অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন সহ জীবনযাত্রা উন্নয়নের বিষয়ে ভারী ভারী সব বই আছে, বাংলাদেশে শতশত পন্ডিত বিজ্ঞজন তা পড়াচ্ছেন, হাজার হাজার ছাত্র ছাত্র্রী প্রতিদিন সেসব বই পড়ছেন, বড় বড় ডিগ্রী অর্জন করছেন! আমাদের নেতা নেত্রীরা হাজার রকম মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনে জয়ী হয়ে পরবর্তীতে নিজেদের ইতিমধ্যে গুছানো আখের জনগনের রক্ত শুষে আরো বেশি গুছাতে ব্যস্ত! মানবাধিকার অর্জনের লক্ষ্যে আমরা প্রায় প্রতি মাসে বিভিন্ন দিবস উদযাপন করছি, বড় বড় সেমিনার সিম্পোজিয়াম ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ বক্তৃতায় সমৃদ্ধ হচ্ছে, মিছিল মিটিং বর্ণাঢ্য র্যালী আর সমাবেশের আড়ম্বরের কমতি নেই এসব দিবস উদযাপনে...
যাঁদের জন্য এতো সব আয়োজন, যাঁদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এতো আড়ম্বর, দিবস শেষে হিসেবের খাতা খুলে দেখা যায়- সব কিছুই আগের মতো, কোন পরবির্তন নেই তাঁদের দুর্ভাগ্যের! বিন্দুমাত্র উন্নতি হয়নি দূরাবস্থার, নুন্যতম প্রশমন হয়নি তাঁদের দুর্ভোগের!!!!
এটাই বাস্তবতা...!!!
আর এই কঠিন বাস্তবতার শিকার একজন জয়নাল.....
সুজলা সুফলা গ্রামের সংসার সর্বশান্ত হয় একমাত্র কিশোরী কন্যাকে পাত্রস্থ করতে যেয়ে.. অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে যেটুকুও অবশিষ্ট ছিলো তাও কেড়ে নেয় সর্বগ্রাসী নদীর ভাঙ্গন। সর্বস্ব হারিয়ে কপর্দকশূণ্য জয়নাল ভাগ্যের অন্বেষনে গ্রাম ছেড়ে পাড়ি জমায় শহরে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে রিকশা টেনে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ আসে, সংসারে দুমুঠো অন্নের ব্যবস্থা হয়। নির্মম বাস্তবতা জয়নালদের দু'বেলা দু'মুঠো ভাতের (!)বিলাসিতা বেশিদিন সইতে পারেনা, রিকশার সাথে সিএনজির সংঘর্ষের ছোট দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয় জয়নাল! পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি অক্ষম হয়ে পড়ায় শুধু দুমুঠো ভাত বন্ধ নয়, মাথার উপরের ছাদ সরে যায় জয়নাল পরিবারের.. খোলা আকাশের নীচে পথের ধারে ফুটপাথ হয়ে উঠে তাঁদের ঠিকানা... জীবন বাঁচাতে বাড়াতে হয় ভিক্ষার হাত!!!
জয়নালদের মতো জীবন যুদ্ধে পরাজিত সৈনিকদের বিপদ শুধু এক দুদিক থেকে আসেনা... তাই সদ্যজাত সন্তান সহ জয়নালের কিশোরী কন্যা আইরিনকে ত্যাগ করে তার অপদার্থ কুলাঙ্গার স্বামী। হতভাগ্য কিশোরী আইরিন অসহায় সন্তান সহ আশ্রয় নেয় ভিখেরী বাবা মা'র রাজপথের ভাসমান সংসারে!!
অবুঝ শিশু হৃদয়, যার থাকার কথা ছিলো দুধ ভাতে, বাবা মা'র মমতায় বড় হবার কথা... আজ অসহায়, আশ্রয়হীন- খোলা আকাশ ছাদ হয়ে তাকে আগলে রাখে। ভীষণ অসুস্থ নানা পাশে শুয়ে চটে জড়ানো ছোট্ট শরীরে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দেয়... নিঃস্ব, অসুস্থ অক্ষম জয়নাল আর কিইবা করতে পারে এই দেবশিশুর জন্য! ছোট্ট দুগ্ধপোষ্য শিশুকে বাঁচিয়ে রাখার কঠিন সংগ্রাম আইরিনের, আর সেই সাথে নিজেকে মানুষের মতো দেখতে কিছু জীবের কাছ থেকে বাঁচাবার, যারা রাতের আঁধারে হায়নার রূপধারন করে!!! ফুটপাথবাসী নারীদের জন্য এসব হায়নাদের কালোথাবা দিনের আলোয়ও কম লোভী নয়, এদের পাপাচার আর পাপদৃষ্টি নিয়ত বিব্রত, উত্তক্ত, অপমানিত করে গৃহহীন আইরিনদের....
জয়নালদের জীবন এমনই.. শুধু ক্ষুধা তৃষ্ণার জ্বালা আর বাসস্থানের অভাব নয়.. জয়নালদের কিশোরী কন্যারা নিজেদের রক্ষা করতে পারেনা হায়নাদের কালোথাবা থেকে, একসময় বাধ্য হয়ে বেছে নেয় অন্ধকার জীবন.. পথের পরে থাকা দেবশিশুটিকে বিকলাঙ্গ করে আরেকদল নরপশু বানিজ্য করে ভিক্ষাবৃত্তির, অথবা তাকে লালন করে একজন ভবিষ্যত সন্ত্রাসীর গড়ার লক্ষ্যে.. ধুঁকে ধুঁকে শেষ হয় এদের জীবন... এটাই বাস্তবতা।
অসহায় অক্ষম জয়নাল, আইরিনরা সাধ্যমতো জুঝে একসময় মেনে নেয় এই নির্মম পরিনতি, স্বীকরা করে নেয় এই তাঁদের নিয়তি..!
