সূতপা'র আহ্লাদিপনা হঠাৎ কোন দিন মাত্রা ছাড়িয়ে যায় । এরকম যে প্রতিদিন ঘটে তা নয় । অনেকদিন পর দেখা গেল কোন এক ঝলসানো দুপুরে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়বে গায়ের উপর । আচমকা চুমু খাবে কিংবা পেছন থেকে চুল ধরে দিবে হ্যাচকা টান । দুষ্টু মিষ্টি কথা বলে চারপাশের পরিবেশ মাতিয়ে রাখবে সেদিন । কালো মোটা চশমার রাশভারি চরিত্রের আড়ালে জেগে উঠবে অন্য নারী ।
সূতপা'র আহবান উপেক্ষা করার মত নয় । ও যে দিন আগ্রহী হয়ে উঠে, ঠিক ঠিক ষোলআনা আদায় করে নেয় । কোন পুরুষের এই খেলা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়ার সুযোগ নেই । আমি সূতপাকে গভীর আবেগে কাছে টেনে নিই । সূতপাও নিজেকে মেলে ধরে, ভালোবাসার সুখ স্পর্শে নিজেকে বিলিয়ে দেয় আমার যেমন খুশি ইচ্ছের কাছে ।
সূতপা আমার স্ত্রী, ভেরি স্মার্ট এন্ড কিউট লেডি । সূতপা জীবনে আসার পর থেকেই আমার ক্যারিয়ার গ্রাফ দ্রুত উপরে উঠতে থাকে । হতাশায় নিমজ্জিত আমি সূতপার হাত ধরেই জীবনে ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছি । এক্সিকিউটিভ হিসাবে জব শুরু করে এখন আমি মার্কেটিং ম্যানেজার । সূতপাও একটা মুঠোফোন কোম্পানীতে মিড লেভেল জব করে । দুজনেই ক্যারিয়ারিস্ট, তাই একটা আপোষের ভিতর দিয়েই আমাদের জীবনটা এগিয়ে চলেছে । কেউই কাঊকে নিয়ে ঘাটাই না, ঘাটাঘাটি করে পাঁকে পড়ে থাকতে হয় । আমাদের এইম ইন লাইফ, প্রতিষ্টানে সমাজে উঁচু পদে থাকা । তাই সূতপা যখন আমার পিএস সিমি কে নিয়ে খোঁচা দেয়, সিমির উত্থিত যৌবন নিয়ে রসালো ইংগিত করে- দুজনের সম্পর্কের বাঁধনটাকে তা কখনোই অতিক্রম করে যায় না ।
সিমি বছর দুয়েক ধরে আমার পিএস হিসাবে আছে । নিজেকে উত্থিত যৌবনা হিসাবে প্রকাশ করার জন্য যা করা সম্ভব সবই করে । ড্রেস আপে সে কখনই স্থুল নয়, বরং সুক্ষ ভাবে নিজের ফিগার আর শরীরের সংবেদনশীল বাঁক গুলো প্রকাশ করাকে সিমি শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে । প্রথমে চুপচাপ রিজার্ভ একটা ইমেজে নিজেকে প্রতিষ্টা করার চেষ্টা করলেও এখন সে আমার সাথে যথেষ্ট খোলামেলা । দৃষ্টি দিয়ে ভোগ করার পুরো অধিকারই সিমি আমায় দিয়েছে । নিঃশ্বাসের উঠানামার সাথে তার বুকের প্রতিবার দুলে উঠা যখন আমি ভোগ করি, রহস্যময় এক হাসিতে ছুঁয়ে যায় সিমির মুখ । সে হাসিতে প্রণয়ের আহবান স্পষ্ট হলেও এর বেশি আমি এগুইনা । ভীতু কোন কালেই ছিলাম না, তবে আমি পাঁড় ক্যারিয়ারিস্ট । আমার ক্যারিয়ার গুরুজনেরা আগেই বলে দিয়েছেন, প্রাইভেট সেক্রেটারি আর গাড়ির ড্রাইভার হলো মালিক পক্ষের ফাঁদ । এদের কখনই বিশ্বাস করবে না । আমার স্মুথ ক্যারিয়ারে আমি কোন স্পট রাখতে চাইনা । সিমির উত্থিত বুকের অশান্ত উর্মিমালা তাই আমার কাছে ক্যালেন্ডারে ঝুলে থাকা মুক্তবক্ষ যৌবনবতি নারীমূর্তি ছাড়া কিছুই নয় ।
