বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন নিয়ে অনেকেই লিখেছেন, সাংবাদিক, ব্লগার থেকে শুরু করে সমাজের বড় বড় রতি মহারথিরা তার জন্মদিন নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষন করেছেন। দীর্ঘদিন অনুসন্ধানের পর তার মেরেজ সার্টিফিকেট, স্কুল সার্টিফিকেট থেকে শুরু করে তার জন্মতারিখ বিষয়ক সকল তথ্য জনসম্মুখে উপস্থাপন করেছেন।
অনেকেই দাবী করেন ১৫ই আগষ্টে খালেদার জন্ম হয়েছিল, তবে বহু খুঁজেও এই কথার পক্ষে কোন বিশ্বাস যোগ্য / মেনে নেয়ার মতো তথ্য-প্রমাণ পাইনি। গত কয়েকদিন আগে এক বড় ভাই আমাকে বলেছিলেন, শেখ মুজিবের মৃত্যুর মধ্য দিয়েই খালেদা সহ আরও অনেক রাজনৈতিক আবর্জনার জন্ম হয়েছিল, মুজিব যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে খালেদার মতো রাজনীতিক আবর্জনার জন্ম হতো না।
সে ভাইয়ের কথার আরও বিস্তারিত যুক্তি পেলাম দ্বীপ রয় নামক এক ব্লগারের কমেন্ট থেকে, তিনি লিখেছেন -
শেখ মুজিব যদি না মারা যেতেন তা হলে জিয়াউর রহমান প্রাসিডেন্ট হতেন না, আর জিয়া না মারা গেলে খালেদা জিয়া চিরকাল গৃহিনী থেকে যেতেন, সে হিসাবে যেদিন শেখ মুজিব মারা গেছেন সে দিন থেকেই খালেদা জিয়ার জীবনে নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। আর তাই ১৫ আগষ্ট শেখ মুজিবের মৃত্যু দিবস-এবং খালেদা জিয়ার জন্ম দিবস(পুনঃজন্ম)।
ভেবে দেখুন, ১৫ আগষ্ট এর পর খালেদা জিয়া একজন সৈনিকের গৃহবধু থেকে হয়ে গেলেন প্রেসিডেন্টের স্ত্রী, তার পর প্রেসিডেণ্ট (জিয়া) মারা যাবার পর হয়ে গেলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী!! ভাবা যায়? কি সুন্দর সিনেমার মতো কাহিনী?? তবে একটা কথা বুঝতে পারিনা, ম্যাডাম কেনো জিয়ার মৃত্যু দিবসে আর একটা জন্মদিন পালন করেন না??? আসলে তো উনার প্রকৃত জন্মদিন হওয়া উচিৎ ছিলো ৩০ এ মে, জিয়ার মৃত্যু দিবসে তাই না? কারন,জিয়া না মারা গেলে তো ম্যাডাম আর ম্যাডাম হতেন না।
খালেদা সমর্থকরা গতকাল একটি পোস্টের মাধ্যমে ১৫ই আগষ্টে খালেদার জন্ম হয়েছিলো দাবী করে বিভিন্ন যুক্তি উপস্থাপন করেন এবং তর্কের এক পর্যায়ে খালেদা জিয়ার পাসপোর্টের ছবি দেখিয়ে সবাইকে আস্বস্ত করার চেষ্টা করেন।
গত ১৫ই আগষ্টে খালেদা জিয়া যখন জন্মদিনের কেক কাটছিলেন তখন সাধারন জনতার মতো আমিও, ঘৃণাভরে থুথু নিক্ষেপ করছিলাম। জন্মদিন নিয়ে লিখার ইচ্ছা হলেও চরম অরুচিতে ভুগে থেমে যাচ্ছিলাম, কিন্তু খালেদা সমর্থকদের উল্লাস দেখে চরম অরুচি সত্যেও লিখতে বাধ্য হলাম।
বহুবছর ধরে খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকীর দিন ১৫ই আগষ্টকে নিজের জন্মদিন দাবী করে আসছেন, অন্যদিকে বিরোধীদের মতে তিনি ১৫ ই আগষ্টে জন্মগ্রহণ করেননি, বঙ্গবন্ধুকে হেয় করার জন্য, উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত ভাবে এই দিনটিকে জন্ম বার্ষিকী হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
তাহলে কবে তার জন্ম হয়েছিলো, তিনি কি সত্যি সত্যিই ১৫ই আগষ্টে জন্মগ্রহণ করেছিলেন? আসুন তার জন্মদিন সম্পর্কিত কিছু তথ্য প্রমাণ, দেখে নিই -
১) ম্যাট্রিক পরীক্ষার মার্কশীট অনুসারে খালেদা জিয়ার জন্মদিন ১৯৪৬ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর
২) বিয়ের কাবিননামা অনুসারে উনার জন্মদিন ১৯৪৪ সালের ৯ই আগষ্ট।
৩) ১৯৯১ সালের ২০শে মার্চ তারিখে দৈনিক বাংলা পত্রিকায় সরকারী সংবাদ সংস্থা বাসস থেকে পাঠানো তথ্যের উপর ভিত্তি করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জীবনী ছাপা হয়। এতে উল্লেখ করা হয় যে উনার জন্মদিন ১৯৪৫ সালের ১৯শে আগষ্ট।
৪) ২২/৮/১৯৯৭ দৈনিক ইত্তেফাকে খালেদা জিয়ার জন্ম দিন নিয়ে একটি রিপোর্ট
৫) ২০০০ সালের ভোটারের তথ্য বিবরনী ফরমে খালেদা জিয়া উল্লেখ করেন যে তার জন্মদিন ১৯৪৬ সালের ১৫ই আগষ্ট! এছাড়া তিনি নিজেকে এইচএসসি পাস দাবি করেন যদিও শিক্ষাবোর্ডের ডকিউমেন্ট (মার্কশীট) অনুসারে তিনি ম্যাট্রিকে ফেল করেছিলেন।
৬) খালেদা জিয়ার বর্তমান পাসপোর্টের ছবি (অনেকের মতে এটা ফটোশপে বানানো), যেখানে উল্লেখ করা আছে তার জন্মদিন ১৯৪৬ সালের ১৫ই আগষ্ট!
