লিখবো না , লিখবো না করেও এই বইটা নিয়া লিখতে বসছি। কারন, প্রথমত, আমার খায়া দায়া কাম নেই। দ্বিতীয়ত, এই বই টা পড়তে পড়তে অসংখ্যবার আমার আব্বার কথা মনে পড়েছে।
আমার আব্বা ছিলো অত্যন্ত ধর্ম ভীরু মানুষ। তেমন কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও ইসলাম সম্পর্কে ছিলো বিস্তর পড়াশোনা। তার ফলে, আমি ইসলামের যেকোন একটা শাখা ধরে উনার সংগে নানা আজাইরা আলাপ করতে পারতাম। আমি ইসলামের তিনশো ষাট ডিগ্রি বিপরিতে গিয়ে কথা বললেও উনি রাগতেন না। বরং উনার বিদ্যা বুদ্ধি প্রয়োগ করে বোঝানোর চেষ্টা চালাতেন। আব্বা মরে যাওয়ার আমার সবথেকে বড় ক্ষতি হইছে যে, আমি পরিচিত কারো সাথে ধর্ম নিয়া ক্রিটিক্যালি কথা বলতে পারি না।
আমি ব্যাক্তিগত ভাবে ধর্ম কর্ম না করলেও , সেটা নিয়ে আমার বিস্তর আগ্রহ আছে। কারন আমার কাছে সবসময় মনে হয়েছে, ধর্ম আসলে ম্যাজিক। এইটা এতোই শক্তিশালি ম্যাজিক যে , এইটা ব্যাবহার করে মানব সভ্যাতার ইতিহাস বারে বারে পাল্টায়া গেছে। কিন্তু সব ম্যাজিকের পেছনে একটা চতুর ম্যাকানিজম থাকে, সেই ম্যাকানিজম ই আমার আগ্রহের বিষয়।
আলি দস্তি এই নামের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় আমার বউ। আমার চোত্রিশতম জন্মদিনে আমার বউ আমাকে সমান সংখ্যক বই উপহার দেয়। তার ভেতর এই বই ছিলো, নবি মোহাম্মদের ২৩ বছর। সারা জীবন আমরা "নবী" এইভাবে লিখে এসেছি। এই বই তে "নবি" - এইভাবে লেখা। গুরুত্ব কমানোর জন্য কিনা জানিনা।
আলি দস্তি বলেছেন এই বই লেখার অনুপ্রেরনা তিনি পেয়েছেন কোরয়ান থেকে। সেখানে নবীকে রক্ত মাংশের মানুষ এবং বার্তা বাহক রুপে বার বার দেখানো হয়েছে। বই লেখা হয়েছে মানুষ মুহাম্মদকে নিয়ে।
যেহেতু তিনি মানুষ তাই মানবিক দোষ ত্রুটির উর্ধে নয়। সেইসব মানবিক দোষ এবং গুনের ক্রিটাক্যাল বিশ্লেষন এই বই।
বইতে খুব ই কম সংখ্যক হাদিস ব্যাবহার করা হয়েছে ঘটনা ব্যাখ্যা করার জন্য কারন হাদিস নিয়ে অনেক মতভেদ আছে। কোরয়ানের আয়াত ব্যাবহার করা হয়েছে, কোরানের আয়াত ব্যাখার জন্য তাফসীর আল জালালাইন সাহায্য নেয়া হয়েছে, যেটা সুন্নিদের কাছে অন্যতম গ্রহনযোগ্য তাফসীর।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, সহজ কথা যায় না বলা সহজে। এই বই এর সারমর্ম সহজে আমি বলতে পারবো না। তবে নবি জীবনের কয়েকটা ঘটনার কথা বললে ধারনা পেতে পারেন।
