ফোন জিনিসটাই আমার পছন্দ নয়, মানুষ কানের সাথে এই যন্ত্রটা সেটে তেরছা হয়ে খাম্বার মতো ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে থাকার মাঝে কি সুখ খুজে পায় কে জানে। হয়তো কথা বলার লোক নেই বলেই মুঠোফোন মাত্রেই চরম বৈরাগ্য আমার, এবং আমার সামান্য পরিচিত ব্যক্তিরাও এ কথা জানে যে কাউকে ফোন করা বা কারো ফোন ধরা এই উভয় ক্রিয়ার ওপরই আমার কিঞ্চিৎ বিতৃষ্ণা রয়েছে। তবে এতো ফোন বিদ্বেষী হওয়ার পরও আমি স্বীকার করতে বাধ্য যে কাউকে বিরক্ত করবার মাধ্যম হিসেবে মুঠোফোন নামক বস্তুটির জুড়ি মেলা ভার। সে কোন নোয়াখালীতে পুনর্জন্মপ্রাপ্ত শাইলকের অধূনা মিসড কল হোক বা কোন দোস্তরূপী দুশমন(আমার মতো

তো সেই ব্রাহ্মমুহূর্তটি কখন? আমরা এতো আজাইরা কাম করবার মতো সময় পাই কখন?? ডিং ডিং!! সঠিক জবাব - অবশ্যই পরীক্ষার সময়! বিস্তারিত জানতে অদ্রোহের পরীক্ষাবিষয়ক পোস্টটি দেখুন। সেই ১-১ এই এ মহান গৌতম বুদ্ধসমান উপলদ্ধির সূত্রপাত; পরীক্ষার চাপে চ্যাপ্টা হয়ে যখন আমাদের ক্যান্টিনের পরোটার মতো পাতলা হয়ে যাচ্ছিলাম তখনি টের পাই যে হাত উসখুস করছে, জিহবা সুড়সুড় করছে; সংকেতটা মোটেও অস্পষ্ট কিছু নয় - কোন একটা হাবিজাবি কম্মো করবার জন্য আমাদের গুরু শয়তান মাথায় হাত বোলাচ্ছেন। আমরা তেনাকে নিরাশ করি না - বুদ্ধি নিয়ে আসে বন্ধু জিসান। কেননা আমরা আমাদের ডিপার্টমেন্টের আতেল মেয়েগুলিকে ফোন করে কিঞ্চিৎ বিরক্ত করি? টেনেটুনে আদ্দেক সিলেবাসের বাছাইকৃত অংশগুলো মোটামুটি শেষ হয়েছে বলে যখন আমরা মনকে প্রবোধ দিচ্ছি তখন ঐসব মহিলা বিদ্যামহাসাগরেরা নিশ্চয়ই তাদের পঞ্চম রিভিশন শেষে আরও কোথা থেকে আনকোরা নতুন কিছু অংক মুখস্থ করা যায় তা ভেবে ভেবে মরছে। কাজেই আশা করা যায় ফোনে খরচ হওয়া দুএক মিনিট এবং আফটার শকের আরো মিনিটখানেক নষ্ট তেনাদের জন্য কোন ব্যাপার হবে না। কিন্তু ফোন করে কি পরিচয় দেব?? আবার বুদ্ধি জোগাল জিসানের উর্বর মস্তিষ্ক - ওয়াই আই খান!! সবার চোখ রসগোল্লার মতো হয়ে গেলেও আমি খুব একটা আশ্চর্য হলাম না, কারণ ক্লাস টেস্টে পার্শিয়াল মার্কিং না করায় জিসানসহ আরো অনেকেই স্যারের ওপর বেজায় খেপা। ঐবার ওয়াই আই স্যার এবং ছালেক স্যার(দুটোই পরিবর্তিত নাম, তবে বুয়েটিয়ানরা আশা করি বুঝে নেবেন

- হ্যালো কে বলছেন?
