পাক্কা ছয়মাস পর আবার ক্রিকেট। লম্বা সময় বিরতিতে রীতিমত হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। আজকে সময় যেন কাটছেই না, এমনই টান টান উত্তেজনা অনুভব করছি। ক্রিকেট নিয়ে প্রথম লেখা গল্পখানি তাই আপনাদের জন্য দিলাম।
০১
সোনার হরিণতুল্য টিকেটখানি হাতে নিয়ে বিজয়ীর বেশে গ্যালারীতে ঢুকলো তাকিব। গ্যালারীতে বসে এই প্রথম খেলা দেখা হচ্ছে ওর। সেটা যদি মন মত উদযাপন করতে না পারে, তবে এত খাটাখাটনি আর টাকা - সবই পানিতে যাবে।
দুই দিন ধরে টিকেটের পিছনে দৌড়ে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট ম্যাচের টিকেট পায়নি। অবশেষে ব্ল্যাক মার্কেট থেকে ১৫০ টাকার টিকেট ৯০০ টাকা দিয়ে কিনতে হয়েছে।
আশা করলো, ওর আশেপাশে ওর মতই কোন ক্রিকেটখোর পোলাপাইন পড়বে। তাহলে খেলাটা খুব ভালভাবেই উপভোগ করতে পারবে। পিঠ চাপড়ে, চিৎকার চেঁচামেচি করে খেলা দেখার মজাই আলাদা! আফসোস! ওর বন্ধুরা কেউ টিকেট পায়নি। পেলে বেশ মজা করে খেলা দেখা যেতো।
এইসব ভাবতে ভাবতে নিজের আসনটা খুঁজে বের করে নেয় সে। খেলা শুরু হতে এখনো ঘন্টাখানেক দেরী আছে। এই ফাঁকে সে একটু ফেসবুকে ঢুঁ মারে।
ট্যাবে ওপেন করা অবাঞ্চিতার গল্পটা নজরে পড়ল ওর। এই অবাঞ্চিতা মেয়েটা খুব অদ্ভুত। ওর লেখাগুলি দারুণ লাগত তাকিবের। সাধারণত তাকিব কাওকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়ে এক্সেপ্ট করার জন্য ঘ্যানঘ্যান করে না। কারোর ইচ্ছা হলে এক্সেপ্ট করবে, না ইচ্ছা হলে নাই। ছ্যাঁচড়ামি বা গায়ে পড়া স্বভাব তাকিবের নীতিবিরুদ্ধ। কিন্তু এই মেয়েটার বন্ধু হওয়ার ঝোঁক তখন ওর মাথায় চেপে বসেছিল। বহুদিন ঝুলে থাকার পরও যখন মেয়েটা ওকে অ্যাড করল না, তখন বাধ্য হয়েই মেয়েটাকে মেসেজ করল। অনেক অনুরোধ উপরোধের পর, ওর ফ্রেন্ড লিস্টে জায়গা হল তাকিবের।
কিন্তু ওই পর্যন্তই । চ্যাটে হালকা কথাবার্তা হলেও, মেয়েটার নামটা পর্যন্ত জানতে পারেনি সে। এমনিতে মেয়েটা খুব মিশুক। অনেক কথা বলে। আবার নিজেই নিজেকে বাঁচাল বলে! ওর কথা, "অন্য কেউ পঁচানোর চেয়ে নিজেই নিজেকে পঁচাই! তাহলে আর কেউ চান্স পাবে না।" এইসব কথা মনে পড়ায় একটু মুচকি হাসল তাকিব। "পাগলী একটা" আপনমনে বিড়বিড় করে ওর লেখা গল্পটা পড়তে শুরু করেছিল।
গতানুগতিক প্রেম কাহিনী না। ভাই বোনের দুষ্টু মিষ্টি ঝগড়া ঝাটি আর খুনসুটির গল্প। এতই তন্ময় হয়ে গল্পটা পড়েছিল যে পাশে এসে যে কেউ বসেছে- তা বলতেই পারবে না। পড়তে পড়তে যখন গল্পের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে, তখন আর তাকিবের মুখের মুচকি হাসির রেখাটা নেই। তার বদলে ওর চোখ টলমল করছিল। এমন হৃদয়ছোঁয়া গল্প লেখে কী করে মেয়েটা?
০২
‘একি! আপনি কাঁদছেন নাকি!’
