রূপালী মাছের মত
যেদিন নদীর নীলে
তুমি খুলে দিলে নিজস্ব গোপন
জলের রহস্যে মূল্যবান হলে তুমি;
সেই থেকে পৃথিবীর সমস্ত নদী
আমার অভিন্ন হৃদয়।
-নদী আখ্যান
পৃথিবীর সমস্ত নদীর কোমলতা আর গভীরতা নিয়ে কবির আকাঙ্খাকে মিশে যেতে দেখি ইতিহাসে। কবিতা এক অনন্য যুদ্ধাস্ত্র,কবি সেই সৈনিক যা দিয়ে পাঠকের মন জয় করে অবলীলায়। কবি সালিম সাবরিন গত শতকের মধ্য আশীর দশক থেকে কবিতা লিখছেন। নিরবে নিভৃতে নিজের মত একাকী। স্বীকার করতেই হয় সৈনিক তিনি। নিজেকে প্রকাশের জন্য উচ্চকিত আড়ম্বর নেই বরং যুদ্ধেই যার নিজেকে নিবেদনই একমাত্র শপথ। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ''দুমুখো ঈগলের কোলাজ''। নামটাই কেমন অদ্ভুতভাবে আকৃষ্ট করে। কি রহস্য এই দুমুখো ঈগলে। একটু পেছনে ফিরলেই দেখতে পাই সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন আর বিশ্ব পুঁজিবাদের প্রসারে সামরিক স্বৈরতন্ত্রের ছোবলে আক্রান্ত তৃতীয় বিশ্ব। সোভিয়েত রাশিয়ার ভাঙনের মুহূর্তে লেলিন স্কোয়ার থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে লেলিনের মূর্তি। সেখানে স্থাপন করা হয়েছে জারতন্ত্র আর সাম্রাজ্যবাদের প্রতীক দুমুখো ঈগল।
সেই দুমুখো ঈগলের কোলাজ ই কবি আঁকছেন তার কবিতায়। বাংলাদেশের গনতন্ত্র তখন হরন করে যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারা চলছে, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ভূলুন্ঠিত, দেশ প্রায় অকার্যকর, অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে যুদ্ধের বিভীষিকা, ঠিক এ সময় কবি সঞ্চয় করছেন তার কাব্যের উপকরন।
বড় বড় আর শক্ত কথা দিয়ে জটিল করে ফেলতে চাইনা কবিকে অথবা কবিতাকে। নিতান্তই আমার ভাললাগা থেকে লিখতে শুরু করেছি। লেটার প্রেসে ছাপা দু'মুখো ঈগলের কোলাজ হাতে নিতেই এক অন্যরকম অনুভূতি হয়। সেই প্রাচীন শব্দের কথা মনে হয়, বসে বসে খটাখট করে কেউ একজন কবিতার প্রতিটি বোধ ছাপার অক্ষরে ফুটিয়ে তুলছে। যেন হাত দিলেই টের পাওয়া যায় প্রথম বইয়ে কবির অসম্ভব মমতার কথা।
এই কাব্যে রয়েছে মোট ২৮টি কবিতা রয়েছে। প্রেম,প্রকৃতি,ইতিহাস, ঐতিহ্য আর গনমানুষের কথা জড়াজড়ি করে রয়েছে কবিতা গুলোতে।
প্রতিটি কবিতা ই সামনে আসে ভিন্নতার স্বাদ নিয়ে। 'বৃক্ষের টেলিপ্যাথি' দিয়ে যাত্রা শুরু করে আর থামতে হয়না। 'নদী আখ্যানে' এসে কবির প্রশ্ন দোলা দিয়ে যায় -
''নদী কি মানুষের অস্তিত্বের দলিল!
নদী কি চিরকাল প্রেমিকের নীল অনুভব!
