পৃথিবীতে সম্ভব সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়- মাতৃগর্ভ। এরচেয়ে নিরাপদ, জীবাণুমুক্ত ও আরামদায়ক স্থান সম্ভব নয়। সেখান থেকে একজন নতজাতক যখন ধুলোবালি মাখা জীবাণু সংকুল পৃথিবীতে আসে, তার নাজুক শরীর ও দুর্বল রোগপ্রতিরোধক ক্ষমতার কারনে জীবন হয় ঝুঁকিপূর্ণ! এই পরিবেশে একটি নিরাপত্তাবেষ্টনীর মতো তাকে সকল প্রতিকূলতা থেকে রক্ষা করে মমতাময়ী মায়ের কোল ও শিশুর রোগপ্রতিরোধক ক্ষমতার অসাধারণ গুনাবলী সমৃদ্ধ মাতৃদুগ্ধ!
আমাদের দেশে এই ব্যাপারটি অত্যন্ত অবহেলিত- কারণ ধরেই নেয়া হয় যিনি জন্ম দিলেন তিনি তো স্তন্যদান করবেনই, এটা তাঁর একার দায়িত্ব এবং অবধারিত ব্যাপার। বিষয়টি এতো সহজ নয়, আর সে কারনেই দেখা যায় শেষ পর্যন্ত অনেক সদ্য প্রসূতীর সন্তান মার্তৃদুগ্ধ থেকে বন্চিত হচ্ছে!! মাতৃদুগ্ধ বন্চিত শিশুরা বিভিন্ন রোগে সহজে আক্রান্ত হয় এবং কখনও অকালে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে।
ইউনিসেফের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিশ্বের সকল নবজাত শিশু ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধু মাত্র মায়ের দুধ পান করলে প্রতিবছর প্রায় ১৫লক্ষ শিশুর মৃত্যুরোধ হয়তো সম্ভব হতো।
মাতৃদুগ্ধের উপকারিতা সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই!! মায়ের দুধ শিশুর জন্য শুধুমাত্র শ্রেষ্ঠতম পুষ্টিকর ও সঠিক খাদ্য নয় বরং তা যে কোন রোগপ্রতিরোধক টিকার চেয়ে অধিক শক্তিশালী ও কার্যকর। ডায়রিয়া, ইনফ্লুয়েন্জ্ঞা, অটাইটিস মিডিয়া, হারপিস ইনফেকশন, শ্বাসতন্ত্রের ইনফেকশন, নেক্রোটাইজিং এন্টারোপ্যাথি ইত্যাদি রোগের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়া ছাড়াও কৃত্রিম ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে।
ফর্মূলা বা কৃত্রিম শিশু খাদ্যে লালিত শিশুদের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি মার্তৃদুগ্ধে লালিত শিশুর চেয়ে অনেক অনেক বেশি। এসকল রোগ শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে ব্যহত করে এবং শিশু মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকগুন বৃদ্ধি করে।
মায়ের দুধ যে শুধু মাত্র শ্রেষ্ঠতম পুষ্টি ও রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা সম্পন্ন তাই নয় বরং তা শিশুর জীবন রক্ষার সাথে সাথে সাশ্রয়ীও- শিশুখাদ্য হিসেবে মাতৃদুগ্ধ পরিবারের খরচ ও সময় দুটোর সাশ্রয় করে থাকে।
বিশ্বের সকল নবজাতকের পুষ্টি, সুস্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিষ্চিত করতে WHO এবং UNICEF এর যৌথ প্রচেষ্টায় BFHI বা Baby Friendly Hospital Initiative এর উদ্যোগ গ্রহন করা হয়।
হাসপাতাল বা মাতৃসদনকে স্তন্যদানকারী মায়েদের জন্য একটি শক্তিশালী ও যথাযথ দৃষ্টান্ত এবং সাহায্যকারী অনুকুল স্থান হিসেবে উপস্থাপন করা এর মূল লক্ষ্য।
উন্নতবিশ্বের অধিকাংশ মাতৃসদন ও হাসপাতালে ল্যাকটেশন সেন্টার আছে। মায়েদের স্তন্যদানের সুবিধার্থে সেখানে মানসিক সহায়তা সহ স্তন্যাদানের যথাযথ পজিশন ও টাইমিং শিখানো হয়, এসব সেন্টারে স্তন্যদানে সহায়ক প্রয়োজনীয় সকল সামগ্রী পাওয়া যায়।
