মা ও শিশুর যত্ন ভবিষ্যতে শুধু শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষা নয় এমনকি প্রচুর সাশ্রয়েও সাহায্য করতে পারে। ধাত্রীবিদ্যা বা অবস্টেট্রিকস এ প্রতিনিয়ত পরিবর্তন আসছে এধরনের প্রিন্যাটাল আর পোস্টন্যাটাল কেয়ার সম্পর্কিত।
এর মাঝে জরুরী কিছু বিষয় আছে যা সদ্যজাত শিশু ও মায়ের স্বার্থে প্রতিটি মা,বাবা ও পরিবারের জানা জরুরী অথচ আমাদের দেশে সেভাবে এর চর্চার প্রচলন হয়নি।
গর্ভবতী মায়েদের যত্ন সম্পর্কে সরকারী পর্যায়ে প্রচুর প্রচার দীর্ঘদিন থেকে চলে আসলেও তা আজও পুরোপুরি সফল হয়নি। গর্ভবতী মায়েদের শুধু সুষম পুষ্টিকর খাবার আর ভারী কাজ থেকে বিরত রাখা নয়, সেই সাথে তাঁদের মানসিক ভাবে উৎফুল্ল রাখাটা অত্যন্ত জরুরী। এ বিষয়ে যিনি সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারেন, তিনি হলেন তাঁর স্বামী।
*উদ্বেগহীন বা চিন্তামুক্ত- আমেরিকার বেশ কিছু হাসপাতালে উইমেন সেন্টার খোলা হয়েছে, যা শুধুমাত্র ধাত্রী বিদ্যা ও গাইনোকোলজির রুগীদের সেবা দিয়ে থাকে। এসব সেন্টার পরিচালিত হয় নারী চিকিৎসক দ্বারা এবং সকল স্টাফ নারী। এমন অনেক সেন্টারে গর্ভবতী মায়েদের রাজকন্যার সাথে তুলনা করে তাঁদের মানসিক ভাবে সব সময় রিল্যাক্সড রাখার চেষ্টা করতেও দেখেছি। রাজকন্যা বলার কারন এই, "তুমি শুধু নিশ্চিন্ত হয়ে আরাম করো, যা কিছু সমস্যা আমরা দেখছি"।
*ইমোশনাল ক্রাইসিস- গর্ভবতী নারীর শরীরে তিল তিল করে একটি মানুষের সৃষ্টি হয়, মায়ের শরীরের নির্যাস শুষে একটি প্রাণ বেড়ে উঠে...... এই প্রক্রিয়া খুব সহজ নয়। এই প্রক্রিয়ার প্রধান ভূমিকা পালন করে "হরমোন"। একজন গর্ভবতী নারী ও সদ্য প্রসুতি নারীর শরীরে হরমোনের সুনামী চলে বললেও ভুল হবেনা। এই হরমোনাল রাশের কারনে তাঁদের শারীরিক পরিবর্তন সকলের দৃষ্টি গোচর হলেও যা আড়ালে থেকে যায় তা হলো মায়েদের মানসিক পরিবর্তন। প্রচন্ড ইমোশনাল হয়ে পাড়েন তাঁরা এসময়-
একারনে অনেকের মাঝে কোন কারন ছাড়া কান্নাকাটি করার সাথে সাথে মাঝে মাঝে হতাশা বা ডিপ্রেশন, খিটখিটে স্বভাব সহ প্রচন্ড মেজাজ দেখা যায়। এমন সময় বাবাদের মনে রাখা জরুরী তাঁর সন্তানকে এই পৃথিবীতে নিয়ে আসতেই স্ত্রীর এমন মেজাজ ও অস্থিরতা, আর তাই এসময় স্ত্রীর সাথে ভালো ব্যবহার, তাঁকে বুঝতে চেষ্টা করা ভীষণ ভীষণ জরুরী। এমনকি পরিবারের অন্য সদস্যরা যেন তাঁর স্ত্রীকে ভুল না বুঝে এবং তাঁর সাথে নম্র ও সহানুভূতিশীল আচরন করে তা তাঁকেই দেখতে হবে।
