তিনমাসে যে ৮০+ বই পড়ে শেষ করেছি, কিছু কিছু বইয়ের পূর্ণ প্রতিক্রিয়া লিখলেও, সবগুলি যথাযথ পাঠপ্রতিক্রিয়া লেখা হয়নি। কখনো হয়তো ইচ্ছে করেনি, কখনো বা দু'লাইন বা চার লাইন লিখতে ইচ্ছে হয়েছে। তাইই করেছি। এই দু'চার লাইনের অনুভূতি গুলি একসাথে গুছিয়ে রাখতে ইচ্ছে হল।
আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরী
যে কারণে ডায়েরিটা বিখ্যাত, সে ব্যাপারটা আমাকে তেমন ছুঁয়ে যায়নি। আমি একটু কাঠখোট্টা টাইপের মানুষ। যুদ্ধের সময় জার্মানরা ইহুদীদের কেমন অত্যাচার করেছে, সেই কাহিনি পড়ে আমার চোখে পানি আসেনি। পাকিস্তানিরা এরচেয়ে বহুগুণ বেশি অত্যাচার আমাদের করেছে।
আমার যেটা ভালো লেগেছে, সেটা হল ছোট্ট মেয়েটার ব্যক্তিত্ব। ওর তীব্র জীবনবোধ, আত্ম-উপলব্ধি আর বুদ্ধিমত্তা আমাকে মুগ্ধ করেছে। সেই সাথে ওর লেখক সত্ত্বাকেও আমার খুব ভাল লেগেছে। ছোট একটা মেয়ে এত গুছিয়ে ডায়েরী লিখেছে যা দেখে আমার মনে হয়েছে, আমিও যদি এভাবে ডায়েরী লিখতে পারতাম! ওর লেখা কিছু কিছু অংশ তো আমার সাথে মিলেই গেছে!
যেমন -
"কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও আমি ভেঙ্গে পড়িনি, আমার আদর্শকে জলাঞ্জলি দিইনি। জানি, বর্তমান অবস্থায় সেগুলোর বাস্তবায়ন অসম্ভব, তবুও সযত্নে তাদের বুকের ভেতর লালন করছি। কারণ আমি এখনো বিশ্বাস করি মানুষের ভিতরটা নির্মল সুন্দর। এই বিশ্বাসই আমার স্বপ্নের ভিত্তি, আমি তো আমার স্বপ্নগুলোকে এমন কিছুর উপর দাঁড় করাতে পারি না, যা কেবল মৃত্যু - ধ্বংস দিয়ে গড়া।"
প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও আমি তো জানি, ওর এই কথাগুলি আমার সাথে কতটা মেলে!
বইয়ের পরিশিষ্টতে বলা আছে হল্যান্ড মুক্ত হবার মাত্র দুইমাস আগে নির্যাতিতা আনা ফ্রাঙ্ক মৃত্যুবরণ করে। আমি জানি না, ঠিক কী ধরণের নির্যাতনের শিকার হয়ে ও মারা গেছে। কোনভাবে জানা গেল ভাল হত।
খুব কষ্ট লেগেছে মেয়েটার জন্য। কষ্টটা শুধু ওর জন্যই লেগেছে, আর কারো জন্য নয়।
কবি
হুমায়ূন আহমেদ
প্রচন্ড মাথা ধরা নিয়ে মোটা একটা উপন্যাসের বই পড়ে যাচ্ছি। উপন্যাসের শুরুটা খুবই বিরক্তিকর লেগেছে আমার কাছে। মনে মনে ভাবছিলাম, হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস আবার বিরক্তিকরও হয়!!!
বিরক্তি লাগার কারণ হলো কবিতা। কবিকে নিয়ে লেখা উপন্যাসে কবিতা থাকবে, সেটা খুব স্বাভাবিক।
কিন্তু আমার যে কবিতা পছন্দ নয়!
