রিয়াজ, একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ, পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। সে একজন দায়িত্বশীল স্বামী এবং একজন বাবা। কিন্তু তার জীবনে এমন কিছু ঘটেছিল, যা তাকে গভীর হতাশার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। রিয়াজের সন্তান আদিত্য, একজন অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারের শিশু। শিশুটির বিশেষ চাহিদা এবং ভিন্ন ধরণের আচরণ প্রথমে রিয়াজের জন্য বোঝা হয়ে উঠেছিল। আদিত্য কথা বলতে দেরি করে, চোখের দিকে তাকাতে চায় না, এবং মাঝে মাঝে আচরণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। রিয়াজ ও তার স্ত্রী সুমনা প্রথমে বুঝতেই পারেনি কিভাবে তাদের সন্তানকে সাহায্য করবে।
সন্তানের ভিন্নধর্মী আচরণ নিয়ে সমাজের অজানা মন্তব্য এবং কাজের চাপের কারণে রিয়াজের মানসিক অবস্থা খারাপ হতে শুরু করেছিল। নিজেকে সে অসহায় মনে করতে লাগল, মনে হচ্ছিল যেন জীবনটা তার হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। দুঃশ্চিন্তাগুলো ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করতে থাকল। অফিসের কাজে মন দিতে পারছিল না, এবং পরিবারেও আগের মতো মনোযোগ দিতে পারছিল না। তার রাতের ঘুম হারিয়ে যেতে শুরু করল। ভোরের প্রথম আলো দেখার আগেই সে জেগে থাকত, শুধুই চিন্তা আর চাপ তাকে আচ্ছন্ন করে রাখত।
একদিন রিয়াজ অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখল, সুমনা চুপচাপ বসে কাঁদছে। আদিত্য সারাদিন বিক্ষিপ্ত ছিল, এবং তার মায়ের সাথে কোনভাবেই যোগাযোগ করতে পারছিল না। রিয়াজ বুঝতে পারল, এই একা লড়াই শুধু তার নয়; সুমনাও একইভাবে লড়ছে। কিন্তু রিয়াজ তার সমস্যাগুলো নিয়ে কখনো সুমনার সাথে কথা বলেনি, এমনকি নিজের দুর্বলতার কথাও গোপন রেখেছিল।
সেই রাতে, রিয়াজ সিদ্ধান্ত নিল যে সে আর একা লড়াই করবে না। সে সুমনার সাথে তার হতাশা, চাপ, এবং কষ্টের কথা শেয়ার করল। সুমনাও তাকে সমব্যথী হয়ে শুনল এবং বলল, "আমরা একসাথে আছি, এবং একসাথে সবকিছু মোকাবেলা করব। আমাদের ছেলেটা অন্য সবার থেকে আলাদা, কিন্তু সে আমাদের সেরা উপহার। আমরা ওর পাশে থাকব, যেমন আমাদের ওর পাশে থাকা উচিত।"
এরপর রিয়াজ এবং সুমনা একসাথে পরামর্শকের কাছে গেলেন। তারা শিখলেন কীভাবে তাদের সন্তানের সাথে আরও ভালোভাবে যোগাযোগ করতে হবে এবং তাকে বোঝার জন্য ধৈর্য ধরতে হবে। ধীরে ধীরে রিয়াজ তার ছেলের অটিজমের নানা দিক বুঝতে শুরু করল। আদিত্য তাকে একদিন সরাসরি চোখে তাকিয়ে হাসল। সেই হাসি রিয়াজের ভেতরে যেন নতুন এক আলোর সঞ্চার করল। তিনি বুঝতে পারলেন, আদিত্যও তাকে ভালোবাসে, শুধু তার প্রকাশের পদ্ধতি আলাদা।
রিয়াজ তার হতাশা মোকাবেলা করতে ধীরে ধীরে শিখতে লাগল। তিনি মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিলেন, তার অনুভূতিগুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে শুরু করলেন, এবং নিজের মধ্যে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার, তিনি শিখলেন, জীবনের প্রতিটি তরঙ্গের মাঝেই একটা আলো থাকে—তার সন্তান আদিত্য সেই আলো। তাকে শুধু সঠিকভাবে দেখার চেষ্টা করতে হয়।
সন্তানের অটিজম মানে জীবন থেমে যাওয়া নয়। রিয়াজ শিখলেন, জীবন মানেই ওঠানামা, তবে তার মধ্যেও আনন্দ আছে, ভালোবাসা আছে, শুধু তা খুঁজে বের করার জন্য একটু বেশি পরিশ্রম করতে হয়। এখন রিয়াজ আর সুমনা একসাথে হাসে, একসাথে কাঁদে, এবং একসাথে লড়াই করে—তাদের ছেলে আদিত্যকে ঘিরে।