ঠিক রিভিউ যেটাকে বলে, আমি সেটা লিখি না। বই নিয়ে আমার যাবতীয় অনুভূতি লিখে রাখি। তা হয়তো কিছু কিছু ক্ষেত্রে উপন্যাসের কাহিনির বাইরের কথাও এসে যায়। বই নিয়ে আমার এই অনুভূতিকে বইকথা হিসেবে প্রকাশ করি। পারফেক্ট রিভিউ এখানে পাওয়া যাবে না।
কিছু কিছু বইয়ের পূর্ণ প্রতিক্রিয়া লিখলেও, সবগুলি যথাযথ পাঠপ্রতিক্রিয়া লেখা হয়নি। কখনো হয়তো ইচ্ছে করেনি, কখনো বা দু'লাইন বা চার লাইন লিখতে ইচ্ছে হয়েছে। তাইই করেছি। এই দু'চার লাইনের অনুভূতি গুলি একসাথে গুছিয়ে রাখতে ইচ্ছে হল।
মেন এগেইনস্ট দ্য সী
চার্লস নডহফ ও জেমস নরম্যান হ
বইটা খুব আগ্রহ নিয়ে পড়তে শুরু করেছিলাম। ইদানিং সমুদ্র নিয়ে লেখা যেকোন উপন্যাস পড়তে খুব ভালো লাগে। এটাও তার ব্যতিক্রম না। প্রচন্ড খিদের সময় ওরা যখন একটুকরো রুটি আর একঢোক পানি দিয়ে দুপুরের বা রাতের খাবার খাচ্ছিল, ঠিক সেই সময়ে আমিও ফ্রুটকেক খাচ্ছিলাম। কী এক অদ্ভুত কারণে, বইটা পড়তে পড়তে অবচেতন মনেই গপ গপ করে হাতে ধরা কেকটা খেয়ে নিয়েছি। তারপর ঢক ঢক করে পানির বোতলটা নিয়ে আধবোতল পানি খেয়ে ফেললাম। কেন যেন মনে হচ্ছিল, মাঝসাগরের ওই ছোট্ট নৌকায় আমিও রয়েছি। আমার ভাগের খাবারটুকু তাড়াহুড়ো করে না খেয়ে নিলে পরে আর কিছুই জুটবে না!
কী হাস্যকর!
কয়েক পাতা পরই একটা পৃষ্ঠায় স্টার চিহ্ন দিয়ে লেখা সেবা প্রকাশনি থেকে অনুদিত বাউন্টিতে বিদ্রোহ দ্রষ্টব্য। বুঝলাম, এর আগের আরেকটা পার্ট আছে এই বইয়ের।
পড়তে ইচ্ছে হলো খুব। একই সাথে মনে হল, বাউন্টিতে বিদ্রোহ নামটা খুব চেনা চেনা লাগছে। আছে নাকি বইটা আমার কাছে?
আমার সমস্ত বই দাদুর লেখে যাওয়া স্টিলের আলমারিতে থাকে। খুঁজে পেতে বের করলাম বাউন্টিতে বিদ্রোহ । শক্ত মলাটের পেপারব্যাক বই। মলাটে লেখা, পাঞ্জেরী সচিত্র কিশোর ক্লাসিক সিরিজ। জীবনে একবার বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলাম। পাঞ্জেরির সৌজন্যে। ওতে জিতেই এই বই পুরস্কার পেয়েছিলাম।
খুশি হয়ে পড়তে শুরু করলাম। এটাও রূপান্তর। কিন্তু সেবার মত সুখপাঠ্য নয়। কেমন যেন কেবল বয়ান দিয়ে যাচ্ছে - এরকম। অর্ধেকটা পড়ে বুঝলাম, মেন এগেইনস্ট দ্য সী এর আগের পার্ট নয় এটা। এখানে মেন এগেইনস্ট দ্য সী এর কাহিনিটুকু সহই আছে। তফাৎ হল এটা ক্যাপ্টেনের জবানীতে লেখা আর মেন এগেইনস্ট দ্য সী ডাক্তারের জবানীতে লেখা। মজার ব্যাপার হল, মেন এগেইনস্ট দ্য সী ডাক্তারের জবানীতে লেখা হলে কী হবে, বাউন্টিতে বিদ্রোহ তে ডাক্তার বিদ্রোহের আগেই মারা গেছে!
