‘আমার অরণ্য মাকে কেউ যদি কেড়ে নিতে চায়, আমার সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করে কেউ যদি অন্য সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়, আমার ধর্মকে কেউ যদি খারাপ বা অসভ্য ধর্ম বলে, আমাকে কেউ যদি শুধু শোষণ করে নিতে চায় তবে আমি বিদ্রোহ করবই।’ ১৮৯৫-১৯০০ সালের মুন্ডা বিদ্রোহের নায়ক বিরসা মুন্ডার এমন চিন্তাচেতনা থেকেই সে সময় উলগুলানের জন্ম হয়। উলগুলান আদিবাসীদের দেখিয়েছিল জমিদার, মিশনারি, ইংরেজ শাসকদের হাত থেকে মুক্তির স্বপ্ন।
আজ ৯ জুন বিরসা মুন্ডার ১১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯০০ সালের এই দিনে ইংরেজ শাসকদের বন্দিদশা অবস্থায় উলগুলানের নায়ক বিরসা মুন্ডা মারা যান। মুন্ডা জনগণের কাছে বিরসা আজ কিংবদন্তি। বিরসাকে নিয়ে কত গান, কত গল্প। বর্তমানের রাঁচি জেলার উলিহাটুতে ১৮৭৫ সালের ১৫ নভেম্বর বৃহস্পতিবারে তিনি জন্ম নিয়েছিলেন। সে সময় মুন্ডা সমাজে বারের নামে নাম রাখার বেশ চল ছিল। তাই বাবা সুগানা ও মা করমি ছেলের নাম রেখেছিলেন বিরসা। বিরসার জন্ম নিয়ে আজো মুন্ডারা গান গায়— হে ধরতি আবা! জন্ম তোমার চালকাদেতে ভাদ্র মাসে/ অন্ধজনের চোখ মিলল ভাদ্র মাসে/ চলো যাই ধরতি আবাকে দেখি/ এ বড়ো আনন্দ হে, তাঁকে প্রণাম করি/ আমাদের শত্রুদের তিনি হারিয়ে দিবেন ভাদ্র মাসে।
মুন্ডা ভাষায় বিদ্রোহকে বলা হয় ‘উলগুলান’। বিরসার নেতৃত্বে মুন্ডাদের উলগুলান কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। পৃথিবী যখন তথাকথিত সভ্য হয়ে এসেছে, ঠিক সেই সময় ভারতীয় উপমহাদেশের আদি জনগোষ্ঠী আদিবাসীদের অসভ্য বলে, নীচ বলে ঘৃণা করা হয়েছে। আদিবাসীরা অনেক সময়ই চুপ করে এসব সহ্য করেছে। যখন অন্যায়-নির্যাতন সীমা ছাড়িয়েছে, তখন আদিবাসীরা সংঘটিত করেছে বিদ্রোহ। এটি সেই সময় ইংরেজ শাসকদের ভিত নড়িয়ে দিয়েছিল। তত্কালীন ভারতের ছোটনাগপুরের সিংভূম, রাঁচি, পালামৌ জেলাগুলোয় মুন্ডাসহ অন্য আদিবাসীদের ঘনবসতি ছিল। ১৮৩১-৩২ সালের কোল বিদ্রোহ, ১৮৫৫-৫৬ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহের পর ভারতের আদিবাসী অধ্যুষিত জায়গাগুলোয় আবারো আদিবাসীদের ওপর জমিদারদের অত্যাচার চলতে থাকে। আদিবাসীরা হিন্দি-উর্দু বুঝত না, ফলে আদিবাসীদের ঠকানো যেত খুব সহজেই। আদিবাসীরা নিজেদের গোষ্ঠীর বাইরের লোকদের ‘দিকু’ বলত। দিকু, ব্রিটিশ শাসক, জমিদারি প্রথা এ সবই আদিবাসীদের কাছে আতঙ্ক হয়ে দাঁড়াল। আদিবাসীদের শুধু ঠকিয়ে, তাদের ওপর অত্যাচার করে, তাদের শুধু বেগার খাটিয়ে ইংরেজরা-জমিদাররা ক্ষান্ত হয়নি। আদিবাসী মুন্ডাদের