মার্কেটিং ম্যানেজার হিসাবে আমার কাজ কোম্পানীর মান্থলি আর ইয়ারলি সেলস টার্গেট এচিভ করা, যা আমি ভালভাবেই করি । এটা এচিভ করার জন্য ম্যানেজারদের মূল অস্ত্র ‘পিক এন্ড ফায়ার’ পলিসি । যে তোমাকে টার্গেট করে দিচ্ছে তাকে তুমি খুশি কর আর যে পারেনা তাকে ছুড়ে ফেলে দাও । কিন্তু আমার ট্রেনিং গুরু রবার্ট ব্রাউনি শিখিয়েছেন অন্য জিনিস । সেলস ম্যানদের কাছে টেনে নাও, তাদের কাঁধে তোমার স্পর্শ দাও । ওরা যখন তোমাকে বিশ্বাস করবে, তোমার উপর আস্থা রাখবে- তুমি যাই টার্গেট দাও তা এচিভ করে দিবে । টাকা-প্রমোশনের চেয়েও স্যালস ম্যানের কাছে বড় মোটিভেশন বসের পারসোনাল টাচ, যা একই সাথে কাজের পরিবেশকেও নির্মল রুপ দেয় । সেলস টীমকে মোটিভেশনের ক্যাপস্যুল খাইয়ে আমি দিব্যি টার্গেট এচিভ করে চলেছি । ইনসেন্টিভ-বোনাস কম দিলেও আমি ওদের রোজ মোটিভেশন দিই । রিজিওনাল এবং ডিস্ট্রিক ম্যানেজারদের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপ করি, ওদের পারিবারের খোঁজ খবর নেই । আর এতে সেলসের পাশাপাশি কোম্পানীর প্রফিটেবিলিটি বেড়ে গিয়ে আমার ক্যারিয়ার পাথওয়ে আরো স্মুথ হয়ে যায় । সেলস কলিগ ছাড়াও কোম্পানীর ইন্টারনাল এবং কর্পোরেট স্টেকহোল্ডারদের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্ল্যানিং-অরগানাইজিং নিয়ে কথা বলার ব্যস্ততার মাঝে দিন পার হয়ে যায় ।
সেলস কলিগদের সাথে মোটিভেশনাল কমিউনিকেশন সেশন অফিস থেকে বাসা অবধি চলতে থাকে । বাসায় এসেও ওদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কথা বলতে হয়, ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশনে ডিশিসান দিতে হয় । বাচ্চা দুটো এসে মাঝে মাঝে বায়না ধরে, বাপী এটা দিতে হবে! ওখানে যেতে হবে! বাচ্চাদের প্রয়োজনের দিকে আমাদের দুজনেরই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি । কারণ যা কিছু করছি সবই ওদের ভবিষ্যতের জন্য । সূতপা’র করিতকর্মা মা অবশ্য আমাদের কাজ আরো সহজ করে দিয়েছেন, ঊনার পরিচিত একজন মিস্ট্রেসকে বাচ্চাদের দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে । ভদ্রমহিলা আমাদের সঙ্গেই থাকেন এবং বাচ্চাদের দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করে চলেছেন । সূতপা’র শিফটের জব, সপ্তাহে তিনদিন ডে, বাকি তিনদিন ইভেনিং শিফট । সূতপা’র