লেখালেখি হলো আমার জগত, আমার মানস ভ্রমণের অখন্ড মানচিত্র । বাস্তবের চরিত্রগুলো আমার জগতে সদর্পে চারণ করে । আমি তাদের হাসি কান্না সুখ দুঃখে তুলির আঁচড় ছুঁয়ে দিই । অপছন্দের আঁক গুলো ইরেজার দিয়ে ঘষে তুলে বসাই কল্পনার রঙ । প্রতিটা চরিত্র আমার জগতে বিশিষ্ট হয়ে উঠে । প্রতিটা অনুভূতিকে মহান করে তুলে আমি ঈশ্বরের সৃষ্টিশীলতায় স্পর্ধার আঙুল তুলি । নিকৃষ্ট পংকিল চিত্রনাট্য যিনি ইচ্ছেমত মঞ্চায়ন করে চলেছেন, আমি তাকে অস্বীকার করি । আমার সৃষ্টির কোমলতা পেলবতায় আমি তাকে ক্রমাগত ছাড়িয়ে যেতে চাই ।
আমার বৈকালিক ভ্রমনের পথটুকু শহর ছাড়িয়ে গ্রাম পেরিয়ে মিশেছে উঁচুনিচু পাহাড়ের সারিতে । শরীরচর্চা আমার উদ্দেশ্য নয় । ঐ পথ আমি পাড়ি দেই রঙ-তুলি-পেন্সিল নিয়ে । আমার কল্পিত পৃথিবী গড়ার যাবতীয় উপকরণ তুলে আনি ঐ অদূর পথ থেকে । নোংরা আবর্জনাময় বস্তির চারপাশে বুনে দেই লাল-নীল-হলুদ পুষ্পবৃক্ষ । ফুল থেকে ফুলে উড়ে বেড়ায় হলুদ–নীল প্রজাপতি, সবুজ ঘাস ফড়িং । তাদের পিছু পিছু ঘুরে বেড়ায় বস্তির নাঙ্গা শিশুর দল । উপরের ফ্যাকাশে আকাশটাকে রাঙিয়ে দিই গাঢ় নীল-আকাশী রঙের ছোপে । নীলাভ আলোয় ঝলমল করে এখানকার মানুষের মুখ ।
ঐ যে জামকালো কুচকুচে মেয়েটা, সাজি তার নাম । গরীব বাপটা খুব আহলাদি ছিল মেয়ের প্রতি, বড় সাধ করে নাম রেখেছিল সাজিয়া বেগম । আধপেট খেয়ে পয়সা বাঁচিয়ে মেয়েটার জন্য কিনে আনত প্লাস্টিকের চুড়ি, চুলের ক্লিপ । লাল জামা পড়িয়ে কখনো পিঠে কখনো কাঁধে নিয়ে পাড়া বেড়াত । গরীবের এত আহলাদ ঈশ্বরের সইবে কেন! হঠাৎ রঙমঞ্চ থেকে তিনি নামিয়ে দিলেন বাপটাকে । কালো পরীর ছোট্ট মেয়েটা এখন মায়ের পিছু পিছু নুড়ি পাথর নিয়ে খেলা করে । বিশাল পাথরের চাঁইগুলোকে হাতুড়ি পিটিয়ে নুড়ি বানানো এখন মায়ের কাজ ।
অকালে বাপ হারানো সাজিয়া কে তুলে নিয়ে আসি আমার পৃথিবীতে । দৃষ্টির প্রখরতা আর সীমাহীন চতুরতায় মা সাজি'কে সোনালী ডানায় আঁকড়ে রাখে । লোলুভ শিশুগামীদের চোখ এড়িয়ে সাজি বেড়ে উঠে মায়ের পরম নির্ভরতার ছায়ায় । আমার রাঙিয়ে দেয়া সবুজে ছুটে বেড়ায় সে প্রজাপতির পিছু পিছু । ডোবা থেকে কলমিলতা তুলে আনে, কানে গুজে দেয় বাহারি ফুল । চোখে মুখে ঝড়ে পড়ে অপার লাবন্য, যেন কোজাগরী চাঁদ ঢেলে দেয় সে মুখে অপার জ্যোৎস্না প্রভা ।
আকাশের দিকে মুখ তুলে আমি স্মিত হাসি । মেঘহীন আকাশে বিদ্যুৎ চমকে ক্রুর হেসে ঈর্ষাতুর ঈশ্বর আমার হাসির জবাব দেন । অসময়ের ঝড়োবৃষ্টি আর হাওয়ার ধমক আমাকে কাঁপিয়ে দিয়ে যায় ।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে । ব্যাকুল মায়ের প্রাণ সাজি'কে খুঁজে বেড়ায় ইতিউতি । শেষ বিকেলের হঠাৎ বৃষ্টির পর সাজি বেরিয়েছিল ঝরে পড়া গাছের ডাল কুড়াতে । সাংবাৎসরিক উনুনের জ্বালানী যোগায় ঝরে ভেঙ্গে পড়া শুকনো ডাল । সন্ধ্যা নেমে এলে মা আর স্থির থাকতে পারে না, অজানা আশঙ্কায় বুকে তার অলুক্ষণে কাঁপন লাগে । ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়ে পথে, সাজির খোঁজে । নির্জন একাকী রাস্তায় কিছুদুর এগুতেই বুড়ো শিমুল গাছের নিচ থেকে ভেসে আসে মুমূর্ষু গোঁঙানী । দিকবিদিক শুন্য হয়ে প্রাণপণ দৌড়ে ছুটে আসে অস্ফুট শব্দের উৎস মুখে । ভয়াবহ নিষ্ঠুরতায় কালসন্ধ্যা নির্বাণ হয়ে ফিরে আসে মায়ের বুকে । ইতস্তত বিধ্বস্ত সাজি'কে জড়িয়ে ধরে মা । সর্বনাশের কিছুই বুঝতে বাকি থাকে না তার । আঁচল দিয়ে রক্তস্রোত চেপে ধরে সর্বস্ব হারানো কিশোরী মেয়েকে কোলে নিয়ে ঘরে ফিরে মা ।
ক্ষুব্ধ ক্রোদ্ধ আমি আকাশের দিকে নিষ্ফল মুষ্ঠি ছুড়ি । ঈর্ষান্বিত ঈশ্বরের কূটচালে আমার সৃষ্টি আজ ভূলুন্টিত হয়ে আছে । তবু আমি থেমে থাকি না, বিধ্বস্ত সৃষ্টিতে নতুন রঙ চড়াতে থাকি । সাজি'র মাকে ফিরিয়ে দেই মনোবল আর দৃঢ়তা । নতুন করে বেঁচে থাকার আশায় মা-মেয়ে পাড়ি জমায় শহরে । বস্তির একখানা কুড়ে ঘরে আশ্রয় নেয় তারা । জীবিকা হিসাবে মা খুজে নেয় বাসা-বাড়ির কাজ । শারীরিক-মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত সাজি মায়ের কোমল স্পর্শে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে থাকে ।
মা এবাড়ি ওবাড়ি কাজ করে শেষে থিতু হয় আফজাল সাহেবের বাসায় । বাড়ির কর্ত্রী রাজিয়া বেগমকে রাঙিয়ে তুলি অপ্রথাগত নরম কোমল নারী হিসাবে । রাজিয়া বেগমের আশ্রয়ে সাজি'র মা খুঁজে পায় পরম আত্মীয়ের ছায়া । সাজিয়াদের জীবনে রাজিয়া বেগম আভির্ভুত হন মঙ্গল শুভাকাঙ্খী হয়ে । এদিকে সাজি ও ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে । পনের বছরের কিশোরীর শরীরে নেমে আসে যৌবনের অকাল বান । যৈবতি কন্যার সদ্য ফোটা পুষ্প সুভাসে ছুটে আসে বস্তির পুষ্প-রেণু শিকারীর দল । কিন্তু সাজিয়ার নিস্পৃহতা আর মায়ের কড়া চোখের আগুনে পুড়ে যায় তাদের নির্লজ্জ সাধ ।
সব শুনে রাজিয়া বেগম প্রস্তাব দেন সাজি'কে তাদের বাসায় থেকে যাবার । বাঘের থাবায় আহত মা তাতে সায় দেয় না । ঘরে যে রাজিয়া বেগমের যুবক পুত্রের সদর্প বিচরণ! এদিকে সাজিয়ার জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় বস্তির ল্যাংড়া মুদি দোকানী রমজান । সাজির মা লম্পট রমজানের প্রস্তাব মুখের উপর প্রত্যাখান করে । এর আগেও দুইবার বিয়ে করেছিল রমজান । প্রথম বউ নাকি মারা গেছে কোন অসুখে, আর দ্বিতীয় বউ পালিয়ে গেছে অন্য পুরুষের হাত ধরে ।
সাজি'র দ্বিতীয় জীবন সুখময় করতে আমি দৃঢ় বদ্ধপরিকর । তাই স্কলারশিপ পেয়ে রাজিয়া বেগমের যুবক পুত্র একদিন চলে যায় বিদেশে । আর যৌবনবতি সাজিয়ার নিরাপদ আশ্রয় মিলে রাজিয়া বেগমের কোমল ছায়ায় । নিজের মেয়ের মতোই দেখেশুনে বিয়ের দেবার প্রতিশ্রুতি পেয়ে আশ্বস্ত হয় সাজি'র মা । আমিও প্রশান্তির আমেজে গা ভাসাই, আমার সৃষ্টির আপাত নিরাপত্তায় । নির্ভাবনায় ডুব দিই অসমাপ্ত গল্পের নতুন পাণ্ডুলিপি লেখায় ।
