এমএলএম ব্যবসা জনপ্রিয় ব্যবসা হলেও কিছু অসৎ লোক এই ব্যবসার মডেলকে প্রতারণার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। প্রতারিত হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। বাংলাদেশে ডেষ্টিনি-২০০০ লিমিটেড নামক কোম্পানি লক্ষ লক্ষ মানুষের পয়সা হাতিয়ে নিয়ে এখন মিডিয়ার চ্যানেল পর্যন্ত কিনে নিয়েছে। অথচ হাদা গঙ্গারাম মানুষ বুঝতেও পারছেনা যে কি করে তাদের পয়সা দিয়েই কোম্পানি বড়লোক হয়ে গিয়ে এখন আখের গুছাচ্ছে অথচ তারা কিছুই না পেয়ে হাঁ করে মরিচীকার মত ক্রাউন হওয়ার আশায় বসে আছে।
অনেকে মনে করে থাকে যে কোন একটা কোম্পানি টাকার বিনিময়ে পণ্য দিলেই সেটা সত্যকারের এমএলএম কোম্পানী। কিন্তু এটা ঠিক নয়। এরকম হাজারো কোম্পানি বিডিতে এবং এদেশের বাইরে রয়েছে যারা টাকার বিনিময়ে চমৎকার সব পণ্য দিয়ে থাকে কিন্তু তবুও তারা পিরামিড স্কিম। এবং পণ্য ভিত্তিক পিরামিড স্কীমগুলোই মানুষের চোখে খুব সহজেই ধুলো দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বীরদর্পে।
তো চলুন পার্থক্যরুপে দেখে নেয়া যাক একটি সত্যকারের এমএলএম কোম্পানি এবং পিরামিড স্কিমের পার্থক্য।
----------------------------------------------------------------------------------
প্রকৃত এমএলএম/ডিরেক্ট সেলিং বিজনেস : সর্বশেষ স্তরের ভোক্তার নিকট পণ্য বিক্রয় করে, ডাউনলাইন ডিস্ট্রিবিউটরদের নিকট নয়। অর্থাৎ যেসব কোম্পানি তাদের ডিস্ট্রিবিউটর নেটওয়ার্কের বাইরে কাস্টমার তৈরি করতে পারে এবং তাদের নিকট পণ্য বিক্রয় করতে পারে সেসব কোম্পানি প্রকৃত কোম্পানি। উদাহরণস্বরুপ: একজন মুদি দোকানদার বা একজন পোস্টম্যান এমএলএম কোম্পানির ডিস্ট্রিবিউটর না হতে পারে কিন্তু যদি কোম্পানির এমন কোন পণ্য থাকে যেটা সে কিনতে নিজে থেকে আগ্রহী হয়, তবে সেটাকে প্রকৃত ডিরেক্ট সেলিং কোম্পানি বিবেচনা করা যায়।
প্রকৃত ডিরেক্ট সেলিং কোম্পানীতে যারা কাস্টোমার হিসেবে থাকবে তাদেরকে অবশ্যই ডিস্ট্রিবিউটরদের নিকট হতে আলাদা করতে হবে। ডিস্ট্রিবিউটরদের কাজ হচ্ছে কোম্পানীর উৎপাদিত পণ্য বা সেবা সেইসব কাস্টোমারের নিকট পৌঁছে দেয়া। মূলত কাস্টোমাররাই পণ্যের বা সেবার জন্য অর্থ খরচ করবে এবং সেই অর্থ ডিস্ট্রিবিউটরদের মাঝে বিতরণ করা হবে মার্কেটিং প্ল্যান অনুসারে।
পণ্য বা সেবা অবশ্যই অবশ্যই এবং অবশ্যই কোম্পানীর ডিস্ট্রিবিউটর নয় তথা কোম্পানির সাথে ব্যবসায়িক স্বার্থে জড়িত নয় এমন মানুষ কর্তৃক ব্যবহৃত হবে। প্লিজ দয়া করে এই বিষয়টির প্রতি গভীরভাবে নজর দিন। যদি এমন কোন পণ্য বা সেবা নিয়ে কাজ করা হয় যা ডিস্ট্রিবিউটরের বাইরে অন্য কেউ কিনতে বা ব্যবহার করতে আগ্রহী হয়না, তবে ১০০%+ নিশ্চিত যে কোম্পানী পণ্যের নামে ডিরেক্ট সেলিং এর ছদ্মবেশ পড়ে আছে, মূলত এটা পিরামিড স্কিম।