যখন ইভেনিং ডিউটি থাকে আমি তখন বাসায় পুরোদমেই অফিস চালাতে পারি । ডে-ডিউটির দিনেও তেমন একটা সমস্যা হয় না । বাসায় থাকলে সন্ধ্যার পর থেকেই সূতপা ল্যাপ্পীতে সামাজিক যোগাযোগ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে । কাদের সাথে তার এই আত্মমগ্ন নিবিড় যোগাযোগ, তা নিয়ে না ভাবাই আমাদের সুখি সংসারের গোপন মন্ত্র । তাছাড়া সূতপা ফেসবুকে ব্যস্ত থাকে বলেই আমিও নির্বিঘ্নে আমার অফিসের কাজ বাসায় বসে করতে পারি ।
হাল আমলের এইসব সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোকে দু’চোখে দেখতে পারি না । মানুষের কাজের স্পৃহাকে নষ্ট করে দিয়ে অলস বানিয়ে দেয় এই সব সাইট । যখন একজনের ক্যারিয়ার ডেভলাপমেন্টের দিকে কেয়ারিং হওয়া উচিত, তখন সে এসব আজে বাজে সাইটে ঘুরে বেড়ায় । আমি আগে মাঝে মাঝে ঢুকতাম । বিরক্তিকর লাইক-পোকিং, সাথে স্কুলমেটদের পূনর্মিলনি, কলেজ-ভার্সিটির এলামনাই- কি হবে এসব করে! সেই স্কুল লাইফে গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় পড়তে এসেছি, আর কখনো পেছনে ফিরে তাকাইনি । কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় জীবন কাটিয়েছি, কোন শিকড় না গেড়েই । শিকড় গাড়লে এক জায়গায় পড়ে থাকতে হয় । এজন্য হয়ত কোথাও বন্ধুবান্ধব তেমন জোটেনি, কিন্তু এটা নিয়ে কোন খেদও নেই । জীবনে সামনে এগিয়ে যেতে হয় । আমার কাছে ক্যারিয়ার করাই বড় কথা । আমার অর্গানাইজেশনে আমি একদিন কান্ট্রি ম্যানেজার হব, ক্রমে এশিয়া-প্যাসিফিকের সিইও হওয়া আমার চুড়ান্ত স্বপ্ন ।
আমার নিজের তেমন ঘনিষ্ট বন্ধুবান্ধব না থাকলেও আমাদের পারিবারিক বন্ধু আছে । সূতপা’র সবচেয়ে প্রিয় দুই বান্ধবী রাশা আর সোহেলী, ওরা আবার সূতপা’র কলিগও । এই তিন বান্ধবীর সৌজন্যে আমরা তিন বন্ধু পরিবার । সম্পর্কের ঘনিষ্টতা এতই যে মনে হয় একই পরিবার । প্রতি মাসেই কারো না কারো সৌজন্যে পার্টি হয় । মাঝে মাঝে আমরা দলবেঁধে ক্লাবে নাইট পার্টিতে এটেন্ড করি, নিজেদের বৌদের কোমড় জড়িয়ে নাচি । পৃথিবী শুদ্ধ লোকেদের দেখাতে চাই, দেখ আমরা কত সুখি! নেচে গেয়ে ক্লান্ত হয়ে হার্ডড্রিন্কস পান করি, পরষ্পরের সুস্বাস্থ্য কামনা করে । রাশা আর সোহেলীর হাজবেন্ড প্রায়ই হ্যাং আউট হয়, ওদের স্ত্রীরা তখন ধরে টরে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তোলে । তারপর কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলবে, আগেই বলেছি ওসব ছাইপাশ খেয়োনা! আমি আর সূতপা হালকা বিয়ার খাই । সূতপা হ্যাং আউটের ভয়ে হুইস্কিতে চুমুক দেয় না কিনা আমি জানি না । তবে আমি খাইনা আমার ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা করে । একজন মার্কেটিং ম্যানেজারকে চব্বিশ ঘণ্টা তার জব নিয়ে ভাবতে হয় । হ্যাং আঊট হওয়া স্মুথ ক্যারিয়ারের জন্য মোটেই ভাল কাজ নয় ।
