somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যে দশটি কারণে সামরিক আদলতে তাহেরেরে বিচার অবৈধ

২৮ শে আগস্ট, ২০১০ রাত ১:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


প্রথমত: মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান নিজস্ব এবং গোষ্ঠীগত ইচ্ছা ও স্বেচ্ছ্বাচারিতা চরিতার্থ করার জন্য ৭ই নভেম্বরের পর থেকে অনেকগুলো সামরিকা ফরমান ও আদেশ জারি করেছেন। এমনি একটি অধ্যাদেশ ছিল ৸Special Martial Law Tribunal Regulation 1976৹৷ রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি সায়েম ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্টের ঠিক ১০মাস পর ১৯৭৬-এর ১৪ জুন এ অধ্য্যাদেশটি জারি করেন। এই অধ্যাদেশ জারির ধান্দা একটিই- ইতোমধ্যে গ্রেফতারকৃত ৭ নভেম্বরের সিপাহি বিপ্লবের নেতা কর্ণেল তাহের ও জাসদ নেতৃবৃন্দের বিচার করা। জেনারেল জিয়ার ইচ্ছা ও নির্দেশেই সায়েম এ অধ্যাদেশটি জারি করেছিলেন। কারণ সায়েম রাষ্ট্রপতি হলেও দেশের সর্বময় ক্ষমতা তখন প্রকৃত অর্থে সেনাপ্রধান জিয়ার হাতেই কেন্দ্রীভূত ছিল। অর্থ, স্বরাষ্ট্র ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছাড়াও তিনি তখন অন্যতম ডিসিএমএল(উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক) ও ছিলেন।
ঐ সামরিক আইনের আর্টিক্যাল ৩(D) তে বলা হয়েছিল:
ট্রাইব্যুনাল এ বিধি বলবত হবার আগে সংঘটিত হোক বা পর সংঘটিত হোক
ক) দন্ডবিধির(১৮৬০ সালের ৪৫নং) ষষ্ঠ ও সপ্তম অনুচ্ছেদের অধীনে শাস্তিযোগ্য যে কোন অপরাধ;
খ) ১৯৫২ সালের সেনাবাহিনী(১৯৫২ সালের ৩৯ নং) আইন, ১৯৫৩ সালের বিমান বাহিনী(১৯৫৩ সালের ৬ নং) আইন অথবা ১৯৬১ সালের নৌবাহিনী(১৯৬১ সালের ৩৫ নং) অধ্যাদেশ কিংবা এসব আইন ও অধ্যাদেশের অধীনে জারিকৃত যে কোন বিধি অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ;
গ) ১৯৭৫ সালের সামরিক আইন বিধির ১৩ বা ১৭ নং বিধির(১৯৭৫ সালের ১নং বিধিসমূহ) অধীনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ; কিংবা
ঘ) এ ধরনের কোন অপরাধ সংঘটন বা তাতে সহায়তা দানের চেষ্টা বা ষড়যন্ত্র অথবা অপরাধ সংঘটনের প্রস্তুতি হিসেবে শাস্তিযোগ্য যে কোন অপরাধের বিচার করতে পারবেন।

আটিক্যাল ৪(জ) এ ট্রাইবুনালের ক্ষমতা ও কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছে: ট্রাইবুনালের কোন সিদ্ধান্ত বা রায়ের ব্যাপারে কোন কর্তৃপক্ষের কাছেই আপিল করা যাবে না।

দ্বিতীয়ত: ৫সদস্য বিশিষ্ট এ ট্রাইব্যুনালে চেয়ারম্যানসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন সশস্ত্র বাহিনী থেকে আগত যাদের আইনগত অভিজ্ঞতা বা চর্চা প্রশ্নের উর্দ্ধে ছিল না। তদুপরি এরা সবাই ছিলেন সামরিক প্রশাসনের অংশ। প্রচলিত রীতিতে সাধারণত মার্শাল ল কোর্টে বিচার বিভাগ থেকে বিচারক নেয়া হয়। এটি হলো বিচারের নূন্যতম নিরপেক্ষতা অক্ষুন্ন রাখার প্রাথমিক শর্তের একটি। কিন্তু আমাদের আলোচ্য ট্রাইবুনালে প্রচলিত ঐ রীতিকে উপেক্ষা করা হয়েছিল।

