" সে চাঁদের চোখে বুলিয়ে গেল ঘুমের ঘোর
সে প্রানের কোথায় দুলিয়ে গেল ফুলের ডোর
কুসুম বনের উপর দিয়ে কি কথা সে বলে গেল
ফুলের গন্ধ পাগল হয়ে সংগে তারি চলে গেল
হৃদয় আমার আকুল হল, নয়ন আমার মুদে এলরে
কোথা দিয়ে কোথা গেল সে..."
(কবিগুরু)
নৈশ্বঃব্দই বুঝি সবচেয়ে ভালো প্রকাশ মাধ্যম এমন ক্ষনে...
আশি-নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের নাটক তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে । ঐ সময়ে যারা দর্শক ছিলেন, তাদের চোখের সামনে আজও ঐ নাটক গুলোর ছবি আর সংলাপ ভেসে উঠে । প্রতি সপ্তাহে মংগলবারে থাকত ধারাবাহিক নাটক আর বৃহষ্পতিবারে একক নাটক । একসংগে দুইটা ধারাবাহিক চলত, এক মংগলবার একটি দেখালে পরের মংগলবার অন্যটি দেখাত অর্থাৎ প্রতিটা ধারাবাহিক নাটক দুই সপ্তাহ পর পর প্রচারের সুযোগ পেত । আর শুক্রবারে সকালে দেখাত 'মনের মুকুরে', আগে প্রচার হওয়া একক নাটকগুলোর পূনঃপ্রচার ।
ঐ সময়ে যারা দর্শক ছিলেন, মনে করে দেখুন বাংলাদেশ টেলিভিশনের নাটকে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ কিভাবে আসত । বছরে দুইবার, স্বাধীনতা দিবস আর বিজয় দিবসে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নাটক প্রচারিত হত । ঐ সব নাটকে পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী, রাজাকার-আলবদর শব্দ গুলো নিষিদ্ধ ছিল । পাকিস্থানী বর্বর হানাদারদের তখন 'ওরা' বা 'তারা' জাতীয় নিরিহ শব্দ দিয়ে চিহ্নিত করা হত । আর টিভি নাটকে রাজাকার-আলবদর জাতীয় শব্দ উচ্চারন রীতিমত দেশদ্রোহিতার শামিল বলে গন্য হত ।
আমি তখন দেশের একটা স্বনামধন্য কলেজের একাদশবর্ষীয় ছাত্র । আমাদের রাশভারী অংকের শিক্ষক খুব নিবিষ্টমনে ব্ল্যাকবোর্ডে অংক করে যাচ্ছেন, সব ছাত্র-ছাত্রী মনযোগ সহকারে পড়া বুঝে নিচ্ছে । এমন সময় আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে দুস্ট ছাত্রটি ক্লাস গ্যালারির পেছন থেকে ন্যাকা স্বরে পাখির মত করে ডেকে দিল 'তুই রাজাকার'...। অমনি যেন বোমা ফাটলো, সারা ক্লাস এমনকি আমাদের রাশভারী অংকের স্যার পর্যন্ত হেসে কুটিকুটি ।
হ্যাঁ, আমি সেই বিখ্যাত সংলাপটির কথাই বলছি, 'তুই রাজাকার' । আমাদের দেশে যখন কোথাও যুদ্ধপরাধী স্বাধীনতা বিরোধীদের নাম উচ্চারন করা যেতনা , তখন ডঃ হুমায়ুন আহমেদ তাঁর 'বহুব্রীহি' নাটকে একটা টিয়ে পাখির ঠোটে 'তুই রাজাকার' সংলাপ (গালি) টি দিয়ে এটাকে সবার কাছে জনপ্রিয় করেছিলেন । এই যুদ্ধপরাধী রাজাকার-আলবদরদের ঘৃনা করার বিষয়টি হুমায়ুন আহমেদই আমাদের প্রথম শিখিয়েছেন । তার এই সাহসী পদক্ষেপের কারনেই 'তুই রাজাকার' গালিটি তখন সারা বাংলাদেশে আপামর জনতার কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠে ।
ডঃ হুমায়ুন আহমেদের এই সাহসী পদক্ষেপ, এই রাজাকার-আলবদর বিরোধী প্রচারনা পরবর্তীতে শহীদ-জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির রাজাকার-আলবদর বিরোধী আন্দোলনে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে । আর আজকে যুদ্ধপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে পারাটা, অতীতের এই সব ধারাবাহিক আন্দোলন আর রাজাকার-আলবদরদের ব্যাপারে জনগনের ক্রমশ সচেতন মনোভাবের ফল ।
তাই ডঃ হুমায়ুন আহমেদকে শুধু একজন জনপ্রিয় সাহিত্যিক বা গল্পকার হিসাবে চিহ্নিত করাটা আমার কাছে মনে হয়, প্রকৃত হুমায়ুন আহমেদকে আড়াল করে রাখার নামান্তর ।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১২ বিকাল ৩:০৮