* খাদ্যাভ্যাস- সন্তান প্রসবের সময় যতো ঘনিয়ে আসে প্রসুতি মায়ের প্রতি আরো অধিক মনযোগী হওয়া প্রয়োজন। তাঁর খাদ্যাভ্যাসের মাঝে দুধ অত্যন্ত জরুরী একটি উপাদান। গর্ভকালীন পুরো সময়েই শিশুর শরীরের যথার্থ বেড়ে উঠার জন্য দুধপান জরুরী। আর শেষের দিকে এর প্রয়োজন আরো বেশি সন্তানের জন্মের পরবর্তী সময় ব্রেস্ট ফিডিং এর জন্য। লাল শাক, পালং শাক, গাজর, লাউ জাতীয় সব্জি এসময় বেশ উপকার করে থাকে।
*প্রসুতি কক্ষে উপস্থিতি- সন্তান জন্মের সময় চিকিৎসকের অনুমতি নিয়ে বাবাদের সেসময় প্রসুতি কক্ষে, সিজারিয়ান হলে অপারেশন থিয়েটারে উপস্থিত থেকে প্রসুতিকে মানসিকভাবে সাপোর্ট করা অত্যন্ত জরুরী।
প্রয়োজনে তাঁর হাত ধরে, তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে তাঁকে আস্বস্ত করলে তা মায়েদের মানসিক স্বাস্থের জন্য ইতিবাচক ফল নিয়ে আসে।
*প্রথম দেখা- সন্তান জন্মের পর পরই মায়ের কাছে শিশুকে নিয়ে আসা জরুরী। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে সদ্যজাত শিশুর শরীরটা মুছে একটু পরিস্কার করে তাকে মায়ের কাছে নিয়ে আসা হয়। সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে জন্ম শিশুদের ওটিতে মাকে দেখিয়ে ঘরে নিয়ে এসেই মায়ের কোলে দেয়া হয় ব্রেস্ট ফিডিং এর জন্য।
*কোলস্ট্রাম - মাতৃদুগ্ধের প্রথম অংশ বা কোলস্ট্রাম যেকোন শিশুর জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান ও জরুরী খাদ্য। প্রচুর প্রচুর এন্টিবডি সমৃদ্ধ এই ঘন হলুদ তরল শিশুর শরীরে যেকোন টিকার চেয়ে অধিক রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি করে ও শিশুর ব্রেইন ও শারীরিক ডেভেলপমেন্টে সাহায্য করে। বাংলাদেশে "শাল দুধ" নামে পরিচিত কোলস্ট্রামের গুরুত্ব এতোটাই যে একে "লিকুইড গোল্ড" নামেও ডাকা হয়।
*স্কিন টু শ্কিন কন্টাক্ট- মায়ের গর্ভের এক নিরাপদ আরামদায়ক বদ্ধ থলে থেকে শিশুটি সম্পূর্ণ অ্রপরিচিত এক পৃথিবীতে এসে পৌঁছে। এই পৃথিবীতে তার একমাত্র এবং সবচেয়ে চেনা, সবচেয়ে পরিচিত অনুভূতি হলো মায়ের ঘ্রান আর কন্ঠস্বর। যথাশীঘ্র শিশুর সকল পোশাক বা কাঁথা খুলে মায়ের চামড়ার সংস্পর্শে আনার লক্ষ্যে মায়ের জামার ভিতর ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এই স্কিন টু স্কিন কন্টাক্ট মা ও শিশুর বন্ধনের সাথে সাথে শিশুকে আস্বস্ত করে আর মায়েদের পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন কমাতে কিছুটা সাহায্য করে। এসময় লক্ষ্য রাখা উচিৎ ঘরের তাপমাত্রা যেনো আরাম দায়ক থাকে। খুব ঠান্ডা হলে মা্য়ের শরীরের ছুঁইয়ে শিশুকে দিয়ে তাদের দুজনকে ভালোভাবে একটি কাঁথা বা কম্বল দিয়ে ঢেকে দেয়া প্রয়োজন।
