০.১. ভূমিকা:
মহাকবি কায়কোবাদ (১৮৫৮-১৯৫২) প্রকৃত নাম কাজেম আলকোরেশী বাঙালী মুসলমান সাহিত্যিকদের সাহিত্য সাধনার ইতাহাসে নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী নাম। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাঙলা কাব্যে মুসলিম সাহিত্য সাধকদের ভূমিকা খুব বেশি অগ্রগণ্য নয়।যদিও ভারতীয় উপমহাদেশর মুসলিম শাষনের প্রায় সাড়ে পাঁচশত বছরের গৌরবময় ইতিহাস আছে। তবুও মুসলিম ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সর্বোপরি মুসলিম জাতীয়তাবাদের চেতনার উন্মেষ, বড় কোন সাহিত্যিক প্রতিভার দ্বারা বিকশিত হয়ে উঠেনি।
যদিও মধ্যযুগের মুসলমান কবিদের দোভাষী পুঁথিসাহিত্য,জঙ্গনামাঅন্যান্য রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানে মুসলিম বীরত্বের এবং শৌর্যবীর্যের পরিচয় পাওয়া যায়
কিন্ত বলা যায়, প্রকৃতপক্ষে তা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রেক্ষাপট বা ইতিহাসের অনুষঙ্গ ধারন করে উঠতে পারেনি।
মহাকবি কায়কোবাদ যে যুগে জন্মগ্রহণ করেছেন তার পূর্বেই ঊনিশ শতকের বাঙালী জাতীয়তাবাদ বা নবজাগরনের সূচনা হয়েছিল।
ঊনবিংশ শতাব্দীর জাতীয়তাবোধে অনুপ্রানিত হয়ে কায়কোবাদ জাতীয় উদ্দীপনামূলক কাব্য রচনা করলেন।
সমসাময়িক অন্যান্য কবিদের মত তিনি সাম্প্রদায়িক মনোভাবসম্পন্ন ছিলেন না। তার কাব্য তাই স্বদেশ ও স্বজাতী প্রীতির ঊর্ধ্বে বলা যায়। পূণর্জাগরনবাদী হিন্দু লেখকেরা সে সময় ভারতবর্ষ বলতে মুসলিমবর্জিত ভারতবর্ষকে বুঝত তার স্পষ্ট ছাপ তাঁদের লেখায় দেখতে পাওয়া যায়। অন্যদিকে পুনর্জাগরনী মুসলমানদের চেতনায়ও তেমনি এ দেশের চেয়ে আরব ইরান ছিল নিকট আত্মীয়।
কিন্তু ভারতীয় মুসলমানদের শৌর্য-বীর্যের ইতিহাস তুলে ধরতে গিয়ে কায়কোবাদ এ বিভ্রান্তি থেকে নিজেকে রক্ষা করেছিলেন।
একজন যথার্থ মুসলমান হয়েও তিনি ছিলেন খাঁটি বাঙালী।
তাঁর দৃষ্টিতে জাতীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য অর্থ ছিল ভারতীয় হিন্দু মুসলমানের ইতিহাস ঐতিহ্য। তাই তিনি হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের বীরত্বের ঐতিহ্যের ইতিহাস তুলে ধরলেন তাঁর লেখায়।
মহাকবি হয়ে উঠলেন ধীরে ধীরে। যদিও তিনি গীতিকবিতা রচনার মাধ্যমে সাহিত্যক্ষেত্রে এসেছিলেন কিন্তু মহাকাব্য রচনাতেই প্রতিভা বিকাশের সার্থকতা অনুভব করেন। গীতিকবিতার সর্বগ্রাসী প্রভাব উপেক্ষা করে মহাশ্মশান রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। অথচ বিংশ শতাব্দীর পরিবেশ মহাকাব্য রচনার উপযোগী নয় বলে ধরা হয়। মহাকাব্য রচনার প্রতি তাঁর আগ্রহের কারন সম্পর্কে মহাকাব্যের গৌরব ও বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে মহাশ্মশান কাব্যের ভূমিকায় কবি লিখেছেন,