চমকে উঠে পাশে ফিরে তাকাল, তাকিব। ওর পাশের সীটটা তখন আর খালি নেই। অষ্টাদশী এক তরুণী বসে আছে। আশে পাশে আর কোন মেয়েকে দেখতে না পেয়ে বুঝতে পারল, এই মেয়েটাই ওকে প্রশ্ন করেছে।
‘কাঁদব কেন?’ অপ্রস্তুত হয়ে জবাব দিল তাকিব।
‘আমার তো মনে হল আপনি................’ মুঠোফোনের আওয়াজে মেয়েটার কথা থেমে যায়। দারুন উত্তেজিত হয়ে সে ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
‘এই রে! সেরেছে!’ মনে মনে ভাবে তাকিব। আজকে ওর খেলা দেখাটা মাটি হবে!
প্রথমত, অবাঞ্চিতার গল্পটা পড়ে ওর মনটা অসম্ভব খারাপ হয়ে আছে। ওকে অনলাইনে পেলে জিজ্ঞেস করা যেত, কেন ও এত দুঃখের গল্প লিখে মেয়েটা! যেহেতু ও এখন অনলাইনে নাই, তাই এখন সেটাও করা যাবেনা।
দ্বিতীয়ত, পাশে বসা এই মেয়েটাকে ওর মারাত্মক সমস্যা বলে মনে হচ্ছে। যেহেতু তার সাথে কেউ নেই, তারমানে তার সঙ্গীরা কেউ তার আশেপাশে সিট পায়নি। এরমানে খেলার পুরোটা সময় এই মেয়ের অত্যাচার সহ্য করে যেতে হবে। নিশ্চয়ই খেলা দেখতে বসে ১০১টা প্রশ্নের উদয় হবে তার মনে - আর কিছুক্ষণ পরপর তাকিবকেই অইসব প্রশ্নের জবাব দিয়ে যেতে হবে। আর ফোন একটা তো আছেই! কিছুক্ষণ পর পরই ওটা বেজে উঠছে , আর মেয়েটা হাসিমুখে বেশ জোরে জোরেই কথা বলছে।
বাসে সুন্দরী তরুণীর পাশে বসে যাতায়াত করাটা যতই উপভোগ্য হোক না কেন, খেলার মাঠে তা খুবই বিরক্তিকর। আর মেয়েটা আহামরি সুন্দরীও নয়। শুধু চোখ দুইটা . . . ধুর! কী ভাবছে আবোল-তাবোল! নিজেকে ধমক দিয়ে আগের ভাবনায় ফিরে গেল সে! এই ধরনের মেয়েগুলো খেলা ভাল করে বোঝে না। যেটুকু বোঝে ওটুকু না বোঝারই সামিল। আর ওই অল্পবিদ্যা নিয়ে এমন বড়বড় কথা বলবে , আর ক্রিকেটারদের এমনভাবে দোষ ধরবে - যেন সে ক্রিকেট সম্পর্কে মহাপন্ডিত! এরকম একটা মেয়েকে পাশে বসিয়ে খেলা দেখার কোন ইচ্ছেই ছিল না তাকিবের। কপাল মন্দ! কী আর করা!
০৩
খেলা শুরু হয়ে গেছে। টসে জিতে নিউজিল্যান্ড ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ইতিমধ্যে গ্যালারীর সবগুলো আসন পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ বাদেই খেলা শুরু হবে। তাকিব বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়ছে। একটুপর ও ওর অতি প্রিয় ক্রিকেট টিমের সবাইকে সরাসরি দেখবে! একটা উত্তেজিত হাসি ওর মুখে ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। মেয়েটার সেলফোন আবারো বেজে উঠেছে।
একটু কড়া ভাষায় ফোন সাইলেন্ট করার কথা বলবে কিনা ভাবতে ভাবতেই মেয়েটা ফোন রিসিভ করে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলতে শুরু করে দিয়েছে। 'আশ্চর্য মেয়ে তো!' তাকিব আপনমনেই গজগজ করছে, এখানে কী খেলা দেখতে আসছে? নাকি ফোনে কথা বলতে আসছে? আরে বাপ! তোর যখন কথা বলার এতোই সখ - তাহলে তুই বাসায় বসেই বল না! গ্যালারিতে বসে বলতে হবে কেন? শুধু শুধু টিকেটের অপচয়! এই টিকেটটা পেলেও হয়তো ওর বন্ধুটা খেলা দেখতে আসতে পারতো …
'ধুর! কী যে বলিস! অত আহামরি কিছু লিখি নাই, তুই যেভাবে বলছিস …
