"থ্রী এএম ফ্রেন্ড" বলে একটি প্রচলিত কথা আছে, সাধারনত বন্ধুত্বের ঘনিষ্ঠতা বুঝাতে বাক্যটি ব্যবহৃত হয়।
ব্যাপারটা এমন- কারো যদি রাত তিনটায় জরুরী প্রয়োজনে সাহায্যের প্রয়োজন হয় তখন যে বন্ধুটিকে সে সবচেয়ে আগে সবচেয়ে নির্দ্বিধায় স্মরন করবে, সেই হলো এই থ্রী এম ফ্রেন্ড।
আমার বন্ধু মহলে প্রায় সকল ধর্মের সমাবেশ, তারপরও যদি থ্রি এম ফ্রেন্ড এর কথা বলতে হয় তাহলে তেমন যে ফ্রেন্ডকে সবচেয়ে আগে মনে পড়বে সে হিন্দু। আমি রক্ষনশীল মুসলিম।
আমার সেই বন্ধু শুধু হিন্দু নয়, কোন কোন সময় সে তা প্রায় এমন গোড়ামীর পর্যায়ে নিয়ে যায় যে তার পরিবারের সদস্যরাই বিরক্ত হয়ে আমাকে প্রায়ই পরামর্শ দেয় আমি যেনো খাবারে মধ্যে গরু মিশিয়ে ওকে খাইয়ে দেই। এ নিয়ে আমরা সবাই অনেক হাসাহাসি করি!
"ধান ভানতে শীবের গীত" টাইপ গল্প হয়ে যাচ্ছে! যে কারনে এই গল্পের অবতারনা তা হলো, আমরা এই গোড়া হিন্দু বন্ধু যখন থেকে গোড়ামী শুরু করলো তখন আমিষ ভোজন পুরোপুরি ত্যাগ করে। ধরে নেই বন্ধুর নাম রাহুল(ভারতীয়দের প্রিয় নাম)। রাহুলের মতো অসাধারন ভালো আর সহজ সরল একজন মানুষ সচরাচর চোখে পড়েনা। যে কারো বিপদে যেকোন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে আগে সে হাজির। ঝড় ঝন্ঝা এমনকি নিজের পেশা, কোন কিছুই তাকে এই বিপদের বন্ধু হওয়া থেকে বিরত রাখতে পারেনা।
আমার পারিবারিক যেকোন অনুষ্ঠানে যদি দুইশত আমিষপ্রেমী অতিথি আসে, তার মাঝেও শুধু রাহুলের জন্য যথেষ্ট নিরামিষের ব্যবস্থা রাখা হয়। আমাদের দেশি ঐতিহ্যে বেশ মশলাদার আমিষের প্রচলন আছে, আর আমিষের পাশা পাশি একধরনের ভারসাম্য রক্ষার্থেই হয়তো আমাদের নিরামিষ গুলো বেশ সাদামাটা। রাহুল আর দু একজন রক্ষনশীল হিন্দু বন্ধু বান্ধুবের কারনে আমাকে ভয়াবহ ধরনের মশলা সমৃদ্ধ ভারতীয় নিরামিষ রান্না শিখতে হয়েছে। তাদের নিখাদ নিঃস্বার্থ বন্ধুত্ব, এমন শিখতে বাধ্য করেছে।
নিরামিষভোজি বন্ধুদের জন্য রান্নার সময় তাদের চেয়েও বেশি সতর্কতা অবলম্বন করি। কোন চামচ, পাত্র কোন কিছুতে যেনো আমিষে ব্যবহৃত কোন কিছুর ছোঁয়া না লাগে! মহান আল্লাহ্'র প্রতি আমার দৃঢ় বিশ্বাস আর পারিবারিক শিক্ষা আমাকে অপরের ধর্মানুভূতিকে সন্মান করতে শিখিয়েছে।
আমি কখনও আশা করবোনা রাহুল আমার জন্য তার অনুষ্ঠানের আয়োজনে গরুর গোশতের ব্যবস্থা রাখবে। কারন আমি জানি তার ধর্ম বিশ্বাসের সাথে তা বিপরীত অবস্থানে। রাহুল এতোটাও গোড়া যে সে তার গাড়িতে কোন আমিষ বহনকে মহা পাতকের কাজ মনে করে।
প্রতিটি ঈদের জন্য রাহুলের অধীর আগ্রহে অপেক্ষা। ঈদের উপহারও কিনে রাখে আগে থেকেই; আমাদের সাথে এক হয়ে রাহুল আর তার পরিবার ঈদ উপভোগ করে প্রতি বছর। আমি কখনও পূজায় যাইনা, রাহুল কখনও আমাকে পুজার দাওয়াত ও দেয়না। কেনো?
