১।
ফাঁকিবাজ ছাত্র হিসেবে আমার সুনাম ছিল। শুধু আমি কেন? আমার ব্যাচের বেশিরভাগ ছাত্ররই একই দশা ছিল। তাই হয়ত সবচেয়ে খারাপ ব্যাচ হিসেবে কলেজে সবাই আমাদের এক নামে চিনতো। ক্লাসে টিচার এসে রোল কল করার পরই ক্লাস থেকে আমার বের হয়ে যাওয়া ছিল সময়ের ব্যপার মাত্র। বেশ কয়েকদিন হাতেনাতে ধরাও খেয়েছিলাম কবির স্যারের হাতে। আর কি! পরে ক্লাসে সবার সামনে কান ধরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল।
ক্লাসে যে কয়েকজন মেয়ে ছিল তার মধ্যে অহনাকে বেশ ভাল লাগতো। এই ভাল লাগার পিছনে বেশ মজার একটা কাহিনী আছে। একবার ক্লাস ফাঁকি দিতে যেয়ে যথারীতি কবির স্যার এর হাতে ধরা খেলাম। সেদিন ক্লাসে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে খুব ঘাড় ব্যাথা করছিল। তাই মাথা সোজা করে একটু এদিক ওদিক করছিলাম। হঠাৎ আমার এক জোড়া চোখ আটকে গিয়েছিল আর এক জোড়া চোখের ইশারায়। কতক্ষণ সেই জোড়া চোখ আমাকে দেখছিল তা জানি না তবে অদ্ভুত এক শিহরণ খেলে গিয়েছিল আমার মাঝে।
সেই জোড়া চোখের মহিমায় কিনা কে জানে! আমি এরপর থেকে ক্লাস ফাঁকি দেয়া ধীরে ধীরে কমিয়ে দিতে লাগলাম। এতে আমার ইমেজের যে বিশাল ক্ষতি হল সেটা আর না বললেও চলে। বন্ধুরা আমাকে বার বার বললেও ক্লাস ফাঁকি দিতাম না। আসলে দিতে ইচ্ছে করতো না। ক্লাসে কিংবা ক্লাসের বাহিরে আমার চোখ জোড়া বার বার কি জানি খুঁজে বেড়াতো। বার বার চেষ্টা করেও তা থামাতে পারতাম না। মনে হত কোন এক চোখের ইশারা একবার পেলে থেমে যাবে এমন ছটফটানি।
২।
অহনার সাথে ক্লাসে আমার চোখাচোখি বেশি হত। কথা খুব কম বলা হত ওর সাথে। আসলে আমি পারতাম না তার সামনে যেয়ে কথা বলতে। যতই গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস হোক না কেন, আমার দৃষ্টি আমি সরাতে পারতাম না অহনার দিক থেকে। আমার এই ব্যপারটি হয়ত ক্লাসের বেশিরভাগ বন্ধুরাই বুঝতে পেরেছিল। ওরা আমাকে দেখে মুচকি মুচকি হাসতো, কানাঘুষা করতো একে ওপরের সাথে। তবে আমাকে সরাসরি বলার সাহস পেত না কখনো। এমন ও হয়েছে পলকহীন চোখে অহনার দিকে তাকিয়ে আছি আর হঠাৎ সে আমার দিকে তাকালো। এ অবস্থায় আমি তখন না পারি দৃষ্টি ফেরাতে আবার না পারি তাকিয়ে থাকতে।
এখনো মনে আছে স্টাডি ট্যুরে গিয়েছিলাম কুমিল্লাতে। ক্লাসের সবাই গিয়েছিলাম আমরা। খুব মজা করেছিলাম সেদিন। একে তো গিয়েছিলাম কুমিল্লার প্রসিদ্ধ এলাকায় তার উপর আবার ছিল সেদিন ইকবাল স্যার এর জন্মদিন। স্যার আমাদের পুরো ট্যুরের খরচ বহন করেছিলেন। সেই আনন্দময় ভ্রমণেই বহুবার সুযোগ পেয়েছিলাম অহনার সাথে একবার কথা বলার। কিন্তু তার সামনে যেয়ে আমি কিছু বলতে পারতাম না। সব ভুলে যেতাম। একটা সংকোচ কাজ করতো নিজের মনের মাঝেই।
অহনা নিজেও হয়তো বুঝতে পারতো আমার এই অবস্থা। তাই হয়ত সে নিজেও আমার কাছে এসে কথা বলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সে আমার সামনে আসলেই আমি কোন কাজের ছুতোয় সে স্থান ত্যাগ করতাম। কিছুদূর যেয়ে যখন পিছন ফিরে তাকাতাম তখন দেখতাম সে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