তৃতীয়ত: এ ট্রাইব্যুনালকে তাবত দুনিয়ার আইন শাস্ত্রের ইতিহাসে একটি বিরল আলোচ্য বিষয় হিসেবেই চিহ্রিত করা যাবে। কারণ ট্রাইবুনালকে দেয়া ক্ষমতার পরিধি। মোট ৩ ধরণের অপরাধের শাস্তি বিধানের এখতিয়ার দেয়া হয়েছিল একই ট্রাইবুনালকে- ক) সাধারণ আইনের অপরাধ খ) সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে অপরাধ গ) সামরিক আইন বিরুদ্ধ অপরাধ। সম্ভবত বিভিন্ন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ও বেসামরিক ব্যাক্তিদের বিচারকার্য একই সঙ্গে সম্পন্ন করার লক্ষেই ততকালীন কর্তৃপক্ষ এই কাজটা করেছিল।

চতুর্থত: ট্রাইবুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ করা হয় কর্নেল ইউসুফ হায়দার কে যে মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশে থেকেও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দান করেনি। শুধু মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে নয়, মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিল। অথচ যাদের বিচারের জন্য তাকে চেয়ারম্যান করা হয়েছিল তারা সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। এ বিবেচনা থেকেও বিষয়টি যথেষ্ট আপত্তিকর।

পঞ্চমত: সামরিক অধ্যাদেশেই বলে দেয়া হয়েছে ট্রাইবুনালের রায়ের বিরুদ্ধে কোন আপিল করা যাবে না, বিচার কার্য চলবে রুদ্ধদার কক্ষে এবং বিচার প্রকৃয়া সম্পর্কে তথ্যপ্রকাশ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ থেকে শুরু থেকেই বিচার নিয়ে জনমনে যে সংশয় সৃষ্টি হয়, পরবর্তী মাত্র ৩০দিনে তার সত্যতা প্রমাণিত হয়।

ষষ্ঠত: বিচার শুরুর দিন অভিযোগগুলো উত্থাপিত হবার পর ট্রাইবুনাল ৮ দিনের জন্য মুলতবি হয়। এই আটদিন ই কেবল আসামি পক্ষের উকিলদের মামলার কাগজপত্র ও আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির সময় দেয়া হয়। অথচ সরকার পক্ষ মামলা সাজাতে সময় নিয়েছিল ছয় মাস। আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য এত কম সময় প্রদান ইতিহাসে বিরল। অভিযুক্তরা আইনজীবিদের সাথে কথা বলতে পারতেন কেবল কোর্টে থাকার সময়টুকুতেই!

সপ্তমত: সাধারণত সাক্ষীদের বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করার জন্য নিরপেক্ষ প্রত্যক্ষদর্শী থাকে। এ মামলায় এ বিধানটিও অগ্রাহ্য হয়। ৩ জুলাই আসামি পক্ষের আইনজীবীরা রাজসাক্ষী ফখরুল আলমকে বিস্তারিত জেরা করার অনুমতি চাইলে সেটা প্রত্যাখ্যান করা হয়।

অষ্টমত: যারা এ মামলা সাজিয়েছিল তাদের কথা মতোই সাক্ষীরা মামলা চলাকালে সাক্ষ্য দিচ্ছিল। আর এই বানানো সাক্ষ্য দিতে গিযে মিথ্যাচার আর ভুলের ছড়াছড়ি ছিলো। যেমন রাজসাক্ষী ফখরুল এক পর্যায়ে বলেন, ড. আখলাকুর রহমানের মোহাম্মদপুরুস্থ বাসায় সে কর্ণেল তাহের কে দেখেছে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা কর্ণেল ভোরার সাথে টেলিফোনে কথা বলতে। অথচ ড. আখলাকের বাসায় কোন ফোনই ছিল না।