এরকম ছোট ছোট কিছু অসংগতি ছাড়া প্রায় সবই মিলে গেছে। তবে বাউন্টিতে বিদ্রোহ কে পাঞ্জেরী কেটে ছেটে একাকার করে ফেলেছে। ১৫৮ পৃষ্ঠার বই, দুই পাতা পর পরই ছবি, এতেই পুরো কাহিনি লেখা। .
সেবা যদি বইকে কেটেছেটে পাঁচ ভাগের এক ভাগ করে থাকে, পাঞ্জেরী সেটাকে দশভাগের একভাগ করে ফেলেছে!
আবার পাঞ্জেরীরটায় লেখকের নামও আলাদা।
বাউন্টিতে বিদ্রোহ সত্য ঘটনা অবলম্বনে ইতিহাসখ্যাত এক ট্রিলজি। আমি কেবল মাঝেরটা পড়েছি। এতটাই নেশা ধরে গেছে যে বাকি দুইটা কিনতে অর্ডার করে দিয়েছি।
দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী
আর্নস্ট হেমিংওয়ে
নোবেলজয়ী এই বিখ্যাত লেখকের লেখা এই প্রথম পড়েছি। তাও আবার এই বইটার জন্যই তিনি নোবেল পেয়েছিলেন। গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে অনবদ্য এক কাহিনি। পুরো কাহিনিটাকেই যে হেমিংওয়ে রূপকার্থে ব্যবহার করেছেন, অনুবাদক রওশন জামিল শুরুতে বলে না দিলে বুঝতেই পারতাম না। এম্নিতেই পড়ে যেতাম। বইয়ের মাহাত্যও বোঝা হত না।
একজন নিঃসঙ্গ বুড়োর জীবন, তার পেশা, সাগরের প্রতি অসীম ভালোবাসা, এমনকি নিজের শিকার করা বিশাল মার্লিন মাছটার প্রতি যে ভালোবাসা হেমিংওয়ে দেখিয়েছেন, এরকমটা আর কখনোই আমি পড়িনি। মাছটাকে বাঁচাবার জন্য বুড়োর যেই আপ্রাণ চেষ্টা, এবং একদম শেষ মুহূর্তে এসে তাতে বিফল হয়ে যাওয়া, হাঙরের দলের মাছটার গলাধঃকরণ - এর সবই প্রচন্ড প্রচন্ডভাবে ঝাঁকিয়ে দিয়ে গেছে আমাকে। বিরাট মাছের কেবল মাথাটা নিয়ে বুড়ো যখন তীরে গেল, এত প্রচন্ড কষ্ট যে হচ্ছিল! এই পুরো ব্যাপারটাকেই হেমিংওয়ে জীবনের সাথে তুলনা করেছেন। আমরা আমাদের জীবন বিপন্ন করে এমন বিরাট কিছু অর্জন করার চেষ্টা করি, কিন্তু সেটা অর্জন করার পর ভোগ করার সময় পর্যন্ত যেতে যেতে সমুদ্রের হাঙরের মত কিছু দুর্বৃত্ত তা ছিনিয়ে নেয়।
ইসস! কী গভীর ভাব!
আমিও যদি এমনটা লিখতে পারতাম!
