শ্যামল আমার চোখে দেখা মানুষ,কম করে হলেও বছর পচিশ ওকে দেখছি।বিচিত্র ছেলে।অবশ্য আজ তাকে ছেলে বললে ও লজ্জা পাবে,বলবে,পঞ্চাশ বছর বয়েস হয়ে গেল বিমলদা,আজও ছেলে! তা ঠিক,কিন্তু আমার কাছে সে এখনও যে অনেকটা পুরনো শ্যামল।
ছবি- সাহিত্যিক বিমল কর।
অন্য দশজনে সাধারণত যা পারবে না-শ্যামল তা অনায়াসে পারে।কে যেন বলেছিল,শ্যামল কোথায় এক ইন্টারভিউতে বলেছে- ''কুবেরের বিষয় আঁশয়'এর মত বই লিখতে হলে ডস্টয়েভস্কির আমরক্ত হয়ে যেত।জানি না,এমন কথা শ্যামল বলেছিল কিনা!তবে যদি বলে থাকে-তবে তার মুখেই এসব মানায়।
শ্যামলকে যারা চেনে তারা জানে শ্যামল খেয়ালের মাথায় দুম দাম অনেক কিছু বলতে পারে,করতেও পারে।এই খেপামি তার আছে।কিন্তু মুখে যে যাই বলুক তার মন অন্যরকম।
আগেই বলেছি -শ্যামল তখন টালিগঞ্জের মধুরাথা বিদ্যাপিঠে মাস্টারী করে,একদিন স্কুলে যাওয়ার সময় দেখল,বরেন(বরেন গঙ্গোপাধ্যায়,বাংলা সাহিত্যের আরেক কৃতি লেখক)কথা নেই বার্তা নেই শ্যামল বরেনকে বগলদাবা করে বাসে ঊঠল।তারপর স্কুলে নিয়ে নিয়ে হেডমাস্টার মশাইকে বলল,স্যার আমার বন্ধু বরেন গঙ্গোপাধ্যায়,সাইন্স গ্রাজুয়েট।একে আমাদের স্কুলের টিচার করতে হবে।ওকে বসিয়ে দিন।
শ্যামলের সুপারিশ অমান্য করার সাধ্য হেডমাস্টারের ছিল না।বরেনের চাকরি হয়ে গেল।এই রকম আরও কত যে নাটকীয় কান্ড করেছে শ্যামল কে জানে।ওর মধ্যে অল্প বয়স থেকেই একটা মজার ভাব ছিল।সেটা বয়েসের ব্যাপার।খানিকটা তার স্বভাবের।শুনেছি,সত্যেনকে একবার টালা পার্কে নিয়ে গিয়েছিল তারাশংকরবাবুকে দেখাতে।তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় বাইরে এসে দাঁড়াতেই শ্যামল একেবারে অন্তরঙ্গ গলায় বলল,জেঠামশাই,'এ আমাদের সতু।আপনাকে দেখতে চাইছিল, ওকে নিয়ে এলাম।সতু,জেঠামশাইকে প্রণাম কর।'এই রকম অজস্র গল্প আছে শ্যামলকে নিয়ে।তার বন্ধুরাই বলে।একবার নাকি শংকর(শ্যামলের বন্ধু ও আরেকজন লেখক)শ্যামলকে বলল,এই সিগারেট কিনে আন।'শ্যামল বলল-পয়সা নেই। শংকর বলল- এত লোক যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে চেয়ে নে।'শ্যামল সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার লোকের কাছে হাত পেতে দাড়াল।পথচারী অবাক।ব্যাপার কী?বিনীত গলায় শ্যামল বলল,' শংকর সিগারেট খাবে।ওই যে দাঁড়িয়ে আছে শংকর।'
আমি যে শ্যামলকে দেখি তখন তার বয়েস কত আর? চব্বিশ- পচিশ বড় জোর।তাজা ছেলে।একাবারে যুবক।সুন্দর চেহারা ছিল শ্যামলের।মাথায় লম্বা,গড়াপেটা স্বাস্থ্য,দোহারা,পরিস্কার মুখ, যেমন স্পষ্ট নাক তেমনি চোখ।পুরুষালি চেহারা বলতে যা বোঝায়-সেই রকম।শ্যামল তখন আনন্দবাজার পত্রিকায় এসেছে।সাংবাদিক হয়ে।
ছবি- যুবক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
তখন যে শ্যামল ঘন ঘন লিখত তাও হয়ত নয়।কম লিখত।কিন্তু আমাদের সঙ্গে তার মেলামেশা ছিল খুবই।কলেজ স্ট্রিটের আড্ডায় শ্যামল আসত,গল্পগুজব করত, জ্যোতির্ময়কে খেপাত,শংকরের সাথে এক-আধা বার মজার কান্ড করত।সপ্রতিভ ছেলে।কোনো কিছু রেখে ঢেকে বলত না,যা বলত স্পষ্টাপষ্টি।ওর কাছে- ওদের পুরনো স্কুলের গল্প,বাড়ির গল্প শুনতে শুনতে আমরা হাসতাম।ওর দাদাকে শ্যামল ভয় পেত খুব।শ্যামল নাকি তার হাতে বেদম মার খেয়েছে বেশি বয়সেও।সত্যি কিনা কে জানে!
