ভারতীয় নায়ক নায়িকাদের নিয়ে আমাদের আগ্রহ, অণুরাগ আর উচ্ছাস অপরিসীম!
.
পথ চলতে দেখা হত দরিদ্র শিশুকে দুটো পয়সা দিতে আমাদের হাজার আপত্তি থাকলেও এসব নায়কদের নর্তন বা কখনও শুধু দুমিনিটের দর্শন পাবার আশায় দশ বিশ হাজার টাকা খরচ করতে পারি নিমেষেই।
আজ আমার দৃষ্টিতে ভারতের শ্রেষ্ঠ নায়ক সম্পর্কে কিছু কথা
.
তিন চার বছর আগে ইউটিউবে দেখছিলাম, ভারতীয় চলচ্চিত্রর কলাকুশলী শিল্পীদের কোন এক পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠানে দেশের শ্রেষ্ঠ নারীদের পুরস্কৃত করা হচ্ছে। চলচ্চিত্র সংক্রান্ত পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠানের মাঝে এধরনের উদ্যোগ দেখে বেশ কৌতুহলী হয়ে উঠি। একে একে নারীরা এসে পুরস্কার গ্রহন করছেন, বেশ কয়েকজনের পর শ্রেষ্ঠ নারীর পুরস্কার গ্রহনে এলেন একজন ভদ্রলোক - অরুনাচালাম মুরুগানানথাম। এসে হাসি মুখে বললেন; বছরের সেরা ভারতীয় নারীদের অন্যতম হতে পেরে আমি গর্বিত!
একজন পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও নারী হিসেবে মুরিগানানথামের এমন পুরুস্কার পাবার ইতিহাস শুধু গৌরবাজ্জ্যল নয় অত্যন্ত রোমান্চকর এবং অনুপ্রেরণার।
ঘটনার শুরু ১৯৯৮ সালে, অরুনাচালামের পৃথিবী তখন নববিবাহিত স্ত্রীকে ঘিরে, আর আছে তাঁর বিধবা মা। একদিন লক্ষ্য করেন স্ত্রী তার কাছে থেকে খুব গোপনে কাপড়ে আড়াল করে কিছু নিয়ে যাচ্ছে! তিনি ভীষণ কৌতুহলী হয়ে উঠেন জানতে, অনেক পীড়াপীড়ি করায় স্ত্রী তাকে যা দেখালেন তিনি চমকে গেলেন, ময়লা আবর্জনা মাখা ছেঁড়া কাপড়-জানলেন স্ত্রীর ঋতুস্রাবে তা ব্যবহার করবে! আহত হলেন অরুন, কাপড়টি এতোটাই নোংরা যে তিনি তার মটর সাইকেল মুছতেও তা ব্যবহার করবেননা। বাজারে যে স্যানিটারি ন্যাপকিন পাওয়া যায় তা কেনো ব্যবহার করছেনা জানতে চাইলে স্ত্রী জানালেন সেই ন্যাপকিন কিনলে সংসারে টানাটানি পড়বে, দুধ ডিমের খরচটা জোগানো যাবেনা! প্রিয়তমা স্ত্রীর অবস্থা চিন্তা কে মন খারাপ হলো তাঁর।
স্ত্রীকে খুশি করতেই তিনি বাজারে গিয়ে এক প্যাকেট স্যানিটারী ন্যাপকিন কিনে আনেন। সামান্য কিছু তুলার এমন উচ্চ মূল্য দেখে চমকে যান আর সেই সাথে পণ করেন নিজেই তৈরী করবেন স্যানিটারী ন্যাপকিন। কিছু দিনের মধ্যেই তুলো পেচিয়ে ন্যাপকিন তৈরী করে স্ত্রীকে দেন এবং জানতে চান কেমন হয়েছে, স্ত্রী যখন বললেন ফিডব্যাক জানাতে আরো একমাস অপেক্ষা করতে হবে তখন অরুনাচলম প্রথম জানলেন ঋতুস্রাব নারীদের একটি মাসিক প্রক্রিয়া।
স্ত্রীকে মুগ্ধ করতে যে পণ করেছেন যদি সেখানে প্রতিবার ফিডব্যাক পেতে তাঁকে যদি একমাস অপেক্ষা করতে হয় তাহলে সাফল্য পেতে কয়েক যুগ সময় পেরিয়ে যাবে।
একটু খোঁজ নিয়ে জানলেন শুধু তাঁর স্ত্রী নয়, নিজ গ্রাম সহ আশেপাশের প্রায় ৯০% নারী স্যানিটারী ন্যাপকিন ব্যবহারের অক্ষম শুধুমাত্র আর্থিক কারনেই। আর এর বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে পুরনো ময়লা ও অতি জীর্ণ কাপড়ের টুকরো শুধু নয় বরং সেই সাথে বালু, ভুষি, গাছের পাতা এমনকি ছাই এর মতো অতি অস্বাস্থ্যকর দ্রব্যাদি, গ্রামের নারীকূল তাঁদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সহ্য করে চলেছেন নতুন জীবন সৃষ্টি অতি মূল্যবান শারীরিক প্রক্রিয়ার এক অবর্ণনীয় অস্বস্তি আর কষ্ট!