৭) তিনি নিজেকে এইচএসসি পাস দাবি করলেও, বোর্ডের দেয়া তথ্য অনুযায়ী খালেদা ম্যাট্রিকে সর্বমোট সাত বিষয়ে ফেল করেছিলেন
২) উনার জন্মদিনের তথ্যসহ ঢাকা বোর্ডের আরও একটি সার্টিফিকেট।
ম্যাট্রিক পরীক্ষার মার্কশীট, বিয়ের কাবিননামা, ভোটার ফরম থেকে শুরু করে কোন দলিলেই তার জন্ম তারিখ ১৫ই আগষ্ট এমন উল্লেখ না থাকলেও হঠাৎ করেই ২০০০ সালের ভোটারের তথ্য বিবরনীর মাধ্যমে খালেদা জিয়া দাবী করেন ১৯৪৬ সালের ১৫ই আগষ্টে তার জন্ম হয়েছিলো। তারপর থেকে ঘটা করে, বিশাল সাইজের কেক কেটে এবং দলের সমর্থকদের নিয়ে আনন্দফুর্তি করে এই দিন উদযাপন করছেন।
বিভিন্ন বানোয়াট তথ্য প্রমাণের মাধ্যমে ১৫ আগষ্টেই তার জন্ম হয়েছিলো এমন দাবী করলেও, একথা আজ প্রমাণিত যে, মূলত জাতির পিতাকে অপমান করার জন্যই তিনি তার জন্ম বার্ষিকী হিসেবে এ দিনটিকে বেছে নিয়েছেন। কথিত আছে , সাকা চৌধুরীদের মতো দেশ বিরোধী রাজাকাররা জাতির পিতা শেখ মুজিবের মৃত্যু দিবস নিয়ে উপহাস করার জন্যে খালেদার মগজে এই তারিখটা ঢুকিয়ে দেয়।
১৫ ই আগষ্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদিবস। সেদিন কতিপয় মিরজাফরের প্ররোচনায় পড়ে বিপথগামী সেনাসদস্যরা জাতির জনক সহ তার পরিবারের সকল সদস্যদের নৃসংসভাবে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু বাঙালীদের শোষন থেকে মুক্ত করার জন্য অমানবিক নির্যাতন মাথা পেতে নিয়েছিলেন, বাঙালীদের একটি মানচিত্র উপহার দেবার জন্য পরিবার পরিজনের মায়া ত্যাগ করে জীবনের বহু বসন্ত জেলে বসে পার করে দিয়েছেন। তিনি এমনি এক ব্যাক্তি ছিলেন যার অবদানের কারনে আমরা নিজেদের স্বাধীন দেশের নাগরীক দাবী করি। তিনি ত্যাগ স্বীকার করেছেন বলেই দেশে গণতন্ত্র এসেছে, নির্বাচন হচ্ছে, খালেদা জিয়ার মতো এইট পাশ মহিলা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করছেন। বঙ্গবন্ধু যদি প্রতিরোধের ডাক না দিতেন, তাহলে আজ এই খালেদা জিয়াকে নিয়ে আলোচনা তো দুরের কথা, দেশের মানুষ তাকে ভালো করে চেনতই না !! যুদ্ধের সময় যদি বঙ্গবন্ধু ত্যাগ স্বীকার না করে পাকিস্থানীদের সাথে আতাত করতেন, তাহলে তার স্বামী জিয়াউর রহমানকে দেশদ্রোহীতার দায়ে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হতো, আর দেশের অন্যসব নারীদের মতো খালেদা জিয়াকেও কর্ণেল বেগ এর মতো পাকিস্থানী সেনাদের রক্ষিতার ভুমিকা পালন করতে হতো।
বঙ্গবন্ধু দৌহিত্র সজিব আহমেদ ওয়াজেদ (জয়) তার ফেইসবুক স্টাটাসের মাধ্যমে প্রশ্ন করেছেন, এটি সত্যিই দুঃখজনক যে খালেদা জিয়া প্রতি বছর এইদিনে তার জন্মদিন পালন করতে পছন্দ করে। বিভিন্ন দাপ্তরিক নথিতে তার তালিকাভুক্ত ভিন্ন ভিন্ন জন্মদিন আছে, যার কোনটিই ১৫ই আগষ্ট নয়। কি ধরনের ব্যক্তি এটি করতে পারে?
