আগামী ২৪-২৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হচ্ছে পাঁচ দিনব্যাপী ঢাকা-সুন্দরবন লং মার্চ । কয়েক হাজার মানুষ এই প্রচার অভিযানে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেবে সারাদেশসহ গোটা বিশ্ববাসীকে একটি ভয়াবহ প্রকল্প সম্পর্কে সতর্ক এবং সচেতন করতে। একই সঙ্গে মুনাফালোভী শাসকগোষ্ঠীকে আমাদের জাতীয় গর্ব এবং প্রাকৃতিক সম্পদের আধার সুন্দরবন ধ্বংস করে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে বিরত রাখতে এই লং মার্চ।
সুন্দরবন শুধু আমাদের জাতীয় গর্বই নয় বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাকৃতিক বর্ম হিসেবে জলোচ্ছ্বাস, সাইক্লোন, টর্নেডোর হাত থেকে রক্ষা করে। আধুনিক জীবনের অপরিহার্য উপাদান বিদ্যুৎ। আজও দেশের প্রায় ৫৫ ভাগ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে বিদ্যুৎসেবা থেকে বঞ্চিত। কিন্তু এই বিদ্যুৎ এবং উন্নয়নের কথা বলে মুনাফালোভী শাসকগোষ্ঠীর পাল্লায় আমরা কি সুন্দরবনকে ধ্বংস করতে চলেছি? মূলত বিদ্যুৎ সঙ্কটে কথা বলে, আমাদের জাতীয় স্বার্থ নষ্ট করে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল এবং আর্থসামাজিকভাবে অনেক উপকারী সুন্দরবনকে ধ্বংস করার হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই এই কর্মসূচি। তেল গ্যাস খনিজসম্পদ বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির এটাই প্রথম কোনো কর্মসূচি নয় । এর আগেও জাতীয় স্বার্থবিরোধী অনেক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে জোরালো ভূমিকা রেখেছে এই কমিটি।এবার শাসকগোষ্ঠী এবং মুনাফালোভীদের থাবা পড়েছে আমাদের জাতীয় গর্ব সুন্দরবনের ওপর । সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে মাত্র ১৪ কি. মি. এর মধ্যেই বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলায় কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরির ঘোষণা দিয়েছে সরকার। যদিও সরকার প্রণীত কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবেশগত সমীক্ষা বা ‘ইআইএ’ রিপোর্টেই বলা হচ্ছে, এটা একসময় সুন্দরবনেরই অংশ ছিল ।
২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি ভারতের জ্বালানি সচিবের বাংলাদেশ সফরকালে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) এবং ভারতের রাষ্ট্রীয় সংস্থা ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার কোম্পানি (এনটিপিসি) যৌথভাবে ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানির মাধ্যমে ১৩২০ মেগাওয়াটের একটি তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে । কোনো রকমের পরিবেশগত সমীক্ষা ছাড়াই ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাস থেকেই রামপালে ১৮৩৪ একর জমি অধিগ্রহণ এবং মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়ে যায়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, এটা প্রথম পর্যায়ের কেন্দ্র । একই স্থানে পরবর্তী সময়ে আরও ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে ।
এই প্রকল্পকে নিয়ে প্রধানত তিনটি প্রধান সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে । প্রথমত, অসম এবং অস্বচ্ছ চুক্তি যাতে মালিকানা এবং জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয় । দ্বিতীয়ত, আমাদের জাতীয় গর্ব এবং অমূল্য সম্পদ সুন্দরবনের ওপর হুমকি। তৃতীয়ত, অনিয়ম এবং দুর্নীতির মাধ্যমে কাজের শুরু ।
চুক্তির ধরনে বলা হয়েছে, এই প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ৭০ ভাগ আসবে বিদেশি ঋণ থেকে । বাকি ৩০ ভাগের ১৫ ভাগ বহন করবে ভারত এবং বাকি ১৫ ভাগ বহন করবে বাংলাদেশ। কিন্তু বিদেশি ৭০ ভগের সুদসহ সব মূলধন পরিশোধ করার দায়িত্ব এককভাবে বাংলাদেশের। অর্থাৎ মাত্র ১৫ ভাগ বিনিয়োগ করে ভারত শতকরা ৫০ ভাগ অংশের মালিকানা পাবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে কয়লা যোগানোর সব দায়িত্ব বাংলাদেশের । সময়মতো কয়লা না পাওয়া গেলে বা যে কোনো কারণে বিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ থাকলে বা কোনো ক্ষয়ক্ষতি হলে ভারত কোনো দায় নেবে না । এ প্রসঙ্গে আরও একটি চুক্তির কথা উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিদ্যুৎ সঙ্কটের কথা বলে এর আগেও এশিয়া এনার্জি নামের একটি ভূঁইফোঁড় কোম্পানি বাংলাদেশ সরকারকে মাত্র ৬ ভাগ রয়্যালটি দিয়ে ফুলবাড়ী কয়লা খনির মালিক হতে চেয়েছিল । লক্ষাধিক মানুষকে জীবন জীবিকা থেকে উচ্ছেদ করে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তুলতে চেয়েছিল । কিন্তু জনগণের ‘অভ্যুত্থান’ এর মুখে তারা এখনও এই সর্বনাশা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়নি।