- হ্যা আমি ওয়াই আই খান বলছি, তোমাদের ওয়াই আই খান স্যার।
- ওহ! স্লামালিকুম স্যার, কিন্তু এত রাতে ... (গাধা মেয়েটা বিশ্বাসও করেছে স্যার ফোন করেছেন খিক খিক!)
- আর বোল না, রাতে কলরেট কম থাকেতো ... আর তাছাড়া ক্লাসে তোমাদের ভালোমতন সিলেবাস শেষ করাতে পারি নাই, কখনোই পারি না অবশ্য!! এইবার তাও অনেকদূর গিয়েছিলাম ... তাই ভাবলাম তোমাদের পরীক্ষার জন্য কিছু সাজেশন-টাজেশন দিয়ে হেল্প করি আর কি -
- ওহ! অনেক ধন্যবাদ স্যার! কিন্তু আমিতো ক্যালকুলাসের সমস্ত অংক শেষ করে ফেলেছি স্যার(ওরে খাইছেরে কি সাঙ্ঘাতিক আঁতেলরে বাবা!)। কাজেই আমার ক্যালকুলাসের সাজেশনের দরকার নেই। তবে কো অর্ডিনেট জিওমেট্রির সাজেশন থাকলে অবশ্য ভালোই হত, ওটায় আবার প্রস্তুতি খূব একটা ভালো না ....
- কো অর্ডিনেটের সাজেশন লাগবে? আগে বলবা না! ছালেএএক!! অ্যাই ছালেক! দৌড়ায়ে তোর জিওমেট্রির প্রশ্নটা নিয়ে আয় তো!!
বলেই ফোন কাট। ছালেক স্যারের মতো এত সিনিয়র স্যারকে ওয়াই আই স্যারের মতো অমায়িক ভালোমানুষের এহেন সম্বোধনের হেতূ ঐ রাতে সেই বালিকা উদ্ধার করতে পেরেছিল কিনা কে জানে! যাহোক অনেক্ষণ হাসাহাসি করে এবার নেক্সট টার্গেটকে কল দেওয়া হল।
- হ্যালো কে বলছেন?
- হ্যা আমি ওয়াই আই খান বলছি, তোমাদের জেড আই খান স্যার। (যথারীতি)
- ওহ স্যার এত রাতে ...(ইত্যাদি ইত্যাদি আরো অনেক ন্যাকামী ...)
- আর বোল না, রাতে কলরেট কম থাকেতো ... আর তাছাড়া ক্লাসে তোমাদের ভালোমতন সিলেবাস শেষ করাতে পারি নাই, কখনোই পারি না অবশ্য!! এইবার তাও অনেকদূর গিয়েছিলাম ... তাই ভাবলাম তোমাদের পরীক্ষার জন্য কিছু সাজেশন-টাজেশন দিয়ে হেল্প করি আর কি - (সফলতার কারণে আগের ফরম্যাটই বহাল)
- অনেক ধন্যবাদ স্যার। কিন্তু আমার মনে হয় না সাজেশন লাগবে। ক্লাসে আপনি খুব ভালো পড়িয়েছিলেনতো তাই ওখানেই সব পড়া হয়ে গেছে(স্যার না হয়ে টায়ার হলে বোধহয় এতক্ষণে বিস্ফোরণ ঘটতো)। আর তাছাড়া এরপর সমস্ত বইয়ের অংকগুলোও শেষ করে ফেলেছি(বলে কি!!)।
- খূব ভালো, খুব ভালো ... তোমরাইতো দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, তা মা “ ... ” এই বইয়ের অংকগুলো করেছোতো?(একটু চিপায় থাকা একটা বইয়ের নাম।)
- অবশ্যই স্যার।
- আচ্ছা, আচ্ছা ... আর “...”, “...” এই বইগুলোর?(স্যার ক্লাসে নাম বললেও যে বইগুলো কেনার প্রয়োজন অনুভব করি নি আমরা কেউই)
- অবশ্যই স্যার, পি এল এর সময়ই শেষ করেছি(ইন্নালিল্লাহ!! এ দেখি আরো এক কাঠি বাড়া!)
