ছবি তোলা জিনিসটা সবসময়ই আমাকে বিমোহিত করেছে। কিভাবে চমৎকার একটি মুহুর্ত ছোট্ট চৌকোণ কাগজের মাঝে ধরা পড়ে যায় ভাবতেই বেশ মজা লাগে। ছোটবেলায় আব্বার ক্যামেরাটা বগলদাবা করবার জন্য কতই না ফন্দী এটেঁছিলাম। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ(কান্নাকাটি), গোপন অভিযান(আলমারির তালা হ্যাক করবার প্রচেষ্টা), আইনি প্রচেষ্টা(হাইকোর্ট - মানে আম্মার কাছে আপিল) এমনকি সদাচরণ এবং ভালো রেজাল্ট কোনটাই আমার পিতার টাইটেনিয়ামের হৃদয়ে বিন্দুমাত্র চিড় ধরাতে পারে নি। তখন থেকেই বাবা-মা বঙ্গদেশীয় মন্ত্রীদের মতো আশ্বাসবাণী শুনিয়ে আসছেন "“বড় হ বাবা তারপর কিনে দেব।"” এই একই ভাঙা রেকর্ড কানের পাশে চার পাঁচ বছর বাজার পর যখন উচ্চতা দরজার সাথে ঠোকর খাওয়ার পর্যায়ে পৌছাল তখন পুনরায় আবেদন করায় বিস্মিত মুখে তেনারা জানালেন - লম্বা হওয়াই নাকি বড় হওয়া নয়!! তাঁদের সাথে তর্ক করবো নাকি এইবারে চওড়া হওয়ার চেষ্টা চালাবো এই ভাবতে ভাবতেই টেকনোলজি নামক এক মহান দেবতার কল্যাণে আমার হাতের মুঠোয় চলে এল এমন এক মুঠোফোন যার পশ্চাৎদেশে আবার ছবি তোলারও সুবন্দোবস্ত আছে। এবারতো আমি মহাখুশী। আকাশের ছবি, বাতাসের ছবি তুলে বেড়াই আর মহা বড় ফটোগ্রাফার হওয়ার স্বপ্ন দেখি। স্বল্পবসনা নারী, ভয়াবহ যুদ্ধ, এল ডোরাডো, আটলান্টিস, আমাজনের নরখাদক এবং আরো স্বল্পবসনা নারী - সকল উত্তেজক আর ভূবনমোহিনী বস্তুর ছবি তুলে বেড়াই কল্পনায়। তবে একথা বলাই বাহুল্য যে প্রকৃতি নয় বরঞ্চ প্রকৃতির বিনাশকারী আদমসন্তানদের ছবিতোলার অভিজ্ঞতাই বেশি চমকপ্রদ।
ছবি তোলার মতো স্বাভাবিক ব্যাপারটাকেই অনেকে আবার অনেক বেশি সিরিয়াসলি নেন। আমার এক কাজিন আছে যে ফিটফাট ফুলবাবুটি না সেজে ছবি তোলাটাকেই ব্যাপক গর্হিত কাজ মনে করে। আবার আমার মতো অনেকেই আছে শ্যাবি গেটআপ আর চেহারায় ছবি তোলানোই তাদের কাছে বিশাল কৃতিত্ব। সবসময় বেশ স্মার্ট আর সপ্রতিভ হলেও ছবি তোলার সময় ক্যামেরার লেন্সের সামনে দাঁড়ালে কারো কারো শরীরের নার্ভাস সিস্টেম নামক অংশটা ক্র্যাশ করে। কেউ কেউ দরদর করে ঘামতে থাকে, কারো বা ঐ সময়ই শরীরের অদ্ভুত অদ্ভুত লোকেশনে বেজায় খাউজানি দেখা দেয়। আমার এক খালা আছেন, কোন বিচিত্র কারণে এ পর্যন্ত তোলা সমস্ত ছবিতেই তাঁর চোখ বন্ধ, লেন্সের চোখ খুললেই তাঁর আঁখিপল্লব যেন স্বয়ংক্রিয় কোন সংকেতের ইশারায় যবনিকাপতন ঘটায় । তাঁর