শিশুর জন্মের পর অধকিাংশ মা সন্তানকে স্তন্যদান শুরু করলেও অনেক ক্ষেত্রে তা ছয়মাস পর্যন্তও সম্ভব হয়না। এ নিয়ে আমাদের দেশে মায়েদের উদ্দেশ্যে কটাক্ষ করার লোকের অভাব না হলেও, এর প্রকৃত কারণ উদ্ধার ও তার সমাধানে এগিয়ে আসার উদ্যোগের অভাব পরিলক্ষিত হয়।
নবকজাত শিশু যেন প্রথম ছয় মাস শুধুমাত্র মায়ের দুধ এবং দুবছর বয়স পর্যন্ত অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি মায়ের দুধের পুষ্টিতে লালিত হতে পারে তা নিশ্চিত করতে মায়ের পাশাপাশি পরিবারের সকলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আর এই কাজটিকে সহজ ও বাস্তবায়িত করতে গুরত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করা অত্যন্ত জরুরী: -
*মায়ের যত্ন:
১. ব্রেস্টফিডিং বা স্তন্যদানে সবচেয়ে প্রথম এবং প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মায়ের সুস্বাস্থ্য(শারিরিক ও মানসিক দুটোই)। গর্ভবতী মায়ের দেহে বিভিন্ন হরমোনের আধিক্য দেখা যায়, বলা যায় গর্ভবতীর শরীরে চলে হরমোনের উৎসব। যার ফলে তিনি শারিরিক ও মানসিকভাবে ভীষণ প্রভাবিত হন।
শিশুর জন্মের পর এই প্রভাব কিছুটা কমে এলেও তিনি শারিরিক ভাবে দুর্বল এবং অনেক ক্ষেত্রে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকেন।
শিশুর লালন পালনে আর সব কিছুর মতো মাতৃদুগ্ধ দানে মায়ের পাশাপাশি পিতার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের সমাজ ব্যবস্থায় ব্যাপারটি অনেককে অবাক করলেও এটাই বাস্তবতা। শিশুকে স্তন্যদান করবেন মা আর সেই মায়ের যত্ন, তাঁর পুষ্টি, বিশ্রাম নিশ্চিত করবেন পিতা।
২.এসময় মায়ের যথাযথ খাদ্যগ্রহন ও পুষ্টি জরুরী। মায়ের পুষ্টিহীনতা মতৃদুগ্ধ উৎপাদনে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। এসময় সাধ্য অনুযায়ী দুধ, ডিম, সব্জিসহ পুষ্টিকর খাবার গ্রহন করা জরুরী।
৩. স্তন্যাদানকারী মায়েদের হাইড্রেশন বা পর্যাপ্ত পানি পান অত্যন্ত জরুরী।
৪.মানসিক এবং শারীরিক সুস্থতার লক্ষ্যে পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং ঘুম(প্রতিদিন নুন্যতম ৮ ঘন্টা) জরুরী।
*বিশেষ খাবার:
বিভিন্ন দেশের নিজ নিজ বিশ্বাস ও ঐতিহ্যনুসারে এসময় শিশুখাদ্যের পরিমান বৃদ্ধির লক্ষ্যে মায়েদের ভিন্ন ভিন্ন ফল, সব্জি, ভেষজ ও খাদ্য গ্রহনে উৎসাহিত করে।
এর মাঝে উল্লেখযোগ্য:
১.দুধ
২.কালোজিরা
৩.লাউ
৪.সাগুদানার পায়েস
৫.পেঁপে
৬.মেথী-আমাদের দেশে কালোজিরার মতো জাপান এবং বর্তমানে আমেরকিায়ও মেথী গ্রহনে উৎসাহিত করা হয়। ল্যাক্টেশন সেন্টারে ক্যাপসুলাকারে মেথী, মেথীর চা বিপুল পরিমানে বিক্রী হয়ে থাকে।
*পজিশন:
স্তন্যদানের যথাযথ পজিশনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন-
১. ক্র্যডেল:- সাধারন কোলে নেবার ভঙ্গীতে যে প্রচলিত পজিশনে স্তন্যদান করা হয়, তা সব চেয়ে জনপ্রিয় ও কার্যকর।
২.বল হোল্ডিং:- সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেবার পর প্রচলিত পদ্ধতি বা ক্র্যাডেল পজিশনে স্তন্যদান অনেক ক্ষেত্রে মায়ের জন্য কষ্টকর, মাঝে মাঝে প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠে। এক্ষেত্রে “বল হোল্ডিং” অত্যন্ত কার্যকর।
