ঠিক রিভিউ যেটাকে বলে, আমি সেটা লিখি না। বই নিয়ে আমার যাবতীয় অনুভূতি লিখে রাখি। তা হয়তো কিছু কিছু ক্ষেত্রে উপন্যাসের কাহিনির বাইরের কথাও এসে যায়। বই নিয়ে আমার এই অনুভূতিকে বইকথা হিসেবে প্রকাশ করি। পারফেক্ট রিভিউ এখানে পাওয়া যাবে না।
লেখকের প্রথম যে বইটা পড়েছি, সেটা হল ১৯৫২। ছোটবেলায় যখন তিন গোয়েন্দা পড়তাম, তখন একবার একটা কাহিনি ধরলে ওটা শেষ করা ছাড়া উঠতে পারতাম না। এক বসায় শেষ করতে না পারলে খুব অস্থির লাগতো, খুব ছটফট করতাম। আর এখন বই পড়ি কাজের ফাঁকে ফাঁকে। কিছু করার নাই, একবসায় বই শেষ করার সময়টা কই?
কিন্তু এই ১৯৫২ বইটা জিরিয়ে জিরিয়ে বই পড়ার ট্র্যাডিশন ভেঙ্গে দিল। সেই ছোটবেলার মত থ্রিল পেলাম। বইয়ের শেষ পৃষ্ঠায় যাওয়ার আগপর্যন্ত থামতে পারলাম না।
বইমেলায় বাতিঘরের নতুন যে বইগুলি এসেছে, সবগুলি কিনে ফেলেছিলাম। এরমধ্যেই একটা ছিল করাচি। কিনার পর জানতে পারলাম, এটা একটা সিরিজের প্রিক্যুয়েল। ভাবলাম, ধুর! সিরিজে ঢুকতে গেলাম ক্যান? বাকি সব বই পড়া শেষ হয়ে গেলেও, ওটা পড়ে রইল। পরে একদিন সজল বলল, সিরিজের বই হলেও পড়তে পারবেন বইটা। সিরিজের সাথে এটার তেমন কোন যোগসূত্র নেই।
পড়লাম। কাহিনি হল, তিনযুগ আগের ঘটনা মীমাংসা করতে হবে বাস্টার্ডকে। সেজন্যে পাড়ি দিতে হবে বারো শ’ মাইল, যেতে হবে এ বিশ্বের সবচেয়ে অরাজক আর বিপজ্জনক শহর করাচিতে। প্রথমে টার্গেট সহজ আর মিশন কঠিন ভাবলেও অচেনা করাচি তাকে বার বার চমকে দিতে শুরু করলো। অপ্রত্যাশিত সব সব ঘটনার মুখোমুখি হতে হলো তাকে। একটা সময় মনে হলো টার্গেটের নাগাল পাওয়াটা শুধু কঠিনই নয় অনিশ্চিতও বটে। তবে হাল ছেড়ে দেবার পাত্র নয় সে। চূড়ান্ত আঘাত হানার সময় বুঝতে পারলো দুনিয়া কাঁপানো একটি ঘটনার মধ্যে ঢুকে পড়েছে অযাচিতভাবে!
বইটা পড়তে বেশ ভালো লেগেছিলো। ইচ্ছে হল, সিরিজের অন্য বইগুলি শুরু করি। কিন্তু আমি তো আমাকে জানি! একবার কোন সিরিজে মজে গেলে শেষ না করা পর্যন্ত শান্তি পাব না। তাই কিনলাম না ওগুলো।
ঢাকায় গিয়ে কেন যেন মনে হল, শুরু করে দিই সিরিজটা। সবাই এত প্রশংসা করে! লোভ সামলাতে পারছিলাম না। কিনে ফেললাম নেমেসিস। যা হবার কথা ছিল তাই হল। এক রাতে শেষ হয়ে গেল বইটা। কাহিনীটা একটু বলি, দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থায় মারা গেলেন নিজের অ্যাপার্টমেন্টে। সিটি হোমিসাইড ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগ বিস্ময়কর দ্রুততায় ধরে ফেললো সম্ভাব্য খুনিকে। সন্দেহের তীর গিয়ে পড়লো লেখকের যুবতী স্ত্রীর ওপর। ওদিকে মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে লেখকের আত্মজীবনী মেইল হয়ে গেলো অন্য একজনের কাছে। বেরিয়ে এলো নানান কাহিনী...তারপর ঘটনা মোড় নিতে থাকে ভিন্ন দিকে। শেষ পর্যন্ত জেফরি বেগ যা জানতে পারলো তা একেবারেই অপ্রত্যাশিত আর অচিন্তনীয়।
বইটা থ্রিলার হিসেবে অবশ্যই খুব ভাল। নইলে এটা পড়েই বাকিগুলো পড়ার জন্য আমার এত উচাটন হত না। কিন্তু এই বইয়ে নাজিম ভাই থিম হিসেবে এমন একটা স্পর্শকাতর ব্যাপার বেছে নিয়েছেন যে ওটাকে ফেইমসিকিং না বলে পারা যায় না।
একটু আধটু খুঁত তো থাকবেই, তাই বলে সিরিজটা তো না শেষ করে থাকা যাচ্ছে না!
