু মানবিক ব্যবহার, একটু ভালোবাসা এঁদের সাহায্য করে হাসি মুখে হাজার মাইল পাড়ি দিতে!
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০১৬ দুপুর ১:৫৫