- বেশ বেশ ... অনেক ভালো কাজ করেছ। অনেক অংক শিখা হয়ে গেছে। তবে কিনা এইবারের প্রশ্নের পেছনে আমি বেশি কষ্ট করি নাই, এইবারের প্রশ্ন তোমাদের উচ্চ মাধ্যমিকের বইগুলো দেখেই করেছি!! তবুও তোমার পরিশ্রম প্রশংসনীয় ... আচ্ছা এখন ছাড়ি, আরো অনেককে ফোন করতে হবে কেমন?
- কিন্তু স্যার! মানে ... ইন্টারের-
আবারো ফোন কাট! ভ্যাবাচেকা খাওয়া বালিকাটির মুখ চর্মচক্ষে দেখতে পারলেও আন্দাজ করতে খুব একটা বেগ পেতে হচ্ছিল না। বেচারী নিশ্চয়ই স্যারকে সুশীল ভাষায় গালাগালি করছে এখন। যাহোক রাতের শেষ কলটি করলাম আরেক হতভাগিনীকে।
- হ্যালো কে বলছেন ...
- আমি তোমাদের স্যার ...(ইত্যাদি ইত্যাদি)। পরীক্ষার আগে তোমাদের খোঁজ খবর করছি আর কি। প্রশ্ন সামান্য কঠিনই করেছি কিন্তু তোমাদের মতো ছাত্র-ছাত্রীরা নিশ্চয়ই অনেক আগেই পড়াশোনা শেষ করে রেখেছ তাই না?(নতুন অ্যাপ্রোচ, এইবার আর পড়াশোনার কথাবার্তার দিকে পা বাড়াচ্ছি না)
- কি যে বলেন স্যার!(আনন্দে গদগদ)। হ্যা স্যার, মোটামুটি সব অবশ্য কাভার দিয়ে ফেলেছি। (যা ভেবেছিলাম!!)
- বাহ ! বেশ ভালো। আহা ... আমার পিচ্চিটা ফোন ধরার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছে কিযে করি! ... ঝামেলা! অ্যাই যা এখান থেকে!!
- (রূঢ় ব্যবহারে বিন্দুমাত্র বিচলিত নয়) আহা স্যার বকছেন কেন, দিন না আমি কথা বলে শান্ত করে দিচ্ছি।
ফোন ধরিয়ে দেওয়া হলো আমাদের “জানোয়ার”কে। দেখতে গন্ধমাদন পর্বতের মতো হলেও বেচারার ভোকাল কর্ড এখনো ডায়াপার আমলের মতোই রয়ে গেছে।
- হ্যালো আপু কেমন আছো?
- ভালো বাবু, তুমি কেমন? (পার্ফেক্ট! বিশ্বাস করে ফেলেছে!)
- আমিও ভালো। সামনে না আমার ড্রয়িং পরীক্ষা।
- তাই নাকি, তাহলে যাও ছবি আঁকা প্র্যাক্টিস করো....
- করবো তো, কিন্তু একটা জিনিস জানতে আসছি তোমার থেকে ... আব্বুকে জিজ্ঞেস করলে আব্বু ধমক দেয় তো ...
- কি জিনিস বলোতো দেখি!
- আপু বলতে পারবা পিরিয়ড মানে কি?
কিছুক্ষণ নীরবতা এবং আবারো ফোন কাট! এইবার অবশ্য অন্যপ্রান্ত থেকে। তেব আমরাও এতো সহজে ছেড়ে দেবার পাত্র নই। আবার ফোন লাগানো হল।
- আপু ফোন রেখে দিলা যে?
- (নিরুত্তর। মনে হয় দাঁত কিড়মিড় করছে)
- তুমি “পিরিয়ড” মানে জানো না এইটাতে লজ্জার কিসু নাইতো!! আমি এইমাত্র ডিকশনারী দেখে বের করলাম। পিরিয়ড মানে হল পর্যায়কাল!!
ফোন কাট! এবং আমাদের অট্টহাসিতে আউলার দোতলা কেঁপে উঠল। সবাই মিলে ঠিক করলাম পরের পরীক্ষার সময়ও এ কুকীর্তি বহাল থাকবে।(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ১:২৬