সূতপা তার বান্ধবীদের সাথে এতটাই ঘনিষ্ট যে, আমার পিএস সিমি কে নিয়ে খোঁচাখুঁচি ওর বান্ধবীরাই আগে শুরু করে । সূতপা প্রথমে খুব ভাব ধরে, করুক না! যা খুশি করুক! আমি তো ওকে পুরো স্বাধীনতা দিয়ে ছেড়ে দিয়েছি! তারপর আস্তে আস্তে তার গলায় ঝাঁঝ বাড়বে । জানি তো, অফিসে তার কি কাজ খুব ভালই জানি! সিমির বুবসের ভিতর মুখ ঢুকিয়ে রাখাই হল তার কাজ! সূতপার কথা শুনে তার বান্ধবীরা হিহি করে হেসে উঠে । আর আমি মাথা নিচু করে সত্যি সত্যি সিমির বুকের সুতীক্ষ্ণ ধার মাপার চেষ্টা করি । আমাদের এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মাঝে কোনকিছুই গোপন থাকে না । সবচেয়ে ভয়ংকর যে তথ্যটি সূতপা এদের কাছে ফাঁস করেছে, সেটা সে সবার কাছে বেশ রসিয়েই বলে । সূতপা বলে, ‘আগে জানতাম দুনিয়ার বড় বড় আবিষ্কারের ধারণা মানুষ পায় বাথরুমে বসে, আর সৈকত তার মার্কেটিংয়ের ইনোভেটিভ আইডিয়া আর টিপস আবিষ্কার করে সহবাসের সময়!'
আমরা শুধু ঢাকায় আড্ডা দেইনা, তিন পরিবার মিলে ঢাকার বাইরেও বেড়াতে যাই । বিশেষ করে রোজার ঈদে ঢাকার বাইরে কোন রিসোর্টে কয়েকদিন থেকে আসি । আড্ডা দেই, মজা করি আর স্পেশাল বারবিকিউ নাইট উদযাপন করি । তিন পরিবারের বাচ্চাদের মাঝেও প্রগাঢ় বন্ধুত্ব । কোরবানীর ঈদে সাধারনত দেশের বাইরে যাওয়া হয় । অফিস থেকে ইয়ারলি ফরেন ট্যুর পাই । এই সুযোগে পরিবার নিয়ে কোথাও থেকে ঘুরে আসি । আসছে কোরবানীর ঈদে ভুটান যাচ্ছি । সূতপা আর আমাদের ছেলেমেয়ে জিহান-রাহী ভুটান ট্যুরের উত্তেজনার আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে আছে ।
ভুটান যাওয়ার আগে মা'কে একটা ফোন করা দরকার, কোরবানীর টাকা-পয়সা বাড়িতে পাঠাতে হবে । মা'কে ফোন দেয়া একটা যন্ত্রনা, শুধু বলবে কবে বাড়ি আসবি? আরে বাবা, বাড়িতে আমার কি কাজ? টাকা-পয়সা যখন যা লাগে সেতো পাঠাচ্ছিই । কত করে বলি, মা শুধু শুধু গ্রামে থেকে কষ্ট করছ কেন, আমার কাছে চলে আস । মা কিছুতেই আসবে না, গ্রামে থেকে একা একা কষ্ট করবে তবু আসবে না । যদিবা গাড়ি পাঠিয়ে কখনো ঢাকায় আনি, দুদিন পরেই যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে যাবেন । মা আমাদের বাসায় আসলে সূতপাও খুশি হয়, যদিও এই খুশি কতটুকু শ্বাশুরির প্রতি ভালোবাসায় আর কতটুকু বাচ্চাদের জন্য এক্সট্রা একজন কেয়ারটেকার পাওয়ায়- আমি নিশ্চিত নই ।