শুধু গতানুগতিকের বাইরে লেখা চেষ্টা করছি। জানিসই তো আমার বড় ভাই নাই। একজন বড় ভাই থাকলে ছোট বোনের সাথে তার সম্পর্ক কেমন হতে পারে তা নিয়েই লিখলাম আর কী … '
গজগজানি বন্ধ করে বড় বড় চোখ নিয়ে মেয়েটার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে তাকিব। ওর পাশে বসা এই মেয়েটা "নুহার ডায়েরি" গল্পের লেখিকা! এই মেয়েটাই অবাঞ্চিতা অতিথি আইডির মালিক? যে মেয়েটার নামটাও জানতে পারে নাই,
সেই মেয়েটাই এখন তাকিবের পাশে বসে! একেই বুঝি বলে কাকতালীয় ঘটনা। উত্তেজনায় তার দম বন্ধ হয়ে আসতে চাচ্ছে।
নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং শেষ। বাংলাদেশী পেসার রুবেল আর মাশরাফি খুব মার খেয়েছে ব্ল্যাক ক্যাপ্সদের ব্যাটিং প্রতিরোধ করতে গিয়ে। বিশাল টার্গেট! এই টার্গেটে খেলতে নেমে কেমন করবে টাইগাররা - কে জানে! দশ মিনিট পরেই ওদের ব্যাটিং শুরু হবে।
টান টান উত্তেজনা থাকায় খেলা চলাকালীন মেয়েটার সাথে কোন আলাপ হয়নি। কী বলে ওর সাথে কথা শুরু করা যায় - ভাবছে তাকিব। কিন্তু তার আগেই মেয়েটা নিজ থেকেই আলাপ শুরু করল।
'কী বাজে বোলিং , দেখেছেন? মাশরাফির কাছে প্রত্যাশা একটু বেশিই ছিল!'
'হুম?' মেয়েটার সাথে সহজ হতেই পারছে না তাকিব। কিন্তু মেয়ে বলেই চলেছে নিজের মত করে,
'একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন? ওরা কিন্তু ডানপাশে ফেলা বলগুলো খেলতেই পারেনি। অথচ ম্যাশ আর রুবেল যেন ডানপাশে বল ফেলতেই পারেনি! বরং নতুন প্লেয়ার আল আমিনকে দেখেন? সে ব্ল্যাক ক্যাপসদের দূর্বলতাটা ঠিক বুঝেছে! এই কারণেই এক ওভারে দুইটা উইকেট নিতে পেরেছে সে!'
'কথা তো ঠিকই বলেছেন।' আমতা আমতা করে বলতে শুরু করল তাকিব।
মেয়েটার কথার তোড়ে ও মুখে কোন কথাই জোটাতে পারছে না। কোনমতে একটু সাহস সঞ্চয় করে মেয়েটাকে তার নামটা জিজ্ঞেস করবে কিনা ভাবছে ও।
'ইয়ে . . . '
হাত নাড়িয়ে মেয়েটা ওকে থামিয়ে দিল। উত্তেজিত ভঙ্গীতে চিৎকার করে বলল - 'ওরা মাঠে নামছে!'
'ওরা মাঠে নামছে!'
আবারো মাঠে মনোযোগ দিতে বাধ্য হল তাকিব। যদিও কিছুটা মনোযোগ মেয়েটার প্রতিই ছিল।
তবে বেশিক্ষণ ওর প্রতি মনোযোগ আটকে থাকল না তাকিবের। কিছুক্ষণ পরই খেলায় ডুবে গেল ছেলেটা। দল খারাপ খেলছে না। কিন্তু খেলার এই গতি দিয়ে জিততে পারবে কিনা বুঝতে পারছে না। মাঝেমধ্যে দুএকবার মেয়েটার দিকে তাকাচ্ছে না যে- তা নয়। যতবার তাকিয়েছে , ততোবারই ওকে দুহাত গালে ঠেকিয়ে মাঠের দিকে চেয়ে থাকতে দেখেছে , নয়তো গভীর মনোযোগ দিয়ে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছে। কোনবারই কথা বলার সাহস সঞ্চয় করতে পারেনি। আর মেয়েটাও নিজ থেকে আর কোন কথা বলেনি।
০৪
বেশ হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে পনেরো রানে হেরে গেল বাংলাদেশ। এই সিরিজে এটাই ওদের প্রথম হার। ইসসসসসস! বাংলাদেশ কি টি২০ তে ভাল খেলতে পারবেই না? ভাবতে ভাবতেই পাশে তাকালো তাকিব। ওমা! মেয়েটা তো নেই সেখানে! দাঁ ড়িয়ে গিয়ে এদিক ওদিক মেয়েটাকে খুঁজলো । নেই তো নেইই! যেন হাওয়া হয়ে গিয়েছে! এত মানুষ যে , ভীড় ঠেলে বের হওয়াও সম্ভব না এখন। মেয়েটা যে কীভাবে বের হয়েছে - আল্লাহই জানেন!