মধ্যে তারা খ্রিস্টধর্ম, হিন্দুধর্ম প্রচার করে তাদের নিজ ধর্ম থেকে আলাদা করা হয়। এতে মুন্ডাসহ অন্য আদিবাসীদের সমাজব্যবস্থা, সংস্কৃতি বিপন্ন হতে শুরু করে। অনেক মুন্ডাসহ অন্য আদিবাসীরা নিজ ধর্ম-সংস্কৃতি বিলিয়ে দিয়েও ধর্মান্তরিত হয়েছিল, যাতে ধর্মান্তরিত হলে তাদের অত্যাচারিত হতে না হয়। কিন্তু ধর্মান্তরিত হওয়ার পরও আদিবাসীরা রক্ষা পেল না। বিরসা মুন্ডার বাবা সুগানা মুন্ডা খ্রিস্টান হয়েছিলেন। বিরসাও খ্রিস্টান হয়েছিলেন। কিন্তু যখনই মুন্ডারা তাদের অধিকারের কথা বলেছে, তখনই ইংরেজ সাহেব কি, কি জমিদার, আর মিশনারিরাইবা কি, কেউ তাদের অধিকারের কথা বলেনি। তাইতো বিরসা বলেছিলেন, ‘মিশনের সাহেব আর অফিসার সাহেব সবাই এক জাতের। সাহেব সাহেব এক টোপি হ্যায়।’
১৮৯৫ সালের দিকে ২০ বছরের যুবক বিরসা বুঝতে পারেন আর চুপ করে থাকলে চলবে না। মুন্ডাদের আদি ধর্ম থেকে কুসংস্কার বাদ দিয়ে তাদের নতুন ধর্ম শেখাতে হবে। মিশন, সরকারি কর্মচারী, আদালত, জমিদার, মহাজন, ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ধর্ম শেখাতে হবে। বিরসা বলেছিলেন, ‘আমি বিরসা নই, আমি ধরতি আবা। এই পৃথিবী আমার সন্তান। আমি মুন্ডাদের নতুন ধর্ম শিখাব। আমি তোদের কোলে নিয়ে ভুলাব না। দুলাব না। আমি মুন্ডাদের মরতে আর মারতে শিখাব।’ বিরসা তার এই নতুন ধর্মে মুন্ডাদের দীক্ষিত করতে শুরু করেছিলেন। কানে কানে এই খবর চলে গিয়েছিল রাঁচির ডেপুটি কমিশনারের কাছে। তিনি বিরসাকে ধরতে হুকুম দিয়েছিলেন। এদিকে মুন্ডারি ভাষায় অভিধান লিখে বিখ্যাত হয়ে ওঠা পাদ্রি হফম্যান ইংরেজ সরকারকে আভাস দেয় যে, বিরসা স্থির করেছে মিশনারিদের হত্যা করবে। শুরু হয় বিরসা মুন্ডাকে ধরার অভিযান। রাতের আঁধারে ধরা হলো বিরসাকে। বিরসার বিচার হলো। একতরফা বিচার। ইংরেজ শাসকদের সাজানো বিচারে বিরসার দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হলো।
বিরসার জেলে থাকা অবস্থায় মুন্ডা এলাকায় বৃষ্টির অভাবে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। কিন্তু এর মধ্যেও মুন্ডারা অপেক্ষা করতে থাকে কবে তাদের বিরসা ভগবান জেল থেকে বের হবে আর তাদের পথ দেখাবে। হাজারীবাগ জেলে বিরসা দীর্ঘ সময় থাকার পর ১৮৯৭ সালের ৩০ নভেম্বর সরকার তাকে মুক্তি দেয়। বিরসার মুক্তিতে মুন্ডাসহ আদিবাসী সমাজে উৎসবের আমেজ বসে। গ্রামে গ্রামে নাচ-গান ও নাগাড়া বেজে ওঠে। বিরসা আবার তার নতুন ধর্মে সবাইকে দীক্ষিত করতে শুরু করে। বিরসার নতুন ধর্মে যারা যোগ দিল, তাদের বিরসাইত বলা হলো। বিরসাইতরা নানা রকম কাজের ভার পেল। শুরু হলো বিদ্রোহের প্রস্তুতি। সভা হতে