এবার আরো দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হলেন একজন কারখানা শ্রমিক মুরুগানানথাম।
স্ত্রী ও নিজের বোনেরা তাঁর এই প্রকল্পকে নিতান্ত পাগলামী ভেবে সেসব স্যানিটারি ন্যাপকিন পরীক্ষা করে দেখতে অস্বীকৃতি জানালে তিনি বিপদে পড়েন তবু দমে যাননা। একসময় অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মেডিকেল কলেজের কয়েকজন ছাত্রীকে ভলান্টীয়ার হিসেবে রাজী করতে সক্ষম হন তবে যখন জানতে পারেন মাত্র দু একজন তাঁর তৈরী ন্যাপকিন ব্যবহার করে এবং অন্যরা সেই অভিজ্ঞতা কপি করে তার গবেষণাপত্র পূরণ করছেন তখন তিনি ঠিক করেন নিজেই পরীক্ষা করবেন।
ফুটবলের ব্লাডারকে ইউটেরাস বা জরাযূর বিকল্প হিসেবে বানান, পরিচিত বন্ধু স্থানীয় কসাই খাসী জবাই হলেই তার দরজায় কড়া নেড়ে জানিয়ে যায়... সেই খাসীর রক্ত ফুটবলের ব্লাডারে ভরে নিজের পোশাকের নীচে আড়াল করে রাখতেন। তাঁর দৃঢ়তা এতোটাই ছিলো যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে তিনি রক্ত কিভাবে জমাট না বাঁধিয়ে তরল রাখা যায় সেই প্রক্রিয়াও শিখে নেন। তারপর সেই কৃত্রিম ইউটেরাসের সাথে নল যুক্ত করে তিনি হেঁটে, দৌড়ে, সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়ান পাঁচ ছয় দিন। একটি সাক্ষাৎকারে দেখেছিলাম তাঁকে বলতে "সেই ছয় সাত দিন আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন ও দুর্বিসহ সময় ছিলো আর সেই সময় নারী জাতির প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও সন্মান হাজার গুনে বেড়ে যায়"।
রক্তমাখা সেই কাপড় তিনি যখন পাড়ার কুয়োর পাড়ে পরিস্কার করতেন তখন স্থানীয়রা ধরেই নেন মুরুগাথানানথাম কোন জটীল যৌনরোগে আক্রান্ত হয়েছে!!! শুধু তাই নয় এসব দেখে তাঁর প্রাণপ্রিয় স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে চলে যান পিত্রালয়। এ্ই সময়টাকে সৃষ্টিকর্তার প্রহসন বলে মনে করেন তিনি, যে প্রিয়তমা স্ত্রীর প্রতি তীব্র ভালোবাসার কারনে তাঁর কষ্টলাঘবেই এই যুদ্ধ, সেই যুদ্ধে বিরক্ত হয়ে স্ত্রীই চলে যান।
তিনি বুঝতে পারেন ভালো এবজর্পশন হয় এমন স্যানিটারী ন্যাপকিন বানাতে হলে সত্যিকারের ব্যহৃত স্যানিটারি ন্যাপকিন পরীক্ষা করেই তিনি সবচেয়ে সহজে নিজের তৈরী ন্যাপকিনের ত্রুটি ভালোভাবে জানবেন। আবারও অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে কয়েকজন ছাত্রীকে রাজী করিয়ে ব্যবহৃত ন্যাপকিন সংগ্রহ করে নিজের বাড়ির পিছনে স্তুপ করে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করেন। উৎকট দুর্গন্ধে একদিন তাঁর মা সেই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে ফেলেন এবং সেই মুহুর্তে কাপড় চপোপড় গুছিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যান।
তার চেয়েও ভয়ংকর ঘটনা ঘটে যখন গ্রামবাসী এই গবেষণাগারের খবর জানতে পারে, তারা নিশ্চিত হয় কোন খারাপ ভুতের আছরের কারনেই তাঁর এমন পাগলামী। তারা সিদ্ধান্ত নেয় গাছে উল্টো করে ঝুলিয়ে ওঝা দিয়ে এই পাগলামীর চিকিৎসা করবে। গ্রাম ছেড়ে যাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি সেই যাত্রায় কোনরকমে রক্ষা পান তবে তাতে থেমে থাকেনা গুরুনানথমের এক অদ্ভুত যুদ্ধ!!!
