শব্দকরদের নিয়ে প্রথম পোস্ট প্রকাশ করার পর অনেকেই শব্দকরদের ব্যাপারে ভিবিন্ন তথ্য জানতে চেয়েছেন এবং অনেকেই শব্দকরদের নিয়ে আরও তথ্যবহুল লিখা প্রকাশ করার পরামর্শ দিয়েছেন। সেই সুত্র ধরে শব্দকরদের ব্যাপারে বিভিন্ন তথ্য খোঁজা শুরু করি, তখনি গুগলে অনুসন্ধান করে নিচের লিখা খুঁজে পেলাম।
শব্দকরদের নিয়ে তথ্যবহুল এই লিখাটি বিএনবি নিউজ নামক একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত হয়েছিল, বিশ্বজিৎ রায় নামক এক স্থানীয় সাংবাদিক এসব তথ্য সংগ্রহ করে রিপোর্টটি প্রকাশ করেছিলেন ।
এই রিপোর্ট হাতে আসার পর আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, উনার লিখা থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য নিয়ে নিজের হাতে লিখে তা প্রকাশ করব। পরে ভাবলাম আমাদের সমাজের ৯৫% সংবাদকর্মী যেখানে এদের নিয়ে কোন কথা বলছেন না, সেখানে বিশ্বজিৎ রায়ের এই রিপোর্ট আমাদের কাছে বিশাল পাওয়া। আমি জনাব বিশ্বজিৎ রায়ের মহতি উদ্যেগের প্রতি সম্মান জানিয়ে তার লিখা হবহু প্রকাশ করলাম।
আশা করি আপনারা শব্দকরদের ব্যাপারে যতটুকু তথ্য আশা করছেন তার চেয়ে বেশী তথ্য এই পোস্টে আছে।
------------------------------------------------------
দারিদ্রতা আর অনুন্নয়নের বৃত্তাবদ্ধতায় ক্রমশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া এক আদিবাসী জনগোষ্টী “শব্দকর সমপ্রদায়”। এরা আমাদের বাঙালী সমাজেরই একটি অংশ। বংশ পরম্পরাগত ভাবে ঢোল বাজানোর পেশাটা তাদের জীবিকা নির্বাহের মূল বা প্রধান পেশা হয়ে উঠায় তাদেরকে ঢুলিও বলা হয়। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় পেশাগত বাদ্যকার (বাজনাদার) এই জনগোষ্টী এরা ডুকলা নামে অভিহিত। শব্দকর উপাধিটা তাদের শিক্ষিত সমাজের কাছ থেকে পাওয়া।
প্রকৃত পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও ধারনা করা যায় মৌলভীবাজার জেলার ৫৩টি গ্রামে প্রায় ১০ হাজার শব্দকর সমপ্রদায়ের বসবাস রয়েছে বলে। গননা হলে হয়তো প্রকৃত সংখ্যাটি জানা যেতো। তবে বৃহত্তর সিলেট বিভাগের মধ্যে কমলগঞ্জ থানায় শব্দকর সমপ্রদায়ের সংখ্যা বেশী।
যুগ যুগ ধরে এই সমপ্রদায়টি দারিদ্রতা আর অনুন্নয়নের বৃত্তাবদ্ধতায় নিশ্চল ও নিঃসীম যন্ত্রণার আধারে কালাতিপাত করেছে। শব্দকরদের বস্তি প্রশাসন কেন্দ্র থেকে দূরে কিংবা কাছে যাই হোক না কেন বিপন্ন অস্তিত্বের এই জনগোষ্টীকে এ পাড়া ও পাড়া থেকে সহজেই পৃথক করে চেনা যায়। এটি সহজেই বুঝতে অসুবিধা হবেনা যে শত বছরেও এই সমপ্রদায়ের আদিতে উন্নয়নের কোন ছোঁয়া লাগেনি। মানুষের জীবনে দারিদ্রতার ভয়াবহতা কিরুপ হতে পারে তার এক নিষ্টুরতম প্রতিচ্ছবি এই শব্দকর সমপ্রদায়।