টাকা নেই হাতে। কিন্তু বইগুলি তো আমার পড়তেই হবে! আবার চাঁদপুরে এই বইগুলি পাওয়া যায় না। ঠিক করলাম এইমাসে ঢাকায় গিয়ে অবশ্যই কিনব বাকি তিনটা বই। এরই মধ্যে সাহিত্য সভার প্রতিযোগিতায় তৃতীয় হয়ে কন্ট্রাক্ট পেয়ে গেলাম পুরস্কার হিসেবে। নেক্সাস নাকি বাতিঘরে নাই। আর কনফেশনটা ভুলে জাকির ভাইয়ের কাছে রয়ে গেছে। কী আর করা? কন্ট্রাক্ট নিয়েই ফিরে এলাম।
পাঁচ লক্ষ টাকা দামের একটি টেলিফোন কল! কোটি টাকার ষড়যন্ত্র। পেশাদার খুনি বাস্টার্ডকে ফিরে আসতে হলো দেশে; একটি লাইফটাইম কন্ট্রাক্ট । আত্মবিশ্বাসী বাস্টার্ড তার মিশনে নেমে পড়তেই সব কিছু জট পাকাতে শুরু করে। বিশাল এক ষড়যন্ত্রের অংশ হয়ে যায় সে। এ দিকে দৃশ্যপটে আর্বিভূত হয় হোমিসাইড ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগ। তাদের দু’জনের লক্ষ্য একেবারেই ভিন্ন। ষড়যন্ত্র আর পাল্টা ষড়যন্ত্র-রাজনীতি আর অন্ধকার জগতের কাহিনি।
এই বইয়েই আমি বাস্টার্ডের প্রেমে পড়ে গেলাম। হ্যাঁ, নায়ক নয়, ভিলেনের প্রেমেই পড়লাম। বাস্টার্ড এমন এক ভিলেন, যাকে সবাই ভালোবাসবে। মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগলো। মানুষের নাম বাস্টার্ডও হয়?
ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরতে ফিরতে অর্ধেক পড়া হয়ে গেল। বাকিটুকুও শেষ হলো রাতের আগেই। অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। পরের বইগুলি কবে পাব হাতে? সজলকে বললাম, বইগুলি যেম্নেই হোক যোগাড় করে দিতে। করল সে। কনফেশন আর নেক্সাস পাঠিয়ে দিল কুরিয়ারে।
কুরিয়ার থেকে যখনই বই আনতে যাই আমি, তখনই অদ্ভুত একটা পুলক অনুভব করি। বইগুলি এনেই পড়তে শুরু করলাম নেক্সাস। যথারীতি এক বসায় পড়েছি বইটা। কিন্তু দেড়শ পৃষ্ঠা পেরিয়ে গেলেও বাস্টার্ডের দেখা পাচ্ছিলাম না। মন খারাপ হচ্ছিল খুব। আগেই তো বলেছি, জেফরি নয় বাস্টার্ডের প্রেমে পড়েছি আমি। যাই হোক, অবশেষে তার দেখা পেয়ে মুখে হাসি ফুটলো। যদিও খুব কম সময়ই ছিল সে নেক্সাসে।
এটার কাহিনি সংক্ষেপ হল, অভিজাত স্কুল সেন্ট অগাসটিনে খুন হলো নিরীহ এক জুনিয়র ক্লার্ক। হোমিসাইডের ইনভেসটিগেটর জেফরি বেগ তদন্তে নামতেই দ্রুত ঘটনা মোড় নিতে থাকে - দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয ভয়ঙ্কর এক সন্ত্রাসীচক্র। কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পডে ইনভেসটিগেটর। কিন্তু দমে যাবার পাত্র নয সে। অবশেষে সত্য উদঘাটনে সফল হতেই সূত্রপাত ঘটে নতুন একটি উপাখ্যানের।
কনফেশন হাতে নিয়ে বসে আছি। শুরু করব, কিন্তু মন খারাপ হচ্ছে খুব। এটা পড়ে ফেললেই তো এই সিরিজ পড়া শেষ হয়ে যাবে। এরপর? এরপর কী করব?
তার উপরে আবার নাজিমউদ্দিন ভাইয়ের জাল ছাড়া বাকি সব বই পড়া শেষ। এরপরে কবে তাঁর বইয়ের রোলার কোস্টারে উঠতে পারব কে জানে!
তার উপরে কনফেশন পড়তে শুরু করে একদম হতাশ। বদলে গেছে পেশাদার খুনি বাস্টার্ড। সে আর টাকার বিনিময়ে মানুষ খুন করেনা। তবে সম্পূর্ণ ভিন্ন কারনে ফিরে গেল নিজের পুরনো পরিচয়ে। আবারো মুখমুখি হল হোমিসাইড ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগের। ইন্টারোগেশন রুমে শুরু হল বাস্টার্ডের অতীত জীবনের কনফেশন। কিন্তু বেশিরভাগ চ্যাপ্টারই সিরিজের আগের বইগুলিতে পড়ে ফেলেছি। কনফেশনটা যেন জোর করে টেনে বড় করা বই।
এই সিরিজটার তেমন বড় কোন খুঁত আমি পাইনি। সিরিজের সব বইই যে ফাটাফাটি লেভেলের হবে, সেটা আশা করা বোকামি। তবে একটা ব্যাপার না বললেই নয়। যদিও এটা জাস্ট ব্যক্তিগত মতামত। বইয়ের নামগুলি। এক্সেপশনাল নাম, বেশ থ্রিল আছে নামগুলিতে, কিন্তু তারপরও আমার আপত্তি। আমার ধারণা, বাংলা ভাষার সাহিত্য বাংলা নামেই হওয়া উচিৎ।
রেটিং ব্যাপারটা ঠিকভাবে আসে না আমার। নাম্বার দিয়ে বইয়ের কোয়ালিটি যাচাই করা যায় না। তাই সেদিকে যাই না। এম্নিতে বলি,
সিরিজে সবচেয়ে ভালো বই হলো কন্ট্রাক্ট।
ক্রমান্বয়ে বললে,
কন্ট্রাক্ট > নেক্সাস > করাচি > নেমেসিস > কনফেশন
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ১১:৪২