প্রথম পর্বে লিখেছিলাম ছুটিতে দেশে যাওয়ার পথে কায়রো ভ্রমণ নিয়ে। এবার ফেরার গল্প। ঢাকা থেকে গন্তব্য জুবা, দুবাই,জেদ্দা আর কায়রো হয়ে। উদ্দেশ্য জেদ্দায় ৭২ ঘণ্টা ট্রানজিট নিয়ে মক্কা ও মদীনা দর্শন এবং অবশ্যই উমরাহ্ পালন।
বাংলাদেশ থেকে উমরাহ পালনের জন্য অবশ্যই কোন না কোন একটি অনুমোদিত ট্র্যাভেল এজেন্সির থেকে প্যাকেজ নিতে হয়। এক্ষেত্রে দিন,হোটেল এবং প্যাকেজভেদে পার পারসন খরচ ১,১০,০০০/- থেকে ১,৪০,০০০/- এর মত (প্লেন ফেয়ার সহ, নরমালি ঢাকা- জেদ্দা- ঢাকা টিকেট ৫০,০০০/- থেকে শুরু, খুব অদ্ভুতভাবে উল্টা রুটে জেদ্দা- ঢাকা-জেদ্দা রুটের টিকেটের দাম এর অর্ধেকের কাছাকাছি!)। সে সময়টাতে বাংলাদেশিদের জন্য উমরাহ ভিসা বা ভিজিট ভিসা বন্ধ ছিল, বিকল্প কি করা যায়,চিন্তা করে দেখলাম,সব আইনের ই কিছু গ্যাপ থাকে, এক্ষেত্রেও থাকা উচিত, এবং রাস্তা একটা পেয়ে ও গেলাম,উমরাহ ভিসা বা ভিজিট ভিসা বন্ধ থাকলেও ট্রানজিট ভিসা ত চালু আছে!এ সময় উমরাহ করতে চাইলে সৌদি আরবের উপর দিয়ে যাত্রাপথে ট্রানজিটে উমরাহ্ করে যাওয়ার চেয়ে চমৎকার সুযোগ আর কিছুই হতে পারে না, টাকা ত বাঁচল বাঁচলই, আর সাথে ভিসা জটিলতা থেকেও মুক্তি!সাধারণত যাত্রা বিরতি ৭২ ঘণ্টার কম হলে ট্রানজিট ভিসার জন্য আবেদন করা যায়,ট্রানজিট মেলালাম ৭১ ঘণ্টা ৫০ মিনিট, full utilization of time limit।
ঢাকার সৌদি দূতাবাসে অ্যাপ্লাই করলাম ট্রানজিট ভিসার জন্য।এদের ভিসা প্রসেস একটু আজব কিসিমের।দূতাবাসে বিশাল ভিড়, এদের প্রায় ৯৫ ভাগই নিজের জন্য আসেনি, তারা বিভিন্ন ট্র্যাভেল এজেন্সির এজেন্ট, হাতে বিশাল পেটমোটা খাম, ভিতর থেকে অনেকগুলো সবুজ পাসপোর্ট আর সাদা ফর্ম উকি দিচ্ছে। সিরিয়াল ধরলে সারাদিন পার হয়ে যাবে, অজ্ঞতা ভিড় ঠেলে Counter এ চলে গেলাম অনেকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে।এখানে একজন সৌদি নাগরিক বসে,আর সাথে তার দোভাষী এক বাঙালি। সৌদি বেটা বেশ কিছু প্রশ্ন করে, উত্তর সন্তোষজনক হলে পাসপোর্টের ফটোকপির উপর একটা সাইন করে দেয়। পরবর্তী কাজ অনলাইনে ফর্ম ফিল আপ করা। এটা আবার যে কোন যায়গা থেকে করলে হবে না, তাদের অনুমোদিত ৭/৮ টা এজেন্সি আছে,সেখান থেকে ফিল আপ করে নিয়ে আসতে হবে। এর একটা লিস্ট আছে,দূতাবাসেই পাওয়া যায়। সাইন করা পেপারস নিয়ে চলে গেলাম বনানী ১১ নাম্বারের আল মানার কনসালটেন্সি সেন্টারে। এখান থেকে ১২০০ টাকার বিনিময়ে ফর্ম ফিল আপ করে আবার এলাম দূতাবাসে। ফর্ম জমা দেয়ার ১৫-২০ মিনিটের ভিতরেই হয়ে গেল ভিসা।