সেদিন বজ্র সহ ঝড়ো বৃষ্টি নেমেছিল কিনা জানা নাই । তবে খালি বাসায় মাথায় তেল মেখে দেয়ার ছলে ডেকে এনে আফজাল সাহেব যখন কন্যাসম উর্বশী যুবতি সাজি'র উপর উপগত হন, হাত-পা ধরে ছেড়ে দেবার জন্য অনেক অনুনয় করেছিল সে । বাবার মত মানুষটা সকল অনুনয় বিনয় পায়ে ঠেলে হায়েনার আক্রোশে ঝাপিয়ে পড়েছিল সাজি'র উপর । বিধ্বস্ত পাণ্ডুবর্ণ শরীরটা টেনেটেনে বস্তির নিজের ঘরে ফিরে যাবার পর মায়ের আর চুড়ান্ত সর্বনাশের কিছু বুঝতে বাকি থাকেনি ।
হা ঈশ্বর, এ কেমন প্রতিশোধ! অন্ধ আক্রোশে প্রতিদ্বন্ধীর সৃষ্টি এভাবে ধ্বংস করে দাও! আবার সাজি'র মা কেও তুমি রঙ্গমঞ্চ থেকে উঠিয়ে নিলে! ভেবেছ সাজি'কে এতিম করে দিয়ে আমার সৃষ্টির চুড়ান্ত বিনাশ করবে! উঁহু, এত সহজে ছাড়ছি না । আমি আবার গড়বো সাজি'র পৃথিবী, আবার লিখব সাজি'র জিতে যাওয়ার গল্প!
হ্যাঁ, রাজিয়া বেগম! তিনিই পারেন এই গল্পটা এগিয়ে নিতে । তার প্রচেষ্টায় খুব নিরবে সাজিয়ার বিয়ে হয় রমজানের সাথে । কিছু অর্থকড়িও তুলে দেন তিনি লোভী রমজানের হাতে । দেবতাতুল্য স্বামী আফজাল সাহেবের বিকৃত লোভের কাটাকাটিও বলতে পারেন একে । সাজিও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে এসে মনোযোগী হয় নতুন জীবনে, নতুন সংসারে । আর যেদিন সাজি বুঝতে পারে তার নতুন প্রাণের স্পন্দন, আনন্দে আত্মহারা হয় ।
গল্পের এই পর্যায়ে ঈশ্বর খেলেন নতুন চাল । যৌবনে পেটের দায়ে ভেসেকটমি করা রমজান জানে এই শিশুর পিতা সে নয় । তবু অনাগত শিশুর প্রতীক্ষায় আগ্রহভরে অপেক্ষা করে সে । জন্ম নেয়া শিশুটিকে পিতৃস্নেহেই আগলে রাখতে চায় রমজান । কিন্তু ঈশ্বর তার মনে ঢুকিয়ে দেন অবিশ্বাসের দোলাচল । নিজের সাথে ক্রমাগত যুদ্ধ করে এক সময় সে হেরে যায় । স্ত্রী-পুত্র-সংসার সব ফেলে সে বেছে নেয় নিরুদ্দেশ যাত্রা । ঈশ্বর ভজনেই লম্পট রমজান খুঁজে নেয় নিজের মুক্তি ।
ঈশ্বরের উপর্যুপরি কোপানলে আমিও বিধ্বস্ত হই । একরাশ বিবমিষায় ভরাক্রান্ত হয় হৃদয় । রঙ-তুলি-পেন্সিল ছেড়ে পালাবার পথ খুঁজি একজন পরাজিত আমি । খুব ইচ্ছে হয় সাজিয়াকে নিয়ে নতুন গল্প লিখি । খুব ইচ্ছে হয় রুপকল্পে আবার সাজাই সাজিয়ার নতুন সংগ্রাম । নিজে বাঁচার পাশাপাশি শিশু পুত্রটিকেও বাঁচিয়ে রাখবে সে । তার কাছে কেউ কখনো ভালোবাসা চায় নি । ফেলে দেয়া জিনিস হিসাবেই সবাই তাকে লুটেপুটে খেয়েছে । আমি লিখতে চাই সাজিয়ার ভালোবাসার গল্প, নিজের ইচ্ছেমত জীবনটাকে উপভোগ করার গল্প ।
আমার ইচ্ছেগুলো হেরে যায় আসল ঈশ্বরের দুর্দমনীয় নিষ্ঠুর ইচ্ছেগুলোর কাছে । রঙ–তুলি-পেন্সিলের পরাজিত ঈশ্বর হয়ে বেঁচে থাকাই লেখকের অমোঘ নিয়তি ।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই নভেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৩:৪২