''সাহিত্যের বাজারে আজকাল কবিতার বড়ই ছড়াছড়ি। কিন্তু দুঃখের বিষয় বঙ্গ সাহিত্যে মহাকাব্যের জন্ম অতি বিরল। মধুসূদনের পর হইতে আজ পর্যন্ত মহাকবি হেমচন্দ্র ও নবীনচন্দ্র ব্যাতীত কয়জন কবি মহাকাব্য লিখিয়াছেন। এখনকার কবিগন কেবল 'নদীর জল', 'আকাশের তারা' ,'ফুলের হাসি','মলয়পবন' ও 'প্রিয়তমার কটাক্ষ' লইয়াই পাগল। প্রেমের ললিত ঝংকারে তাহাদের কর্ণ এরূপ বধির যে, অস্ত্রের ঝনঝনি বীর বৃন্দের ভীষন হুংকার তাহাদিগের কর্ণে প্রবেশ করিতে অবসর পায়না। তাহারা কেবল প্রেমপূর্ণ খন্ড কবিতা লিখিয়া নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করেন।
খন্ড কবিতা কেবল কতগুলি চরনের সমষ্টি,সামান্য একটি ভাব ব্যাতীত তাহার বিশেষ কোন লক্ষ্য নাই, কিন্তু মহাকাব্য তাহা নহে; তাহাতে বিশেষ একটি লক্ষ্য আছে,-কেন্দ্র আছে। কবি কোন একটি বিশেষ লক্ষ্য ঠিক করিয়া ও ভিন্ন ভিন্ন গঠনপ্রণালীর অনুসরণ করিয়া নানারূপ মালমসলার যোগে বহু কক্ষ সমন্বিত একটি সুন্দর অট্টালিকা নির্মান করেন।
ইহার প্রত্যেক কক্ষের সহিত প্রত্যেক কক্ষেরই ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ, অথচ সকলগুলিই পৃথক, সেই পৃথকত্বের মধ্যেই আবার একত্ব,ইহাই কবির নূতন সৃষ্টি ও রচনা কৌশল।- ইহাই মহাকাব্য।'' ১
মহাকাব্যের মধ্যে কবি প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ মনে করে গীতিকবিগণকে কোন গুরুত্ব দেন নি। জাতীকে জাগ্রত করার ব্রত নিয়ে মহাকাব্য রচনা শুরু করেন তিনি। মহাশ্মশান ১৯০৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। সমগ্র কাব্য প্রকাশ হতে কবির সময় লেগেছিল প্রায় দশ বছর।
এই দীর্ঘ কাব্যে তিনি যে শুধু ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন ছিলেন তা নয়, সাথে সাথে তিনি ছিলেন ইতিহাস নিষ্ঠও।ইতিহাসের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা আর নিষ্ঠতা ছিল প্রশংসনীয়। ইতিহাসকে যথার্থ ভাবে গ্রহণ করে কাব্যের শৈল্পিক মর্যাদা রক্ষার জন্য হলেও তিনি ইতিহাসের প্রকৃত সত্য ও তথ্য থেকে বিচ্যুত হননি।
বর্তমান আলোচনায় 'মহাশ্মশান' কাব্যের ইতিহাস চেতনার অনুষঙ্গ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে নিম্নরূপ বিষয়ে দৃষ্টিপাত করা হয়েছে।
০.২. পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও মহাকাব্যের কাহিনীর প্রেক্ষিত:
উত্তর পশ্চিম ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের পানিপাত জেলার একটি শহর পানিপথ।এখানে ভারত মহাদেশের ইতিহাসে পানিপথের যুদ্ধ হিসেবে খ্যাত তিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যু্দ্ধ সংগঠিত হয়।
পানিপথের প্রথম যুদ্ধ সংঘঠিত হয় ১৫২৬ সালে। তৈমুর বংশের রাজা ওমর শেখ মিরজার ছেলে বাবর পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদিকে নিহত করে মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনা করেন। পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৫৫৬ সালে। এই যুদ্ধে শেরশাহের উত্তরাধিকারী আদিল শাহের সেনাপতি হিমু আকবর ও তাঁর সেনাপতি বৈরাম খানের সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হলে আকবরের উত্থান ঘটে।
পরবর্তীতে ১৭৬১ সালে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ হয় দুরানি সাম্রাজ্য ও মারাঠা সাম্রাজ্যদ্বয়ের মধ্যে। কান্দাহারের আফগান রাজা আহমদ শাহ মারাঠা ও শিখদের পরাজিত করে এই যুদ্ধে এবং ভারতে মারাঠা শাষিত রাজ্যের পতন ঘটানো হয়। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মহারাষ্ট্রীয়দের পরাজয় এবং আহমদ শাহ আবদালীর বিজয় বর্ণনাই মূলত 'মহাশ্মশান' মহাকাব্যের বিষয়বস্তু।
ভারতে হিন্দু রাজ্য পুনঃস্থাপনের সংকল্পে মারাঠারা অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে। কাবুল অধিপতি আহমদ শাহ আবদালীর সহায়তায় রোহিলার অধিপতি নজীবদ্দৌলা ভারতের মুসলিম শক্তির সংগঠন করেন। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মুসলমানরা জয় লাভ করলেও উভয় জাতীর জীবনে করুন ও মর্মান্তিক পরিনতি নেমে আসে।
মহাকবি কায়কোবাদ এই ভয়াবহ সংগ্রামের মাধ্যমে মানবভাগ্যের উত্থানপতনের বিস্ময়কর রহস্য অনুধাবন করেছিলেন। তাঁর মতে,
''একপক্ষে পানিপথ যেমন হিন্দু গৌরবের সমাধিক্ষেত্র,অপরপক্ষে মুসলমান গৌরবেরও মহাশ্মশান।''
কায়কোবাদ এই ঐতিহাসিক কাহিনীকে উপজীব্য করে লিখলেন মহাশ্মশান। মূল কাহিনীর সঙ্গে অনেকগুলো প্রণয়কাহিনীও স্থান পেয়েছে এই কাব্যে। সুবিশাল এক কাহিনী নিয়ে কায়কোবাদ মহাকাব্য রচনায় নিয়োজিত করলেন নিজেকে।অসংখ্য ঘটনা,চরিত্র উপাদান মহাকাব্য রচনার অনুকূলে ছিল। নতুনত্ব যদিও তেমন ছিলনা কিন্তু ভাষা প্রয়োগে সরলতা ও অকৃত্রিমতা এই মহাকাব্যে কায়কোবাদের স্বাতন্ত্র্য তুলে ধরে। এই কাব্যে সমসাময়িক জাতীয় চেতনার প্রতিফলন ঘটেছিল তা সুস্পষ্ট।
কায়কোবাদ জাতীয় গৌরবের কাহিনী পরিবেশনেই মনোযোগের সাথে উদ্যোগী হন।কাব্য রচনার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে তাঁর নিজের মতই তার প্রমান। তিনি 'মহাশ্মশান' গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছিলেন,