কবি নিজেই হয়ত তখন চেষ্টা করছেন প্রশ্নটিকে জয় করতে। একের পর এক উত্তরে তিনি কখনো নদীকে বলছেন আশা ও ইতিহাসের নাম নদী,কখনো বলছেন প্রবাহিত মানবস্রোতের নাম নদী।
পৃথিবীর ইতিহাস ঝড়োষ্ণ জলে মিশে আছে আর তাই হয়ত খাদ্যের প্রয়োজনে, বেঁচে থাকার লড়াই এ বারবার তৈরী হয় প্লাবনে ভাসার কিস্তি,নুহের নৌকা।
আপন অস্তিত্বের চারপাশের প্রতিনিয়ত বিষ অপেক্ষা করে দংশনের। এতো কেবল এক জনমের যাত্রা, অথচ এমন যাত্রা অনাদিকাল হতে প্রতিজনের। 'ফনায়িত হাত' কবিতায়
তাই কবিকে হয়ে যেতে দেখি ইতিহাসের অংশ। হরপ্পা সেই প্রাচীন সভ্যতা যার সাথে লুকিয়ে আছে ধ্বংশ হয়ে যাওয়া অনেক স্বপ্ন আশা আর আকাঙ্খা। সেই নগরের মত অন্ধকারে চলে যেতে হয়,যায় উষ্ণতার বর্তমান। কত পট পরিবর্তন হয়, অস্তিত্ব পুড়ে যায় আগুনে যেন চারপাশে কি নিদারুন হতাশা!
রোমান্টিক কবি সালিম সাবরিন রোমান্টিকতার আবহে থেকে আশ্চর্য শব্দজাত বোধের চেতনায় আকৃষ্ট করে রাখেন পাঠক কে। 'হরতালে রচিত পঙতিমালা' কবিতায় দেশপ্রেমিক কবিকে দেখি। কবি মূলত সাহসী,বিপ্লবী এবং আত্নবিশ্বাসী। মানবিকতার পরাজয়ে স্পষ্ট প্রতিবাদী হয়ে উঠেছেন তিনি। স্বৈরাচারবিরোধী গনতান্ত্রিক আন্দোলনে কবিও তার অংশের কথা উচ্চারনে সোচ্চার। দেশমাতৃকা তখন প্রেমিকার রূপ ধরে কবির সামনে।
''আজ হরতাল হবে এ শহরে
ভবানীগঞ্জে কোন মিনিবাস যাবেনা
পেপারওয়েটের মতো হৃদয়ে পাথর রেখে
কষ্ট পাবো, সারাদিন
আজ আমাদের দেখা হবেনা।''
কবিতায় পট বদল হয় তখনি যখন তিনি দৃপ্ত কন্ঠে বলেন,
''তুমি আমার দেশ প্রিয়তমা
তুমি প্যালেস্টাইনের ষোড়শী যুবতী
ইসরাইলের হিংস্র সৈনিকের হাত থেকে
আমি তোমাকে রক্ষা করার জন্য লড়ছি।''
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন অতিক্রম করে তরুন কবির এই কাব্যে রোমান্টিকতা মননের প্রতিবিম্ব স্পষ্ট। অথচ এই রোমান্টিকতা শুধুমাত্র নিছক প্রেমজ নয় বরং পরতে পরতে যুক্ত হয়েছে ভিন্নমাত্রা। 'বন্ধকী নিবাস থেকে' কবিতায় প্রেমিকাকে ফিরে পাবার দূর্বার আকাঙ্খায় থেকেই কবি মনে করিয়ে দেন-
''উইনি মেন্ডেলার মতো
দেখো,আমরাও একদিন
ফিরো পাবো
বসন্ত- আফ্রিকা।
কবির কি শুধুই বসন্ত ফিরে পাবার ব্যাকুলতা? না। কবির ব্যাকুলতা স্বাধীনতার জন্য। এই স্বাধীন জীবন ই আনবে বসন্তের সুবাতাস।
'কোথায় রাখবো স্পর্শ আমার' কবিতায় কবির যে হাহাকার দেখি তা ছড়িয়ে পড়ে উত্তর থেকে উত্তরে। এ হাহাকার একা কবির নয় এ হাহাকার উত্তর প্রজন্মের ও।
''হিরোশিমা কিংবা হেলেনের গ্রীসের মত
হরিৎমানচিত্রে তুমি বুঝি গলিত বিষাদ!