রূপকথায় জয়নালদের পরিনতি অন্যরকম...... রূপকথার রাজ্যে পথের ধারে চটে জড়ানো শিশুটি চোখে পড়ে ছোট্ট কোন পরীর, স্বর্গের দুয়ার থেকে ছোট ছোট মুঠো ভরে সেই অপ্সরী খাবার নিয়ে আসে জয়নাল পরিবারের জন্য, কখনও খাবার কখনও পথ্য..... ছোট্ট পরীর সাধ্যমতো চেষ্টা ছোট্ট হৃদয়কে ভালো রাখার..! খবর পৌঁছে যায় স্বর্গরাজ্যে, জয়নাল পরিবারের দূঃখ দুর্দশায় মর্মাহত স্বয়ং দেবদূত মর্ত্যে নেমে আসে রাজপথের পাশে তাদের ভাসমান সংসারে! চিকিৎসা হয় জয়নালের, ডাস্টবিনের ধারের দুর্গন্ধময় ফুটপাথের বিছানো চট ছেড়ে ছোট্ট দেবশিশু হৃদয়ের ভাগ্যে জুটে নরম সুন্দর বিছানা, বারবণিতার অবধারিত জীবনকে পাশ কাটিয়ে কিশোরী আইরিন খুঁজে পায় নিরাপদ আশ্রয়...তিনবেলা আহারের সংস্থান হয় জয়নাল পরিবারের, খুঁজে পায় নিজ ঘর! অচিরেই স্বাবলম্বী হবার স্বপ্নটি ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত হতে থাকে... অবসান ঘটে তাদের সকল কষ্টের! রূপকথায় রাজপথের ধারে দুর্গন্ধময় ডাস্টবিন থেকে জয়নালদের আশ্রয় মিলে স্বপ্নীল সুন্দর স্বচ্ছল সুখী জীবনে!
বাস্তবতাটা রূপকথার মতো নয়; আইরিন, হৃদয়, জয়নালদের বাস্তবতা বড় বেশী নির্মম!! এখানে জয়নালরা পরাজিত হয় বারবার...
তবে, এবার একটি অঘটন ঘটেছে...
এই জয়নাল পরিবারের জীবনে রূপকথার ঘটনাটি বাস্তবেই ঘটেছে!!!!!!!
এই ছোট্ট অপ্সরী, এই দেবদূত আমাদের সকলের পরিচিত.. আমাদের সকলের কাছের মানুষ!!
ছোট্ট অপ্সরীটি আর কেউ নন, তিনি আমাদের প্রিয় সহব্লগার সোহায়লা রিদওয়ান।
আর দেবদূতকে হয়তো অনেকেই চিনতে পেরেছেন.. কারন এই প্রথম নয়, অতীতে অনেকবার তিনি অসহায় দুঃস্থ মানুষের পাশে দেবদূত রূপে দেখা দিয়েছেন, ব্লগারদের সাহায্যের আবেদনে সাধ্যমতো সহায়তা নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন শ্রদ্ধেয় প্রিয় ব্লগার ফয়সল নোই।
বলা হয়, এক হাতে দান করলে অন্য হাতটি যেনো না জানে। তবু আমি এই দুই মহৎ মানুষের কথা প্রকাশ করছি, তুলে ধরছি জয়নাল পরিবারের জীবন কথা.... শুধু একথা মনে করিয়ে দিতে, মহান সৃষ্টি কর্তার কৃপায় আমাদের সীমিত সামর্থের ছোট ছোট প্রচেষ্টা দিয়ে আমরা একেক জন ইতিবাচক ভাবে পাল্টে দিতে পারি জয়নালদের জীবন! তাঁদের ভয়ংকর নির্মম বাস্তবতাকে রূপকথায় রূপান্তরিত করতে পারি যদি আমাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও স্বদিচ্ছা থাকে।
এই ছবিটি আমাদের অনেকের প্রাণ কাঁদিয়েছে... বাস্তবে প্রতিদিন এমন ছবি আমাদের চোখে পড়ে। “আমি আর কিইবা করতে পারি! হায় নির্মম বাস্তবতা!!” এমন ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমরা তাঁদের পাশ কাটিয়ে যাই নিজেদের অক্ষমতা স্বীকার করে, অথচ একটু উদ্যোগী হলেই জানতে পারবো নিজেকে যতোখানি অসহায় অক্ষম ভেবেছিলাম হয়তো ততোখানি নই, হয়তো কিছু করা সম্ভব তাঁদের জন্য!!!!
হয়তো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব জয়নালদের জীবনে, জয়নাল কন্যার জীবনে, ছোট্ট হৃদয়ের জীবনে.....
চলুন, আমরা আমাদের ছোট ছোট প্রচেষ্টা দিয়ে রূপকথাকে ঠাকুরমা'র ঝুলি থেকে বের করে হৃদয়ের জীবনে, আইরিন, জয়নালদের জীবনে নিয়ে আসি!
ছবির জন্য কৃতজ্ঞতা:- কৃতজ্ঞতা ফয়সল নোই ও সোহায়লা রিদওয়ান।।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মার্চ, ২০১১ দুপুর ১:৫২