৩।
ইন্টারে আমার সাথেই পড়েছিল অহনা। সিট পরেছিল একই রুমে। তাও আবার আমার পিছনেই। ইন্টার পরীক্ষার শেষ দিন সব সাহস সঞ্চয় করে অহনার সাথে কথা বলেছিলাম। পরীক্ষা শেষে নিচে দাঁড়িয়েছিলাম অহনার সাথে কথা বলবো বলে। ও যখন নিচে নেমে আসলো তখন মনে হল সে আমাকেই খুঁজছে। আমি কাছে যেয়ে তার সাথে প্রায় ১০ মিনিটের মত কথা বলেছি। আমার বহু কাংক্ষিত ১০ মিনিট। মনে হচ্ছিল এই ১০ মিনিট যেন ১০ সেকেন্ডে শেষ হয়ে গিয়েছিল! তার কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলাম এখন এই অবসর সময়ে কি করবে। ভেবেছিলাম সে উত্তর দিবে। কিন্তু একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে সেদিনের মত সে বিদায় নিয়েছিল। আমি এই হাসির কারণ উদ্ধার করতে পারি নি। তবে যাওয়ার আগে আমাদের মোবাইল নম্বর আদান প্রদান করতে ভুল হয় নি।
ফোন নম্বর থাকলেও তাকে কখনো ফোন করা হয় নি। মাঝে মাঝে মেসেজ দিলে সে ব্যাক করতো অনেক দেরিতে। যা আমার কাছে কিছুটা বিরক্তিকর মনে হত। তাই হয়ত ফোন দিতাম না।
এরপর বিভিন্ন সরকারি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির জন্য দৌড়াদৌড়ির কারণে ইন্টারের সেই প্রথম ভাললাগা একেবারেই যেন এক জায়গায়ই থেমে ছিল।
৪।
১ বছর পর কোনো এক বিয়ে বাড়িতে
আমার বড় বোনের বান্ধবীর বিয়েতে দাওয়াত পেয়ে আসলাম। তেমন কাউকে চিনি না বলে বসে আছি কোণার কোন এক চেয়ারে। চারপাশে চোখ বোলাতে যেয়েই খেয়াল হল স্টেজে লাল পাড়ের শাড়ি পরা একটি মেয়ে কনের পাশে বসা আছে। আমার চোখ আটকে গেল মুহুর্তে এর জন্য। বেশ অবাক হলাম অহনাকে এভাবে দেখে। ভাবিনি তাকে এভাবে দেখবো। আমার সেই প্রথম ভাললাগা।
আস্তে আস্তে স্টেজের দিকে এগিয়ে যেতেই অহনা দেখতে পেলো আমাকে। হাসি মুখে এগিয়ে যেতেই
অহনাঃ আরে! কি খবর?
আমিঃ ভাল আছি। তোমার কি খবর?
অহনাঃ ভাল।
আমিঃ তা এতদিন কই ছিলে? একটা ফোনও তো করতে পারতা! তাও কর নি।
অহনাঃ আসলে .........।। আমার ............।
আমিঃ থাক। আর বলা লাগবে না।
অহনাঃ নাহ! আসলে.........।। আমি গত......।।
আমিঃ তোমাকে যে কত মিস করেছি তুমি চিন্তাও করতে পারবে না।
“এই অহু, শুনছো, এদিকে এসো। আম্মা ডাকছে”।
আমিঃ কে ডাকলো?
অহনাঃ (ব্যতিব্যস্থ হয়ে) আমার স্বামী!
আমিঃ কী!! তুমি বিয়ে করলা কবে?
অহনাঃ প্রায় ৪ মাস হল। তোমার সাথে কথা বা দেখা করার কোন সুযোগ পাই নি। খুব ব্যস্থাতায় কেটেছে এই কয়েকটা মাস।
আমি নির্বাক তাকিয়ে ছিলাম অহনার দিকে। কোন কথা বলার কিংবা শোনার ইচ্ছে বা শক্তি কোনটাই ছিল না।
আমার সাথে কথা বলে বিদায় নিয়ে কখন যে অহনা আমার দৃষ্টি সীমার বাহিরে চলে গেল তা খেয়াল করি নি। শুধু অনুভব করেছি মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা ফুলের অংকুরেই বিনষ্ট হওয়া।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে নভেম্বর, ২০১১ দুপুর ১২:০৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