লাগল মুন্ডা এলাকার গ্রামে গ্রামে। তামাড় ও খুঁটির পর্বতমালা থেকে কিছু দূরে ডোম্বা বা সাইকোর বনে ঢাকা উপত্যকা ডোম্বারি এলাকায় বিরসা তার প্রধান ঘাঁটি বানিয়ে বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ১৮৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি, তার পর ১৮৯৯ সালের অক্টোবর বা নভেম্বরে ডোম্বারি পাহাড়ে বিরসাইতরা সভা করে। এ সভায় বিরসা ব্রিটিশ রাজের লাল নিশান দেখিয়ে মুন্ডাদের বলে, ‘দিকুদের সঙ্গে যুদ্ধ হবে। এই নিশানের মতো লাল রক্ত বইবে মাটিতে।’
১৮৯৯ সালের ডিসেম্বরে সাহেবদের বড়দিন উৎসবের ওপর বিরসা নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সিংভূম ও রাঁচির ছয়টি থানায় ২৪ ডিসেম্বর বিরসাইতরা মিশনগুলোয় আক্রমণ করে। এ সময় বহু মিশন, গির্জায় আগুন জ্বলতে থাকে। বেশকিছু ইংরেজ সাহেব, মিশনারি, চৌকিদার আহত-নিহত হয়। ব্রিটিশ সরকারের টনক নড়ে। রাঁচির ডেপুটি কমিশনার স্ট্রিটফিল্ড বিরসাকে ধরার জন্য পুলিশ নিয়ে আসে। কিন্তু বিরসাকে ধরা যায় না। ১৯০০ সালের ৬ জানুয়ারি বিদ্রোহীরা এক জার্মান জঙ্গল চৌকিদার ও তার চাকরকে হত্যা করে। তার আগের দিন গয়া মুন্ডা নামক এক বিরসাইতের বাড়িতে ৫০-৬০ জন বিরসাইত মিলিত হয়। খবর পেয়ে সেখানে রাঁচির খুঁটি থানার হেড কনস্টেবল তার দুজন কনস্টেবল ও তিন চৌকিদারকে নিয়ে গয়া মুন্ডার বাড়িতে পৌঁছলে বিদ্রোহীরা দুই কনস্টেবল জয়রাম ও বুদুকে হত্যা করে, অন্যরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ঘটনার পর দুমকা ও রাঁচি থেকে পুলিশ বাহিনী, ডোরানডা থেকে সেনাবাহিনী এনে সিংভূম ও রাঁচির কমিশনার, ডেপুটি কামশনার বিরসাকে ধরার জন্য সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে। সৈলরাকাব পাহাড়ে অভিযান চালায় ইংরেজ বাহিনী। চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা হয় পাহাড়টি। স্ট্রিটফিল্ড বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণের জন্য আহ্বান করেন, কিন্তু বিদ্রোহীরা তার এ আহ্বানে সাড়া দেয়নি। শুরু হয় এক অসম যুদ্ধ। একদিকে চলে ঝাঁকে ঝাঁকে বন্দুকের গুলি, অন্যদিকে মুন্ডাদের তীর। অবশেষে বাস্তবতা, আধুনিক অস্ত্র বন্দুকের কাছে তীর পেরে ওঠে না। বিরসা তার সঙ্গীদের নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। এ অসম যুদ্ধে অনেক মুন্ডা নারী-পুরুষ ও শিশু নিহত হলেও সেই সময় সরকারি হিসাবমতে চারজন পুরুষ, তিনজন নারী ও একটি শিশু মারা গেছে বলে জানানো হয়। বিরসাকে ধরার জন্য ৫০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। এদিকে বিরসা গোপনে