ঊনবিংশ শতাব্দির মধ্যভাগ থেকেই বাংলা কথা সাহিত্যের পথচলা শুরু । বন্কিম-রবীন্দ্র-শরৎ সহ অনেক খ্যাতিমান লেখকের হাত ধরে এই কথা সাহিত্য আজ একটি সমৃদ্ধ এবং শক্তিশালী পর্যায়ে উপনীত হয়েছে । এই সময়ে লেখকেরা শত শত চরিত্র তৈরি করেছেন, যাদের মাঝে অনেক চরিত্রই পাঠকের কাছে ব্যাপক গ্রহনযোগ্যতা পেয়েছে । আমি এইরকম কিছু জনপ্রিয় চরিত্রের লুলিয় বৈশিষ্ঠ নিয়ে কিন্চিত আলোকপাত করিবো । 'লুল' শব্দটাকে 'রসিক প্রেমিক' 'রসিক বা মজার মানুষ' এই সব পজিটিভ অর্থে দেখার জন্য অনুরোধ রইলো । আর শুরুতেই অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রতি ক্ষমা প্রার্থনা করে নিচ্ছি, কারন আজকে তার দুটি অমর চরিত্র 'শ্রীকান্ত' আর 'দেবদাস' এর লুলিয় ব্যবচ্ছেদ করিবো ।
শ্রীকান্ত :
শ্রীকান্তের তখন কিশোর বয়স, যৌবনের তেজ এবং দৃঢ়তা না আসিলেও দম্ভ তাহার ঠিকই হাজির । আর ইন্দ্রের মত দুঃসাহসিক বন্ধু জুটিলে কাহার না সাহস বেড়ে উঠে । সেই সাহসের তোড়ে কুলত্যাগী 'অন্নদা' দি'র প্রেমের মায়ায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যায় কিশোর শ্রীকান্ত । যাইহোক শেষপর্যন্ত সেটা শুধু মায়াতেই আবদ্ধ থাকে । যদিও পরে অনেকবারই শ্রীকান্ত তার ভালোবাসার প্রথম মানুষটির কথা মনে করেছে, তার অন্য প্রেমিকাদের নামের সাথে সাথে অন্নদা'র নামটিও উঠে এসেছে ।
প্রথম যৌবনে শ্রীকান্ত যাহার প্রেমে মজিলেন তিনি পাটনার নামকরা বাঁইজী, পিয়ারী । শ্রীকান্ত কোন এক রাজকুমারের শিকারের অনুগামী হয়ে জংগলে তাবু গেড়েছিলেন । সেখানেই কোন এক ক্ষনে বাঁইজীর সাথে পরিচয় । অত:পর আবিষ্কৃত হলো এই বাঁইজী তার কৈশোরের পরিচিত রাজলক্ষী । রাজলক্ষী মামার বাড়িতে আশ্রিতা ছিলো । বালকবেলায় শ্রীকান্ত অষ্টমবর্ষীয়া সুশ্রী অনাথ বালিকাটিকে জোড় করে কাঁটাবনে পাঠিয়ে বঁইচি ফলের মালা গাঁথিয়ে আনিত । কোন এক শুভদিনে বালিকাটির বিয়ে হয়ে যায় এবং তাহার কিছুদিন পর খবর রটিয়া যায় সে যক্ষায় মারা গিয়েছে । আসলে রাজলক্ষী স্বামী পরিত্যক্তা হয়ে মামাকে দিয়ে রটিয়ে দেয় সে মারা গিয়েছে । ইত্যবসরে জনৈক বাঁইজীর আশ্রয়ে দীক্ষা নিয়ে নিজেই নামডাক করে ফেলে । তো রাজলক্ষীর সাথে শ্রীকান্তের পরিচয় হওয়ার পরেই পাশার দান উল্টিয়া যায় । মানে এবার শ্রীকান্ত একজন অনাথ বামুন আর ধনবতী-রুপবতী রাজলক্ষী পাটনায় তার খাসমহলে তাকে নিয়ে গিয়ে রস-রঙপূর্ণ জীবন অতিবাহিত করা শুরু করে । শ্রীকান্তও এই সুযোগে বাঁইজীর ভালবাসা-অনুগ্রহ-কৃপা-আহলাদ পেয়ে ধন্য ধন্য করছিলেন । কিন্তু এই মধুসময় তার কপালে বেশি সইলোনা, রাজলক্ষী একদিন রেগে শ্রীকান্তকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন । মনের দুঃখে সে বর্মামুল্লুকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় । এই খবর পেয়ে লক্ষী পূনরায় তার সাথে দেখা করেন । "বড় প্রেম শুধু কাছেই টানেনা, গাছেও তুলে" ।