কম কথায় তার প্রশ্নের উত্তর হলো্, কৃতজ্ঞতাবোধহীন, ইজ্জতের প্রতি সামান্য সম্মানবোধ হীন, দেশপ্রেমহীন, জনগনের প্রতি সম্মানবোধ হীন খালেদা জিয়াই একমাত্র এই কাজ করতে পারেন।
খালেদা জিয়ার যদি সামান্য কৃতজ্ঞতাবোধ থাকত, নিজের ইজ্জতের প্রতি খালেদার যদি সামান্য সম্মানবোধ থাকত, তাহলে তিনি এই দিনে উৎসব করতেন না।
জাতির জনকের নির্মম হত্যার এই দিনে দেশের সকল জনগন শোকে মুহ্যমান, সেই জনগনের প্রতি খালেদা জিয়ার যদি সামান্য সম্মানবোধ থাকতো, তাহলে তিনি এই দিনে দলবল নিয়ে আনন্দফুর্তি করতে পারতেন না।
খালেদা সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হলে, যার হাত ধরে এই বাঙালি জাতির জন্ম, বাংলাদেশের জন্ম, সেই বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যার দিনে রাজকীয় বার্নাঢ্য জন্মদিনের উৎসব আয়োজন করতে পারতেন না।
বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত তার চিরশত্রু পাকিস্থানী শাষকরা তাকে নিয়ে কুটুক্তি করার সাহস পায়নি। তাদের পরোক্ষ প্ররোচনাতেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলেও বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর উল্লাস করাতো দুরের কথা, তার মৃত্যু নিয়ে দুটি কথা বলারও সাহস করেনি। কিন্তু এদেশে জন্ম নেয়া খালেদা জিয়া প্রতিবছর বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু বার্ষিকী উদাযাপন করে আসছেন। খালেদা জিয়া ১৫ ই আগষ্টে নিজের জন্মবার্ষিকী পালনের মাধ্যমে শুধু বঙ্গবন্ধুকে অপমান করছেন না, বাঙালী জাতিকে অপমান করছেন, স্বাধীনতাকে অপমান করছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করছেন, আমাদের দেশপ্রেমকে পদদলিত করছেন।
তিনি এসব করার সুযোগ পাচ্ছেন কেন জানেন ? আমরা সুযোগ দিচ্ছি বলে ! হ্যা, সব দোষ আমাদের, আমরা যদি তাকে প্রধানমন্ত্রী অথবা বিরোধী দলীয় নেত্রীর তকমা না দিতাম, তাহলে তিনি আমাদের ট্যাক্সের টাকায় সংসার পরিচালনা করে, আমাদেরকেই অপমান করার দুঃসাহস দেখাতে পারতেন না।
এখনও সময় আছে, রুখে দাড়াতে হবে, খালেদা জিয়াকে আস্তাখুড়ে ছুড়ে ফেলতে হবে, নাহলে সামনে এমন দিন আসবে যেদিন হয়তো বাঙালী পরিচয় দিতেও আমাদের লজ্জাবোধ হবে, তার আগেই সোচ্চার হোন, প্রতিরোধ করুন।
পুনশ্চ - প্রতিবছর খালেদা যখন এই দিনকে নিজের জন্মদিন দাবী করে বর্ণ্যাঢ্য উদযাপন করেন, তখন মনে নানান প্রশ্ন আসে, জানতে ইচ্ছে হয়, তিনি কি একবারও ভেবে দেখেছেন, বঙ্গবন্ধু যদি যুদ্ধের সময় পাকিস্থানীদের সাথে আতাত করতেন তাহলে উনার কি অবস্থা হতো ? দেশের মানুষ কি আজ তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চেনতো নাকি রক্ষিতা / ধর্ষিতা হিসেবে চেনতো ? যাদের প্ররোচনায় আজ বঙ্গবন্ধুকে অপমান করার দুঃসাহস দেখাচ্ছেন, সেসব রাজাকাররা তখন তার সাথে কেমন ব্যাবহার করতো ? তারা নিশ্চই অন্যান্য বাঙালী মেয়েদের মতো করে তাকেও পাকিস্থানী হায়েনাদের শিকারে পরিণত করতো ? সাথে সাথে তারাও নিশ্চই শেয়ালের মতো খালেদা জিয়া নামক হায়েনাদের শিকারে ভাগ বসাতো ? মাননীয় খালেদা জিয়া কি কখনও এমন করে ভেবে দেখেছেন ?
তথ্যসুত্র : বিভিন্ন ব্লগ এবং ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা : দিকভ্রান্ত পথিক (লিও ভাই), অরুপ দা। উনাদের দুজনের সাহায্য না পেলে আমার পক্ষে এই পোস্ট লিখা সম্ভব হতো না।