একটি বলকে পাশে একহাতে ধরার মতো করে শিশুকে স্তন্যদান করায় মায়ের তলপেট বা সিজিরয়িান সেকশনের ক্ষতস্থানে শিশুর ভার পড়েনা, ফল স্তন্যদান মা ও শিশু উভয়ের জন্য সহজ হয়।
৩.ক্রস ক্র্যাডেল:- প্রিম্যাচিউর শিশুর ক্ষেত্রে অধিক সহায়ক।
৪.লাইং বা শায়িত:- মায়েদের জন্য কিছুটা রিল্যাক্সিং হলেও শিশুর জন্য অনেক ক্ষেত্রেই বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।
*কর্মজীবি মায়েদের জন্য:
আন্তরিক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষে কাজে ফেরার পর অনেক মায়ের সন্তানকে কৃত্রিম খাবার বা বেবিফুড, গরুর দুধ বা পাউডার দুধের আশ্রয় নিতে হয়, যা মোটেও কাম্য নয়। এ সমস্যা সমাধানে কর্মজীবি মায়েদের জন্য প্রায় বন্ধু সম একটি যন্ত্র “ব্রেস্ট পাম্প"”। কাজের সময় শিশুকে স্তন্য দান সম্ভব না হলে তাঁরা এই পাম্পের সাহায্যে মতৃদুগ্ধ সংগ্রহ করে তা যথাযথ উপায়ে সংরক্ষণ করতে পারেন। যা তাঁদের অনুপস্থিতিতে পরিবারের অন্য কেউ বোতলের মাধ্যমে শিশুকে খাওয়াতে পারেন। ফলে মায়ের অনুপস্থিতিতেও শিশুটি মাতৃদুগ্ধের উপকারিতা থেকে বন্চিত হয়না।
নতুন মায়েদের ক্ষেত্রে স্তন্যদানের শুরুতেও ব্রেস্টপাম্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ব্রেস্ট পাম্প বিভিন্ন দামের আছে তবে ইলেক্ট্রিক পাম্প সবচেয়ে কার্যকর ও কিছুটা ব্যয়বহুল। ল্যাক্টেশন সেন্টার থেকে এই পাম্প ভাড়া করা যায়।
*পোশাক:
স্তন্যদানের উপযোগী আরামদায়ক ও স্বস্তিকর পোশাক মায়েদের জন্য জরুরী। এবিষয়েও ল্যাক্টেশন সেন্টার সহায়তা করে থাকে।
*প্রস্তুতি:
একজন পুরুষের কাছে স্তন্যদান যতোখানি অপরিচিত ব্যাপার, প্রথমবার সন্তানলাভ করা মায়ের কাছেও অনেকটা তেমনি।
তই, গর্ভবতী অবস্থা থেকে এব্যাপারে মানসিক প্রস্তুতি জরুরী। পরিবারের মুরুব্বী এবং স্বামী উৎসাহ দান করে এই প্রস্তুতিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে পারেন।
*আধুনিকতা ও স্তন্যদান:
সময়ের সাথে সাথে মানুষ যতো আধুনিক ও শিক্ষিত হচ্ছে উন্নত বিশ্বের মায়েরা ফিরে যাচ্ছেন ব্রেস্ট ফিডিং বা স্তন্যদানে। শিক্ষা, মাতৃদুগ্ধের উপকারিতা এবং শিশুর জন্য এর গুরুত্ব অনুধাবন তাঁদের এবিষয়ে উৎসাহিত করছে। হাজারও ব্যস্ততার মাঝে শিশু সন্তানকে মাতদুগ্ধের আশির্বাদ থেকে বন্চিত করছেননা।
স্তন্যদানে অন্যতম সুন্দর ও গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, মা ও শিশুর মানসিক নৈকট্য বা বন্ধন দৃঢ় করায় এর কোন বিকল্প নেই।
মা এইচ আইভি ইনফেকশন বা এইডস আক্রান্ত না হলে আর যেকোন অবস্থায় শিশুকে স্তন্যদানে কোন বাঁধা নেই।
সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে নারী পুরুষ নির্বিশেষে আমরা সকলেই আমাদের পরিবার ও পরিচিতজনদের শিশুদের মাতৃদুগ্ধের আশির্বাদপুষ্ট হতে সহায়তা করতে পারি।
জন্মের পর থেকে ছয়মাস বয়স পর্যন্ত মার্তদুগ্ধ হোক শিশুর একমাত্র খাদ্য।।
বিশ্বের প্রতিটি শিশু বেড়ে উঠুক মাতৃদুগ্ধের আশির্বাদ ও নিরাপদ ছায়াতলে।
*ব্রেস্টফিডিং এর সিম্বল “গোল্ডেন বো” “সোনালী বো” যা শুধু মাত্র একটি চিহ্ন নয় বরং গুরত্ব ও কার্যকারিতার অর্থ বহন করে। “গোল্ডেন বো”র চমকপ্রদ ব্যাখ্যা।।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০১০ সকাল ১১:৫৯