আমাদের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠানের নাম বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ রেগুলেটরি কমিশন। বাংলায় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন। প্রতিষ্ঠানটির সংক্ষেপিত নাম বিটিআরসি। নামের মধ্যে কাজের যে ইঙ্গিত তাতে নিয়ন্ত্রণ শব্দটিই প্রধান। নিয়ন্ত্রণ বলতে কী বোঝায়? বাংলা একাডেমীর ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে বলা হয়েছে_ নিয়ন্ত্রণ অর্থ শাসন, নিয়মন, সংযমন, নিবারণ, প্রশমন। বাংলাদেশের বাস্তবতায় যখন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রযুক্তির প্রসার দরকার, তখন টেলিযোগাযোগ বিষয়ক একটি স্বায়ত্তশাসিত কমিশনের নামে কেন নিয়ন্ত্রণ শব্দটি জুড়ে দেওয়া হবে? প্রশ্নটি ওঠা উচিত। গত দেড় দশকে দেশের টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিপুল অগ্রগতি হয়েছে। এ অগ্রগতির জন্য বেসরকারি খাতের উদ্যোগগুলোই বাহবা পায়। কেন এসব ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগগুলো পিছিয়ে থাকে? অনেক সমস্যার কথাই ওঠে। কিন্তু যেসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডের মূল সুর নিয়ন্ত্রণ, নিবারণ, বাধা দান তারা অগ্রগতিতে অবদান রাখবে কীভাবে? প্রতিষ্ঠানটির নাম যদি হতো টেলিযোগাযোগ উদ্বুদ্ধকরণ কমিশন, তাহলে হয়তো উন্নয়নকামী একটি দেশের কমিশন হিসেবে তাদের অবদান অনেক ভালো হতো। বিটিআরসির সঙ্গে নিয়ন্ত্রণের সম্পর্ক বোধকরি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ২৫ জানুয়ারি বিডিনিউজ খবর দিয়েছে , বিটিআরসি সম্প্রতি বাংলাদেশ কম্পিউটার সিকিউরিটি ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিম, সংক্ষেপে_ সিএসআইআরটি নামে একটি দল গঠন করেছে। টিমটি সাইবার অপরাধ শনাক্তকরণে কাজ করবে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে নিরাপত্তা নিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্যোগী হতে পারে। সাইবার জগতে ক্রমবর্ধমান পর্নোগ্রাফি, জালিয়াতি, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের প্রাইভেসি লঙ্ঘন ঠেকাতে এ ধরনের টিমের অবদান থাকতে পারে। অগণতান্ত্রিক, স্বার্থান্বেষী শক্তিকে প্রতিহত করার জন্যও এ টিমের অবদান থাকতে পারে। কিন্তু এই টিমের মূল কাজ হিসেবে যা জানা যাচ্ছে তা কতটা সাইবার অপরাধের সঙ্গে জড়িত আর কতটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। কেননা বিটিআরসি বলছে, সিএসআইআরটির মূল কাজ রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ায় এমন ওয়েবসাইটগুলো শনাক্ত করা এবং টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া। প্রশ্ন হলো, সাইবার জগতে এত অপরাধ থাকতে কেন রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিদ্বেষের দিকেই বিটিআরসির বিশেষ নজর পড়ল? বাংলাদেশ ধর্মীয় সহাবস্থানের অনন্য এক স্থান, সামাজিকভাবেও শান্তিপূর্ণ একটি দেশ। কিন্তু রাজনৈতিক বিদ্বেষ বলতে কী বোঝায়? বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো রাজনৈতিকভাবে পরস্পরের প্রতি বিদ্বিষ্ট। এসব দলের নেতারা অনেক সময় শালীনতার তোয়াক্কা না করে পরস্পরের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ান। এ বিদ্বেষ কমানোর দায়িত্ব কি বিটিআরসির? আর রাজনীতির মাঠের এই বিদ্বেষ বাদ দিয়ে হঠাৎ অনলাইন জগতেই কেন রাজনৈতিক বিদ্বেষ খোঁজা হবে? আর রাষ্ট্রীয় বিদ্বেষ বলতে কী বোঝায়? রাষ্ট্র মত-বর্ণ-ধর্ম-জাতি-পেশা নির্বিশেষে সকলের জন্য। এমন একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ থাকবে কেন? অনলাইন জগতের অনেক নাগরিক মনে করছেন, বিটিআরসির এই উদ্যোগ আসলে ভিন্নমত, সমালোচনা ও গণতান্ত্রিক তর্ক-বিতর্কের পথ রুদ্ধ করার উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু হয়েছে। নইলে, সাইবার জগতের এত অপরাধ বাদ দিয়ে হঠাৎ করে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক বিদ্বেষ ছড়ানোর যুক্তি তাদের মাথায় আসত না। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই, বিটিআরসি অনলাইন জগতে অগণতান্ত্রিক ও স্বার্থান্বেষী শক্তির তৎপরতা ঠেকাতেই এই টিম গঠন করেছে, তাহলেও রাজনৈতিক ভিন্নমতের বিরুদ্ধে তাদের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণযোগ্য হবে না। অগণতান্ত্রিক শক্তিকে ঠেকাতে হলে গণতন্ত্রকেই মজবুত করতে হবে। আর গণতন্ত্রকে মজবুত করতে হলে মানুষকে কথা বলতে দিতে হবে। মানুষের কথা শুনতে হবে। সরকার ও বিরোধী দল ছাড়া গণতন্ত্র হয় না। তেমনি ভিন্নমত ছাড়াও গণতন্ত্র হয় না। ভিন্নমতকে বিদ্বেষ বলে আখ্যায়িত করার কোনো অবকাশ গণতান্ত্রিক সমাজে নেই। মানুষের মুক্তমতকে বাধাগ্রস্ত করে গণতন্ত্র রক্ষার উদ্যোগ কোনো গণতান্ত্রিক শক্তি নিতে পারে না। ফলে বিটিআরসির উদ্যোগ যাতে দেশের ব্লগ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মুক্তমতকে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। ইন্টারনেট মানুষের সামনে গণতন্ত্র, অধিকার ও মতপ্রকাশের এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। ইন্টারনেটকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে এমন উদ্যোগ কখনোই আসা উচিত নয়। গণতান্ত্রিক সরকারের তরফে এমন উদ্যোগ এলে তার চেয়ে দুঃখজনক আর কিছুই হতে পারে না।
লেখাটি ২৭ জানুয়ারি তারিখের সমকালে প্রকাশিত।