এদের শারিরীক গঠন সাধারন বাঙালী জনগোষ্টীর ন্যায় । শব্দকরদের সমাজ ব্যাবস্থা ব্রাম্মণ শাসিত। বিয়ে শাদী থেকে সামাজিক বিধি বিধানে ঠাকুরের (ব্রাম্মনের) প্রভাব বেশী। ধর্ম বিশ্বাস ও আচার আচরনে এরা সনাতন হিন্দু সমপ্রদায়ভুক্ত অন্য দশটি সমপ্রদায় কিংবা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী যেকোন সমপ্রদায় থেকে এই জনগোষ্টীকে অতি সহজেই চিহ্নিত করা যায়। আদি বাঙালীদের বিভিন্ন উৎসব অনুষ্টান এদের মধ্যে বহুল প্রচলিত থাকলেও চড়ক পূজা ও শিবের গাঁজন উৎসব এদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। শিব এদের কাছে লৌকিক ও অনার্য দেবতা হিসাবে পূজিত। এছাড়া তারা নিজস্বভাবে বাড়ীতে নারায়ন দেবতা ও মনষা দেবীর পূজা অর্চনা করে থাকে। চৈত্র সংক্রান্তির দিনে এরা চড়ক পূজা করে থাকে। আর সামাজিক পূজা অর্চনার জন্য পঞ্চায়েতি দূর্গা মন্ডপ ছাড়া তাদের নিজস্ব কোন দেবতা মন্দির নাই। বাকী দেবতাদের পূজা অর্চনা তারা অর্থের অভাবে করতে পারেনা।
এদের মধ্যে ধামাইল গানেরও প্রচলন রয়েছে। নিম্নে একটি ধামাইলের কয়েকটি লাইন তুলে ধরা হলো-
শিব আইলা হিনান করি - গৌরী এ দিলা সিদ্ধি ভরি।
ওমাই ওমাই ওমাই গো -অউনি গৌরির জামাই গো
লেংটা বেটা - আওরে শিব জগৎ জটা।।
অতীতে এই সমপ্রদায়ের লোকজন বিয়েশাদী, খেলাধূলা ও ষাড়ের লড়াই সহ বিভিন্ন অনুষ্টানে বাদ্য বাজাতো। কেউ কেউ বরকনের পালকী বহন ও নাইওরী আনা নেওয়ার কাজ করতো। কেউ কেউ বেগারী খাটতো। কেউবা করতেন ওঝার কাজ ; আবার কেউবা করতো বাচ্চা পাঠাকে খাসি এবং বাছুর ষাঢ়কে শুষ্কমুক্ত করে বলদ বানানো কিংবা হুক্কার টিকি বানানোর কাজ। কিন্তু লাইট্রেস কালচারের আগ্রাসনে যেমন পালকি কালচার নির্বাসনে গেছে তেমনি আধূনিক প্রযুক্তির বাদ্যযন্ত্রের প্রভাবে হারিয়ে গেছে আমাদের ঢাক-ঢোল, মৃদঙ্গ-বাঁশি। আর এসব নিয়েই ছিল যাদের জীবন-জীবিকা সেই শব্দকর সমপ্রদায়ের লোকেরা বাপদাদার খান্দানী পেশা ছেড়ে জীবিকা নির্বাহের তাগিদে কেউ কেউ করছে দিনমজুরী, কেউ চালাচ্ছে রিক্সা, কেউ করছে কুলিগিরি আর কেউবা বেঁছে নিয়েছে ভিক্ষাবৃত্তি।
খড় ও বাঁশের তৈরী কূড়ে ঘরে ওদের বসবাস। অনেক পরিবারই ভূমিহীন। কারো সামান্য জমিজমা থাকলেও সুদখোর মহাজন কিংবা মোড়লদের চক্রান্তে তা বেহাত হয়ে গেছে। সর্বোপরি নাগরিক অধিকার সম্পর্কে তাদের রয়েছে অসচেতনতা। শিক্ষা ক্ষেত্রে নেই কোন আগ্রহ। তবে ২/১ জন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাশের রেকর্ড রয়েছে তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে। তাদের বস্তিতে নেই কোন প্রাথমিক বিদ্যালয়। শিশু বয়সেই তারা পরের বাড়ীতে চাকুরীতে চলে যায় দারিদ্রতার কারণে।
দারিদ্রতার সাথে মানুষের অপরাধ সংগঠনের যে একটা সম্পর্ক রয়েছে, তাতে দরিদ্র মানুষ অনেক সময় অভাব অনাটনের কারনে চুরি ডাকাতিসহ নানা অপরাধ প্রবণতার সাথে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু আশ্চর্য্যরে ব্যপার হচ্ছে , সেই অর্থে শব্দকর সমপ্রদায়ের মধ্যে কোন অপরাধী চোখে পড়েনা দিনমজুরী অথবা ভিক্ষা বৃত্তির মাধ্যমেই তারা যা উপার্জন করে তা দিয়েই দিন যাপন করছে।
