কিভাবে একটি জাতীকে পরাজিত করে , নিজের পদানত এবং দাস হিসেবে ব্যবহার করা যায়। অনেকে যুদ্ধের কথা বলবে। কিন্তু তাতে অনেক ঝামেলা, অনেক রক্তক্ষয়। তারচেয়ে ধিরে ধিরে কিছু পদক্ষেপ নিয়ে তা বাস্তবায়ন করলেই পুরো জাতীকে ধ্বংস করে তাদের নিজের পদানত করা যায়। বিখ্যাত কিছু সমাজ গবেষক, সাইকোলজিস্ট, রাজনৈতিক গবেষক মিলে গবেষণার মাধ্যমে একটি পদ্ধতি সবার সামনে তুলে ধরেন যার মাধ্যমে একটি দেশ, জাতীকে বিনা যুদ্ধে, বিনা রক্তপাতে ধ্বংস বা নিজ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
আসুন পদ্ধতি গুলো নিয়ে আলোচনা করি।
Step 01: To shape truth, control the media:
প্রথমত, আপনার দরকার হবে অব্যর্থ দুটি অস্ত্র। মিডিয়া এবং একদল ওয়েল এডুকেটেড লোকজন যাদের এককথায় নাম দেয়া যায় “সুশীল সমাজ”। এইসব লোক বিভিন্ন জন বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ হবে, আর্ট, সাহিত্য, গান, কবিতা থেকে শুরু করে ব্যবসা, প্রকৌশল, অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞ হতে হবে, উচ্চ শিক্ষা অর্জিত হতে হবে। আপনার মিডিয়া ক্রামাগত এদের কথা, মতামত, জীবনধারা ফোকাস করতে থাকবে। কোন ঘটনা ঘটলেই তাদের বক্তব্য তুলে ধরবে বারবার , প্রতিবার, শতবার, যাতে সাধারন জনগণ তাদের জাতীর বিবেক, আশা ভরসার স্থল, নব জাগরণের অগ্রপথিক ভাবতে শুরু করে। অবশ্যই এসব লোকদের ভাল অভিনেতা হতে হবে। কারন প্রয়োজন অনুযায়ী এদের অভিনয়, মিথ্যা, ভন্ডামি দ্বারা আপনার প্রযোজিত নাটক মঞ্চস্ত করতে হবে। আর এক্ষেত্রে মিডিয়া পালন করবে প্রধান ভূমিকা। যে কোন ঘটনাকে আপনার সুবিধা অনুযায়ী দর্শকদের(জনগনের) সামনে উপস্থাপন করবে মিডিয়াই। সত্যকে গোপন করে, মিথ্যাকে ক্রমাগত সত্য বলে প্রচার করে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য প্রধান হাতিয়ার এই মিডিয়া। আপনার ধ্যান ধারণা, মতবাদ ক্রমাগত আস্তে আস্তে করে বিভিন্ন নাটক, ফিল্ম ইত্যাদি দ্বারা মানুষের মনে ঢুকিয়ে তা গ্রহণযোগ্য করার হাতিয়ার হচ্ছে এই মিডিয়া। আস্তে আস্তে তারা সেটা গ্রহন করতে থাকবে, আর একসময় এর উপরই নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। তবে এক্ষেত্রে আপনার প্রধান বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে জাতিটির নিজস্ব সংস্কৃতি, জাতীয়তা বোধ, তাদের যুবসমাজের চিন্তা ধারা, ধ্যান ধারণা। এসব কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন তা নিয়ে পরবর্তীতে আলোচনা করব। তবে এসব ক্ষেত্রেও মিডিয়া আপনাকে দারুণ সাহায্য করবে। তাই আপনার প্রথম অস্ত্র হবে মিডিয়া এবং সুশীল সমাজ।
প্রথমেই আসি মিডিয়ার ব্যাপারে। বর্তমান এই তথ্য বিষ্ফোরণের যুগে গণমাধ্যমের সহজ ও ব্যাপক বিস্তার এবং প্রযুুক্তিগত উন্নতির ফলে গণমাধ্যম আজ আমাদের কাছে অনেক বেশি স্বাভাবিক একাটি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আজ এমন একটি অবস্থানে আমরা আছি যেখানে গণমাধ্যম থাকা না থাকার প্রশ্নটি অচল। বাস্তব সত্য এই যে, গণমাধ্যম ছাড়া আমাদের জীবন অসম্ভব অর্থাৎ বলা চলে এটি আমাদের জীবনকে অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করছে।