তারপরও যতটা সম্ভব , খুঁজেছে তাকিব। পায়নি। হুড়াহুড়ি করে মেয়েটাকে খোঁজার সময় যে তার পকেটমার হয়ে গেছে বলতেও পারবে না। রিকশা করে বাসায় ফেরার পর ভাড়া দিতে গিয়ে বুঝল, ওর পকেটমার হয়ে গেছে। সাথে অত সাধের মোবাইলটাও গেছে!
এরপর অনেকদিন ফেইসবুকে ঢুকতে পারেনি। কারণ মাসখানেক পর নতুন মোবাইল কিনে যখন ফেইসবুক ব্রাউজিং করতে গেল , তখন দেখল ওর আইডি হ্যাক হয়ে গেছে। তৎক্ষণাৎ নতুন আইডি খুলে "অবাঞ্চিতা অতিথি" লিখে সার্চ দিয়েছিল। কিন্তু ওই নামে কোন আইডি খুঁজে পায়নি তাকিব। অবাঞ্চিতার সাথে ওর কোন মিউচুয়াল না থাকায় মেয়েটার কোন খোঁজ বের করতে পারল না ও। মেয়েটা যেন পুরোপুরি হারিয়ে গেল তাকিবের জীবন থেকে।
০৫
প্রায় বছরখানেক পরের কথা। হরতালে ভার্সিটির ক্লাস বন্ধ হওয়ায় খুলনায় নিজের বাড়িতে এসেছে তাকিব। ৩-৪ দিন ছুটি পেলে ও সাধারণত বাড়িতে আসে না। এবার আসার বিশেষ কারণ আছে। বিশেষ কারণটা হল , বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ে টেস্ট সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টটি খুলনায় হবে। প্রথম টেস্ট ঢাকায় হওয়া সত্ত্বেও খেলা দেখতে পারেনি সে। টিকিট পায়নি। এদেশের মত ক্রিকেট উন্মাদনা আর কোন দেশে আছে বলে মনে হয়না! যেখানে অন্যান্য দেশে ওয়ানডে-টি২০ তে দর্শকের দেখা মিলে না , সেখানে বাংলাদেশে টেস্ট খেলায় টিকিট পাওয়া যায় না! এটা থেকেই বাঙ্গালীদের ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসা প্রকাশ পায়।
গত একটা বছর ধরে ওরা ধারাবাহিকভাবে খারাপই খেলে গেছে! জিম্বাবুয়ের সাথে প্রথম টেস্টে জয় পেলেও , খুব একটা ভাল পারফরমেন্স করেনি ওরা। বলতে গেলে ধুকতে ধুকতে জয় পেয়েছে। এর জন্য যে কেবল ক্রিকেটাররা দায়ী , তা নয়। ওদের পারফরমেন্সের চেয়েও খারাপ হল বিসিবি! এত আবাল মার্কা ক্রিকেট বোর্ড আর কোন দেশের আছে বলে মনে করে না তাকিব।
টিকিট নিয়ে ভাবনা নেই , বন্ধু ফয়সালকে বলে রাখায় সে টিকিট কেটে রেখেছে।
০৬
দ্বিতীয় দিনের খেলা শেষে তৃপ্ত মন নিয়ে বাসায় ফিরছে তাকিব। বহুদিন পর দল এত ভাল খেলছে। তামিম খুব দায়িত্বশীল ইনিংস খেলে সেঞ্চুরী করেছে। আর সেই সাথে সাকিব সাকিবীয় ইনিংস খেলেই সেঞ্চুরী পেয়েছে। রিয়াদও নিয়মিতভাবে ভাল খেলে চলেছে। শুধু মুশির দায়িত্বজ্ঞানহীন আউট হওয়ায় একটু বিরক্তই লেগেছে তাকিবের। তাছাড়া বাকি সবাই মিলে বেশ ভাল একটা টার্গেট দাঁড় করাতে পেরেছে। স্টেডিয়ামে খুব হৈ হুল্লোড় করে খেলা দেখেছে ওরা। খুলনায়ও যে এতো দর্শক হবে ভাবেনি তাকিব। ওর কেন যেন মনে হচ্ছে এতো এতো এতো দর্শকদের মাঝেও পরিচিত একটা মুখ দেখতে পেয়েছে। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারল না , কার মুখ দেখেছে ও। মনে একটু খচখচানি নিয়ে ঘুমাতে গেল তাকিব।
ঘুমের মধ্যে সে স্বপ্ন দেখল। নতুন কোন ঘটনা নয় , অনেক আগে তার সাথে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার ক্ষুদ্রাংশ দেখল স্বপ্নে। অবচেতন মন সেই পরিচিত মুখটাকে স্বপ্নের মাধ্যমে মনে করিয়ে দিয়েছে। স্বপ্নের মধ্যে সে বারবার বলতে চেয়েছে , 'মেয়ে তোমার নাম কী?'