এবার প্রিপারেশন ফেস। টানা ১ সপ্তাহ নেট ঘেঁটে হজ উমরাহ সম্পর্কিত যত আর্টিকেল পেলাম সব পড়ে ফেললাম।এভাবে মক্কা মদীনায় করনীয় বিষয়ের উপর যেমনঃ কোথায় কি করতে হবে, কোনটার পরে কোনটা, ইহরাম কিভাবে পরতে হবে, কোথায় কি দোয়া পড়া যায়, মক্কা মদীনার দর্শনীয় স্থান কি কি, কোথায় কিভাবে যেতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি..... নিয়ে একটা অতি দীর্ঘ ১৪ পাতার একটা নোট দাড়িয়ে গেল। আব্বুর থেকে শিখলাম ইহরাম কিভাবে পরতে হবে, সাথে ইউটিউবে বারকয়েক দেখে নিলাম।
এবার যাত্রার পালা। ঢাকা থেকে এমিরেটসে দুবাই হয়ে রাত ০৩৪০ এ পৌছালাম জেদ্দায়।সে এক বিশাল এয়ারপোর্ট, তার চেয়েও বিশালাকায় জঘন্য তার ইমিগ্রেশন আর তার কর্মকর্তারা। গদাই লশকরি চালে চলছে কাজকর্ম।বেশির ভাগ ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাই ইংলিশের ই ও জানে না। এখানেই খেয়ে ফেলল ৪ টা ঘণ্টা! আনবিলিভেবল !!! অবশ্য এসব অনাচার শুধু কালো আর বাদামী চামড়ার জন্য, সাদা চামড়ার তোয়াজ করার জন্য রয়েছে আলাদা সুপারসনিক গতির কাউনটার। কিছু বাঙালি এ দেখা পেলাম সেখানে, তবে তারা বড় কোন দায়ীত্তে নেই,সব ছোট ছোট কাজ। অবশ্য তারা যথেষ্ট হেল্পফুল।অবশেষে সকাল ৮ টার পর মুক্তি মিলল ইমিগ্রেশন থেকে।বাইরে অপেক্ষমাণ আনোয়ার আঙ্কেল আর তার বন্ধু করিম আঙ্কেল কে যে কি অবর্ণনীয় পাঙ্গায় রেখেছি এই ৪ ঘণ্টা তা বলাই বাহুল্য।
উমরাহ পালন আর মক্কা মদীনা দর্শনের জন্য ৭২ ঘণ্টা খুবই দুরহ শিডিউল, কিন্তু কিছু করার নেই, নবীর(সঃ) এর দেশে এসে তার সাথে দেখা না করে যাওয়া টা কেমন দেখায়! প্ল্যান করলাম, প্রথমে উমরাহ করব, এর পর চলে যাব মদীনা, সেখান থেকে ফিরে হারাম শরীফে টানা ৫ ওয়াক্ত নামায পড়ব। তিন দিনের জন্য এটা খুবই টাইট শিডিউল। পুরা সময়টা যেন আল্লাহ কে দিতে পারি তাই মসজিদেই থাকবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম, হোটেলে রুম বুকিঙের ব্যাপারে চিন্তাই করলাম না। হোটেল নিলে তার বিলাসবহুল কক্ষ আর আরাম আমাকে টানবে। রুমে থাকলে মন পরে থাকবে মসজিদে,আর মসজিদে থাকলে মন আকুপাকু করবে রুমে যেতে, এই দোটানা থেকে পার্মানেন্ট মুক্তি !