একজন সাহিত্যপ্রেমী হিসেবে এটা যে খুব ভয়াবহ অপরাধের পর্যায়ে পড়ে, সেটা আমি জানি। কিন্তু তবুও আমার যে কিছু করার নাই। পাঠ্যবইয়ের কবিতা ছাড়া আমি হাতে গোনা কিছু কবিতা পড়েছি। তাও হয়ত ঠেকায় বেঠেকায় পড়ে। ছোটবেলায় পিনি কে দেখতাম, কোথাও সুন্দর কিছু পঙক্তি দেখলেই ডায়েরীর পাতায়, টেবিলের কাঠে, এখানে সেখানে লিখে রাখত। ওর অতি আগ্রহ কপি করার জন্য আমিও চেষ্টা করতাম কবিতা পড়তে। কবিতাকে ভালোবাসতে। হয়নি কখনো।
কবি উপন্যাসটা পড়ছিলাম কবিতাগুলি এড়িয়ে। কিন্তু বোনের বিয়েতে জাগতিক বস্তুগত কিছুই দিতে না পারা আতাহারের বাড়িয়ে দেওয়া চিরকুটের কবিতাটা আমি এড়িয়ে যেতে পারিনি। ওটা পড়ে মিলির মতোই কেঁদে ফেলেছি।
দুপুরে বন্ধু জিজ্ঞেস করছিল, হুমায়ূন আহমেদের কোন লেখা পড়ে আমি কেঁদেছি। ওকে বলা হয়নি, স্যারের প্রায় সবগুলি বই পড়ার কোন না কোন সময়ে আমার চোখে জল এসেছে। সেই অশ্রু কখনো চোখ থেকে গড়িয়ে পড়েনি, চোখেই মরে গেছে।
রূদ্রপ্রয়াগের চিতা
জিম করবেট
একটা মানুষখেকো চিতা, ঠিক কতটা ধুরন্ধর আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির হতে পারে, এই বইটা না পড়লে জানতাম না। জঙ্গল নিয়ে, মানুষখেকো সিংহ নিয়ে আগে পড়লেও মানুষখেকো চিতা সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না। মানুষের কাছাকাছি থেকে মানুষের গতিবিধি সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান তো ছিলইই, সঙ্গে ছিল দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আর ক্ষিপ্ততা। আর ভাগ্যের সহায়তা। ভাগ্য যেন বার বার চিতাটাকেই সাহায্য করে গেছে তার জীবন বাঁচাবার জন্য। আর বহাল তবিয়তে রূদ্রপ্রয়াগের আশেপাশেরর পাঁচশ বর্গমিটার এলাকায় সদর্প রাজত্বে বিঘ্ন না ঘটানোয়।
জিম করবেটের চমৎকার একটা অ্যাডভেঞ্চারস বই "রূদ্রপ্রয়াগের চিতা"। খুব ভাল লেগেছে। প্রাকৃতিক বর্ণনাগুলি এত নিখুঁত হয়েছে যে আমি চোখের সামনেই যেন সব কল্পনা করতে পারছিলাম। কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন আছে। আমি যেটা পড়েছি, সেটা হল সেবা থেকে কাজিদার রূপান্তর। মূল বইটা কি আরো বিস্তারিতভাবে লেখা? কেউ জানেন? সেবা সম্পর্কে একটা অভিযোগ প্রায়ই যেটা পাওয়া যায়, মূল বইয়ের তুলনায় রূপান্তর অনেক অনেক ছোট হয়। এই বইয়ের মূল লেখাটা যদি এরচেয়ে বড় হয়, তাহলে তো সেটা খুব একঘেয়ে হবার কথা। এরচেয়ে বিস্তারিত লিখলে সত্যিই বইয়ে মনোযোগ রাখা যেত না।
দ্য রোড ব্যাক
এরিক মারিয়া রেমার্ক
টান টান উত্তেজনা নাই। বোরিং টাইপের বই হলেও বইয়ের মূল বিষয়টা চমৎকার লেগেছে। যুদ্ধ ফেরত সৈনিকদের ব্যথাটা আমিও অনুভব করেছি।
---------------
ক্ষুদে বইকথা সিরিজের অন্য লেখা - ক্ষুদে বইকথাঃ ০১
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে অক্টোবর, ২০১৬ ভোর ৬:১৭