গণমাধ্যম যেমন নিয়ন্ত্রণ করছে গণমানুষের জীবন যাপন তেমনি গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করে এর মালিক। বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর জন্য এই কথাটি আরো বেশি প্রযোজ্য। এমনকি সরকারি টেলিভিশন তো বটেই বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোও আজ নিয়ন্ত্রিত হয় মালিকের অদৃশ্য হাতের ছোঁয়ায়। এসব জায়গায় এমন কোন সংবাদ বা অনুষ্ঠান প্রচার করা হয় না যা তার মালিকের বিপক্ষে যায়। এমনকি সাংবাদিকদেরও কাজ করতে হয় মালিকের চোখের ইশারায় যা রুদ্ধ করে দেয় সাংবাদিকদের স্বাধীনতার পথ অন্যকথায় তা হরণ করে গণমানুষের তথ্য অধিকার।
মিডিয়া বর্তমানে হয়ে দাঁড়িয়েছে এক কার্যকর অস্ত্র, সেই সুবাদেই এখন “মিডিয়া সন্ত্রাস” শব্দটা সবার পরিচিত। রাত কে দিন করতে, মিথ্যাকে সত্য করতে, অত্যাচারী মহামানব বানাতে, অত্যাচারিতকে অপরাধী হিসেবে তুলে ধরতে, অন্যায় কে জাস্টিফাই করতে এক অব্যর্থ কার্যকর অস্ত্র এই মিডিয়া। বর্তমান বিশ্বে মিডিয়ার এই সন্ত্রাস , এই হিপক্রেসি, এই অন্যায় আক্রমণ বেশী প্রয়োগ হয় ইসলামের বিরুদ্ধে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে সুইজারল্যান্ডের বাজিল নগরীতে অস্ট্রেলিয়ার দুর্ধর্ষ ইহুদী সাংবাদিক ড. থিওডর হার্জেলের নেতৃত্বে বিশ্ব ইহুদী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে তারা গোটা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করার সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র ও সুপরিকল্পিত নীলনকশা প্রণয়ন করে। তারা সকলে একমত হয় যে, বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করতে হ’লে প্রথমত দুনিয়ার সকল স্বর্ণভান্ডার আয়ত্ত করতে হবে এবং সূদী অর্থ ব্যবস্থার জাল বিস্তার করে পৃথিবীর সকল পুঁজি তাদের হস্তগত করতে হবে। এরপর তারা স্থির সিদ্ধান্ত নেয় যে, আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যম যেন তাদের একচ্ছত্র আধিপত্যে চলে আসে এবং মিডিয়ার সাহায্যে দুনিয়াবাসীর মগজধোলাই প্রক্রিয়া শুরু করে তারা তাদের কাংখিত লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পারে। সংবাদমাধ্যম তথা সকল প্রচার মাধ্যমের অসাধারণ গুরুত্ব, প্রভাব ও ভূমিকার কথা উল্লেখ করে ড. থিওডর বলে, ‘আমরা ইহুদীরা পুরো বিশ্বকে শোষণের পূর্বশর্ত হিসাবে পৃথিবীর সকল পুঁজি হস্তগত করাকে প্রধান কর্তব্য বলে মনে করি। তবে প্রচার মিডিয়া আমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে দ্বিতীয় প্রধান ভূমিকা পালন করবে। আমাদের শত্রুদের পক্ষ হতে এমন কোন শক্তিশালী সংবাদ প্রচার হতে দেব না, যার মাধ্যমে তাদের মতামত জনগণের কাছে পৌঁছতে পারে।’
ছোট একটা উদাহরণ দেই “নিউইয়র্কে কোনো কারনে এক লোকের হাতে একটা কুকুর মারা যায় । পশ্চিমা মিডিয়ায় নিউজ আসলো , আত্নরক্ষার সময় দুর্ভার্গক্রমে এক আমেরিকানের হাতে একটা কুকুর নিহত । পরে জানা গেল লোকটা আমেরিকান না । নিউজটা ইডিট করে দেয়া হল , এক বিদেশীর হাতে এক কুকুর খুন ! তারও পরে জানা গেল , লোকটা মুসলমান । এবার নিউজটা পুরোপুরি চেইঞ্জ হয়ে আসল এভাবে , এবার মুসলমান জঙ্গীদের হামলা থেকে রক্ষা পেলনা অবলা প্রানী কুকুরও !!” This is called media manipulation.