পিরামিড স্কীম: এখানে শুধু নতুন নতুন সদস্য খুঁজে বেড়ানো হয় এবং তাদের কাছে পণ্য বিক্রয় করা হয়। প্রতিটি নতুন সদস্য পণ্য কেনে কেবলমাত্র ব্যবসা করার খাতিরে, কখনই ভোগ করার জন্য নয়।
প্রকৃত এমএলএম/ডিরেক্ট সেলিং বিজনেস: এখানে প্রফিট আসে কেবলমাত্র ডিস্ট্রিবিউটরদের নিজস্ব পণ্য বিক্রয় থেকে। ডাউনলাইনদের বিক্রয়ের ওপর কিছুটা পার্সেন্টেজ পাওয়া যেতে পারে কিন্তু কখনই সেটা ডিস্ট্রিবিউটরের নিজস্ব বিক্রয়ের চেয়ে বেশি নয়। ডিস্ট্রিবিউটরের নিজস্ব বিক্রয় বলতে বোঝানো হচ্ছে একজন ডিস্ট্রিবিউটর যখন নিজে তার ডাউনলাউন নেটওয়ার্ক এবং কোম্পানির অন্যান্য ডিস্ট্রিবিউটর নেটওয়ার্কের বাইরে অন্য কোন একজন কাস্টোমারের নিকট বিক্রয় করে যে কোম্পানির সাথে ব্যবসার বিষয়ে অংশীদার নয়।
পিরামিড স্কিম: এখানে প্রফিট আসে কেবল নতুন কোন একজন মানুষ ব্যবসা করার জন্য কোম্পানির পণ্য কিনলে, কাস্টোমার হবার জন্য নয়। অর্থাৎ নিউ রিক্রুটমেন্টই এখানে মূল লক্ষ্য থাকে।
প্রকৃত এমএলএম/ডিরেক্ট সেলিং বিজনেস: এই ধরনের কোম্পানিতে জয়েন করতে কোন রকম টাকা পয়সা লাগেনা। এটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। অথবা যদি টাকা লাগেও সেটা খুবই সামান্য পরিমাণে লাগবে। এবং সেই টাকার বিনিময়ে ডিস্ট্রিবিউটর কোম্পানির পণ্যের স্যাম্পল, পণ্যের লিফলেট/ব্রুশিয়ার/ফ্লায়ার, ট্রেনিং ম্যাটেরিয়ালস তথা সেলস টুলস পাবে, অন্য কিছু নয়। আমেরিকার অ্যারিজোনা প্রদেশ ভিত্তিক ফরএভার লিভিং কোম্পানি বিশ্বের সর্ববৃহৎ অ্যালো ভেরা উৎপাদক, অ্যালো ভেরা সমৃদ্ধ পণ্য প্রস্তুতকারক এবং বিতরণকারী হিসেবে ১৯৭৮ সাল থেকে ডিরেক্ট সেলিং সিস্টেমে ব্যবসা করে আসছে। এই কোম্পানি বিশ্বের ১০ নম্বর এমএলএম কোম্পানি যাদের লেটেস্ট সেলস ফিগার হচ্ছে ২.৬ বিলিয়ন ইউএস ডলারের বেশি। এই কোম্পানিতে জয়েন করতে কোন টাকা লাগেনা।
পিরামিড স্কীম : বেশ বড় অংকের টাকা লাগে। যে টাকার বিনিময়ে ফুটপাত টাইপের কিছু অপ্রয়োজনীয় এবং সাবস্ট্যান্ডার্ড পণ্য পাওয়া যায় যার প্রকৃত মূল্য হয়ত ৫০০% কম! অনেক কোম্পানিতে আবার মান্থলি বা ইয়ারলি একটা ফি দেয়া লাগে একাউন্ট একটিভ রাখার জন্য। এগুলো সবই পিরামিড স্কীম।
প্রকৃত এমএলএম/ডিরেক্ট সেলিং বিজনেস: বায় ব্যাক পলিসি থাকে অর্থাৎ কোন ডিস্ট্রিবিউটর যদি লার্জ ভলিউমে একসাথে অনেক পণ্য কেনে এবং কোন কারণে সে যদি সেগুলো বিক্রয় না করতে পারে তবে কোম্পানি মিনিমাম ৯০% বা তারও অধিক দামে পুনরায় সে পণ্যগুলো ফেরৎ নিয়ে টাকা ডিস্ট্রিবিউটরকে দিয়ে দেয়। এটা প্রকৃত এমএলএম কোম্পানির একটা অবশ্য প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য।