ওপর আমি নানাভাবে পরীক্ষা চালিয়ে দেখেছি, তিনি যদি ঘূণাক্ষরেও টের পান কেউ তার ছবি তুলছে তবে ক্যামেরায় ফ্ল্যাশ থাকুক আর না থাকুক ঠিক ঐ নির্দিষ্ট মুহূর্তটিতে তাক করে তাঁর চোখের দোকানের ঝাপিঁ বন্ধ হয়ে যায়, এ কারণে আজকাল তিনি ছবি তোলানোর প্রক্রিয়াটার ওপরই বীতশ্রদ্ধ হয়ে ইস্তফা দিয়েছেন। আবার আমার রুমমেট সৌমিত্র, এমনিতে ২৪ ঘন্টা তিড়িং বিড়িং করে লাফিয়ে বেড়ায় কিন্তু ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালে সে তারেক রহমানের খাম্বার মতো শক্ত হয়ে যায়। এমনকি চোখের পলক পর্যন্ত পড়ে না। কাজেই ওর ছবি তুললে আপনার মনে হবে মাদাম ত্যুসোর কোন সম্পত্তি ফিল্মবন্দী করছেন। আমার ছোটবোন আবার আরেক নমুনা - জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই অফিসিয়াল ছবি ছাড়া তার কোন সুস্থ স্বাভাবিক ছবি নেই। ছবি তোলার সময় একটা ভেংচি না কাটলে তার আর ঐ বেলার ভাত হজম হয় না। অবশ্য পারিবারিক বোরিং ছবিগুলোতে ওর মতো একটা ক্যারিকেচারের উপস্থিতি সাদামাটা ছবিগুলোতে একটু বৈচিত্র আনে এটা না মেনে উপায় নেই। বাইরে কোন ট্রিপে গেলে সব গ্রুপেরই একজন ছবিতোলার মানুষ থাকে। আমার বন্ধুদের মাঝে আবার এরকম শখের ফটোগ্রাফার আছে দু-দুজন। কোথাও বেড়াতে গেলে এ দুজন কম্পিটিশন দেয় ভালো ছবি তোলার। ওদের রেষারেষিতে মাঝখান থেকে লাভের আলু খাই আমরা - অনেকগুলো ভালো ছবি পেয়ে যাই। আর সকল ভালো ফটোগ্রাফারদের মতোই শেষমেশ দেখা যায় পুরো ট্রিপের ফটো অ্যালবামে ঐ দুটো ফটোগ্রাফারের ছবিই সবচেয়ে কম!!
সম্ভবত আমার মতো অনেকেই আছেন যারা একাই কোন গ্রুপ ছবির সৌন্দর্য্য নষ্ট করে দিতে সক্ষম। অনেকেই ছবি তোলার চেহারা নিয়ে জন্মান না, এর মানে এই না যে তাদের চেহারা ডিপজলের মতো। কোন দৈবকারণে অনেকেরই কেবল ছবি তোলার সময়ই চেহারার সমস্ত নেগেটিভ ফিচারগুলো ইসিনবায়েভার মতো লাফ দিয়ে বের হয়ে আসে। এরা তাই পারতপক্ষে ছবি তুলতে চান না। আর ছবি তুললেও মেলা কাঠখড় পুড়িয়ে তবে রাজি করাতে হয়। আমি নিজে ঐ ক্যাটাগরীর প্রাণী হলেও ছবি তুলতে আমার কখনোই আপত্তি নেই - কারণ এখন আমি আবিষ্কার করে ফেলেছি আমার মতো মানুষদের কিভাবে ফটোতে ভালো দেখানো যায় - ১. ক্যামেরার দিকে ভুলেও না তাকানো আর ২. হাসি - হ্যা, শুনতে ভালো না লাগলেও শুধুমাত্র একটা মনখোলা হাসিই আপনার ক্যামেরা ফেস বদলে দিতে পারে। বিশ্বাস না করলে চেষ্টা করেই দেখুন না!