*ব্রেস্টফিডিং- একজন সন্তানকে মায়ের দেয়া শ্রেষ্ঠ উপহার মাতৃদুগ্ধ। যদিও বিষয়টি অনেকটা গ্রান্টেড ধরে নেয়া হয় তবে বাস্তবতা হলো ব্যাপারটি খুব সহজ নয়। অনেক শিশু ল্যাচিং বা মাতৃদুগ্ধ গ্রহনেরর প্রক্রিয়া সহযে আয়ত্বে আনতে পারেনা। এক্ষেত্রে অত্যন্ত অধ্যাবসায় ও ধৈর্যের প্রয়োজন হয়। এসময় মাকে ব্যার্থ না বলে বা দোষারোপ না করে তাঁকে উৎসাহিত করে যাওয়া উচিৎ। পশ্চিমা দেশগুলোর প্রায় প্রতিটি হাসপাতালে "ব্রেস্ট ফিডিং সেন্টার" আছে যা মায়েদের এবিষয়ে সর্বাত্বক সহায়তা করে থাকে।
অনেক বছর আগে ব্রেস্টফিডিং এর উপর বিস্তারিত লিখেছিলাম। কারো উপকারে এলে লেখাটি স্বার্থক হবে।
মা ও শিশুর স্কিন টু স্কিন কন্ট্যাক্ট
*পোস্টপার্টাম সাইকোসিস- সাইলেন্ট অথচ অত্যন্ত ভয়াবহ একটি ব্যাপার! অনেকেই মনে করেন আমাদের দেশে এর তেমন প্রাদুর্ভাব নেই আবার অনেকে মনে করেন যৌথ পরিবারে এমন হবার সম্ভাবনা নেই-- খুব ভুল ধারনা। আমাদের দেশেও আছে, তবে আমাদের দেশে মায়ের শারিরিক সমস্যার দিকেই মন দেবার সময় খুব বেশিজনের নেই সেখানে তাঁর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবনা প্রায় শুন্য!
মা সন্তানকে হত্যা করছেনা মানে পোস্টপার্টাম সাইকোসিস নেই এমন মনে করার কোন কারন নেই। এই সাইকোসিস যেকোন দেশে বা যেকোন পরিবারে হতেই পারে। এক্ষেত্রে পেরিন্যাটাল(গর্ভবতী সময় ও প্রসুতির পরবর্তী সময়) কেয়ার অত্যন্ত জরুরী! শিশুর জন্মের আগে ও পরে মায়েদের সাথে ইতিবাচক ব্যবহার সেই সাথে মা ও শিশু সম্পর্কে কোন ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য না করা উচিৎ। সন্তান জন্ম ও তার পরিচর্যায় স্ত্রীকে সাহায্যের পাশাপাশি স্বামীদের তাঁর প্রতি থ্যাংকফুল এ্যাটিচুডও জরুরী।
খুব বেশি কিছু নয়। সন্তান জন্মের পর কিছু দিন, কাজ থেকে ছুটি নিয়ে(এ্যাফোর্ড করতে পারলে) স্ত্রীকে বিশ্রামের সময় করে দেয়া, কাজ শেষে ঘরে ফিরে সন্তানের দিকে লক্ষ্য রাখার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিয়ে স্ত্রীকে বিশ্রাম করতে বলা.. এসব ছোট খাটো ব্যাপারগুলো মায়েদের মনে অনেক বড় ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা পবর্তীতে সন্তানের শারিরিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্যে সহায়তা করে।
