হুমায়ুনের বেশিরভাগ লেখায় তাঁর প্রথম স্ত্রী গুলতেকিন এবং সন্তান নোভা-শীলা-বিপাশা-নুহাশদের প্রতি অদ্ভুত ভালবাসা দেখতে পাই । আবার দ্বিতীয় বিয়ের পর তাঁর সাহিত্যে অভিনেত্রী শাওন ও তার দুই ছেলে নিষাদ-নিনিত'র নিয়মিত আসা যাওয়া হয় । কিন্তু প্রথম পক্ষের স্ত্রী-সন্তানরা ক্রমশ তাঁর জীবন ও সাহিত্য থেকে আড়াল হয়ে যায় ।
হুমায়ুনের মত স্পর্শকাতর মানুষ কী করে তাঁর প্রতি তার প্রিয় সন্তানদের উপেক্ষা সহ্য করেছিলেন কিংবা এই সময়ে তাঁর মনোজগতে কী খেলা করছিল, আমরা তার খুব কমই জানতে পারি । অবশেষে আমাদের কৌতুহল কিছুটা হলেও মিটিয়ে গেছেন হুমায়ুন নিজেই, ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে আমেরিকায় থাকার সময় মাত্র চার পৃস্টার একটা লেখা 'তিন ডব্লিউ'তে । তিন ডব্লিউ- হুমায়ুনের তিন কন্যার গল্প ।
"এভরি ক্লাউড হ্যাজ এ সিলভার লা্ইনিং..
আমার কর্কট রোগের সিলভার লাইনিং হলো, এই রোগের কারনে প্রথমবারের মত আমার তিন কন্যা আমাকে দেখতে দখিন হাওয়ায় পা রাখল । ঘর ভর্তি মানুষ, মেয়েদের দেখে হঠাৎ যদি আবেগের কাছে আত্মসমর্পন করে কেঁদে ফেলি, সেটা ভাল হবে না" ।
এই দিয়ে শুরু হুমায়ুনের তিন কন্যার গল্প, তিন ডব্লিউ ।
প্রথম ডব্লিউ, তাঁর বড় মেয়ে নোভা ।
নোভা কিছুদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছে, আমেরিকা থেকে পিএইচডি করেছে । নোভা সম্পর্কে বলতে গিয়ে হুমায়ুন চলে যান তার নর্থ ডাকোটার প্রবাস জীবনে । ইউনিভার্সিটি তাকে বাগান করার জন্য এক টুকরো জমি দিয়েছিল । মহা উৎসাহে হুমায়ুন কাজে লেগে গেলেন, তার সর্বক্ষনিক সংগী কন্যা নোভা । যেদিন নোভা বাগানের গাছ থেকে ছিড়ে টকটকে লাল টমেটো বালতিতে ভরছে এবং বলছে 'আই মেইড ইট', মেয়ের আনন্দ দেখে হুমায়ুন চোখ মুছলেন ।
দ্বিতীয় ডব্লিউ, মেজো মেয়ে শীলা ।
শীলা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে অনার্স ও এমএতে ইকোনমিকসে প্রথম শ্রেনী পেয়েছে । এখানেও হুমায়ুন চলে যান অতীতে, যখন শীলার বয়স ১২ কিংবা ১৩ । একবার হুমায়ুন প্রচন্ড শীতে লস অ্যান্জেলেস এর জংগলে তাবু খাটিয়ে ক্যাম্পিং করতে গেছেন পুরো পরিবার নিয়ে । গভীর রাতে শীলার কান্নার শব্দে তার ঘুম ভেংগে যায়, শীলার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল । তারপর সারারাত হুমায়ুন শীলাকে নিয়ে বাইরে বসে ছিলেন, শীলা তার কাঁধে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছিল ।
"সকালে ঘুম থেকে উঠে শীলা বলল, বাবা, তুমি একজন ভাল মানুষ ।
আমি বললাম, মা ! পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ মানুষ আছে, একজনও খারাপ বাবা নেই ।
এখন মনে হয় শীলা বুঝে গেছে- পৃথিবীতে খারাপ বাবাও আছে । যেমন তার বাবা ।"
তৃতীয় ডব্লিউ অর্থাৎ ছোট কন্যা বিপাশা'র কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই হুমায়ুন একটু মজা করে নেন ।
"বিপাশা কি বাবার জিন পেয়েছে ? হা হা হা । আমাকে পছন্দ না হলেও আমার জিন কিন্ত মেয়েকে আজীবন বহন করতে হবে!"
তারপর তিনি যথারীতি অতীতে ফিরে গিয়ে তার ছোট মেয়ে বিপাশার স্মৃতি রোমন্থন করেন । হুমায়ুন কোথাও বাইরে গেলে বিপাশা তাকে একটা হোমিওপ্যাথিক শিশি দিয়ে দিত, শিশিতে নাকি তার গায়ের গন্ধ ভরা থাকত । তার গায়ের গন্ধ ছাড়া হুমায়ুন ঘুমুতে পারতেন না ।
বিপাশা আমেরিকা থেকে সেদিনই অসুস্থ বাবাকে দেখতে এসেছে । হুমায়ুন লিখেছেন, "একবার ভাবলাম, বলি- মা, অনেক দিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি । ফিরব কি না তা-ও জানি না । এক শিশি গায়ের গন্ধ দিয়ে দাও । বলা হলো না ।"
তারপরই হুমায়ুন বলছেন,
"আমার তিন কন্যাই দূর দ্বীপবাসিনী । ওরা এখন আমাকে চেনে না, হয়ত আমিও তাদের চিনি না ।
কী আর করা ?
কে সারা সারা ।"
তিন কন্যা আর তার বড় ছেলে নুহাশ সম্পর্কে হুমায়ুনের কাছ থেকে আমরা আরও অনেক কিছুই শুনার আশা করেছি । হয়ত তিনি বলেন নি, কিন্তু কে জানে তার মনোজগতে হয়ত সবসময়ই ছিল তাঁর প্রিয় পূত্র-কন্যাদের আসা-যাওয়া ।
তাইতো শেষে আমরা দেখতে পাই, 'তিন ডব্লিউ'র পাদটীকায় তিনি আবৃত্তি করছেন 'এডগার অ্যালান পো'র এই কবিতাটি..
ফ্রম এভরি ডেপ্থ অব গুড এ্যান্ড ইল
দ্য মিষ্ট্রি হুইচ বাইন্ডস মি স্টিল
ফ্রম দ্য টরেন্ট অব দ্য ফাউন্টেন
ফ্রম দ্য রেড ক্লিফ অব দ্য মাউন্টেন
মাই হার্ট টু জয় অ্যাট দ্য সেইম টোন
অ্যান্ড অল আই লাভড, আই লাভড, আ্যালোন ।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১২ বিকাল ৩:২৫