দেড়টার ঠিক আগে আগে একজন মধ্যবয়স্ক লোক আমাদের ক্লাশে ঢুকলেন। দেড়টা মানে টিফিন পিরিয়ড। স্কুল লাইফে আমরা টিফিন পিরিয়ডকে দেড়টাই বলতাম। এমন না যে ঠিক দেড়টার সময়ই টিফিন হতো। কিন্তু কেন জানি এটাই চলে এসেছে যুগ যুগ ধরে। সে যাগ্গে, যা বলছিলাম — ক্লাশ নিচ্ছিলেন লাভলী আপা। ফাইভের বিজ্ঞান ক্লাশ। একটু পরেই দেড়টা তাই আমাদের মনোযোগ ক্লাশের পড়ার চেয়ে স্কুলের মাঠে ঘন্টি বাজানো আইসক্রিমওয়ালার দিকেই বেশি। অপেক্ষা করছি কখন দেড়টার ঘন্টা বাজবে আর আমরা হুড়মুড় করে বের হবো ক্লাশ থেকে। এমন সময় ক্লাশে অপরিচিত একজনের উপস্থিতিতে কিছুটা বিরক্তই হলাম আমরা। নিশ্চই টিও অফিস থেকে এসেছে। হঠাৎ হঠাৎই টিও অফিস থেকে লোক আসে। পড়াশোনা কেমন হচ্ছে, স্যাররা ঠিকমত ক্লাশ নেন কিনা, কি পড়াচ্ছেন, সবার ইউনিফর্ম আছে কিনা, কাপড় পরিষ্কার কিনা, নখ ছোট কিনা, চুল ছোট কিনা ইত্যাকার নানান বিষয় লক্ষ্য করেন। শুধু তাই না দাঁড়া করিয়ে পড়াও ধরেন। কিন্তু একটা বিষয় গোলমেলে, টিও অফিস থেকে লোক আসলে আগের দিন স্যাররা বলে দেন। ফলে আমরা প্রিপারেশন নিয়ে আসি। গোসল করে চুলে তেল দিয়ে আঁচড়িয়ে পরিষ্কার ইউনিফর্ম পড়ে স্কুলে আসি। সেই সাথে নামতা এবং কিছু ট্রান্সলেশনও মুখস্থ করে আসি যেন ধরলে বলতে পারি। কিন্তু বিনা নোটিশে ক্লাশে চলে আসা লোকটা কে?
রোগা-পাতলা লোকটার চেহারা মলিন। নীল দিয়ে ধোয়া সাদা শার্ট ইন করে পড়েছেন। কিন্তু পায়ে স্যান্ডেল। হাতে একটা মোটা ডায়রী। লাভলী আপা পরিচয় করিয়ে দিলেন — ইনি একজন কবি, তোমাদের কবিতা শোনাবেন।
লোকটা নিজের নাম পরিচয় বললেন যদিও নামটা এখন আর মনে নেই। এরপর তিনি ডায়রী খুলে একে একে অনেকগুলো ছড়া ও কবিতা আমাদের শোনালেন। প্রথম ছড়াটার নাম ছিল ‘চায়ের কাপ’। একটি চায়ের কাপের আত্মজীবনী ছন্দে ছন্দে চমৎকার একটা ছড়ায় বর্ণনা করলেন। আমার খুব পছন্দ হলো। ছড়ার ছন্দটা এখনো মনে পড়ে শুধু কথাগুলো মনে নেই।
অনেক্ষণ ধরে ছড়া ও কবিতা শুনিয়ে তিনি ক্লাশ থেকে বের হয়ে গেলেন এবং ফোরের ক্লাশে ঢুকলেন। এক এক করে সবগুলো ক্লাশে হয়তো যাবেন। উনি যাওয়ার পর লাভলী আপা আমাদের বললেন — এই যে এতক্ষণ উনি তোমাদের ছড়া কবিতা শোনালেন এটা এমনি এমনি না। লোকটা খুব দরীদ্র। তোমরা যে যা পারো দিয়ে ওনাকে সাহায্য করো।
কথাটা শোনার পর কেমন জানি লাগছিল। কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিলামনা এতো চমৎকার ছড়া কবিতা যিনি লেখেন তাকে কেন স্কুলে স্কুলে ঘুরে কবিতা শুনিয়ে নিজের অন্ন জোগাড় করতে হয়? সেই প্রশ্নের জবাব কখনো পাইনি।
প্রতিদিন টিফিনের জন্য বাসা থেকে দুই টাকা করে পেতাম। বেশির ভাগ সময় আমি বাসায় এসে ভাত খেয়ে আবার স্কুলে যেতাম। মাঝে মধ্যে বাসায় না এলে বন্ধুরা মিলে হোটেলে আখনি কিংবা হালুয়া খেতাম। সেই দিন আমার টিফিনের দুই টাকা ওই কবিকে দিয়েছিলাম।
এরপর আরও দুয়েকবার সেই কবিকে দেখেছি, চৌমুহনীতে কোন জনসভায় এক ফাঁকে মঞ্চে উঠে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করতে। এখন লোকটা কোথায় আছে কেমন আছে জানিনা। জানিনা বেঁচে আছে কিনা। তবে চা খাওয়ার সময় হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে যায় সেই ছন্দে ছন্দে পড়া ছড়াটা। বহু বছর পার হয়ে গেছে কিন্তু এখনো শৈশবের সেই লোকটার মলিন চেহারা স্পষ্ট চোখে ভাসে।
আমার যদি একটা টাইম মেশিন থাকতো তাহলে সেই দিনটায় চলে যেতাম এবং লোকটাকে বলতাম — আপনার কবিতাগুলো অনেক সুন্দর। ছড়াগুলো আরও বেশি সুন্দর। আপনার ডায়রীটা আমাকে দেবেন? আমি আপনার একটা বই বের করে দিব। এরপর থেকে আপনি ডায়রীর বদলে একটা ব্যাগে করে আপনার বইগুলো নিয়ে স্কুলে স্কুলে যাবেন। আমার বিশ্বাস আপনার একটা বইও ফেরত আসবে না।