''আমি বহুদিন যাবত মনে মনে এই আশাটি পোষন করিতেছিলাম যে , ভারতীয় মুসলমানদের শৌর্য-বীর্য সংবলিত এমন একটি যুদ্ধকাব্য লিখিয়া যাইব, যাহা পাঠ করিয়া বঙ্গীয় মুসলমানগন স্পর্ধা করিয়া বলিতে পারেন যে একসময়ে ভারতীয় মুসলমানগনও অদ্বিতীয় মহাবীর ছিলেন; শৌর্যে বীর্যে ও গৌরবে কোন অংশেই তাহারা জাতের অন্য কোন জাতী অপেক্ষা হীনবীর্য বা নিকৃষ্ট ছিলেন না; তাই তাহাদের অতীত গৌরবের নিদর্শনস্বরূপ যেখানে যে কীর্তিটুকু, যেখানে যে স্মৃতিটুকু পাইয়াছি, তাহাই কবি তুলিকায় অঙ্কিত করিয়া পাঠকের চক্ষের সম্মুখে উপস্থিত করিয়াছি এবং তাহাদের সেই অতীত গৌরবের ক্ষীণ স্মৃতিটুকু জাগাইয়া দিতে বহু চেষ্টা করিয়াছি।'' ২
ইতিহাস থেকে মহাশ্মশান কাব্যের বিষয় বস্তু নির্বাচনের মাধ্যমে কায়কোবাদ পরিচয় দিয়েছেন স্বাতন্ত্র্যের। এই কাব্যের প্রায় প্রধান সব পুরুষ চরিত্রই ঐতিহাসিক। ইব্রাহিম কার্দি, আতা খাঁ,আদিনা বেগ,সদাশিব, ঐতিহাসিক ব্যাক্তি । সুজাউদ্দৌলা,নজীবউদ্দৌলা,আহমদ শাহ আবদালী প্রমুখ ও ঐতিহাসিক চরিত্র। এমন কি ইতিহাসসম্মত ভাবেই এঁদের চরিত্র অঙ্কন করেছেন তিনি।
তবে ইব্রাহীমের পরিনতি এবং জোহরা বেগম প্রসঙ্গ কবি কল্পনা প্রসূত। হিরনবালা -আতা খাঁর কাহিনীর প্রায় সবটাই কবি কল্পিত। লবঙ্গ-রত্নজীর কাহিনী পুরোটাই কবি কল্পনার অংশ।
বিশ্বনাথ-কৌমুদী কাহিনীর বিশ্বনাথ ও ইতিহাসের বিশ্বাস- রাও একই ব্যাক্তি। ঘটনাগত দিক থেকে দেখা যায় দত্তজীর ছিন্ন মুন্ড আবদালীকে উপহার দেয়ার ঘটনাটি ঐতিহাসিকভাবে সিদ্ধ তবে দত্তজীর শিরচ্ছেদকারীর নাম মিয়া কুতুব শাহ।
মারাঠা এবং দুরানী উভয় পক্ষেরই সুজাউদ্দৌলার সহায়তা কামনা, নজীব কর্তৃক আসন্ন যুদ্ধকে ধর্মযুদ্ধের আখ্যা দেয়া এবং শেষে সুজার মুসলিম শক্তির পক্ষে যোগদান,এসবই ইতিহাসে আছে।
সুজার মাধ্যমে বিশ্বাসের মৃতদেহ সৎকার করার জন্য পাঠানো ঐতিহাসিক, নজীবউদ্দৌলা,আহমদ শাহ আবদালী ও সদাশিবের বীরত্ব এসব ও ঐতিহাসিকভাবে সত্য।
বস্তুত,'মহাশ্মশান' কাব্যের মূল ঘটনা, এবং প্রধান প্রধান পুরুষ চরিত্র ইতিহাস অবলম্বনেই চিত্রিত। যুদ্ধের মূল ঘটনার সঙ্গে সংযুক্ত প্রেমকাহিনী ও অন্যান্য পার্শ্ব চরিত্রই শুধু কবি-কল্পিত।
ইতিহাস এবং কল্পনার অসাধারন যুগলবন্দী এই কাব্যে ঘটলেও কোথাও ইতিহাসকে বিকৃত করেন নি তিনি। অথবা কোথাও ঐতিহাসিক চরিত্রকে এতটুকু হীন করে দেখান নি । এখানেই কবির ইতিহাস চেতনার সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়।
(চলবে)