কারন রাহুল একজন গোড়া হিন্দু হয়েও জানে মুসলিমদের ধর্ম বিশ্বাসের সাথে মূর্তি পূজার অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীতে। তাই এধরনের অবিবেচকের মতো কাজ সে কখনও করবেনা।
আমি আর আমার পরিবারের সাথে রাহুল আর তার পরিবারের বন্ধুত্ব নিখাদ আর নিঃস্বার্থ। আর তাই আমরা খুব সহজ ভাবে এক অপরকে বিরক্ত না করেই নিজ নিজ ধর্ম পালনে সমর্থ।
আমার সাথে বন্ধুত্ব গাঢ় করতে রাহুলদের মসজিদে দাঁড়িয়ে নামায পড়তে হয়না বা ঘরে গরুর ঝাল কারি রান্না করার প্রয়োজন পরে না। ঠিক তেমনি হিন্দুদের পুজা পার্বন এলে আমাকে সাজগোজ করে "ধর্ম যার যার, উৎসব সকলের" টাইপ ভন্ডামীর প্রয়োজন পড়েনা। কারন আমাদের একে অপরের কাছে প্রমানের কিছু নেই। দুটো সম্পূর্ণ বিপরীত মূখী ধর্মের অনুসারীদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধই যথেষ্ট কমিউনাল হারমোনি বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজিয়ে রাখার জন্য।
অত্যন্ত রক্ষনশীল মুসলিম পরিবারে জন্ম আমার, শৈশব থেকে দেখেছি মা বাবা কখনও হিন্দু, মুসলিম, খ্রীস্টান, বৌদ্ধ ভেদাভেদ করেননি। আমাদের বাসায় সকলের সমান অগ্রাধিকার আর সন্মান ছিলো। হিন্দুদের পুজো দেখেছি কৌতুহলি হয়ে, শুধু মাত্র একজন সাধারন দর্শক হিসেবে সেই শৈশবেই। মা বাবা কোন আপত্তি করেননি শুধু নয়, আমাদের খ্রিস্টান প্রতিবেশি যখন ক্রিসমাসের রাতে আমাদের নিয়ে চার্চে যেতে চাইলেন, সেখানেও মা বাবা কোন আপত্তি না করে আংকেল আন্টির সাথে আমাদের যেতে দিলেন। এখনও মনে আছে মধ্যরাতে ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। সেই সাদা চার্চটার ভিতর সেকি উৎসব উৎসব ভাব! আংকেল আন্টি আমাদের পাখির ডানা দিয়ে আগলে রাখার মতো করে বসেছেন, শুধু কমিউনিয়ন আনতে যাবার সময় কি সুন্দর করে বুঝিয়ে আমাদের বসিয়ে রেখে গেলেন। তারপর তাঁদের সাথে আমরা বড়দিন বেড়ানো হিসেবে আন্টির বাবার বাড়ি গিয়েছি অল্প সময়ের জন্য।
এতোগুলো বছর বাংলাদেশেও ঠিক এমনি ভাবেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রিতী বজায় ছিলো। নিতান্ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রনোদিত নাহলে তেমন কোন বিদ্বেষ চোখে পড়েনি। হঠাৎ "ধর্ম যার যার, উৎসব সকলের" টাইপ ফাজলামি করা এক শ্লোগান নিয়ে মাঠে নামার কি প্রয়োজন সেটা প্রথমে বোধগম্য হয়নি। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হলো এধরনের তামাশা করার কারন।