'মেয়ে তোমার নাম কী?'
কিন্তু হঠাৎ করেই দেখল ওর আশেপাশে কেউ নেই। যতদূর দৃষ্টি যায়, ধূসর সাদা। এ কোথায় এসে পড়ল সে? বাঘের গর্জন শুনে চমকে পিছন ফিরল সে। দেখল একটা রাজকীয় রয়েল বেঙ্গল টাইগার হেলেদুলে তার দিকে আসছে! এখানে বাঘ এল কোত্থেকে! ভাবতে ভাবতেই বাঘটা তার উপর ঝাপিয়ে পড়ল।
চিৎকার করে ঘুম ভাংলো তাকিবের। এই কার্তিক মাসের শেষ দিকের হালকা শীত থাকা সত্ত্বেও ঘেমে নেয়ে গেছে সে। এইরকম অদ্ভুত স্বপ্ন দেখার কারণ কী - কে জানে! মোবাইলে দেখল মাত্র ভোর চারটা বাজে। খেলা শুরু হবে সেই নয়টায়। এখনো অনেক সময় বাকি। চাইলেই একটু ঘুমিয়ে নিতে পারে ও। জানে , শুয়ে থেকেও এখন আর ঘুম আসবে না। তাই বিছানা ছেড়ে বাথরুমের দিকে এগোল তাকিব।
০৭
পঞ্চম দিনের খেলা দেখে খুবই হতাশ হচ্ছে তাকিব! একে তো আগের দুইদিনে ম্যাচের অবস্থা নড়বড়ে করে দিয়েছে মুশির ফিল্ড সেটাপ আর বোলারদের ফালতু বোলিং। যার ফলস্বরূপ দেদারসে রান হয়েছে জিম্বাবুয়ের। প্রথম দুইদিন যে পিচে রান করতে জান বের হয়ে গেছে তামিমের, পরের দুইদিন সেই পিচকেই ব্যাটিং সহায়ক পিচ মনে হয়েছে! আর আজ সকালে সাত নাম্বার ব্যাটসম্যান শুভাগতের একটা হাফ সেঞ্চুরীর জন্য মুশি দশটা ওভার নষ্ট করিয়েছে! আর এখন জিম্বাবুয়ে সমানে পিটিয়ে যাচ্ছে! উইকেট ফেলতে পারছে না বোলাররা। মোটে চারটা উইকেট পড়েছে! পঞ্চম দিনেও এমন মেরে খেলতে পারার রহস্যটা বোঝা যাচ্ছে না। নিজেদের পিচে নিজেরাই যদি কোন সুবিধা না পাই, তাহলে কী লাভ এত টাকা খরচ করে?