সুন্দরবন বিশ্বের একক ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সর্ববৃহৎ যার আয়তন প্রায় ৬০০০ বর্গ কিলোমিটার। জোয়ার এবং ভাটা বৈশিষ্ট্যযুক্ত এই বনে আছে প্রায় ৬৬ প্রজাতির উদ্ভিদ, ২০০ প্রজাতির মাছ , ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী জন্তু , ২৩৪ প্রজাতির পাখি, ৫১ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী এবং অসংখ্য অমেরুদণ্ডী প্রাণী। এছাড়াও আমাদের জাতীয় গর্ব রয়েল বেঙ্গল টাইগার, গাঙ্গেয় এবং ইরাবতী নামের দুই ধরনের ডলফিন, ৩ প্রজাতির কচ্ছপের শেষ আশ্রয়স্থল এই সুন্দরবন । প্রায় ৪০০টি খাল এবং ছোটবড় নদী বেষ্টিত ২০০টি দ্বীপের সমন্বয়ে এই বনের আয়তন প্রায় ৬ হাজার বর্গকিলোমিটার । যার বাংলাদেশের অংশের আয়তন প্রায় ৪১১০ বর্গ কিলোমিটার যা মোট বনের প্রায় ৬০ ভাগ এবং ভারতের অংশ প্রায় ৪০ ভাগ বা ২৭৪০ বর্গকিলোমিটার। কিন্তু নির্বিচারে বন উজাড়ের কারণে দিন দিন এর আয়তন কমছে।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র মারাত্মক পরিবেশ দূষণ ঘটায় তাই সাধারণত বিশ্বের অন্যান্য দেশে সংরক্ষিত বনভূমি ও বসতির ১৫-২৫ কিলোমিটারের মধ্যে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয় না। যে ভারতের এনটিপিসি বাংলাদেশের সুন্দরবনের পাশে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে সেই ভারতের ‘ওয়াইল্ড লাইফ প্রটেকশন অ্যাক্ট-১৯৭২’ অনুযায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১৫ কি. মি. এর মধ্যে ‘ইআইএ গাইড লাইন ম্যানুয়াল ২০১০’ অনুসারে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ২৫ কি. মি. এর মধ্যে কোনো বাঘ/হাতি সংরক্ষণ অঞ্চল, জীব বৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বনাঞ্চল , জাতীয় উদ্যান, বন্যপ্রাণীর অভায়ারণ্য থাকা যাবে না । আবার ভারতীয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন সংক্রান্ত গাইড লাইন-১৯৮৭ অনুসারে কোনো সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা যায় না ।
মূলত রাজনৈতিক কারণেই সরকার যেকোনো মূল্যে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায়। এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একাধিক রিট আছে কিন্তু এরপরও সরকার প্রকল্পের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। পরিবেশগত ছাড়পত্র বা পরিবেশগত সমীক্ষার (ইআইএ) অনুমোদনের অনেক আগে থেকেই এলাকায় জোরপূর্বক উচ্ছেদ, নির্যাতনের ও আক্রমণের শিকার হচ্ছে এলাকাবাসী। অধিগ্রহণের বেশিরভাগই কৃষি জমি। এছাড়াও মৎস্যখামার, চিংড়ি চাষ প্রকল্প, সবজি খেত, গরু মহিষ উৎপাদন খামার, দুগ্ধ খামার ও অন্যান্য বাবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই কৃষি জমি অধিগ্রহণ করার ফলে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ কর্মহীন এবং উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছে।
জমি অধিগ্রহণের আদেশ জারি হয় ২০১০ সালের ২৭ ডিসেম্বর।ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসির সঙ্গে বাংলাদেশের পিডিবির যৌথ বিনিয়োগ চুক্তি হয় ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি। কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিবেশগত সমীক্ষা বা ইআইএ’ রিপোর্ট জনগণের মতামতের জন্য পিডিবি তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে। অর্থাৎ পরিবেশগত সমীক্ষা ছাড়াই জনগণের মতামত এবং হাইকোর্টের রিট উপেক্ষা করে প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শুরু করে দেয়া হয়েছে ততক্ষণে।
সরকারের মধ্য থেকেই এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ উঠেছে বারবার। সরকার পরিবেশ সমীক্ষা ছাড়াই এই প্রকল্প এগিয়ে নিতে মরিয়া হলেও সরকারের বিভিন্ন দপ্তর যেমন: বন অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সুন্দরবনের ক্ষতি করে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ব্যাপারে তীব্র আপত্তি তোলা হয়েছে। তবু এই বিদ্যুৎকেন্দ্র করার সিদ্ধান্ত থেকে এখন পর্যন্ত পিছু হটেনি সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থা।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেক বিকল্প পদ্ধতি আছে। কিন্তু আমাদের সুন্দরবন একটাই। জাতীয় স্বার্থ নষ্ট করে সুন্দরবন ধ্বংসের কোনো আয়োজন মেনে নেয়া যায় না। (চলবে)
Link