পিরামিড স্কিম: কোন বায় ব্যাক পলিসি নেই। থাকলেও হয়ত ৫% বা ১০% টাকা ফেরত দেয়া হয় যা আল্টিমেটলি ডিস্ট্রিবিউটরের আর্থিক ক্ষতি নির্দেশ করে।
প্রকৃত এমএলএম/ডিরেক্ট সেলিং বিজনেস: দীর্ঘমেয়াদী ব্যবসা সম্ভব কারণ কোম্পানির পণ্য বা সেবা সাধারণ মানুষ এতটাই পছন্দ করে যে তারা ব্যবসায় জয়েন করতে না চাইলেও বারবার পন্য বা সেবা কিনতে চায়। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি কোন কোম্পানিতে রিপিটেড সেলস বা বারবার একই মানুষের নিকট বিক্রয় করা যায় এমন টাইপের পণ্য বা সেবা না থাকে সেটা পিরামিড স্কীমের উপরে ২০০% পিরামিড স্কীম। রিপিটেড সেলস ছাড়া এমএলএম ব্যবসা কেন, পৃথিবীর যেকোন ব্যবসাই একসময় বন্ধ হয়ে যাবে।
পিরামিড স্কীম: এমন কোন পণ্য বা সেবা থাকেনা যেটা একই কাস্টোমারের নিকট বারবার বিক্রয় করা যাবে। মূলত কোম্পানীর যারা ডিস্ট্রিবিউটর, তাদের বাইরে সেই পন্য বা সেবা ক্রয়ের জন্য কেউ আগ্রহীও হয়না। অর্থাৎ কোম্পানীর পণ্যের কোন রিয়েল মার্কেট তৈরী হয়না এবং সেই পণ্যের কোন ডিমান্ড বা চাহিদাও তৈরী হয়না। কেবলমাত্র কোম্পানির ডিস্ট্রিবিউটররাই সেই পন্য বা সেবা কেনে কেননা তারা পণ্যের ক্রেতা/ভোক্তা নয়, অন্যের নিকট বিক্রয়ের জন্য তথা ব্যবসার উদ্দেশ্যে কেনে।
প্রকৃত এমএলএম/ডিরেক্ট সেলিং বিজনেস: যত বেশি সময় পণ্য বা সেবা বিক্রয়ের কাজে ব্যবহার করা যাবে তত বেশি একজন ডিস্ট্রিবিউটর আয় করতে পারবে। এখানে আয়ের কোন সীমা নেই। ডিস্ট্রিবিউটররা যত বেশি রেগুলার কাস্টোমার তৈরী করতে পারবে তার বিক্রয় তত বেশি হবে এবং প্রতি মাসে তার আয়ও তত বেশি হবে এবং রেগুলার কাস্টোমারের সংখ্যা বাড়লে আয়ও সেই অনুপাতে বাড়বে। ডাউনলাইনের বাইরে রেগুলার কাস্টোমার তৈরী করতে না পারলে কখনই রয়্যালিটি ইনকাম সম্ভব নয়। তাই ডাউনলাইন তৈরীর চেয়ে পণ্য বিক্রয় এবং রেগুলার কাস্টোমার তৈরীর ব্যাপারে বেশি জোর দেয়া হয়। ডাউনলাইন তৈরীর কাজটা এখানে অপশনাল। কেউ করতে চাইলে করবে, না করলে ক্ষতি নেই।
পিরামিড স্কীম: ৯৯.৯৯% ডিস্ট্রিবিউটর এখানে ব্যর্থ হবেই হবে। শুধুমাত্র সদস্য যোগাড়ের প্রতি এত বেশি জোর দেয়া হয় যে পণ্য বিক্রয়ের কথা ডিস্ট্রিবিউটররা মাথায় আনেইনা। আর পণ্য এত বেশি নিম্নমানের এবং অপ্রয়োজনীয় হয় যে এসব পণ্যের কাস্টোমার আসলে রিয়েল মার্কেটে নেই বললেই চলে। যেহেতু নতুন সদস্য যোগাড় না হলে আয় হয়না, এটা একসময় কলাপস করে এবং বন্ধ হয়ে যায়।
প্রকৃত এমএলএম/ডিরেক্ট সেলিং বিজনেস: যে কেউ ইচ্ছে করলেই কোম্পানীর সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারে। ব্যবসা থেকে বেরিয়ে আসার সময় যদি কোন পণ্য পূর্বে স্টক করা থাকে, সেটাও কোম্পানি বায় ব্যাক পলিসির মাধ্যমে কিনে নেয়।