সাম্প্রতিক সময়ে মিডিয়ার শক্তিমত্তা যে কী পরিমাণ ব্যাপক, তা একটু পর্যবেক্ষণেই দেখা যায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতে ঘুমানোর আগে পর্যন্ত একজন মানুষের দৈনন্দিন জীবনে তাকালে সমস্ত অধ্যায় জুড়ে মিডিয়ার প্রভাব স্পষ্ট হয়। দেখা যায়, বিছানা ছেড়ে বেড টি পানের সময় হকার দিনের সংবাদপত্র নিয়ে হাজির। অফিসে যাওয়ার জন্য পথে বেরুলে রাস্তার দু’পাশে সারি সারি বিলবোর্ড বা সাইনবোর্ড পণ্যের প্রলোভন নিয়ে চোখের সামনে স্বতস্ফূর্তভাবে বিরাজমান। অফিসে প্রবেশের পর দাপ্তরিক কাজে ইন্টারনেট ব্যবহার। সারাদিন কাজ করে যখন বাসায় ফিরে আসা হয়, তখন কান্তিকর জীবনের অবসাদ থেকে মুক্তি পেতে একটু লাবণ্য তো চাই। আর সেই লাবণ্যের সন্ধানে এবার টিভি’র সামনে বসে বিনোদনের সন্ধান করা। সংবাদপত্র, বিলবোর্ড বা সাইনবোর্ড, ইন্টারনেট এবং টিভি-এ প্রত্যেকটি বস্তুই মিডিয়ার অংশ। আর এ মিডিয়া জগত ক্রমশ আমাদের জীবনে প্রভাব বিস্তার করছে ব্যাপকভাবে। কখনো হয়তো সচেতনভাবে আবার কখনো অবচেতনরূপে
২৪ অক্টোবর ২০০৯, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সোয়াইন ফু সর্বত্র ছড়িয়ে যাওয়ার দরুণ সে দেশে ন্যাশনাল ইমারেজেন্সি ঘোষণা করে। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের ৫০টি রাজ্যের মধ্যে ৪৬ রাজ্যে এ রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। মৃতের সংখ্যা এক হাজার অতিক্রান্ত, তন্মধ্যে আবার ১ শ’ জন শিশু। ফলে পরিস্থিতি সত্যিকার অর্থেই ভয়াবহ। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অন্যান্য কারণে মৃতের হার কেমন? এ বিষয়টি একটু খতিয়ে দেখা যাক। এখানে, প্রতি বছর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে গড়ে ৬ লাখের উপর, ক্যান্সারে ৫ লাখ ৫৯ হাজার, ডায়াবেটিসে ৭২ হাজার, স্ট্রোকে ১ লাখ ৩৭ হাজার, সাধারণ ফু’তে ৫৬ হাজার। এছাড়া গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট, এইডস, আত্মহত্যা বা খুনের মাধ্যমেও মৃতের সংখ্যা নেহাত কম নয়। প্রশ্ন উঠছে, প্রায় এক বছরে মাত্র সহস্রাধিক লোক মারা যাওয়ার কারণে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ন্যাশনাল ইমারেজেন্সি জারির মাধ্যমে কার স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে? ইতিমধ্যে সনোফি অ্যাভেন্টিসসহ অন্যান্য বহুজাতিক কোম্পানির নিকট থেকে সরকার বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ভ্যাকসিন ক্রয় করেছে। সোয়াইন ফু ছড়িয়ে পড়ার প্রথম দিকে তা মোকাবেলা জন্য বাজেট ঘোষণা হয়েছিল ৪ শত কোটি ডলারের, বর্তমানে তা আরো বাড়ানো হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই ৫০ মিলিয়ন ডোজ সোয়াইন ফু ভ্যাকসিন এবং ডিসেম্বরের মধ্যে আরো ১৫০ মিলিয়ন ডোজের অর্ডার দেয়া হয়। সোয়াইন ফুতে নভেম্বরের প্রথম সপ্তা পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৪ লাখ ৪০ হাজার হলেও মৃতের সংখ্যা ৫ হাজার ৭০০ জন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮ সালে শুধুমাত্র হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ৭.