অধিকাংশ শব্দকর বস্তিতে কোন টিউবয়েল না থাকায় পুকুরের ডোবা নালার জল ব্যবহার করার কারনে ডায়রিয়া, আমাশয়, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি রোগ যেন তাদের নিত্যসঙ্গী। দু’একটি বাড়ীতে রিং লট্রিন থাকলেও অধিকাংশ বাড়ীতেই কাঁচা লেট্রিন। খুব কম পরিবারেই গরু ছাগল হাঁস মুরগী প্রতিপালন করা হয়। বাড়ীতে শাকসব্জীর উৎপাদন পরিকল্পিতভাবে কেই করেনা। তাই নিজস্ব পুঁজি বলতে তাদের হাতে কিছুই থাকেনা। তাদের জীবনের সংকীর্ণতার নির্দিষ্ট গন্ডী যেন এমনি পৃথক করে দিয়েছে।
কৃষি ঋণ কিংবা সরকারী কোন গ্রাহক ঋণের নাগরিক সুবিধা যেমন তারা পায়না তেমনি ভূমিহীনদের জন্য আসা সরকারী সাহায্যও এদের বস্তিতে পৌঁছায়না কোনদিন। নাগরিক অধিকার সম্বন্ধে তাদের রয়েছে অসচেতনতা তাই রাষ্ট্র ও সমাজের সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত হয়। নির্বাচনের সময় ভোটের প্রয়োজনেই এখানে আসেন উপরিতলার মানুষরা। নির্বাচনের রঙবেরং এর পোষ্টারে ছেয়ে যায় সারা বস্তির জীর্ণশীর্ণ কুটিরগুলো। কিন্তু কেউই জানতে চায়না এইসব মানুষের সুখ দুখের কথা। আসেন প্রয়োজনে; প্রয়োজন শেষে আবার চলেও যান। এরা পড়ে থাকে এদেরই মতো। এ পরিস্থিতি তাদের জীবনে নিয়তির মতো স্থির হয়ে আছে।
আরেকটি অদ্ভূত ব্যাপার ঘটে চলছে এই শব্দকর জনগোষ্টীর জীবনে বাংলাদেশের সকল শ্রেণী সমপ্রদায়ের বাড়তি জনসংখ্যার চাঁপ যেখানে বিপদগ্রস্থ করে তুলেছে পুরো রাষ্ট্র কাঠামোকে সেখানে জনসংখ্যা কমার অদ্ভূত ব্যাপারটা ঘটে চলছে শব্দকর জনগোষ্টীর জীবনে। কঠোর দারিদ্রতা আর সামাজিক বিচ্ছিন্নতাজনিত কারনে এই শব্দকর সমপ্রদায়ের জীবনে জন্মের হার কম মৃত্যুর হার বেশী। জীবন সংগ্রাম অর্থাৎ প্রতিদিনের বেঁচে থাকার যে সংগ্রাম তা থেকে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। এই হার ক্রমশ বাড়তে থাকলে একদিন এই সমপ্রদায়ের চিহ্ন হয়তো পৃথিবীতে থাকবেনা।
যতদূর জানা যায়, ১৯৮৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত মিশনারী সাহায্য সংস্থা হীড বাংলাদেশ, গ্রামীন ব্যাংকসহ বিভিন্ন এনজিও সংস্থা এবং কমলগঞ্জ ভিত্তিক সংগঠন আত্ম উন্নয়ন সমিতি (আউস) সহ বিভিন্ন প্রতিষ্টান টার্গেট করে এই সমপ্রদায়ের মধ্যে বছরের পর বছর কাজ করার পরও ওদের জীবনমানের উন্নয়নে কোন বাস্তব অগ্রগতি সাধনে সফলতা অর্জন সম্ভব হয়নি। প্রত্যেককেই ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে সরে যেতে হয়েছে।
তবে এপর্যন্ত এই জন গোষ্টীর জীবনমান উন্নয়নে সরকারী ভাবে কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। দারিদ্রতা আর অনুন্নয়নের বৃত্তাবদ্ধতায় ক্রমশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া এই আদিবাসী জনগোষ্টীকে রক্ষায় এখনি উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
বিশ্বজিৎ রায়,মৌলভীবাজার প্রতিনিধি ।
শব্দকরদের নিয়ে প্রকাশিত হওয়া আগের কয়েকটি পোস্ট :
শব্দকরদের করুন অসহায়ত্বের গল্প : আমরা কি মমতার হাত বাড়াতে পারিনা ?
"শব্দকর" প্রসংগে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো এবং একটি পাইলট প্রকল্পের প্রস্তাবনা