আমাদের যেমনভাবে চলছিল শ্যামলেরও সেইভাবে দিন কাটত।ধীরে ধীরে শ্যামল সংসারী হয়ে গেল।শ্যামলকে অনেক সময় খেয়ালী,খানিকটা বদরাগী মনে হলেও ওর মধ্যে বন্ধু বান্ধবদের জন্যে কোমলতাও যে লক্ষ করিনি তা নয়।শংকরকে ভালবাসত খুব।ছেলেবেলার বন্ধু ছিল শংকর।মিহির মুখোপাধ্যায়কেও পছন্দ করত যথেষ্ট।অনেক দিনের বন্ধু।একটা ঘটনা মনে পড়ছে।সে সময় আমি কিছুদিন রোগে- ভোগে কাহিল হয়ে পড়েছিলাম।একদিন অফিস থেকে যখন বেরুলাম,শরীর আর বইছিল না।মাথা ঘুরছিল।হাত পা কাপছে।একা পাচ পা হাটাও অসম্ভব।তার উপর বৃষ্টি পড়ছে টিপটিপ করে।কেমন করে বাড়ি ফিরব ভাবছি।কোনো রকমে কলেজ ষ্ট্রীটে পৌঁছতে পারলেও বাচি।বীরেনবাবু,প্রবোধদের সঙ্গে বাড়ি ফেরা যাবে।অফিসের নিচে নেমে দাঁড়িয়ে আছি।ভীষণ দুর্বল লাগছিল।
একসময় দেখি শ্যামল অফিসে ঢুকছে। ভিজতে ভিজতেই।তার শিফট শুরু।
'কি হয়েছে বিমলদা?'
'শরীর বড় খারাপ লাগছে।মাথা ঘুরছে।'
একটা ট্যাক্সি ডেকে দেব?
পাবে কী!
'দাড়ান,দেখছি।
শ্যামল আবার বেড়িয়ে গেল বৃষ্টিতেই।
তখন কলকাতা শহরে ট্যাক্সি পাওয়া আজকের মত এত তপস্যাসাধ্য ব্যাপার ছিল না।তবে চাইলেই যে পাওয়া যেত বিকালের দিকে তাও নয়।শ্যামল প্রায় জবাকুসুম হাউস পর্যন্ত হেটে গিয়ে এক ট্যাক্সি ধরে আনল।ভিজে নেয়ে গিয়েছে।আমায় ট্যাক্সিতে তুলল।বলল,'চলুন,আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।
সে কি তোমার অফিস?
পরে আসব।না হয় কামাই হবে!
'আমাকে কলেজ স্ট্রিট পর্যন্ত পৌঁছে দাও।ওখানে প্রবোধরা আছে-।
না।বাড়ি পৌঁছে দেব।আপনাকে খুব সিক দেখাচ্ছে।
শ্যামল কিছুতেই শুনল না আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিল।
এটা এমন কিছু বড় ঘটনা নয়।তুচ্ছ ঘটনা।শ্যামল হয়ত ভুলেই গিয়েছে।আমার মনে আছে।আমাদের জীবনে অনেক তুচ্ছ ঘটনা থেকেই পরস্পরের সম্পর্ক ও মনের ভেতরটা প্রকাশ হয়ে পড়ে।অন্তত সৌজন্য, মানবিক বোধ।
শ্যামল একবার বাড়িতে গুরুজনের কাছে বকুনি খেয়ে আমার কাছে মুখ শুকনো করে বলেছিল,এই বয়সেও বকুনি খেতে হয় বিমলদা! ওর কথা শুনে মজাও লেগেছিল।মনে হয়েছিল,গুরুজনের বকুনি ওর কাছে যতটা না লজ্জার ততটা যেন অভিমানের বিষয়।
বৃহৎ পরিবারের মানুষ শ্যামল।আদি বাড়ি পুর্ববঙ্গে।থাকত টালিগঞ্জে।বিয়ে করার বেশ কিছুদিন পরে চলে গেল চম্পাহাটি।শ্যামলের সে আর এক পর্ব। চম্পাহাটি গিয়ে তার কি হয়েছিল জানি না,কিন্তু সে বদলে যেতে লাগল।
আমি তার চম্পাহাটির ভাড়া বাড়িতে গিয়েছি,তার নিজের বাড়িতেও ওকে মনোযোগ দিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি।কিছু বুঝতে পারিনি। শ্যামল নিজেই বলে,সে একটা ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছিল।সেটা হল জমি।কিন্তু শুধু কি জমি? না,তার কাছে জমির অন্য অর্থ ছিল।ও বলে জমি মানে আশ্রয়,অংকুর। নবজন্ম।এই শহরে থেকে সে চলে গিয়েছিল পুর্ণজন্ম লাভ করতে।