২০ মিলিয়ন লোক, স্ট্রোক করে মারা যায় ৫.৭১ মিলিয়ন, শ্বাস কষ্টে ৪.১৮ মিলিয়ন, ডায়রিয়ায় ২.১৬ মিলিয়ন, যক্ষ্মায় ১.৪৬ মিলিয়ন, রোড অ্যাকসিডেন্টে ১.২৭ মিলিয়ন। ইতোমধ্যে কথিত এ রোগ নিয়ে বহুজাতিক কোম্পানি ব্যাপক মুনাফা আয় করে নিয়েছে। রোগের ভাইরাস যতটুকু প্রসারণ হয়েছে, তার থেকে অনেক বেশি মাত্রায় ছড়িয়েছে মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলো। ওষুধ কোম্পানির সাথে গাঁটছড়ার মাধ্যমে মিডিয়া কোম্পানিগুলো এ পরিস্থিতি তৈরি করে। বাংলাদেশেও প্রথম দিকে কথিত সোয়াইন ফু নিয়ে তথ্য মাধ্যম ব্যাপক শোরগোল তোলে, যদিও তাদের সে আয়োজন শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। পরে বাংলাদেশে যে চার জন সোয়াইন আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছিল, তাদের কেউ সুনির্দিষ্টভাবে সোয়াইন ফু’তে মারা যায়নি। বর্তমানে শুধু সোয়াইন ফু’র ক্ষেত্রে নয়, অন্যান্য বিষয়েও আলোচনা তৈরির মূল মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বহুজাতিক মিডিয়া প্রতিষ্ঠান। যে কারণে আজ থেকে প্রায় তিন দশক আগে মিডিয়া গবেষক বেন বাগডিকিয়ান বলেছিলেন, “জনগণ কতটা জানবে,কতটা শুনবে তা এক সময় ঠিক করে দিত রাজা ও পুরোহিতবৃন্দ, এখন নির্ধারণ করে গণ মাধ্যম. গণ মাধ্যম যা সম্প্রচার করে না জগতে তা সংঘটিত হয় না.গণ মাধ্যম এখন শুধু বাস্তবের প্রতিফলন নয়, বরং বাস্তবের উৎস। ৮০ এবং ৯০’র দশকেও অনেকের চিন্তা-সমালোচনা এবং পর্যালোচনায় বাগডিকিয়ানের এই ধারণার সমর্থন পাওয়া যায় এবং বাগডিকিয়ানের বক্তব্য নাকচ করে দেয়ার মত নয়।
সুতরাং, একটি জাতীর/রাষ্ট্রের জনগণ কি নিয়ে ভাববে, কি নিয়ে আলোচনা করবে, কি নিয়ে প্রতিবাদ করবে, কি প্রতিরোধ করবে তা গণমাধ্যম দ্বারা অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রিত হয়। অর্থাৎ গণমাধ্যমের কাজ হবে রাষ্ট্রের জনগণের চিন্তা, চেতনা, আচরন প্রভাবিত করা। এতে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে ঐ জাতিটির নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা জাতীয়তা বোধ, নৈতিকতা বোধ।এসব কিছু ধ্বংস করতে হলে আপনাকে ঐ জাতীটির #সংস্কৃতি, #ভাষা, #ইতিহাস এই তিনটি বিষয়ের স্বকীয়তা ধ্বংস করতে হবে। আশা স্বপ্ন এবং লোভ দেখিয়ে এই তিনটির ভীত নষ্ট করতে হবে। আপনার মতাদর্শের বা পছন্দনীয় সংস্কৃতি, ভাষা, চালচলন এর মধ্যে প্রবেশ করাতে হবে ধীরে ধীরে। কিভাবে তা করবেন তা পরের ধাপ গুলোতে আলোচনা করা হবে।
Step 02: To shape the sense of nationalism, dilute the culture and the language