জলেশ্বরী
ওবায়েদ হক
ভীষণ ভীষণ ভালো লেগেছে। হুমায়ূন আহমেদের বই পড়ে শেষ করলে যে হাহাকার জন্মে, এই বইয়ের প্রায় পুরোটাতেই সেই হাহাকারবোধ হয়েছে … জীবনধর্মী বইয়ে যে থ্রিল আনা যায়, এই বই না পড়লে জানতামই না! সত্যি বলতে কী, প্রশংসা করার উপযুক্ত শব্দগুচ্ছ পাচ্ছি না …
এরপরের পুরো বইকথাই পুরো হিজিবিজি। সবই হুমায়ূন আহমেদের বই নিয়ে কথা। তাই হিজিবিজি।
খটমটে সাই ফাই পড়লে আমার মাথা ধরে যায়। সাহিত্যের এই একটা শাখা আমার ভালো লাগে না। আমি সযত্নে সেই জেনর থেকে গা বাঁচিয়ে চলি।
সেদিন কে যেন বলল, ফিহা সমীকরণটা পড়ে ফেলতে। যেহেতু স্যারের বই, সাইফাই হোক আর যাইই হোক, কোনটাই বাদ রেখে যাওয়া যাবে না। তাই পড়ে ফেললাম। আর এই প্রথম কোন সাইফাই পড়তে গিয়ে আমার দাঁত ভেঙ্গে যায়নি।
এরপর ধরলাম হিমুর নীল জোছনা। চুয়াত্তর পৃষ্টার বই, ছত্রিশ পৃষ্টা পর্যন্ত পড়ার পর মনে হল বইটা আমার আগের পড়া। শেষ পৃষ্টায় গিয়ে নিশ্চিত হলাম, হ্যাঁ এটা আগেই পড়া হয়েছে। এরপরেও পড়তে ইচ্ছে হচ্ছিল, কিন্তু যেহেতু ঠিক করেছি, এখন আর এক বই দ্বিতীয় বার পড়ব না, তাই ওটা ছেড়ে দিয়ে এখন দারুচিনি দ্বীপ ধরেছি।
কদিন ধরে অদ্ভুত নিয়মে পড়ছি। দিনে এক বই, রাতে আরেক। দিনে বিভিন্ন ক্যাটাগরির বই পড়লেও রাতে পড়ি কেবল হুমায়ূন আহমেদের বই। আসলে কদিন আগে উপন্যাস সমগ্র ১১ পড়ার পর কেবল হুমায়ূন স্যারের বইই পড়তে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আমার কাছে স্যারের যা হার্ডকপি আছে, সব পড়া হয়ে গেছে। তাই বাধ্য হয়ে পিডিএফে পড়ছি। দিনে যখন বাইরে থাকি, তখন একটা বই পড়ি। সেটা শেষ না হলেও সন্ধ্যায় এসে হুপা (স্যারই এই নাম দিয়েছেন তাঁ্র কোন এক বইয়ে। বইয়ের নাম মনে নাই। হিজিবিজি?) বনে যাই। অথচ আগে আমার স্বভাব এমন ছিল না। একটা বই শেষ করার আগে কখনওই অন্য বই ধরতাম না।
রাতে পড়লাম, চোক্ষে আমার তৃষ্ণা। পাগল পাগল একটা মেয়ের পাগল পাগল কাহিনি। নতুন করে বলার কিছু নাই।
আগুনের পরশমণি পড়লাম। ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সিনেমাটা দেখেছি অনেক আগেই। সিনেমা দেখেছি বলে বই পড়া হল না এতদিন। ভাবতাম, কাহিনি তো জানিই!
কিন্তু ছোট ছোট ব্যাপার গুলি, বিশেষ করে অনুভূতির বর্ণনাগুলি বইয়ে যেভাবে লেখা,আছে, সেটা সিনেমায় আসে নাই। পরিচালক হুমায়ূন আহমেদ হলেও সেটা সিনেমায় ফুটেনি।
না-কি ফুটেছে? অনেক আগে দেখেছিলাম বলেই সেসব চোখ এড়িয়ে গেছে?
অভিব্যক্তির পরিপূর্ণ প্রকাশ লোকে টিভিতে দেখে। আমি দেখি হুমায়ূন আহমেদের বইয়ে। নাটক মুভির অভিব্যক্তি আমাকে ছোঁয় না। কিন্তু স্যারের বইয়ের অভিব্যক্তি আমাকে ছোঁয়। শুধু ছোঁয় বললে ভয়াবহ ভুল হবে। প্রচন্ডভাবে নাড়া দিয়ে যায়।
আরো একবার পুরোনো সেই কষ্টটা খুব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আল্লাহ স্যারকে কেন এত জলদি নিয়ে গেলেন?