বিদায় পর্বে দুজনের আলাপ,
পিয়ারী ঘাড় নাড়িয়া বলিল, 'নেবে আমাকে সংগে ?' এই কথা শুনিয়া শ্রীকান্তের বুক ফাটিতে লাগিলো । বলিলো, 'তোমাকে সংগে নিতে পারিনে বটে, কিন্তু যখনি ডাকিবে তখনি ফিরে আসবো । যেখানেই থাকি চিরদিন আমি তোমারই থাকবো রাজলক্ষী ।'
শ্রীকান্তের কলিকাতা হইতে রেংগুনের পথে জাহাজযাত্রা শুরু হইলো । সেই জাহাজ আবার ঝড়ের কবলে পড়ে যাত্রীসমেত মালামাল উল্টাইয়া দিলো । সেই উলট-পালটের মধ্যে এক নারীর সাথে তার পরিচয়- অভয়া । অভয়ার স্বামী কয়েক বৎসর পূর্বে বর্মায় এসে নিরুদ্ধেশ হয়ে যান, তাকে খুজে বের করার জন্যই তিনি একাকী রেংগুন যাচ্ছেন । তো হয়ে গেলো, তার স্বামীকে খুজে দেয়ার দায়িত্ব শ্রীকান্ত নিজের কাঁধে নিয়ে নিলো । রেংগুনে পা ফেলার আগেই তিনি অভয়ার প্রতি ব্যপক দুর্বলটা অনুভব করতে থাকেন । রেংগুনে পৌছে শ্রীকান্ত নিজের জন্য চাকরি-বাকরি না খুজিয়া অভয়াকে নিয়ে পড়ে থাকলেন । পরে খবর পাওয়া গেলো অভয়ার স্বামী এক বর্মী মহিলাকে বিয়ে করে সুখে দিনাতিপাত করিতেছে । কাজেই শ্রীকান্ত বাবুর জন্য রাস্তা আরও পরিষ্কার হয়ে গেলো, তিনি খুশি মনেই একই গৃহে অভয়াকে নিয়ে দিন যাপন করিতে লাগিলেন । এরই মধ্যে বংগদেশ হইতে রাজলক্ষীর একখানা চিঠি বর্মামুল্লুকে আসিয়া পৌছাইলো । একজন স্বামীপরিত্যক্তা তেজী মহিলাকে আশ্রয় দেয়ার পরিবর্তে তিনি রুপবতী-ধনবতী রাজলক্ষীর আঁচলে মাথা গোজাতেই বেশি আকর্ষন বোধ করলেন । অভয়ার কান্নাভেজা চোখের আকুতি উপেক্ষা করে তিনি রেংগুন হইতে পূনরায় কলিকাতায় পদার্পন করিলেন ।
এবার শুরু হলো রাজলক্ষী-শ্রীকান্তের প্রেমের দ্বিতীয় পর্ব । এবার পিয়ারী আরও নিঃস্বার্থভাবে তার প্রেমিককে ভালোবাসা দান করতে থাকেন । রাজলক্ষীর রসের ধারা আকন্ঠ পান করে শ্রীকান্তের লুলামী ভালই চলছিলো । বিভিন্ন তীর্থস্থান দর্শনের নাম করে তারা মূলত গরুর গাড়ীতে করে লং ড্রাইভে বাহির হইতেন । কিন্তু মুশকিল হয়ে গেলো তীর্থস্থান ঘুরে ঘুরে রাজলক্ষীর এক পর্যায়ে ধর্মপ্রীতি বেড়ে যায় । মেরুদন্ডহীন শ্রীকান্ত তবু চেষ্টা করে গিয়েছেন রাজলক্ষীর আঁচলে আরো কিছুদিন নিশ্চিন্তে প্রেমলীলা চালিয়ে যেতে । কিন্তু অকর্মণ্য শ্রীকান্ত তার কাছে নিতান্ত বোঝা হয়ে গেলেন । যদিও ভালোবাসার আগুন রাজলক্ষীর হৃদয়ে তখনো ধিকিধকি জ্বলছিলো । রাজলক্ষীর শেষ চিঠি শ্রীকান্তকে,