গ্রামে গ্রামে সভা করতে থাকে। বিরসা রোগাতো নামক এক গ্রামে শেষ সভা করে। ১৯০০ সালের ফেরুয়ারির ১৩ তারিখে বিরসা সেনত্রা জঙ্গলে ঘুমাচ্ছিলেন। বিশস্ত সাথী ডোনকা মুন্ডার স্ত্রী সালী ভগবানের (বিরসা) জন্য ভাত রাঁধছিলেন। জঙ্গলের মাথার ওপর ধোঁয়া দেখা যাচ্ছিল। মনমারু ও জারকাইল গ্রামের সাতজন মানুষ ধোঁয়া দেখে সেখানে গিয়ে বিরসাকে অতর্কিতে ধরে ফেলে। বিশ্বাসঘাতকতা করে বিরসাকে ইংরেজদের হাতে তুলে দেয়া হয়। বিরসাকে বন্দি করা হয় এবং বিচারকাজ শুরু হয়। বিরসার সঙ্গে সঙ্গে ৫৮১ জন বিরসাইতেরও বিচার শুরু হয়। এর মধ্যে তিনজনের ফাঁসি হয় এবং ৭৭ জনের দ্বীপান্তরসহ নানা মেয়াদে কারাদণ্ড হয়। বিদ্রোহীদের রাঁচি জেলখানায় রাখা হয়েছিল শেকল দিয়ে বেঁধে। ১৯০০ সালের ৩০ মে, বিরসা জেলের খাবার খান না, অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বলা হয় বিরসার কলেরা হয়েছে। বিরসা বাঁচবে না। কিন্তু বিরসা আস্তে আস্তে সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়। হঠাৎ করে ৮ জুন বিরসা আবার অসুস্থ হয়ে ওঠে। এর পর ৯ জুন সকাল ৮টার দিকে বিরসা রক্ত বমি করতে করতে জ্ঞান হারায়। প্রায় ৯টার দিকে বিরসা মুন্ডার মৃত্যু হয়। বিরসা মুন্ডার মৃত্যুতে হাহাকার করে ওঠে অন্য মুন্ডারা। বিরসার মৃত্যুর কারণ হিসেবে কলেরা বলা হলেও বিরসার ময়নাতদন্ত রিপোর্ট ও তার মৃত্যুর পূর্ব লক্ষণের সঙ্গে কলেরা রোগের মিল পাওয়া যায়নি। অনেক অভিজ্ঞ ডাক্তার মনে করেন বিরসাকে অর্সেনিক বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল।
বিরসা মুন্ডা আদিবাসীদের কাছে আজো বিরসা ভগবান হয়ে বেঁচে আছেন। বিরসার উলগুলান আধুনিক অস্ত্রের কাছে পরাজিত হলেও আদিবাসী সমাজ তার এ পরাজয়ে লজ্জিত নয় বরং গর্বিত। বিরসা দেখিয়ে গেছেন অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনে জীবন দিতে হবে। এদেশেও আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য বিরসার মতো লড়ে প্রয়োজনে জীবন দিতে হবে। আজো অনেকে সেবার নামে, ধর্ম প্রচারের নামে জনসংখ্যায় কম আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে নিজ পায়ে দাঁড়াতে না দিয়ে পঙ্গু করার চেষ্টা করছে। বিরসা ভগবান স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন মুন্ডাদের তথা আদিবাসীদের মুক্তির। আজো আদিবাসীরা প্রকৃত মুক্তি পায়নি। আজ সময় হয়েছে প্রত্যেক আদিবাসী এক একজন বিরসা ভগবান হয়ে আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও অধিকার রক্ষার যুদ্ধে শামিল হবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৪:৪৮