নবমত: তাহের ও জাসদের আহবানে এবং নেতৃত্বে সিপাহীরা খালেদ মোশাররফ ও তার সহযোগী শক্তিকে উতখাত করেছে। সুতরাং একে তো বৈধ সরকার উতখাতের প্রচেস্টা হিসেবেই গণ্য করা যায় না। আবার ৭ ই নভেম্বরের বিপ্লবী প্রচেষ্টা যদি অবৈধ হয়েই থাকে তাহলে জিয়া সরকার সে দিনকে বিপ্লব দিবস হিসেবে ছুটি ঘোষণা করেছিল কেন? আবার দিনটি যদি জাতীয় গৌরবেরই হয়ে থাকে তাহলে কর্ণেল তাহের ও সহযোগীদের তো পরস্কৃতই হবার কথা।
এর আগে ৫ নভেম্বর খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিললা যাকে রাষ্ট্রপতি পদে বসালেন- সেই বিচারপতি সায়েম সিপাহি অভ্যুত্থানে খালেদ মোশারফ উতখাত হবার পরও বহালই রইলেন এবং তা জিয়া ও তাহেরর সম্মতিতেই। সুতরাং ৭ নভেম্বরের মধ্য দিয়ে সত্যিকার অর্থে কোন সরকার উতখাত হয়েছে এমনটি বলা যায় না।
অন্যাদিকে বৈধসরকার উতখাতের পাশাপাশি সামরিক বাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির যে অভিযোগ উত্থাপিত হয়, তাও যথার্থ ছিল না। বাংলাদেশ সেনাবাহীনিতে শৃঙ্খলা ভংগের প্রথম ঘটনা হলো ১৫ আগষ্টের ঘটনা। তার ফলে ক্ষমতায় আসা মোশতাক ও তার মেজরাই জিয়াকে এক পর্যায়ে সেনাপ্রধান নিয়োগ করে এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী অফিসারদের শায়েস্তা করার কোন চেষ্টাই নতুন সেনাপ্রধান জিয়া করে নি। ১৫ আগষ্ট থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত নৈরাজ্য ও শৃংখলা ভংগের কোন ঘটনার সংগে তাহের ও তার সহযোগীরা কোনভাবেই জড়িত ছিলেন না বরং সেনাপ্রধান হিসেবে ঐসবের দায় প্রকারান্তরে জিয়ার উপরই বর্তায়।

দশমত: সরকারী পিপি এটিএম আফজাল আসামিদের আইনজীবিদের জানান যে, প্রসিকিউটর হিসেবে তিনি কখনও মৃত্যূদন্ড দাবী করেন নি। তার মতে এরকম সিদ্ধান্ত ছিল সর্ম্পূর্ণ অবাস্তব। কারণ তাহের কে যে অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়, তার জন্য মৃত্যদন্ড দেয়া সম্ভব ছিল না- দেশে সে ধরণের কোন আইন ই ছিল না। অবশ্য ফাসির আদেশ কার্যকর করার দশদিন পর আইন মন্ত্রণালয় এই আইনগত অসংগতি দূর করে। ৩১ জুলাই ১৯৭৬ এ আইন মন্ত্রণালয় সামরিক আইনের ২০তম সংশোধন জারি করে যেখানে বলা হয় “বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীতে কোন ধরণের মতাদর্শ প্রচারের অপরাধের শাস্তি মৃত্যূদন্ড।“ কথা আছে, ততকালীন আইন সচিব তাহেরের মৃত্যদন্ড সংক্রান্ত রায়ের ব্যাপারে আইনি অসংগতি জিয়ার কাছে তুলে ধরলে জিয়া সেই ফাইলটি ছুড়ে ফেলে দেন। তিনি নির্দেশ দেন অবিলম্বে আইন মন্ত্রণালয় থেকে অবিলম্বে এ রায় অনুমোদন দেয়ার।
৪টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২২


ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিচার চাই? না ভাই, আমরা "উল্লাস" চাই

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৩৭





দীপু চন্দ্র দাস একটি পোশাক শিল্প কারখানায় চাকরি করতো। সম্প্রতি দীপু দাস তার যোগ্যতা বলে সুপার ভাইজার পদে প্রমোশন পেয়েছিলো।

জানা যায়, সুপারভাইজার পজিশনটির জন্য আরও তিনজন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৫২


ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×