ধূসর আকাশের হৃদয়,বিষন্নলোকী বেলাভূমি
পৃথিবীর লুন্ঠিত সবুজ বাগানে তুমি
গোলাপের তাজা লাশ হয়ে আছো
এতো ভোরে তোমার চোখের ভেতর সূর্যাস্তের
মুমূর্ষু আলো,- কোথায় স্পর্শ রাখি বলো!''
'বিশ্ববিহারী ঐতিহ্যানুসন্ধানী এই কবি প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের বিচিত্র নগর, সভ্যতা আর চরিত্রকে কবিতায় তুলে এনেছেন স্বাভাবিক গতিতে। মানব ইতিহাসের পত্তনের সময়কাল থেকে কবির নিত্য ভ্রমন এই সংসারে। আর তাই কবি হতাশার ভারি পাথর চাপে খন্ডিত। এই তীব্র অন্ধকার কবির অসহ্য হয়ে উঠেছে।
''চারিদিকে হৃৎপিন্ডের ধ্বংশ,দূর্ভিক্ষের দাহ
কেবল চারিদিকে যুডাস- জুপিটার- বিভীষণ
হন্তারকের হিংস্র হাতিয়ার, তেজষ্ক্রিয় আক্রোশ
মাড়ি এ মড়কে হুলস্থূল পৃথিবীতে ক্ষয়ে ক্ষয়ে
নিমজ্জিত শতাব্দী...''
সময়ের খেয়ায় চড়ে কবির যে জীবন উপলব্ধি তা মূলত বিষাদাত্মক। একজন সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে এই হাহাকার কবির কাছে প্রত্যাশিত নয় কিছুতেই।
'উত্তরাধিকার' কবিতায় কুন্তাকিন্তে কে জানতে গিয়ে খুলে যায় আরো অনেক রহস্যমুখ। বহু শতাব্দীর দাসত্বের শৃঙ্খল কে না চায় ভাংতে! কবির হয়ত কোন জনমে স্বপ্নই ছিল ভূপর্যটক হবার। অতীত থেকে অতীতের সুগন্ধীময় প্রান্তর চষে বেড়ানোর। অথচ উত্তরপুরুষ হবার যাতনা পদে পদে টের পান কবি।দাসত্বের সেই শেকলের ঝনঝনানি কবিকে ব্যাকুল করে।
''অথচ ক্রান্তির শব্দ শুনেই
দৌড়ুলে পা ফেটে রক্ত ঝরে
নিগড়ের ফাঁদে পড়ে থাকি
আজও আমার পায়ের নিচেই
ঝনঝন শব্দে বেজে ওঠে
কুন্তাকিন্তের মতন বহু শতাব্দীর
দাসত্বের পুরাতন সেই শৃংখল।''
'দুমুখো ঈগলের কোলাজ' মূলত যাপিত জীবনের ছায়া। যে ছায়া নিত্য ঘটনাপ্রবাহে কখনো আমাদের বিমূঢ় করে আবার কখনো বা করে আশান্বিত। সময়ের সাথে সাথে চিন্তাধারার নিগূঢ় পরিবর্তন হয়। কবি চঞ্চল হৃদয়কে দমাতে পারেন আবার উসকে দিতেও পারেন। কবি তাঁর হাত দিয়েই ফোটান নান্দনিক শব্দের ফুল।
তাই সাধারন সব কথার ভেতরে কবির হতাশা যেমন ফুটে ওঠে তেমনি সচকিত হয়ে দেখি কবিতো শেষাবধি আশার কথাই বারবার বলছেন! 'দু মুখো ঈগলের কোলাজ' গ্রন্থের শেষ কবিতা 'আমি চলে যাচ্ছি' তাই স্বস্তি দেয়।
''আমি চলে যাচ্ছি
যেতে
যেতে
যেতে
যেতে
শেষাবধি রয়ে গেলাম তোমার কাছে।''