পিরামিড স্কীম: ব্যবসা থেকে বের হয়ে আসতে চাইলে আপলাইনরা বাধা দেয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যবসা কন্টিনিউ করার জন্য বিভিন্ন ভাবে চাপ সৃষ্টি করা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আশা দেখিয়ে মোটিভেশন দিয়ে ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়।
প্রকৃত এমএলএম/ডিরেক্ট সেলিং বিজনেস: এখানে এমন পণ্য বিক্রয় করা হয় যা মানুষ প্রতিদিনের জীবনে খুব সাধারণভাবেই ব্যবহার করে। মূলত গৃহের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য যেমন সাবান, শ্যাম্পু, ডিটারজেন্ট, কসমেটিকস, খাদ্যদ্রব্য, ড্রিংকস প্রভৃতি। অর্থাৎ যেকোন দোকান বা সুপারশপে পাওয়া যায় এমন পণ্য বিক্রয় করা হয়ে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোম্পানির নিজস্ব ফ্যাক্টরিতে পণ্য উৎপাদন করা হয়ে থাকে। অ্যামওয়ে, অ্যাভন, ম্যারি কে, ফরএভার লিভিং এসব বিখ্যাত ডিরেক্ট সেলিং কোম্পানীর পণ্য তালিকার দিকে তাকালে দেখা যায় যে এদের প্রায় সব পণ্যই ডায়েটারি সাপ্লিমেন্ট এবং কসমেটিকস সেকশনের আওতায় পড়ে। এর মূল দুটো কারণ হচ্ছে, কসমেটিকস এবং সাপ্লিমেন্ট একই মানুষের কাছে বারবার বিক্রয় করা যায় তথা রিপিটেড বিজনেস এসব পণ্য দিয়ে সম্ভব। দুই নম্বর হচ্ছে, একটি দেশের ইকোনোমি যতই ডাউন থাকুক না কেন, মানুষ সাধারণত খাদ্যদ্রব্য এবং প্রসাধনী সামগ্রীর পেছনে পয়সা খরচ করা থামিয়ে দেয়না। অর্থাৎ এসব পণ্য দিয়ে মোটামোটি মন্দামুক্ত ব্যবসা সম্ভব। উপরন্তু, পণ্যের দাম এমনভাবে নির্ধারিত করা হয় যা দোকান বা অন্য কোন ক্রয়-বিক্রয়ের স্থানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
পিরামিড স্কীম: অপ্রয়োজনীয় এবং নিম্নমানের পণ্য বিক্রয় করা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মিরাকল প্রোডাক্ট বিক্রয় করা হয়। যেমন: বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পিরামিড স্কিম ইলিংকস গ্লোবাল পঞ্চাশ টাকা মূল্যের একটি ফুটপাতের ব্রেসলেট প্রায় ৭০০০ টাকায় বিক্রয় করে!!!










আশা করি, সত্যিকারের এমএলএম কোম্পানী এবং প্রোডাক্ট ভিত্তিক পিরামিড স্কিমগুলোর ডিফারেন্স সবাই বুঝতে পেরেছেন। এবার এই পয়েন্টগুলোর সাথে আমাদের বাংলাদেশে যে৭০-৮০টি কোম্পানি আছে তাদের কার্যক্রম এবং পন্যের ক্যাটাগরি মিলিয়ে দেখুন। খুবই দু:খের সাথে বলতে হচ্ছে যে একটি কোম্পানীও হয়ত খুঁজে পাবেননা যারা প্রকৃত এমএলএম কোম্পানী।
একটা বিষয় কি আপনারা খেয়াল করেছেন যে অ্যামওয়ে, অ্যাভন, ম্যারি কে, টাপারওয়্যার, প্যাম্পারড শেফ, এনইউ স্কিন এর মত প্রথম সারির কোন এমএলএম কোম্পানীই বাংলাদেশে নেই? যদি এরা থাকত তবে মানুষ খুব সহজেই এমএলএম এবং পিরামিড স্কিমের তফাৎ বুঝতে পারত।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুলাই, ২০১১ দুপুর ১:১৮