"ফুলের বদলে বন থেকে বঁইচির মালা গেঁথে কোন শৈশবে তোমাকে বরণ করেছিলুম, সে তোমার মনে নাই । কাঁটায় হাত বয়ে রক্ত ঝড়ে পড়তো, রাঙামালার সে রাঙা রঙ তুমি চিনতে পারোনি । বালিকার পূজার অর্ঘ্য সেদিন তোমার গলায় তোমার বুকের 'পরে রক্তলেখায় যে লেখা এঁকে দিতো সে তোমার চোখে পড়েনি । ... আমাকে জানো বলেই জানিয়ে দিলুম, যে সূর্য অস্ত যাবে তার পূণরোদয়ের অপেক্ষায় বসে থাকার আর সময় হবেনা । ইতি_ রাজলক্ষী ।
আশ্রয়-ভালোবাসা সব হারিয়ে এবার শ্রীকান্ত পুরোপুরি সন্যাষব্রত নিলেন বোষ্টম ধর্মে । কিন্তু এখানেও তিনি কবিতা আর বৈষ্ণব রস-চর্চায় কিন্চিত বিভ্রান্ত । উপলক্ষ কিছুদিনের ভিতরেই জুটে গেলো, সকল বোষ্টমীর সেরা বোষ্টমী- কমললতা । বয়স ত্রিশের বেশী নয়, শ্যামবর্ণ আঁটসাট ছিপছিপে গড়ন । লুল শ্রীকান্ত তাহাকে প্রথমবারের মত দেখেই আশ্চর্য হয়ে গেলেন । তার মনে হলো এই নারীর চোখ-মুখের ভাব-ভংগী যেন তার পরিচিত । তো হয়েই গেলো.. চুপিসারে শুরু হলো গঁোসাইয়ের সাথে বোষ্টমী কমললতার নতুন প্রেমপর্ব । "চন্ডীদাস বাণী শোন বিনোদিনী পীরিতি না কহে কথা/ পীরিতি লাগিয়া পরাণ ছাড়িলে পীরিতি মিলায় তথা.." এইভাবে কমললতার প্রেমে পুরোপুরি মজিয়া গেলেন শ্রীকান্ত । এরই মাঝে আবারও রাজলক্ষী উপস্থিত, সুতরাং কমললতার কাছ থেকেও এবার বিদায় নেয়ার পালা ।
আর এভাবেই একে একে অন্নদা, রাজলক্ষী, অভয়া, কমললতা'র সাথে লাগাতার প্রেমে মজে শ্রীকান্ত বাংলা সাহিত্যের সেরা লুল নায়কের স্বীকৃতি আদায় করে নিলেন ।
দেবদাস :
এখানেও শুরুটা পাঠশালা প্রেম দিয়ে । পার্বতী যেদিন প্রথম পাঠশালায় আসিলো, সেদিন থেকে দেবদাসের মনকষা অংকে ব্যাপক ভূল হইতে থাকলো । পন্ডিত মহাশয়ের কানমলা এমনকি পাঠশালা হইতে বহিষ্কারের হুমকিতে পার্বতীর মন গলিয়া গেলো । সেই থেকে পারু আর দেবদা'র ঐতিহাসিক প্রেমের শুরু । কিন্তু গুরুজনের এটা সইবে কেন ? তারা জোড় করে দেবদাসকে কলিকাতা পাঠিয়ে দিলেন । যাওয়ার বেলা দেব কিন্চিত গাঁইগুঁই করিলেও কলিকাতা যাওয়ার পর সে নতুন আনন্দে মজিয়া গেলো । এইভাবে প্রায় চার-পাঁচ বছর কাটিয়া যায়, আর পার্বতী গোপনে কাঁদিয়া চক্ষু ভেজায় ।