মা'কে ফোন করতেই সেই একই কথা, এবারও আসবি না? কত বছর হলো তুই বাড়ি আসিস না, তোর কি একবারের জন্য বাপ-দাদার ভিটেমাটি দেখতে মন চায় না! ভুটানে বেড়াতে যাওয়ার কথা মা'কে বলি । আরো বলি পরেরবার অবশ্যই যাব । মা পরিষ্কার কন্ঠে জানিয়ে দেন, তোরা বাড়ি না আসলে কোন টাকা-পয়সা পাঠানোর দরকার নাই । এটা শোনে আমি বিব্রত বোধ করি, কথা না বাড়িয়ে সূতপার দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিই । সূতপা কিছু সময় আলাপ করে ফোন রেখে দেয় । আমার দিকে তাকিয়ে বলে, আমরা বাড়ি যাব না শুনে মা কাঁদছেন ।
অফিসে ঈদের বন্ধের আগে কাজের খুব চাপ যাচ্ছে । মাসের সেলস টার্গেটের আশি ভাগ বারো তারিখের ভিতরে করতে হবে । এটা করার জন্য স্পেশাল সেলস প্রমোশন অফার করা হয়েছে । ম্যানেজারদের সাথে নিয়ে ডিরেক্টরস আর সিইও স্যারের সাথে জরুরী মিটিং চলছে । সিইও স্যারের একটাই কথা, মনিটরিং বাড়াও! টার্গেট এচিভ না করে কোন কলিগ যেন বাড়ি না যায় । মিটিংয়ের মাঝে আমার নিজের বাড়ির কথা মনে পড়ে, কানে বাজছে 'মা কাঁদছেন'!
অফিসের এডমিন সেকশন থেকে জানানো হয়, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজে ঈদের আগের দিন ভুটানের টিকেট কনফার্ম করা হয়েছে । আমাদের ট্যুর অপারেশন গাইডের পক্ষ থেকে একটা ব্রুসিয়ার এসেছে, ট্যুরে সাথে কি কি নিতে হবে সেটার বিস্তারিত গাইডলাইন । গাইডলাইনের পয়েন্টগুলো মনযোগ দিয়ে পড়ছি, হঠাৎ লেখাগুলো অস্পষ্ট হয়ে আসে । কানে বাজছে, 'মা কাঁদছেন'!
কড়া মনিটরিং আর ঈদ বোনাস আটকে দেয়ার হুমকি কাজে লেগেছে । সেলস টীম ঈদের আগেই বেঁধে দেয়া টার্গেট এচিভ করেছে । ছুটির আগে অফিসের শেষদিন তাই অনেকটা ফুড়ফুড়ে মেজাজেই কাটলো । সবাই ঈদের আগাম শুভেচ্ছা আর ভুটান ট্যুরের শুভকামনা জানিয়েছে । আগে আগেই বাসায় ফিরেছি, রাতের ভিতরে লাগেজ গোছাতে হবে । কাল দুপুরে ভুটানের ফ্লাইট । বাসার আসার পরই সূতপা জিজ্ঞেস করে, তোমাকে এমন বিমর্ষ লাগছে কেন? আমি 'কিছু না' বলে এড়িয়ে যাই । সূতপা আরো চেপে ধরে, মায়ের সাথে কথা বলছ না কেন? মা'কে কষ্ট দিয়ে বাইরে যাওয়া কি ঠিক হবে?
সূতপা'র কোন কথাই যেন আমি শুনতে পাচ্ছি না । আমার কানে কেবলই বাজছে, 'মা কাঁদছেন'! জিহান-রাহী আমার কাছে এসে দাঁড়ায়, বাপী এনিথিং রং? তোমার মন খারাপ কেন? জিহানের কথার কোন উত্তর দিই না, ওদের দুজনকে জড়িয়ে ধরি । সূতপা কাছে এসে আমার কাঁধে হাত রাখে, 'গত পাঁচ বছর বাড়ি যাওয়া হয় না, আগে মা কোনদিন এত মন খারাপ করেনি, কাঁদেনি । আমার নিজেরই খুব খারাপ লাগছে'!