বিরক্ত হয়ে অনেক দর্শকই বেরিয়ে গেছে গ্যালারি ছেড়ে। লাঞ্চের পর আবার আসবে হয়ত। খানিকটা হতাশা তাকিবকেও চেপে ধরেছে। ওটাকে চেপে রাখার চেষ্টা করতে করতে সীট ছেড়ে উঠল ও। আজকে গ্যালারিতে এসেই তার চোখ কী যেন খুঁজছে, কিন্তু পাচ্ছে না। লাঞ্চ ব্রেকের সময়টায় তাই সে পুরোদমে খুঁজতে শুরু করল।
ভাগ্যটা ভালোই বলতে হবে , বিরতি শেষ হবার মিনিট দশেক আগেই পেয়ে গেল যা খুঁজছিল। কিন্তু পেয়ে যাওয়াতে যথেষ্ট অবাকই হল। কেবল একটা স্বপ্নকে বিশ্বাস করে যে ওকে পেয়ে যাবে ভাবতেও পারেনি তাকিব! যত যাইই হোক , এটা টেস্ট ক্রিকেট। একটা মেয়ে ওয়ানডে, টি২০ বা লীগ ক্রিকেট দেখতেই পারে , তাই বলে টেস্ট? ওকে দেখে ধারণা পাওয়া যায় যে, এদেশের অন্তত চারভাগের একভাগ মেয়ে ক্রিকেটকে সত্যিকারের ভালোবাসে।
দলের দুরাবস্থায়ও ধৈর্য নিয়ে বসে আছে মেয়েটা। আর একনিষ্ঠভাবে মোবাইল টিপছে। তাকিব ওর কাছাকাছি গিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল , "Excuse me,Madam!"
ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো মেয়েটা। মূহুর্তেই ঝলমলে হাসিতে মুখটা উদ্ভাসিত হল তার। বলল , 'What a coincidence! খেলা দেখতে এলেই দেখি আপনার সাথে দেখা হয়! আশ্চর্য!'
‘আমাকে মনে আছে আপনার?’ অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল তাকিব।
'মনে থাকবে না কেন? আমাকে কী আপনার গোল্ডফিশ মার্কা মেমোরির অধিকারিণী মনে হয়?’ উত্তরের অপেক্ষা না করে আবার বলল , 'আমার প্রচন্ড খিদে পেয়েছে! খালি পেটে আলাপ জমবে না! আসুন কিছু খাই!' বলেই ফুড কর্ণারের দিকে এগোল মেয়েটা।
মাথা নেড়ে তাকিব অনুসরণ করল ওকে।
'কালকের খেলাতেই দেখলাম সাকিবের ব্যাটিং এর সময় দুইটা শর্ট কাভার রাখা হলো কারণ সাকিব কাভারে ভাল, তামিমের পুরা ব্যাটিং এর সময় অফ সাইড ব্লক করে রাখা হল কারণ তামিম অফে ভাল। টেইলরের ফিল্ড প্লেসিং দেখে মনে হচ্ছিল সে প্রত্যেক ব্যাটসম্যানের শক্তির জায়গাটাকে ব্লক করে উইকেট নিতে চায়! আর আমাদের ফিল্ড প্লেসিং সম্পর্কে কিছু বলার নাই। মনে হচ্ছে মুশি কিছু জানে না, চারদিকে ফিল্ডার ছড়ায়ে ছিটায়ে রাখছে ! এইভাবে খেলা হয় নাকি!' খাবার অর্ডার করেই বলতে শুরু করল তাকিব। এবার আর মেয়েটাকে কথা বলার সুযোগ দিতে চায়না ও। ওর বকবকানির চোটে গতবার কোন কথাই বলা হয়নি তাকিবের। এবার সব কথা সেইই বলবে!
‘বোলিং লাইন আপে তো সমস্যা নাই -সমস্যা হচ্ছে ফিল্ডিং সেটাপে। আর সেটাতেও তো পুরোপুরি মুশফিককে দোষ দেওয়া যায়না।'
‘বোলিং লাইনে প্রব্লেম নাই?? হা হা হা!’ ঠাঠা স্বরে হেসে ফেলল তাকিব।
'তৃতীয় দিনের বোলিংয়ে রুবেলের ৪০% শাহাদাতের ৫০% বল শর্ট। আর বাকি বল গুলা ওয়াইড। কোন লাইন নাই। তাও বল ভালো? জুবায়ের অবলিলায় লেগসাইড বল করে। সব বর্ণনা করে বলতে শুরু করলে দিন গিয়ে রাত ফুরিয়ে যাবে! তাও নাকি বোলিং এ সমস্যা নাই। এমন বল করলে কোন ক্যাপ্টেনই ভালো ফিল্ড সেটাপ করতে পারবে না! গ্যারান্টি!'
একটু থেমে আবারো শুরু করল তাকিব। 'বলের কোন লাইন টাইন নাই। অফসাইডে ফিল্ড সেটাপ করলে অবলিলায় লেগ সাইডে বল দেয়। ৬০% শর্ট বল করে। পিচ যতোই ভালো থাকুক উইকেট যাবে কেম্নে?'