পোস্টপার্টাম সাইকোসিসের একটি ভয়াবহ দিক প্যারানয়া বা সন্দেহপ্রবণতা। আমরা যেসব সন্তান হত্যার ভয়াবহ পরিনতির কথা শুনি তা এই প্যারানয়া থেকেই ঘটে থাকে। সকল ক্ষেত্রে সন্তানকে শত্রু না ভেবে অনেকে আশেপাশের পরিজনদেরও শত্রু মনে করে।
আমেরিকার এক ভারতীয় মায়ের কথা জানি- তাঁর শাশুড়ি সাহায্য করার উদ্দেশ্যে বৌকে বিশ্রাম করা সুযোগ করে দিতে শিশুটিকে কোলে নিয়ে পাশের ঘরে যাবার সাথে সাথে ভদ্রমহিলা ছুটে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। রাস্তায় ছুটে চলা গাড়ির সামনে আত্মহত্যা করতে গেছেন সদ্যজাত শিশুর মা কারন তাঁর ধারনা শাশুড়ি তার কাছ থেকে সন্তানকে নিয়ে দূরে চলে যাচ্ছে। স্বামী সময়মতো ছুটে যাওয়ায় স্ত্রীকে বুঝিয়ে আনতে সক্ষম হয়।
এক্ষেত্রে শাশুড়ি বা স্বামী স্ত্রীর প্রতি বিরক্ত হলে বা দোষারোপ করলে তা নিতান্তই অন্যায় ও অমানবিক। প্রথমে তার কথা মেনে যাকে সন্দেহ করছে তাকে দূরে রেখে ধীরে ধীরে বুঝিয়ে তাঁকে সন্দেহ মুক্ত করাটা বুদ্ধিমানের কাজ।
*সামাজিক দায়িত্ব- আমরা যারা নিজেদের শিক্ষিত ও আধুনিক মনে করি একজন গর্ভবতী মায়ের প্রতি আমাদের সকলের দায়িত্ব আছে। কোথাও তাঁকে ভারী কিছু বইতে দেখলে সাহায্য নিতে চাইলে সাহায্য করা জরুরী। প্রচন্ড ভীড়ের বাসে কোন গর্ভবতী মাকে দেখলে প্রয়োজনে আসন ছেড়ে তাঁকে রিল্যাক্সড হতে সাহায্য করা উচিৎ। একজন গর্ভবতী নারীর সাথে সব সময় ভদ্র নম্র ব্যবহার করা জরুরী।
বাংলাদেশের গণশৌচাগার বা পাবলিক টয়লেটের অধিকাংশে নারী পুরুষের আলাদা ব্যবস্থা নেই, সেক্ষেত্রে অপেক্ষার দীর্ঘ লাইনে কোন গর্ভবতী নারীকে দেখে তাঁকে আগে যাবার সুযোগ করে দেয়াটাও অত্যন্ত মানবিক ও ভদ্রচিত কাজ।
দুঃখজনক ভাবে উন্নত দেশের মতো আমাদের দেশের হাসপাতালে গর্ভবতী নারীদের সাথে সুন্দর কোমল ব্যবহারের প্রচলন নেই(বরং অণেক্ষেত্রে দুর্ব্যবহার করা হয়) তবে আমরা নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে পারিবারিক ও সামাজিক ভাবে তাঁদের কিছুটা স্বস্তি ও সুস্থতায় সাহায্য করতে পারি।
এই তথ্যগুলো নিজ পরিবার পরিজন সহ আত্মীয় বন্ধুবান্ধব সকলের কাছে পৌঁছে দিলে অনেক মাও শিশু উপকৃত হবেন।
গ্রামের মায়েদের এসবের প্রয়োজন নেই এমন মনে করা ভুল, তাঁদের প্রয়োজনটা আরো অনেক অনেক বেশী।
***প্রত্যেক পাঠকের কাছে অনুরোধ মা ও শিশু কল্যাণে আপনার পরিবার সহ বন্ধবান্ধবদের তথ্যগুলো জানিয়ে দিন।***
ছবি সুত্র: ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা অক্টোবর, ২০১৫ ভোর ৫:৪৬