যাই হোক,পথিমধ্যে এক ভারতীয় রেস্টুরেন্টে ব্রেকফাস্ট করে চলে গেলাম বাব মক্কা নামক একটা জায়গায়।লাগেজ থাকল করিম আঙ্কেলের গাড়িতে, ফেরার সময় আবার নিয়ে নেওয়া যাবে।দুবাই এয়ারপোর্টেই ইহরাম বাঁধা হয়ে গিয়েছিল ।এখন পুরা ঝাড়া হাত পা,সাথে শুধু ছোট একটা ট্যাব এর ব্যাগ। বাব মক্কা থেকে ১০/১৫ রিয়ালে শেয়ারড মাইক্রো ছেড়ে যায় মক্কার দিকে। জেদ্দা থেকে মক্কা প্রায় ৭০ কিলো দূরত্ব, ফাকা রাস্তায় ও ঘণ্টা খানেক সময় লেগে যায় মক্কা পৌঁছাতে । অনেক দূর থেকেই মক্কা শরীফের মিনার আর ঘড়ি চোখে পড়ে। Underground টানেলে গাড়ি থামার পর এস্কেলেটর বেয়ে ওপরে উঠতেই সামনে দাড়িয়ে পবিত্র কাবাঘর! ৭৯ নাম্বার গেট দিয়ে প্রবেশ করলাম মসজিদুল হারামে। এই গেটের আশে পাশেই সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিস(ব্যাগ রাখার জন্য সেফ লকার, টয়লেট,বারবার শপ, রেস্টুরেন্ট,মার্কেট, জেদ্দা/ মদীনাগামী গাড়ি স্টপেজ.........ইত্যাদি) একত্রে পাওয়া সম্ভব। আরও কিছুটা ভিতরে যেতেই চোখে পড়ল স্বর্ণ খচিত কালো গিলাফে আবৃত কাবাঘর। এই সেই আল্লাহর ঘর, সারা জীবন শুধু টিভিতেই দেখে এসেছি।কত মুসলিমেরই ত সামর্থ্য,ইচ্ছা সবকিছু থাকার পর ও এখানে আসার তাওফিকহয় না! ইবনে বতুতার মত বহু মানুষ দূর দূরান্ত থেকে বছরের পর বছর পায়ে হেঁটে, ঘোড়ায় চেপে এই ঘরের কাছে এসেছিলেন। আবার কত মানুষ ক্বাবার পথে রওয়ানা হয়ে শেষতক আর পৌঁছুতে পারেন নি।আল্লাহ তায়ালা এত মানুষের মধ্যে আমাকে কবুল করেছেন, এই পর্যন্ত এনেছেন, কতই না সৌভাগ্যবান আমি ! মনে মনে ভাবতাম,হয়ত বৃদ্ধ বয়সে আল্লাহ যদি কপালে রাখে এই ঘরে একবার হয়ত আসা হবে, কিন্তু আল্লাহর প্লান ছিল আমার জন্য অন্য রকম।
যাই হোক, তাওয়াফ শুরু করলাম, শুরু হয়ে গেল উমরাহ। এ এক অন্য রকম অনুভূতি।কত মানুষ,কত বর্ণ- কালো,সাদা, বাদামী। অনেকে হুইল চেয়ারে করে তাওয়াফ করছে, কোন প্রতিবন্ধকতাই তাদের পথে বাধা হয়ে দাড়াতে পারেনি। অনেক পাষাণ হৃদয় ও এখানে এসে নরম হতে বাধ্য। মনের দুয়ার খুলে দোয়া করলাম মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে, মনে যা আছে, এই জীবনে যত দোয়া শিখেছি, ইন্টারনেটলব্ধ বিদ্যা যা যা নোট করে এনেছি, পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা যেসব দোয়া শিখিয়েছেন, হাদিস ঘেঁটে দোয়া করার যত আদব কায়দা এবং শিষ্টাচার শিখেছি, সব অ্যাপ্লাই করলাম।