কিন্তু ও ও কম যায় না। উত্তেজিত গলায় বলতে শুরু করল , 'প্রথম দিকে ফিল্ড সেটাপ করার দায়িত্ব ক্যাপ্টেনের। পরে তো সেটা বোলাররা সেট করে, তাইনা? প্রত্যেকটা বোলারের ঠিক কোন লাইনে বল করবে। সেই হিসেব করে ফিল্ড সেটাপ করবে। সেটা তারা করতে পারছে না ঠিকমতো। এইজন্যই বেশি রান আসতেছে। রুবেলের বোলিং নিয়া আমারও অনেক অভিযোগ আছে। আর জুবায়ের এর বোলিং দেখিই নাই ভাল করে। দুজনকে বাদ দিয়ে বলছি।'
‘কিছুটা ঠিক বলেছেন।'
মাথা ঝাকিয়ে সায় দিল তাকিব। ‘তবে ফিল্ড সেটাপের দায়িত্ব শুধু বোলারের নয় , ক্যাপ্টেন এখানে অনেকটা ভূমিকা রাখেন . . .’
-‘আরি আরি! খেলা শুরু হয়ে গেছে! চলেন! চলেন !! চলেন!!!" উত্তেজিত ভঙ্গীতে কথা গুলো বলেই পা বাড়ালো মেয়েটা।
এতক্ষণ ক্রিকেট নিয়ে অনেক আলাপ আলোচনা করলেও এখন আর ওকে বাঁধা দেবার মত বা ওকে বলার মত কোন কথা এল না তাকিবের মুখে। অগত্যা বাধ্য ছেলের মত করে ওকে অনুসরণ করল তাকিব। নিজের সীটে আর ফিরে গেল না। দরকার হলে দাঁড়িয়ে থেকে খেলা দেখবে! তবুও মেয়েটাকে চোখের আড়াল হতে দেবে না আর! আর হারাতে চায়না ওকে!
০৮
ওর ধারেকাছেই তাকিব একটা সীট পেয়ে গেল বসার জন্য! ধুপ করে ওটায় বসে পড়ল ও! মালিক এলেও এখান থেকে উঠবেনা সে , গ্যাট ধরে বসে থাকবে!
হঠাৎ মেয়েটা বলে উঠল, 'একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন? আমাদের দলের একজন প্লেয়ার কিন্তু নিয়মিত ভাল খেলছে , কিন্তু ফোকাসে আসছে না . . . '
'মাহমুদুল্লাহের কথা বলছেন?'
মেয়েটার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলল তাকিব।
'হুম! দেখেন , আজকেও দলকে সে একটা ভাল টার্গেট দিতে সাহায্য করেছে। অথচ ওর কথা কেউ বলবে না! আমরা সবসময় সাকিব-মুশফিক-তামিম নিয়েই মেতে থাকি। এই যে এত্তদিন নিয়মিতভাবে খারাপ খেলার পরও তামিমের সেঞ্চুরিতে লোকে ওকে মাথায় তুলে রাখছে! আর মাহমুদুল্লাহকে দেখেন? কারোর কোন খবরই নাই! এমনকি ওকে বোলিং করতে দেওয়া হয়না! কেনরে বাপ? টেস্ট খেলায় এতজন স্পেশালিস্ট বোলার না রেখে ওদের দিয়েই তো কাজ চালানো যায়! কেন যেন মনে হয় মুশির সাথে রিয়াদের কোন গন্ডগোল চলছে. . .'
'বলেন কী!'
আবারো কথার মাঝখানে ওকে থামিয়ে দিল তাকিব। 'না মানে , ফেইসবুকে মুশির বিয়ের যতগুলো ছবি দেখেছি , কোনটায় রিয়াদ ছিল না! ব্যাপারটা আশ্চর্যজনক না?'
ঝট করে মেয়েটার দিকে তাকালো তাকিব। ও মাঠের দিকে চেয়ে আছে। এইবার এসেছে সঠিক রাস্তায়! খেলা নিয়ে আলাপ আলোচনা করতে গিয়ে ব্যক্তিগত আলোচনায় এগোনো যাচ্ছিলই না! ওর দৃষ্টি ধরে মাঠের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে শুরু করতে গেল তাকিব।
'আপনার ফেইসবুক আইডি . . . ' কথা শেষ করার আগেই মেয়েটা সহ পুরো স্টেডিয়াম ফেটে পড়ল উল্লাসে! জিম্বাবুয়ের পাঁচ নাম্বার উইকেটটা চমৎকার এক স্ট্যাম্পিংয়ের মাধ্যমে নিয়ে নিয়েছে জুবায়ের! স্টেডিয়ামে উত্তেজনা ফিরে এসেছে এই উইকেটের সাথে সাথেই!