প্রথমত ক্ষমতার মসনদে অধিষ্ঠিত দেশপ্রেম বর্জিত নির্লজ্জ পদলেহীদের লালনকারীর বর্তমান প্রধান অত্যন্ত সাম্প্রদায়িক ও উগ্রপন্থী কট্টর মনোভাবাপন্ন। চাটার দল(জাতির জনক দেশ ও জাতির জন্য নিজের দলের লোকদের এক অসাধরন নাম পরিচয় জানিয়ে গেছেন) সেখানে নিজের আনুগত্য প্রমানে এমনিভাবে লেজ নাড়ায়, এতে দুরকম লাভ।
এক দাদাবাবুর সন্তোষ্টি আরেকটি হলো বাণিজ্যিক - উৎসব যেহেতু সবার, তাহলে শুধু নিজ নিজ ধর্ম উৎসব কেনো, সবার উৎসব পালনে আমি মেতে উঠবো। তাহলে এখন থেকে শুধু পুজা, বা শুধু ঈদ নয় সব উৎসবের "বিশেষ মূল্যহ্রাসের" আমিও একজন ভোক্তা হয়ে উঠতেই পারি। অধিক বাণিজ্যের সম্ভাবনা মানে ততোধিক বিজ্ঞাপণ, আর অধিক বিজ্ঞাপণ মানেই মিডিয়ার আয় রোজগারের মহা সম্ভাবনা।
ভন্ড আর নকল সব সময় বিপদজনক। যারা মন থেকে সেকুলার নয়, তারা যখন শুধু বিশেষ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সেকুলার হয়ে উঠার চেষ্টায় মেতে উঠে বা অপরকে বাধ্য করে, তা দেশ ও জাতির বিপদ টেনে আনতে বাধ্য।
ইদানীং পূজার সময় ঘনিয়ে এলে বিভিন্ন স্থানে প্রতীমা ভাঙ্গার খবর কানে আসছে এতো বছর যা শোনা যায়নি। ইচ্ছাকৃত ভাবেই কেউ আমাদের এক ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। হোক তা দেশের মানুষের শান্তি সম্প্রতি ভঙ্গ করে, ক্ষমতার দুর্গন্ধযুক্ত মসনদে টিকে থাকতে প্রভুর সন্তোষ্টীটাই আসল।।।
পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ একটি স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতি যা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে যথেষ্ট। যখন এই শ্রদ্ধাবোধ জোড়পূর্বক চাপিয়ে দেয়া হয়, তখন দেখা দেয় সংঘাত আর বিদ্বেষ।
*দেশের মানুষের ধর্মানুভূতি নিয়ে এধরনের প্রহসনের নজির বিশ্বের আর কোন রাষ্ট্রে আছে বলে জানা নেই।
* এধরনের চাপিয়ে দেয়া "উৎসব সবার" নামক তামাশা শুধু হিন্দু মুসলিমের মাঝে অসন্তোষ নয়, মুসলিমদের নিজের মাঝে অসন্তোষ, হিন্দুদের নিজের মাঝে অসন্তোষ সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ট।
* সাধরন সচেতন জনতা যাঁরা রাজনীতির এই পুঁতিদুর্গন্ধময় চালটি বুঝতে পারছেন, আশা করি তাঁরা এই যড়যন্ত্র ব্যর্থ করার লক্ষ্যে সকল প্রকার সহিংসতা ও নাশকতা মূলক কাজ থেকে বিরত থাকবেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ১০:৫১