জোহরের নামাজের পর চলে গেলাম সাফা মারওয়াতে সাঁই করতে। সেখানে যে কোন কালে পাহাড় ছিল,তা এখন আর মনে হওয়ার কোন উপায় ই রাখে নি সৌদি সরকার।সম্পূর্ণ জায়গাটি এখন একটা টানেলের মত।
সাই শেষ করলেই উমরাহ শেষ। এর পর মাথা মুণ্ডন পর্ব। মারওয়ার ফিনিশিং পয়েন্টে অনেক লোক কাঁচি দিয়ে নমুনা মার্কা চুল কেটে দেয়। আমার বিভিন্ন হাদিস লব্ধ নলেজে যা বুঝেছি তা হল, হয় প্রতিটা চুল সমান ভাবে কাটা লাগবে আর নয়ত একেবারে পুরাপুরি শেভ। যেহেতু দুনিয়ার কোন নাপিতের পক্ষে সম্ভব না এই গ্যারান্টি দেওয়া যে, সে মাথার প্রতিটা চুল কাটতে পারবে,এবং সেইটা সমান পরিমানে, সেহেতু ডাউট না নিয়ে মাথা শেভ করে ফেলাই উত্তম। শেভ করার পর ছিলা চাঁদিতে হাত বুলাতে ভালোই লাগে,সুন্দর গ্রিপ হয়! ৭৯ নম্বর গেট দিয়ে বের হয়ে হাতের বামে মার্কেটের পরেই বেশ কয়েকটা বারবার শপ আছে।গোসল আর ড্রেস চেঞ্জের জন্য হারাম শরীফের প্রতিটা গেটের বাইরেই রয়েছে হাম্মাম।
পরবর্তী গন্তব্য মদীনা। ৭৯ নং গেটের বাইরেই মদীনাগামী শেয়ারড মাইক্রো পাওয়া যায়।হারাম শরীফ থেকে মদীনার দূরত্ব ৪৩৫ কিলো। রাস্তা ফাঁকাই থাকে, এসব মাইক্রো অ্যাভারেজে ১২০ স্পীড ধরে রাখে, মোটামুটি ৪-৪.৫ ঘণ্টায় পৌঁছে যায়, ভাড়া ৫০-৭০ রিয়েলের মধ্যে, বারগেইনিং এর সুযোগ অবশ্যই আছে! সমস্যা একটাই, যাত্রী না ভরার আগ পর্যন্ত ছাড়বে না, আমি দুই ঘণ্টা গাড়িতে বসে ছিলাম। এছাড়া বাসেও মদীনা যাওয়া যায়, কিন্তু অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ বলে তেমন একটা জনপ্রিয় না।ধু ধু মরুভূমি আর রুক্ষ পাথরের পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে ছুটে চলেছে মদীনাগামী এক্সপ্রেসওয়ে। বালুকাময় হলুদ মরুভুমির জিওগ্রাফী বদলায় বাতাসের সাথে সাথে,সকালে এক রকম,বিকালেই তার আরেক রুপ! রক সলিড পাহাড় কেটে বানানো হয়েছে রাস্তা। রাস্তার পাশে দেখা মিলে মেষ চালক রাখালের। মনের অজান্তে মানস পটে ভেসে উঠে ছোটবেলায় খানিকটা