(উৎসর্গঃ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার জন্য শুরু হয়েছিল যে প্রাণপণ যুদ্ধ, তার অবসান ঘটে ১৬ ডিসেম্বর- আমাদের চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে। কিন্তু এ বিজয় এসেছিল এক সাগর রক্তের বিনিময়ে। তাই বিজয়ের আনন্দের বিপরীতে আছে স্বজন হারানোর বিষাদ। বিজয় দিবসের প্রভাতে শহীদদের উদ্দেশে আমরা বলি: আমরা তোমাদের ভুলব না।)
'একটি বাংলাদেশ, তুমি জাগ্রত জনতার/ সারা বিশ্বের বিস্ময়, তুমি আমার অহংকার...।' একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক, ২৫ মার্চ কালরাতের পর জাগ্রত জনতার গর্জে ওঠা; তারপর ৯ মাসের রক্তস্নাত সংগ্রাম শেষে ১৬ ডিসেম্বর বাংলার আকাশে বিজয়ের লাল সূর্যোদয়-সত্যিই এ এক বিস্ময়। এ এক অহংকার। আজ সেই বিজয়ের দিন। এই দিন গোটা বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেছে পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নতুন দেশের অভ্যুদয়; রচিত হয়েছে বাঙালি জাতির বীরত্বের অধ্যায়। সেই মহান বিজয়ের আজ ৪১তম বার্ষিকী।
জাতি আজ শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করছে, স্বাধীনতা-সংগ্রামের মহান পুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। 'পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, আমার তোমার ঠিকানা' বাঙালির স্বাধীন স্বদেশের এ দিশা দিয়ে তিনি ঘুমজাগানিয়া গান শুনিয়ে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিলেন সমগ্র জাতিকে। সুদীর্ঘ দুই যুগের নিরবচ্ছিন্ন স্বাধিকার আন্দোলনের মাহেন্দ্রক্ষণে শুনিয়েছিলেন মুক্তির গান 'এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব পাকিস্তানের জান্তার শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের সময় একাত্তরের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্সের (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসমুদ্রে সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের ডাক দিয়ে ঘোষণা করেছিলেন, 'প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।'
১৬ ডিসেম্বর শুধু বিজয় উৎসবের নয়, বিজয় অক্ষুণ্ন রাখার শপথেরও দিন। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের একচল্লিশতম বার্ষিকীতে জয়ের আনন্দ ও স্বজন হারানোর বেদনা মিশ্রিত অনুভূতি নিয়ে জাতি আজ উদ্যাপন করছে মহান বিজয় দিবস। বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। একাত্তরের এই দিনে দামাল মুক্তিযোদ্ধা আর মুক্তিপাগল মানুষের যূথবদ্ধ প্রতিরোধ-লড়াইয়ের মুখে উধাও হয়েছিল পাকিস্তানি বর্গিরা। ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল এ বিজয়, প্রিয় স্বাধীনতা। ১৬ ডিসেম্বর একরাশ সোনালি স্বপ্ন হৃদয়ে ধারণের দিন।
স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের আবির্ভাব ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা। সেই সময়ের বিশ্বপরিস্থিতিতে নতুন কোনো স্বাধীন রাষ্ট্রের আবির্ভাব খুব সহজ ছিল না। কিন্তু সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিচল প্রত্যয়, অশেষ ত্যাগ স্বীকার, মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের সুযোগ্য ভূমিকায় সেই অসম্ভবকে সম্ভব করা গিয়েছিল। বাংলাদেশের নিপীতিড় মুক্তিকামী জনগণের লড়াই সে সময় বিশ্বব্যাপী বিপুল আবেগ সঞ্চার করেছিল।
বিজয় দিবস উপলক্ষে আজ সাধারণ ছুটি। ভোরে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে বিজয় দিবসের কর্মসূচি শুরু হয়েছে। সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উড্ডীন। ঘরে ঘরে উড়বে লাল-সবুজ পতাকা। সূর্যোদয়ের সময় সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে স্বাধীনতার শহীদদের অমর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেছেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় নেতারা। স্মৃতিসৌধে নেমেছে স্বাধীনতাপ্রিয় জনতার ঢল। বিজয় দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে জাতীয় সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ করেছে বিশেষ ক্রোড়পত্র। টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হচ্ছে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। কিন্তু তারপরও কোথায় জানি একটা শুন্যতা থেকে যাচ্ছে। হায়দার হোসেন এর গানটা বার বার মাথায়ে চক্কর দিচ্ছে কারন স্বাধীনতা অর্জনের পর রাজনৈতিক নেতৃত্বের নানা ভুলের কারণে বারবার সামরিক অভ্যুত্থান ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবক্ষয়ের কারণে গণতন্ত্র ব্যাহত হয়েছে, এখনও হচ্ছে-
ত্রিশ বছর পরেও আমি স্বাধীনতটাকে খুজছি...
