ফারুক হুজুর নামেই তিনি এলাকায় পরিচিত। গত পাঁচ বছর থেকে বায়তুল আমান জামে মসজিদে একসাথে ইমামতি ও মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। দীর্ঘদিন এক জায়গায় থাকার ফলে অনেকের সাথে তৈরি হয়েছে মধুর সম্পর্ক। মাঝে মাঝে ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে ঝগড়ার সুবাদে দুই-একজন আবার বিরাগভাজন ও হয়েছেন।
তবু ও এলাকায় হুজুরের দিনগুলো ভালই কাটছিল। সময় হলে আজান দেন, মানুষ মসজিদে আসে, তাদের নিয়ে জামাতে নামাজ পড়েন। রমজান আসলে তারাবীহ নামাজের দায়িত্ব ও তিনি পালন করেন। ভোর রাতে সবার আগে উঠে মসজিদের মাইকে দোয়া-দুরুদ পড়েন। সবাইকে সেহরি খাওয়ার জন্য ডাকাডাকি করেন। এই বছর রমজানের কয়েকদিন পুর্বে কমিটির সাথে কোন এক বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে ফারুক হুজুর এই মসজিদে আর থাকবেন না বলে সবাইকে জানিয়ে দেন। কিন্তু রমজান চলে আসায় এলাকার মানুষ উনাকে কমপক্ষে ঈদ পর্যন্ত থেকে যাওয়ার অনুরোধ করেন। অবশেষে তিনি সকলের আন্তরিকতার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ঈদ পর্যন্ত থাকার ওয়াদা করেন।
সব কিছুই আগের নিয়মে ঠিকঠাক চলছিল। তারাবীহ নামাজ পড়িয়ে তিনি পালাক্রমে মুসুল্লীদের ঘরে গিয়ে খানা খেয়ে আসেন, আর আসার সময় টিফিন বাটিতে করে ভোর রাতের জন্য খানা নিয়ে আসেন। রাত আড়াইটা বাজলেই মসজিদের মাইক থেকে ভেসে আসে ফারুক হুজুরের সুমধুর আওয়াজ। সবাই ঘুম থেকে উঠে সাহরির জন্য প্রস্তুত হয়ে যান।
কিন্তু আজ রাত আড়াইটা বেজে আরো বিশ মিনিট চলে গেল অথচ মাইকে কোন আওয়াজ আসছেনা। সবাই ভাবল হয়ত আজ হুজুর সময়মত জাগতে পারেন নাই। এভাবে তিনটা পনের বেজে গেল। তবু ও মাইক বন্ধ। মুসুল্লীদের অনেকেই কৌতূহল বশত তাড়াতাড়ি সাহরি খেয়ে কিছুটা সময়ের আগেই মসজিদের উদ্দেশ্য রওয়ানা দেন।
এসে দেখেন মসজিদের দরজা বন্ধ। ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে তিনটা।
আস্তে আস্তে সবাই হুজুরের রুমের দিকে এগিয়ে যান। একি! রুমের দরজা খোলা। ভিতরে বাতি জ্বলছে। কিন্তু হুজুর রুমে নেই। টিফিন বাটিটা রুমের এক কোনায় দাড়িয়ে আছে। অনেকেই মনে করলেন, হুজুর হয়ত কোন কাজে বাহিরে গেছেন। জামাতের সময় হলে চলে আসবেন। কেউকেউ হুজুরের তালাশে আশপাশ ঘুরে আসলেন। এদিকে জামাতের ও সময় হয়ে যায়। অনেকক্ষন অপেক্ষা করে মুসুল্লিরা নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে ইমাম বানিয়ে ফজরের নামাজ আদাত করে নেন। সবাই নিজ নিজ ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে।
দুই -একজনের ঘুম আসেনা। নাজানি কি হল হুজুরের? এভাবে না বলে তো চলে যাওয়ার কথা না। পরদিন জোহর-আসর-মাগরিব এভাবে তারাবীহ পর্যন্ত সবাই অপেক্ষায় থাকেন। কিন্তু হুজুর আর আসেন না। টফিন বাটিটা আগের জায়গায় পড়ে আছে। খাবার পচে দুর্গন্ধ বের হলে একজন বাটিটা ধুয়ে রুমে রেখে যান।
দশম রমজানে হঠাৎ হুজুরের বাড়ি থেকে একটা ফোন আসে। রিসিভ করার সাথে সাথেই ওপার থেকে কান্নাজড়িত কন্ঠে একজন মহিলার আওয়াজ শুনা যায়, "পুলিশের ক্রসফায়ারে মারা গেছেন আপনাদের ফারুক হুজুর"।
এলাকায় কান্নার রোল পড়ে যায়।
জংগী সন্দেহে এভাবে কত নিরাপরাধ ফারুক হুজুররা মারা যাচ্ছেন তার খবর আছে আমাদের?
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুন, ২০১৬ বিকাল ৪:১৩