দীর্ঘ ছয় বছর লেখালেখি থেকে দূরে ছিলাম। ২০১৫-এর পর থেকে মেলায় কোন বই নেই। পরিচিত পাঠক, বন্ধুবান্ধব এবং শুভানুধ্যায়ীরা আমাকে নিয়ে হতাশ। আমি নিজে তাদের চেয়েও বেশি হতাশ। কিন্তু রাইটার ব্লক আমাকে ছাড়ে না।
নীরার সাথে দিনে তিনবার কথা হলে সে নয়বার জিজ্ঞেস করে নতুন লেখা কতোদূর? কবে শেষ হবে?
জানুয়ারির শুরুর দিকে বাবা ডেকে নিয়ে খুব হতাশ গলায় বললেন, "যখন সাংবাদিকতার বয়স হইছিলো না তখন সাংবাদিকতা করতে গেলি, যখন নিজের টেক্সট বই পড়ার কথা তখন বই লিখলি। আর এখন স্টাডি শেষ, এতো অবসর আর তোর লেখালেখি বন্ধ!"
মনের ভেতরটা কেমন খচ করে উঠলো! ফেলে রাখা কয়েকটা অসমাপ্ত লেখার একটা হাতে নিলাম। কিন্তু পরের মাসেই বইমেলা। এই এলিভেন্থ আওয়ারে কোন প্রকাশক পান্ডুলিপি নেবে না।
আমারিকা প্রবাসী বন্ধু ফারহানাকে বললাম— পরিচিত কোন প্রকাশকের সাথে একটু কথা বলো। এবার মেলায় আবার বই করতে চাই।
ফারহানা সানন্দে আমেরিক প্রবাসী সাহিত্যিক মৃদুল ভাইকে বলে দিলো। মৃদুল ভাই অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রর ডেপুটি ডিরেক্টর এবং স্বদেশ শৈলী-র প্রকাশক উজ্জল ভাইর নাম্বার দিলেন। দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়ে উজ্জল ভাইকে ফোন দিলাম। উজ্জল ভাই আরো আন্তরিক মানুষ। বললাম— সময় কম। বইটা আমি নিজেই করতে চাই।
উজ্জল ভাই এক কথাতেই বলে দিলেন, আপনি আপনার মতো করেই বইটা করুন। আমি আপনাকে ISBN নাম্বারটা করে দিচ্ছি।
এর মাঝে চমৎকার একটা প্রচ্ছদ করে ফেলেছে সাবিহাতুল ফাতেমা।
২৬শে মার্চ মেলায় বই দেবার কথা। তখনই বিপত্তি বাঁধলো। তাড়াহুড়া করতে যেয়ে বইয়ের প্রচ্ছদ আর বাইন্ডিংয়ে কিছু ত্রুটি হয়ে গেছে। মেলা থেকে বই ফেরত নিয়ে আসলাম। অনেক বছর এতোটা মন খারাপ হয়নি। ত্রুটিপূর্ণ বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখি আর একটার পর সিগারেট জ্বালাই। টিএসসি থেকে নীলক্ষেত উদ্ভ্রান্তের মতো হাঁটি। একবার বই দেখি আরেকবার সিগারেটে টান দেই।
নতুন করে বই প্রিন্ট হতে হতে লকডাউন শুরু হয়ে গেলো। অল্প কয়েক কপি বই বের করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বন্ধুদের উৎসাহে অনেক বেশি কপি করে ফেললাম, সবই ধার করা টাকা।
এবার মাথায় বজ্রপাতের অবস্থা। মেলা প্রকৃতপক্ষে বন্ধ। ফেসবুকে যারা দিনরাত লাইক-কমেন্ট দেয় তারা বইয়ের পোস্ট দেখলে এড়িয়ে যায়, পরিচিতরা বসে আছে সৌজন্য সংখ্যার অপেক্ষায়। কার্টুনবন্দী বইগুলো দেখে দিনরাত কেবলই মনে হয়— আমি অবুঝের মতো এ-কী করেছি?
কাছের বন্ধুরা এই বিপর্যয় দেখে অধিক টাকা দিয়ে বই কিনতে শুরু করলো। সেটা আর কতোই হবে?
এর মাঝে কবি, ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার কুশল ভৌমিক স্যার ফোন করে বললেন, ২৯ তারিখ টাঙ্গাইল পাবলিক লাইব্রেরি অডিটোরিয়ামে তার উপন্যাসের মোড়ক উন্মোচিত হবে। আমার বইয়ের মোড়ক উন্মোচনও করতে চান একসাথে। এ যেন মরুর আকাশে একফালি মেঘ।
মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে কিছু বই বিক্রি হলো। গুণীজনরা বইটা হাতে নিলেন।
অল্প দুই একজন মানুষের রিভিউ থেকে রকমারি এবং ইনবক্সে কিছু কিছু বইয়ের অর্ডর আসতে লাগলো।
ভেবেছিলাম বইটা সুপার ফ্লপ। কিন্তু হঠাৎ করেই ঋতু বদলে যাচ্ছে। গতকাল আরেক বন্ধু মুমু আমেরিকা থেকে বইয়ের ছবিটা পাঠিয়ে বললো— Does it make you happy?
আমি প্রথমবার অনুভব করলাম খুব বেশি সারপ্রাইজড হলে প্রথমে কিছুক্ষণ খুশি হবার ক্ষমতা থাকে না।
লেখাটি দীর্ঘ হতে হতে গরুর রচনা হয়ে যাচ্ছে। শেষ করছি। মানুষ খুব বেশি সফল হয়ে গেলে আনন্দ, কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসার মতো অনুভূতিগুলো ভোতা হয়ে যায়।
কখনো যদি সফলতা ধরা দেয় তখন আজকের ছোট ছোট আনন্দের এই অনুভূতিগুলো থাকবে কিনা জানি না।
তাই আজকে আনন্দচিত্তে এই কৃতজ্ঞতা পোস্টটি দিয়ে রাখলাম। যেনো ফেসবুক প্রতি বছর মনে করিয়ে দেয় একদিন কতোটা রুট লেভেল থেকে শুরু করতে হয়েছিলো।
ছোট্ট জীবন। বয়স বাড়ছে, আয়ু কমছে। জমে জমে পাহাড় হয়ে যাচ্ছে মানুষের ভালোবাসার ঋণ। এক জীবনে এতো ঋণ শুধিবো কেমনে?
বই: কারাগার
লেখক: মাহাদী হাসান
ধরন: উপন্যাস
জনরা: থ্রিলার (পরবাস্তাব)
প্রকাশক: স্বদেশ শৈলী
প্রকাশকাল: মার্চ, ২০২১
অনলাইন পরিবেশক: রকমারি.কম
পৃষ্টা: ৬৪
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০২১ রাত ১২:২৫