লেখক হিসেবে কী? শ্যামল একবার লিখেছিলঃ 'আকাশের নিচে নির্জনে কত মাঠ পড়ে থাকে।তাদের ওপর দিয়ে হাটবার সময় অদ্ভুত লাগে।প্রান্তরের সাতটা তালগাছ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে।ধানক্ষেত খূড়ে লোকে কচ্ছপ বার করছে।পুকুর কাটতে গিয়ে বারো হাত নিচে নৌকার গলুই পাওয়া গেল।একদা তাহলে এখানে নদী ছিল।জমির অনন্ত রহস্যঃতার সাথে কোর্ট কাছারি।দলিল দস্তাবেজ।উকিল মুহুরিঃলোভ।শরিকানি।অন্তহীন।'
নিজেকে এমনভাবে জড়িয়ে মিশিয়ে দিল শ্যামল সেই জমি মাটি ফসল প্রকৃতি মানুষজনের সঙ্গে যে বোঝা গেল তার লেখার জাতটাই পাল্টে যাচ্ছে।এই সময় শ্যামল এমন গল্প লিখেছে যার তুলনা দেখি না।তার চন্দনেশ্বরের মাচানতলায় কত নিখুঁত,কত সুন্দর,কী আবেশকরা গল্প কেমন করে বলব!কন্দর্প বলে যে গল্পটা পড়েছিলাম তার রেশ ছিল কত দিন ধরে।এ রকম গল্প শ্যামলের আরো আছে।রয়েছে তার ' কুবেরের বিষয় আশয়'-উপন্যাস।ধারাবাহিকভাবে যখন পড়তাম মাঝে মাঝেই বলতে হত, বারে!বড় সুন্দর লিখেছে তো?কোনো সন্দেহ নেই,শ্যামল যে শহর ছেড়ে তফাতে গিয়ে বাসা বেধেছিল তা নেহায়েতই জমির জন্য নয়।তার লেখার জন্য।সে ব্যর্থ হয়নি।অন্তত আমার তাই ধারণা।
তবে জীবন ত একখাতে বয় না।শ্যামল আবার ফিরে এসেছে শহরে।লিখেছেও কম নয়।তার কোনো কোনো উপন্যাস,যেমন ঈশ্বরীতলায় রুপোকথা','চন্দনেশ্বর জংশন'-এসব লেখায় শুধু যে তার ক্ষমতার পরিচয়ই রয়েছে তা নয়, সাহিত্য পাঠকের কাছেও সমাদৃত হয়েছে।আমাদের এক পুরনো বন্ধু,একদার নামকরা কবি,শ্যামলকে চেনেন না,আমাকে বলেছিলেন,এই ভদ্রলোক উপন্যাসের ধর্মটা বোঝেন।ওর আঁকা চরিত্রগুলো একেবারে জ্যান্ত।কত চরিত্র!ভাই,আমি ভদ্রলোকের লেখার এডমায়ার।
শ্যামল যে কৃতী লেখক ,বিশিষ্ট লেখক- একথা কে স্বীকার করছে আর না করছে তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।একটা বিষয় নিশ্চিত-শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে না পড়লে হাল আমলের বাংলা উপন্যাসের একটা বড় দিক না পড়াই থেকে যাবে।শ্যামল শুধু ক্ষমতাবান নয় তার দেখাশোনা অনুভবের মধ্যে ফাকি নেই।সে যা দেখল না তা নিয়ে লেখে না।সাজানো গল্প তার হাতে আসে না।সে পছন্দও করে না।তার মানে এই নয় যে,শ্যামল ইমাজিনেটিভ নয়।যার ইমাজিনেশান নেই,সে কোনো দিন ''চন্দনেশ্বরের মাচানতলায়' লিখতে পারে না।
আমাকে একজন বলেছিলেন-শ্যামল লিখতে লিখতে আগোছালো হয়ে যায়।
জবাবে আমি বলেছিলাম,শ্যামলের গল্প তো খুঁটিয়ে বাধা গরু নয় যে দড়ির মাপ ছেড়ে বাইরে যেতে পারবে না!
কথাটা মুখ থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিল।তেমন কিছু ভেবেও বলিনি।পরে আমার মনে হয়েছে শ্যামলের স্বভাব ও লেখা - দুই -ই বোধহয় ওই রকম।সে কোথাও বাঁধা থাকে না,থাকতে রাজী নয়।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুন, ২০২০ রাত ৮:৪২