স্বাধীনতা কি বৈশাখী মেলা, পান্তা ইলিশ খাওয়া?
স্বাধীনতা কি বটমূলে বসে বৈশাখী গান গাওয়া?
স্বাধীনতা কি বুদ্বিজীবির বক্ত্রিতা সেমিনার?
স্বাধীনতা কি শহীদ বেদিতে পুস্পের সমাহার?
স্বাধীনতা কি গল্প, নাটক উপন্যাস আর কবিতায়?
স্বাধীনতা কি হোটেলে হোটেলে গ্রান্ড ফ্যাশন শো?
স্বাধীনতা কি দুখিনী নারীর জড়াজীণ্ বস্র?
স্বাধীনতা কি অন্নের খোজে কিশোরী প্রমোদবালা?
স্বাধীনতা কি হরতাল ডেকে জীবন করা স্তব্ধ?
স্বাধীনতা কি ক্ষমতা হরনে চলে বন্দুক যুদ্ধ?
নেতা বলো নেত্রী বলো সবার মুখে একই কথা,
“ক্ষমতায় গেলে দেশ বানাইব সোনার খনি!”
কিন্তু যখন পায় ক্ষমতা ভুলে যায় সব অতীত কথা,
ব্যক্তিগত রেশারেশির শোধ নিবার চায়।
আর এই সুযোগে মন্ত্রি আমলা আখেরও গোছায়।
উন্নয়ণ যে বন্দী রইল ফাইলের পাতায়।
বলো বলো রে হায় হায়...
বঙ্গ দেশের রঙ্গ নিয়ে রচিলো হায় কত গান,
সেই গানের মর্মব্যাথায় জুড়ায় আমার মনপ্রান।
“এমন দেশটি কথাও খুজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভুমি”।
সেই রানীর দেশে জন্ম নিয়া কপালেতে রাজ তিলক দিয়া
এমনতর বাটপারি করা কি আমার শোভা পায়।
বলো বলো রে হায় হায়...
আজ নেই বরগী নেই ইংরেজ নেই পাকিস্তানী হানাদার,
আজও তবু আমার মনে শুন্যতা আর হাহাকার?
আজও তবু কি লাখো শহীদের রক্ত যাবে বৃথা?
আজও তবু কি ভুলতে বসেছি স্বাধীনতার ইতিকথা?
এ বছর এমন একটি সময় বিজয় দিবস উদযাপিত হচ্ছে যখন প্রায় প্রতিদিনই গুপ্তহত্যার খবর আসছে, আছে চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা, আছে রাজনৈতিক হানাহানি, আছে উদ্ধমুখী নিত্যপ্রয়জনীও বাজার, আছে সাধারন মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি গুলোর হাপিত্যেশ-নাভিশ্বাস, নড়বরে অর্থনীতি, আছে শেয়ারবাজারের বিপর্যয়, রাস্তায়ে রাস্তায়ে ভিক্ষুকদের শঙ্খা বৃদ্ধি, আছে ডেসটিনি-হালমার্ক কেলেঙ্কারি, দুর্নীতি জাঁকিয়ে বসেছে, বিশ্ব ব্যাংক সহ বড় বড় দাতা গোষ্ঠী আমাদের উপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, জ্বালানি তেল আর বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির জন্য সাধারন মানুসের দুর্ভোগ, টিপাই মুখ বাঁধ এর বিরোধিতা কিনবা বাধা দেবার রাষ্ট্রীয় অক্ষমতা, তার উপর আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতি, মৃত্যু দণ্ড প্রাপ্ত খুনিদের ও দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মুক্তি দেওয়া হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়, সরকার সমর্থিত সংগঠন গুলো মেতে উঠেছে প্রকাশ্য খুনখুনিতে- চাদাবাজিতে, উৎসব হচ্ছে কে কার চাইতে বেশি রক্ত ঝড়িয়ে নিজের পোস্ট পাকা করতে পারে-ঠিক যেমন ছিল আইহামে জাহিলিয়াত এর যুগে, যেখানে পুলিশ সহ সকল আইন শৃঙ্খলা বাহিনি অসহায় কিনবা দেখেও না দেখার ভান করছে, আর এইসব কারনে বহির্বিশ্বে আমরা হয়ে পড়েছি বন্ধুহীন, সর্বোপরি একটি অস্থির সময়।
এখন থাক এই হতাশার কথা। পৌষের শিশিরসিক্ত সকাল এখন। রক্তলাল সূর্য উঠেছে পূর্ব দিগন্তে। প্রভাতসূর্যের বর্ণিল আলোকচ্ছটায় ভাসছে বাংলাদেশ।
'বিজয় নিশান উড়ছে ওই বাংলার ঘরে ঘরে।'
সবাইকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা!
মুক্তিযুদ্ধের গল্পঃ “মুক্তিপথের অগ্রদূতের চরম বন্দনা”