দাদীর কাছে শুনা আর খানিকটা বইতে পড়া আরবের মরুভূমি আর বেদুইনের গল্প। সন্ধ্যার সাথে সাথে নেমে আসে হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা, দিনের বেলার তপ্ত বালুকাভুমির ঠিক বিপরীত! এসব নানা চমৎকারে চমৎকৃত হয়ে রাত সাড়ে ১০ টায় পৌঁছে গেলাম মদীনা, গাড়ি মসজিদে নববীর পাশেই নামিয়ে দেয়।
মদীনার বাতাসে এক অন্যরকম প্রশান্তির ছোঁয়া।শিষ্টাচার আর ভদ্রতায় মদীনাবাসী অতুলনীয়। মসজিদ কমপ্লেক্সের মনোরম আলোকসজ্জা আর ছাতা সদৃশ থামগুলো অত্যন্ত মনোরম, দেখেই একটা শীতল শান্ত অনুভূতি মন কে ছুয়ে যায়। এই সৌন্দর্যের বর্ণনা লিখে প্রকাশ করা সম্ভব না। এখানেই শায়িত আছেন মহানবী (সঃ), দুপাশে দুই ঘনিষ্ঠ সাহাবী, আবু বকর আর উমার ফারুক। রওজার কাছে অনেক ভিড়, প্রথমে পৌছাতে পারলাম না। অপেক্ষায় থাকলাম,কখন ভিড় একটু কমে। মধ্যরাতে আবার চেষ্টা করলাম, এবার সহজেই যেতে পারলাম। রওজার সামনে দাড়িয়ে মনে হল, আমি যেন নবীর (সঃ) সামনেই দাড়িয়ে আছি,তিনি যেন আমাকে দেখছেন।নফল নামাজ, কুরআন, ঘুম,তাহাজ্জুদ...... এ ভাবে মসজিদেই পার হয়ে গেল রাতটা।
ফজরের পর পর ই বের হলাম মদীনা শহর দর্শনে। মসজিদে নববীর বাইরেই ফুটপাতে সকাল সকাল ফল বিক্রি হয়। বড় লাল আঙ্গুর দেখে লোভ হল। খানিকটা কিনে মুখে দিলাম, মনে হল এত সুস্বাদু আঙ্গুর কখনো খাওয়া হয় নি। কিছু নিজে খেলাম,কিছু মুসল্লিদের মাঝে বিতরন করলাম, বিতরনেও এত শান্তি, এত আনন্দ, আগে কখনো অনুভব করি নি। সবার মুখেই হাসি, মনে হল, ১৪০০ বছর আগের মুহাজির আর আনসারদের মিলনমেলায় চলে এসেছি আমি।
মক্কা মদীনায় একটু কান খাঁড়া রাখলেই আশে পাশে বাংলা শুনতে পাওয়া যায়। কিছু বাঙালি ক্লিনারের সাথে পরিচয় হল। এদের থেকেই জানতে পারলাম,২১ নাম্বার গেটের সামনে থেকে মাইক্রো ছাড়ে, মদীনা সাইট সিইং এর জন্য, জনপ্রতি ১০ রিয়াল। ৪/৫ টা দর্শনীয় স্থান( মসজিদে কুবা,মসজিদে কেব্লাতাইন, হজরত হামজা এর কবর ইত্যাদি) ঘুরিয়ে দেখায়।
মদীনার আরেক সৌন্দর্য হল কবুতর।রাস্তার পাশে খাবার ছিটানো থাকে, আর ঝাঁকে ঝাঁকে কবুতর সেখানে চরে বেড়ায়। ছোট শিশুরা কবুতর ধরার চেষ্টা করছে হাসি হাসি মুখে, এ এক অপার্থিব সৌন্দর্য !