এইদিকে পারু বিবাহযোগ্যা হয়ে উঠেছে, তার মা এই ব্যাপারে কথা পাড়িতেই দেব'র মা হাসিয়া উড়াইয়া দিলেন । ইহাতে পারু'র বাবা প্রচন্ড অপমান বোধ করিয়া দোজেবরে এক বুড়ো ধনবানের সাথে তাহার বিবাহ ঠিক করিলেন । সব শুনিয়াও দেবদাস রহস্যজনক ভাবে নির্লিপ্ত থাকিলেন । রাতেই চুপিসারে পারু এসে হাজির হয় দেব'র ঘরে । দেব লোকলজ্জার ভয়ে অস্থির হয়ে পড়ে এবং লক্ষী ছেলেটির মত জানিয়ে দেয় মা-বাবার ইচ্ছের বাহিরে তাহার কিছুই করার নেই । সেদিন সকালেই দেব কলিকাতা চলিয়া যায় । কিন্তু কলিকাতা পৌছাইয়া পারু'র জন্য দেবদাসের হৃদয়ে ব্যাপক মোঁচড় মারিতে থাকিলে সে আবার বাড়ি ফিরিয়া আসিলো । গোপনে জলের ঘাটে পারু'র সাথে দেখা করিয়া তাহাকে বিয়ের অভিপ্রায় জানায় । কিন্তু পারু আর কিছুতেই রাজী হয়না । উত্তেজিত দেব তখন বড়শীর বাঁট দিয়ে আঘাত করে পারু'র কপালে চাঁদের কলংক আঁকিয়া দেয় । (বড়শীর বাঁটের বদলে এখন বংগদেশীয় পুরুষ পুংগবরা সহজলভ্য এসিড ব্যবহার করিয়া থাকে !)
দেব পারু'কে ফেরাতে না পেরে কলিকাতা ফিরিয়া যায় । সেখানে বন্ধু চুনীলালের উৎসাহে রাম-হূইস্কি ইত্যাদি সহযোগে সুন্দরী নর্তকী চন্দ্রমুখীর আসরে হাজিরা দিতে থাকে । চন্দ্রমুখী ক্রমশ দেব'র প্রতি দুর্বলতা বোধ করিতে থাকে । আহা চন্দ্রমুখী, একদিন বিষন্নমুখে চাহিয়া সভয়ে বলিলো,
চন্দ্রমুখী- দেবদাস, আর খেয়োনা ।
দেবদাস- কেন ?
চন্দ্রমুখী- অত সইতে পারবে না ।
দেবদাস- সহ্য করব বলে মদ খাইনে, এখানে থাকবো বলে শুধু মদ খাই ।
চন্দ্রমুখী মরিয়াছে, দেবদাসকে সে ভালবাসিয়া ফেলেছে । মদ খেয়ে খেয়ে বিড়বিড় করে করে দেবদাস ঘুমিয়ে পড়ে । আর চন্দ্রমুখী কাছে আসিয়া অন্চল ভিজাইয়া মুখ মুছাইয়া, সিক্ত বালিশ বদলাইয়া, একটা পাখা লইয়া, বাতাস করিয়া, দীপ নিভাইয়া, দ্বাররুদ্ধ করিয়া অত:পর নিজ কক্ষে প্রস্থান করে ।
এইদিকে পার্বতী বড় বাড়ি, বড় জমিদারি, বড়বড় পুত্র-কন্যা- বড় বড় সব কিছু পাইয়াও দেবদাসের জন্য গোপনে অশ্রু বর্ষন করে । আর চন্দ্রমুখী তাহার দোকানপাঠ-ব্যবসা সব চুকিয়ে দিয়ে দেব-আরাধনায় বসে । চন্দ্রমুখী বলে, "এ জীবনে ভালোবাসার ব্যবসা অনেক করেছি, কিন্তু একটিবার মাত্র ভালোবেসেছি, সে শুধু তোমাকে দেব ।" আর আমাদের দেবদাস একবার পার্বতীর কোলে, একবার চন্দ্রমুখীর আঁচলে আর একবার মদের বোতলে গলা ভিজিয়ে, এই তিন গোলকের চক্করে পড়ে পড়ে একসময় লুলীয় জীবনের ট্র্যাজিক পরিনতি বরণ করে নেয় ।
*****************************************************
সাধু রীতির সাথে কথ্য রীতি মিলে যাওয়া কোন কাকতাল নয়, নিতান্তই পোস্ট লেখকের সীমাবদ্ধতা ।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০১৩ রাত ৯:০৮