'পড়ন্ত শতাব্দীর কবিতা'য় কবি দূর ইতিহাসের আশ্রয় নিয়ে বলে চলেছেন, অন্তরের অব্যক্ত বেদনাকে দিয়ে যাচ্ছেন রূপ। কৃষকের শ্রমে ঘামে ভিজে থাকা মাটি কি করে প্রতিনিয়ত পরাজিত আর অপমানিত হয়ে যাচ্ছে, এ পরাজয় রন্ধ্রে রন্ধ্রে কবিকে ব্যাকুল করে! স্বদেশের প্রতি প্রবল মমতা কবিতায় ফুটে উঠে তাই ইতিহাসের উজ্জ্বলতম চরিত্রগুলোকে সাক্ষী করে।
''মাঝে মাঝে শিলাবৃষ্টি আসে,তচনচ করে
কৃষকের পাকা ধানক্ষেত
যেন বন্য ডাস্টবিন; করাতের স্রোত
স্বদেশের মানচিত্র ছিঁড়েখুঁড়ে গেলে
শের-শায়েরীর মত অভিজাত ইতিহাস
মমতাময়ী ইলামিত্র বুকে জমা রাখে রক্তপাত।''
যেমন ইতিহাস কবির হাতে উপমা প্রতীকে রূপ পেয়েছে কবিতায়, তেমরি ভাবে তারুন্যের জয়গান করতে কবি ভোলেন নি। মিছিলে মিছিলে শুধু অন্যায়ের প্রতিবাদ নয় পাওযা যায় তরুনের মনোশক্তির পরিচয়। 'কালবেলার গল্প' কবিতায় আমরা দেখি-
''এ পথে রক্ত ছিল,প্রান্তরে
আলোর মশাল,প্রানের ভ্রুনে ভ্রুনে
রূপালী হিংসা
দেখেছি অনেক।
এখানে দেখেছি
স্তব্ধতা শিহরিত সাহসী সকাল
পৃথিবীর জঠরে জঠরে
রক্ত এনেছে, দিয়েছে মুক্তি
আর সংহতি।''
প্রকৃতির নির্মল উপাদান,ইতিহাসের সঞ্চয়,প্রেমের সঞ্জীবনী সুধা কবির হাতে প্রান পেয়েছে 'দুমুখো ঈগলের কোলাজ' কাব্যগ্রন্থে তা বলাই বাহুল্য। কবিতা কবিকে স্বস্তি দেয় হৃদয়ের ভার মুক্তির। আর পাঠককে দেয় অনাবিল আনন্দ এবং চিন্তার খোরাক। সব কবিতা পাঠকের ভাল লাগবে বা লাগতেই হবে এমন দায়বদ্ধতা কখনো থাকেনা কোন কবির। কবি সালিম সাবরিন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পর দীর্ঘদিন কবিতা লিখেছেন, নিজের মত করে নিজেকে শানিত করেছেন। নিজেকে করে তুলেঠছেন অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রম। হয়ত এখানেই তিনি প্রশংসার দাবিদার। ২০০৯ সালে তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'নদীমহলের জার্নাল' বের হয়। সে আরেক উপাখ্যান।
কবিতা লেখে অনেকেই। আপন বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোর সম্মুখে আসতে পারে ক'জন! অথচ নিন্দুক কেও স্বীকার করতেই হবে কবি 'সালিম সাবরিন' আলোর কবি, আলোর পথ দেখানোর কবি।
........
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে এপ্রিল, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:০৯