মদীনা থেকে ফেরার আগে এক বাঙ্গালি হোটেলে নাস্তা করলাম, কর্মচারীদের সাথে সুখ দুঃখের আলাপ হল,খুব আন্তরিক কিছু সহজ সরল সাধারণ মানুষ এরা। অনেক পরিশ্রম করে তারা দেশে ডলার পাঠায়, তার খুব কমই আমরা অনুধাবন করি। এদের বেশির ভাগের ওয়ার্ক পারমিটেই লিখা “শ্রমিক”, এরা যত বছর ধরেই এ দেশে থাকুক না কেন, পরিবার নিয়ে আসার পারমিশন কখনোই পায় না। বিদেশের মত যায়গায় নিঃসঙ্গ জীবনযাপন যে কতখানি দুর্বিষহ, লেখনীর সাধ্য নেই তার বর্ণনা দেয়ার।
মদীনা চ্যাপ্টার শেষ করে আবার ফিরে এলাম মক্কায়। মনের ভিতর একটা সুপ্ত ইচ্ছা ছিল, মসজিদুল হারামে যদি টানা ৫ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সাথে আদায় করতে পারতাম! একারণেই তড়িঘড়ি করে মদীনা থেকে ফিরে এলাম, জাস্ট আছরের পূর্ব মুহূর্তে, প্ল্যান হল পরবর্তী আছর পর্যন্ত হারামের সাথেই থাকা। পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় মসজিদে হারামের প্রতিটি যায়গা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। আরও বেশ কয়েক দফা তাওয়াফ করলাম,নিচতলা, দোতালা, তিনতলা সব জায়গায় ই আলাদা আলাদা ভাবে। সবশেষে তিনতলার ছাদ থেকে কাবাঘরের দিকে অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকলাম অনেক সময় নিয়ে, অনুভব করার চেষ্টা করলাম ভিতর থেকে।
মানস পটে সিনেমার স্ক্রিনের মত ভাসতে থাকল পিতাপুত্র হজরত ইব্রাহীম আর ইসমাইলের এই ঘরের নির্মাণকাজ, শিশু ইসমাইল কে রেখে মা হাজেরার সাফা মারওয়া তে দৌড়াদৌড়ি, কাবা শরীফের পাশে আবু জেহেল আর আবু সুফিয়ানের আস্ফালন,বিলালের উপর চলা অবর্ণনীয় নির্যাতন আর আহাদ, আহাদ উচ্চারন! এই ঘরের পাশেই মিশে আছে বিলালের চর্বিগলা ভেজা বালু। ইসলামের প্রথম শহীদ হজরত সুমাইয়া এর শাহাদাত লাভ।এই ছাদের উপর থেকেই মক্কা বিজয়ের পর বিলাল আজান দিয়েছেন,আমি যেন বিলাল কে দেখতে পাচ্ছি! আমার সামনেই কাবার দরজা, এই দরজা দিয়েই বের করা হয়েছিল ৩৬০ টি মূর্তি, এই দরজা দিয়েই মহানবী ঢুকেছিলেন! কত মহাকালের সাক্ষী এই ঘর! আল্লাহ আমাকে শারীরিক শক্তি থাকা অবস্থায় এই ঘর পর্যন্ত এনেছেন, এই শুকুরিয়াই আদায় করা কঠিন।
কাবা শরীফে বেশ কিছু বাঙ্গালির সাথে দেখা হয়েছে। সাথে ফোন না থাকায় জাগতিক বিভিন্ন পেইন থেকে অনেক দূরে ছিলাম, কোন টেনশন ছিল না, নিবিড় মনে আল্লাহর সান্নিধ্য অনুভব করেছি। তৃষ্ণা পেয়েছে, জমজমের পানি খেয়েছি, বাইরে যেয়ে হাল্কা নাস্তা করে আবার ফিরে গিয়েছি মসজিদে।ইচ্ছা করেই ক্যামেরা নেই নি, যেন ছবি তোলার দিকে মনোযোগ চলে গিয়ে আসল উদ্দেশ্য বাহ্যত হয়। মোবাইলে যা তোলা যায়, তাতেই সন্তুষ্ট থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। শুরু করলাম হারাম শরীফ এক্সপ্লোর।দেখলাম,৭৯ নাম্বার গেটের কাছে একটা লাইব্রেরী আছে যা অনেকেরই অজানা থেকে যায়,বিভিন্ন ভাষার ইসলামিক অনেক বই এখানে আছে এখানে। এছাড়া মালিক ফাহাদ গেটের কাছ থেকে সৌদি সরকার থেকে পাবলিশকৃত ইসলামের বেসিক কিছু বই ফ্রী বিতরন করা হয়, অনেকগুলো ভাষায় অনূদিত বইগুলো খুবই হেল্পফুল,আমাদের অনেক বিভ্রান্তি দূর করতে খুব ই কার্যকর। বাংলা ভাষায় যে কয়টি বই পেলাম, নিয়ে নিলাম,একটু বেশি ই নিলাম, একাধিক কপি, বিতরনের জন্য।