অনেক চেষ্টা, বিড়ম্বনা আর বাঁধা বিপত্তি পেড়িয়ে, বিভিন্ন কম্পানীর দাড়ে দাড়ে ঘুরে প্রায় আড়াই বছর পর বাজারে প্রচলিত স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্রকৃত উপাদান সম্পর্কে জানতে পারেন। তবে গাছের বাকল থেকে সেই উপাদান সংগ্রহের প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত মেশিন অত্যন্ত ব্যয়বহুল দেখে নিজে নতুন উপায়ে ভালো অথচ সুলভ মেশীন নির্মানের গবেষণায় মেতে উঠেন।
হাজার অপমান, ত্যাগ তিতীক্ষা আর অক্লান্ত পরিশ্রমের প্রায় সাড়ে চার বছর পর তিনি স্বল্প মূল্যে স্বাস্থ্যকর স্যানিটারী ন্যাপকিন তৈরীর প্রক্রিয়া আবিস্কারে সক্ষম হন।
মাত্র চারটি স্টেপে গাছের বাকল থেকে একই উপাদান অত্যন্ত সহজ সুলভ মেশিনে ভেঙে কার্যকর অথচ সুলভ ন্যাপকিন বানানো সম্ভব হয়।
ভারতের "জাতীয় উদ্ভাবক প্রতিযোগিতা"য় আইআইটি কতৃপক্ষ তাঁর অগোচরেই মেশিনটি দেন এবং ৯৪৩ টি উদ্ভাবনের মাঝে মুরুগানানথামের মেশিন প্রথম স্থান অধিকার করেন। মুহূর্তেই খ্যাতি ছড়িয়ে পরে সর্বত্র.....
প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর পর তাঁর ফোনে একটি কল আসে এবং অপর প্রান্ত থেকে একটি কন্ঠ জানতে চায়, "আমাকে মনে আছে?" তাঁর স্ত্রী ফিরে আসেন তার কাছে, একে একে তাঁর মা আর গ্রামবাসী সকলেই গর্বের সাথে বরন করে নেন অদ্ভুত মানুষ, সফল গবেষককে।
তাঁর যুদ্ধে সেখানেই থেমে যায়না। ভারতের প্রতিটি নারী যেনো নাম মাত্র মূল্যে স্বাস্থ্য সন্মত স্যানিটারী ন্যাপকিন ব্যবহারের সুযোগ পান, সেই সংকল্প ধারন করেন মনে প্রাণে।
স্কুলের গন্ডি পার হতে না পারা সেই মানুষটি আজ ভারতের সবচেয়ে সন্মানিত ও সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ আইআইটি'র বিভিন্ন শাখায় আমন্ত্রিত সন্মানিত গেস্ট লেকচারার হিসেবে যান। অজ পাড়াগাঁয়ের এক কারখানার শ্রমিক নিজের শ্রম আর অধ্যাবসায় বলে আজ ভারতের উচ্চমহলের অত্যন্ত কাঙ্খিত সন্মানিত ব্যক্তি।
নিজের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল মেশিনটি তৈরীর প্রক্রিয়া তিনি ইন্টার নেটে ছেড়ে দেন। তাঁর একটিই উদ্দেশ্য সকল নারী যেনো নাম মাত্রমূল্যে স্বাস্থ্যসন্মত এই স্যানিটারী ন্যাপকিন ব্যবহার করতে পারেন।
এই পোস্টটি লেখার সময়লিংক দিতে গিয়ে লক্ষ্য করি সাইটটিতেকিছু রেস্ট্রিকশন এসেছে এবং আর সে্ই সাথে নতুন উদ্যোক্তারা উপকৃত হবে এমন ভাবনাও যুক্ত হয়েছে।
অরুনাচলম মুরুগানানথামের একটিই স্বপ্ন; "মৃত্যুর আগে যেনো দেখে যেতে পারি, আমার দেশের প্রতিটি নারী স্বাস্থ্যসন্মত স্যানিটারী ন্যাপকিন ব্যবহার করছেন, আবর্জনা ময়লা আর ছাইয়ের মতো অস্বাস্থ্যকর কিছু নয়"
ভারতের অসাধারাণ ভালো গুনগুলো নিজের মাঝে ধারন করতে পারলে আমরা জানবো ভারতীয় সামগ্রীর প্রতি অনুরাগ নয়, তা থেকে নিজেকে বিরত রাখা জরুরী, ভারতীয় পোশাকের জন্য উন্মাদনা নয় বরং তা বর্জনীয়।
ভারতীয় চলচ্চিত্রের নর্তনকুর্দন গান গাওয়া মেকআপ সজ্জিত অভিনেতারা নয়, সত্যিকারের অণুকরনীয় অনুসরনীয় ভারতীয় শ্রেষ্ঠ নায়ক একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, গবেষক এবং সর্বপরি একজন সত্যিকারের প্রেমিক ও মানুষ অরুনাচলম মুরুগাননথাম।
একজন মুরুগানানথামকে নিয়ে তৈরী ডকুমেন্টারী দ্যা মেন্সট্রুয়াল ম্যানের ট্রেলর।
তথ্যসুত্র: ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:২৬