কুহক পড়ে ফেললাম। অনেকদিন আগে স্যারের কালো জাদুকর পড়েছিলাম, ওটার সাথে কিছুটা মিল পেলাম। কালো জাদুকরে মানুষের মাথায় ঢুকে মনে কথা বুঝতে পারার ক্ষমতার সাথে একটা অন্ধ মেয়ের সংশ্লিষ্টতা ছিল। আর কুহকে একই ক্ষমতার সাথে মুক-বধির মেয়ের সংশ্লিষ্টতা।
একটা ব্যাপার খুব বেশি জানতে ইচ্ছে করছে। প্রতিবন্ধীদের কি সত্যিই কোন এক্সট্রা অর্ডিন্যারি পাওয়ার থাকে???
আগে আমি স্যারের বই পেলে নাম ধাম না দেখেই পড়তে শুরু করতাম। সেজন্যই হয়ত বইয়ের নাম দেখে বুঝতে পারতাম না, বইটা পড়েছি, নাকি পড়ি নাই। আজকেও সানি যখন বলল, এখনো কেন অচিনপুর পড়ি নাই, তখন অচিনপুরের পাতা উল্টে দেখি, এই বই আমার আগেই পড়া ছিল। এরকম আরো কত বই আছে, কে জানে!
তবে আজকের পর থেকে স্যারের বই নিয়ে নামজনিত কোন ভুল হবে না …
কেউ যখন কষ্টে থাকে তখন প্রশ্ন করে কষ্টের ব্যাপারটা জানতে নেই। সময়ের সাথে সাথে কষ্টের ওপর প্রলেপ পড়ে। তখন জিজ্ঞেশ করা যায়। প্রলেপ পড়ার আগেই কষ্টের ব্যাপার জানতে চাইলে কষ্টটা অসহনীয় হয়ে ওঠে।
হুমায়ূন স্যারের এপিটাফ উপন্যাস থেকে নেওয়া …
কেমন মিলে গেল!! যখন আমার মন খারাপ থাকে, তখন যদি কেউ বারবার জিজ্ঞেশ করে, কেন মন খারাপ, তখন সত্যিই মেজাজ সপ্তমে চড়ে যায়। মন খারাপের সময় একা থাকতেই ভাল লাগে। হুমায়ূন স্যার কী করে আমাদের সবার সাইকোলজি জেনে নিয়েছিলেন, খুব জানতে ইচ্ছে হয়।
ইদানিং ঘুমুতে যাওয়ার আগে কিশোরীবেলার মত মাথার কাছে মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট আর গল্পের বই নিয়ে শুই। গত ক'দিনে হুমায়ূন আহমেদের পেন্সিলে আঁকা পরী, সে ও নর্তকী আর হ্যাগার্ডের অ্যালান এন্ড হোলি ফ্লাওয়ার পড়েছি। এখন পড়ছি, এবং হিমু।
কেন যেন আগের সেই স্বাদটা পাই না। ভয় ভয় কাঁথার নিচে তিন গোয়েন্দার বই নিয়ে তখনকার আমলের মোবাইলের নীলচে আবছা আলোয় যে আবেগ আর উত্তেজনা নিয়ে বই পড়তাম, সেই অনুভূতিটা আর আসে না। কেন কে জানে!
হয়ত এখন আর আম্মুর হাতে ধরা পড়ার ভয় নেই, হয়ত এখন আর কেউ ডাক দেয় না বলে লুকিয়ে বই পড়ার সেই আনন্দটা পাই না।
আহ ছেলেবেলা!
-----
ক্ষুদে বইকথা সিরিজের আগের পর্বগুলোঃ
ক্ষুদে বইকথা - ০১
ক্ষুদে বইকথা - ০২
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ভোর ৬:৫৪