মসজিদে হারামে অনেক কিছু দেখে যেমন মুগ্ধ হয়েছি,তেমনি অনেক কিছু দেখে খুব হতাশ ও হয়েছি। সাধারনত,মানুষের উচিত দুনিয়াবি সব কাজ বাইরে রেখে এসে এখানে এসে শুধু আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের চেষ্টা করা,সেই দিকেই মনোনিবেশ করা। এসব বাদ দিয়ে অনেক কেই দেখলাম তাওয়াফ এর সময় আল্লাহর অনুগ্রহ আর ক্ষমা তালাশ না করে বিভিন্ন ভঙ্গিতে সেলফি তুলে যাচ্ছে, ভিডিও করছে বার বার। সারা দুনিয়াকে জানান দিতে চায় যে সে এখানে আছে, কি যে কাজ করে এদের মাথায় আল্লাহ ই ভালো জানেন।আল্লাহ এদের হেদায়েত দান করুন।
এছাড়াও আরও অপকর্ম আছে, সাধারনত প্রতি ওয়াক্ত নামাজের আধা ঘণ্টা আগে থেকে তাওয়াফ বন্ধ হয়ে যায়,মুসল্লিরা কাতারে কাতারে বসে যায় কাবা ঘরকে ঘিরে।ইভেন উমরাহ চলাকালেও যদি নামাজের সময় হয় তখন বিরতি নিতে হয়,কিন্তু কিছু মানুষ এ সময়েও সামনের বসা লোক জন কে লাত্থি গুতা দিয়ে হলেও তাওয়াফ করতেই থাকবে,করতেই থাকবে! আরও আছে, তাওয়াফের সময় সামনের জনকে ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা ,হাজরে আসওয়াদের সামনে লজ্জাজনক নারকীয় ধাক্কাধাক্কি আর সেলফি তুলার অসুস্থ প্রতিযোগিতা !আরেক ধরনের প্রতারক আছে এখানে, মিথ্যা টাকা পয়সা হারানোর কাহিনি ফেঁদে অর্থ সাহায্য চাওয়ার কাহিনীও দেখেছি,আল্লাহর ঘরে এসেও এদের হাত থেকে নিস্তার নেই।
আসরের পর রওয়ানা হলাম জেদ্দার পথে। কিছু কেনাকাটা আর বাকি টা সময় করিম আঙ্কেলের বাসায় কাটিয়ে মধ্যরাতে পৌঁছুলাম এয়ারপোর্ট এ।করিম আঙ্কেলের মেহমানদারীর কথা আলাদাভাবে উল্লেখ না করলে অন্যায় হবে।জেদ্দায় বাংলাদেশি কেউ আসলে উনি শুধু তার জন্য জীবনটা দেয়া বাকি রাখেন।করিম আঙ্কেল সৌদি আরবের নামকরা লেজার শো স্পেশালিষ্ট,বাসার সাথেই তার স্টুডিও। একটা মিনি লেজার শো ও দেখা হয়ে গেল ডিনারের পর ডেজার্ট হিসেবে।আরো কিছু বাঙ্গালির সাথে দেখা হল তার বাসায়, অলমোস্ট মিনি গেটটুগেদার হয়ে গেল।
এভাবেই শেষ হয়ে গেল ৭১ ঘণ্টার ট্রানজিট। সুবোধ যাত্রীর মত সৌদি আরবের সাথে লেনদেন চুকিয়ে আবার ফিরে এলাম এয়ারপোর্ট। অলমোস্ট বিনা পয়াসায় যাত্রাপথে উমরাহ হয়ে গেল। মনে মনে প্রত্তাশা,আল্লাহ যেন বার বার আমাকে তার ঘরে আসার তাওফিক দান করেন। সমস্ত প্রশংসা তার জন্য, নিশ্চয়ই আমাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য তার সন্তুষ্টি অর্জন।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মে, ২০১৬ রাত ৯:৫৭