ঘটনা ১ঃ উষর মরুভুমিতে কুরাইশ বংশে যে বাচ্চাটা জন্মগ্রহন করলো । তার চোখ ফোটার আগেই তার জন্মদাতা মারা গেলেন। মা মারা গেলেন কিছুদিন পর। বংশে অনেক ধনী চাচারা থাকলেও এইরকম এতিম একটা শিশুর দায়িত্ব নিলেন তার চাচা আবু তালিব। সেও অতি দরিদ্র। শিশুটি একটু বড় হলে তার প্রধান কাজ ছিলো মরুভুমিতে উট, মেষ , ছাগল চড়ানো। রাতের পর রাত , দিনের পর দিন সেই অকরুন মরুভুমিতে থাকতে হতো তাকে। এর ফলে তিনি আকাশ, নক্ষত্রমন্ডলি, পাহাড় এইগুলা নিয়া ভাবার বিস্তর সুযোগ পেয়েছিলেন।
ফলে মাক্কি সুরাগুলাতে দেখবেন, খুব সাহিত্য সাহিত্য ভাব, খুব শ্রুতিমধুর।
মাক্কি সুরা আরো একটি বৈশিষ্ট হলো, এইটা নরম নরম। যেমন উপদেশ, পরোপকার, ধৈর্য। যার ধর্ম তার তার ইত্যাদি ইত্যাদি। কারন মক্কাতে অবস্থা খুব নাজুক ছিলো। আদেশ নিষেধ আয়াত বলতে গেলে মস্তক ছিন্ন হওয়ার ভয় ছিলো।
ঘটনা ২ঃ মদিনাতে যখন রাষ্ট্র গঠন করে ফেললেন তখন কোরানের আয়াতের চরিত্র পরবর্তন হওয়া শুরু করল। সেখানে গনিমতের মাল, কেনো জিহাদ উত্তম, শহিদ হওয়া কেন ভালো ইত্যাদি ইত্যাদি আয়াত আসলো। কারন তখন হাতে শক্তি এবং অর্থ ছিলো। শক্তি এসেছিলো আন্সার আর মুহাজির থেকে আর অর্থ এসেছিলো বানিয্য কাফেলায় হামলা করে এবং ইহুদি গোত্র ডাকাতি , অবরোধ করে।
ঘটনা ৩ঃ নবি বলেছিলেন, পৃথিবীতে আমার তিনটা জিনিস প্রিয়। এক, সুগন্ধি, দুই, নারী, তিন, নামাজ। এইকথা সবাই বুঝেছিলো কিন্তু সাহস করে বলেছিলো হজরত আয়েশা।
যুদ্ধে করে পাওয়া মেয়েদের গনিমতের মাল হিসাবে বিবেচনা করা হতো। অনেক নারী নিজের প্রান রক্ষার্ত্রে নিজেকে নবির কাছে সমর্পন করতেন। সেইরকম তিনজন নারী ছিলেন। তাদের মধ্যে উম্মে শরিক ছিলেন অতীব সুন্দরী। নবির কাছে উম্মে শরিক আসার সাথে সাথে তিনি তাকে গ্রহন করেন। এতে আয়েশা রাগান্বিত হন। কিছুক্ষনের মধ্যে আয়াত নাজিল হয়ঃ তুমি ওদের যাকে ইচ্ছা গ্রহন করতে পারো , যাকে ইচ্ছা দূরে রাখতে পারো (৩৩ঃ৫১)। আয়েশা তখন বলেনঃ হে আল্লার নবি, আপনাকে খুশি করেতে আপনার প্রভু তো খুব একটা দেরি করেন না। (বুখারী; ভ্লিউম ৭ , বুক ৬২, নম্বর ৪৮)
আরবের একটা দরিদ্র বালক শুধুমাত্র নিজের চিন্তা শক্তি, দুরদৃষ্টি, প্রজ্ঞা, রাজনৈতিক বিচক্ষনতা, বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে একটা বর্বর জাতিকে পৃথিবীর মানুষের কাছে বীর হিসবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। এই অর্জনও তো কম না। নবি জন্মের একশো বছরের মধ্যে পুরো পৃথিবীর ইতিহাস যখন বদলাতে শুরু করেছে তখন কে জানতো ঠিক একশো বছর আগে একটা এতিম মেষ পালক এই ইতিহাসের স্রষ্টা।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০২১ রাত ৮:০৮