ঈদ উপলক্ষে ড্রাইভার আগেই ছুটি নিয়েছে, তাই নিজেই ড্রাইভ করছি । আমার পাশে জিহান, পেছনে সূতপা আর রাহী । গাড়ী নতুন ফ্লাইওভার দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে । না আমরা এয়ারপোর্টে যাচ্ছি না, যাচ্ছি গ্রামের বাড়িতে । গাড়িতে একটা চাপা নীরবতা, সবাই চুপচাপ । ভুটান ট্যুর মিস হওয়ার ডিপ্রেশন এখনো আমাদের কাটেনি । তবে সিদ্ধান্ত আমরা সবাই মিলেই নিয়েছি, জিহান-রাহীও খুশি মনে রাজী হয়েছে দাদু বাড়ি যেতে । চার ঘন্টা বিরামহীন চলার পর অবশেষে আমরা আমাদের জেলা শহর ছাড়িয়ে গ্রামে যাবার রাস্তায় চলে এসেছি ।
আমাদের এলাকাটা নিচু, রাস্তার দুই পাশের দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ এখনো শেষ বর্ষার পানিতে থৈ থৈ করছে । আমন ধানের গাছগুলো বাতাসে দুলছে । একটা মিষ্টি গন্ধ এসে লাগছে নাকে, গন্ধটা আমাকে নস্টালজিক করে দিচ্ছে । অনেক বছর পর যেন ফিরে চলেছি আমার শৈশবের পথে । দুপাশের বিস্তৃত সবুজ দেখে জিহান অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, বাপী পানিতে সবুজ এগুলো কি? আমি উত্তর দেই এগুলো ধান গাছ, আমন ধান । জিহান বোকার মত বলে উঠে, আমি তো ভেবেছিলাম ধান গাছ অনেক বড় হয় । জিহানের বোকা বোকা কথা শুনে সূতপা আর রাহী হেসে উঠে । সূতপা বলে, কেন বাবা! তুমি প্যাডি চিনো না! তুমি তো প্যাডি ফিল্ডের ছবি আঁকো? জিহান বলে, এটা প্যাডি ফিল্ড! প্যাডি ফিল্ড না গোল্ডেন হয়! আমরা আবার হাসি । তারপর ওকে বুঝিয়ে বলি, ধান যখন পেকে যাবে তখন পুরো মাঠ সোনালী রঙে ভরে যাবে ।
আমাদের বাড়ির ভিতরে গিয়ে গাড়ি থেকে নামি । গাড়ির শব্দ পেয়েই মা ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন, সৈকত আসছিস! হ্যাঁ মা, বলেই আমি গাড়ির ব্যাককভার খুলে জিনিসপত্র বের করতে লেগে পড়ি । সূতপা এগিয়ে গিয়ে মা'কে সালাম করে । জিহান-রাহী কিছুক্ষন অবাক হয়ে মায়ের দিকে থাকিয়ে থাকে । মা কাছে ডাকতেই দুজন গিয়ে মা'কে জড়িয়ে ধরে । আমি আড়চোখে মায়ের সাথে আমার পূত্র-কণ্যার জড়াজড়ি দেখি । নাকে একটা সোঁদা গন্ধের ঝাঁঝ আমাকে পাগল করে তুলে । এ গন্ধ আমার খুব পরিচিত, এ গন্ধ আমার মায়ের শরীরের । কর্পোরেট ব্যস্ততা, ক্যারিয়ার লিফ্টিং আর মডার্ণ লাইফস্টাইল সব কিছু পেছনে ফেলে আমি আমার মায়ের শরীরের ঘ্রান শুঁকি । আমার পূত্র-কণ্যা নয়, যেন আমিই জড়িয়ে ধরেছি আমার মা'কে, পরম মমতায় ।
********************সমাপ্ত******************
প্রিয় 'স্বপ্নবাজ অভি'র মা'কে নিয়ে কিছু লেখার আহবানে আমিও শামিল হলাম ।