চতুর্থ জুটির পর আর দাঁড়াতে পারেনি জিম্বাবুয়ে। নিয়মিত বিরতিতে সাকিব-তাইজুল-জুবায়েরের শিকার হয়ে ফিরে গেছে তারা। একেকটা উইকেট পড়ে , আর স্টেডিয়ামেরে মানুষগুলো যেন পাগল হয়ে যায়! তাকিব নিজেও তাদের দলে। প্রচন্ড চিৎকার চেঁচামেচি আর উল্লাসের ফাঁকে ফাঁকে মেয়েটার দিকে তাকায় সে। সবার সাথে পাল্লা দিয়ে ওও তারস্বরে চেঁচাচ্ছে !
জিম্বাবুয়ের পাঁচ নাম্বার উইকেটটার কারন মুশফিকের চমৎকার এক স্ট্যাম্পিং! জুবায়রের বল বুঝতেই পারল না ব্যাটসম্যান। আর বাকি কাজটা সেরে নিল দলপতি মুশফিক।
মুশফিকের তালু বন্দী করে সাকিব যখন শিনাওয়ের উইকেটটা তুলে নিল , তখন জানা গেল ১৪ বারের মত পাঁচ উইকেট পাওয়ার সাথে সাথে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে গেছে সাকিব! প্রায় ৩১ বছর পর এক টেস্টে ১০উইকেট ও সেঞ্চুরির কৃতিত্ব গড়ে ইমরান খান ও ইয়ান বোথামের সাথে নাম লিখিয়েছে সে।
এই গ্যালারির প্রত্যেকটা মানুষ , খুশিতে আত্মহারা! ২০১৪ সালটা পুরোই কেটে গেছে জয়ক্ষরায়। শেষ সময়ে এসে এমন একটা জয় , আর সেটা থেকে এত এত প্রাপ্তি ক্রিকেটপ্রেমী মানুষদের খুশির জোয়ারে ভাসিয়ে নিচ্ছে!
০৯
মেয়েটার দিকে তাকালো তাকিব। এই কাঁদছে , এই হাসছে! উত্তেজিত হয়ে ফোনে কথা বলছে। আবার দ্রুতহাতে কী যেন টাইপ করছে! অথবা ফেইসবুক ব্রাউজিং করছে। সারামুখ খুশিতে উদ্ভাসিত। চোখদুটোও যেন হাসছে। হঠাৎ করেই সাধাসিধা চেহারার মেয়েটাকে অসম্ভব সুন্দরী লাগছে তাকিবের চোখে।
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের এনাউন্স করতেই মাঠে চোখ ফিরালো তাকিব। শামিম চৌধুরীর বকবকানি চলছে। তিনি প্রথমে ব্রেন্ডন টেলর কে ডাকলেন। সে তার "বাণী" দিয়ে গেল। এরপর ডাক পড়ল মুশফিকুরের। পুরো স্টেডিয়াম হুল্লোড় করে উঠল ওকে আসতে দেখে।
ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হয়েছে সাকিব। স্বাভাবিকভাবেই! ম্যান অফ দ্য সিরিজও সেইই হবে নিশ্চিত! সাকিব যাওয়ার পর তাকিব হাসি মুখে মেয়েটার দিকে তাকালো। ওর নামটা এখনো জানা হয়নি। এখনকার ফেইসবুক আইডি হয়তো আসল নামে। কিন্তু কোথায় সে? ওর খালি সীটটা যেন ব্যঙ্গ করছে তাকিবকে! এবারো মেয়েটা ওকে না বলে চলে গেল? ভীড় ঠেলে বহু কষ্টে পুরো গ্যালারি তন্ন তন্ন করে খুঁজল মেয়েটাকে। কিন্তু কোথাও কেউ নেই! যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে মেয়েটা!
মেয়েটা অধরাই রয়ে গেল। সাক্ষী হয়ে রইলো এই ক্রিকেট। এ যেন এক ক্রিকেটীয় উপাখ্যান।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:০০