আমাদের সংস্কৃতি কী রকম হবে, তা এখন নির্ধারণ করছে গণমাধ্যম। সমসাময়িককালে সাধারণ মানুষের বাচন ভঙ্গি, পোষাক, চিন্তার ধরন প্রত্যেকটি বিষয়ে গণমাধ্যমের আধিপত্য প্রশ্নাতীত। বহুজাতিকের মুনাফার প্রয়োজনে বিশ্বব্যাপী অভিন্ন সংস্কৃতি নির্মাণে গণমাধ্যমগুলো সক্রিয়।উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের প্রধান দুই মেট্রোপলিটন শহর ঢাকা এবং চট্টগামের বিষয়ে আলোকপাত করা যেতে পারে। এই শহরগুলোতে লাখ লাখ লোক বসবাস করছে। আকাশচুম্বি বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে। বাস, পথে-ঘাটে অজস্র লোকের বিচরণ, বহুতল কর্পোরেট অফিসে শত শত কর্মকর্তা-কর্মচারী। কিন্তু এই মানুষেরা পরষ্পর থেকে অসম্ভব বিচ্ছিন্ন। পারষ্পরিক সুখ, দুঃখের ভাবনা বিনিময় এদের মধ্যে হয় না বললেই চলে। হয়তো দেখা যায়, পাশের ফ্যাটের একজন সাত আট দিন যাবৎ মরে পড়ে আছে, কিন্তু এই খবর প্রতিবেশীর নিকট এসে পৌঁছায় না। যদি মৃতের শরীর থেকে দুগন্ধ বের না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত অন্যজন খোঁজও নিবে না আসল পরিস্থিতি কি। তাও বাসস্থানের পরিবেশ দূষিত করছে বলে সে এগিয়ে হবে। কেন এই পরিস্থিতি তৈরি হল, সভ্যতার উষালগ্নে যখন ফ্র্যান্সসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হচ্ছিল তখন তো এই অবস্থা ছিল না। মিডিয়া গবেষকরা বলছেন, এই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার জন্য বিদ্যমান অর্থনৈতিক সমাজ কাঠামো যেমন দায়ী, তেমনি তার সহায়ক উপরিকাঠামো হিসেবে গণমাধ্যম বড় ভূমিকা পালন করেছে। গণমাধ্যম বর্তমানে কর্পোরেট বাণিজ্যের মুনাফা রক্ষার্থে বিশেষ সংস্কৃতি নির্মাণে কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। আর এই সংস্কৃতির নাম হচ্ছে গণ সংস্কৃতি। বর্তমানে যা কর্পোরেট সংস্কৃতি হিসেবে চিহ্নিত।
বর্তমানে আমাদের দেশেসহ সারা বিশ্বব্যাপী এ সংস্কৃতির প্রসার দেখা যায়। এ সাংস্কৃতিক রূপটা কেমন? বিষয়টি নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক- আলোচনার স্যাম্পেল হিসেবে আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত যুব সমাজের দৈনন্দিন ভাবনা এবং আড্ডার জগতে প্রবেশ করা যাক। পোষাকে এবং চলনে এরা যথেষ্ট স্মার্ট। এরা সংবাদপত্র পড়ে, একাধিক চ্যানেলে টিভি অনুষ্ঠান দেখে, বিভিন্ন সাহিত্যিক যেমন হুমায়ুন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলনের উপন্যাস পড়ে, বন্য ফুয়াদ বা মিলার গান শুনে, পণ্যায়িত লোকজ পোট্রেট সম্বলিত টিশার্টের সর্বশেষ সংস্করণের বিষয়ে আড্ডা দেয়। মাঝে মধ্যে রাজনৈতিক সমস্যার বিষয়েও কথা বলে। আবার সবকিছু ছাপিয়ে যে বিষয়টি আলোচনার প্রধান বিবেচ্য হিসেবে স্থান পায় তা হচ্ছে প্রেম সম্পর্কিত আলোচনা। অর্থাৎ এই হচ্ছে তাদের সংস্কৃতির মূল কনটেন্ট। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই বৃত্তের বাইরে কেন তাদের আড্ডা যেতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎ, বিভূতিভূষণ, তারাশংকর, জ্যাক লন্ডন বা হাওয়ার্ড ফাস্ট কেন আড্ডার বিষয় বস্তু হতে পারে না? উত্তর-গণমাধ্যম। এই মাধ্যমই এখন সংগীতসহ অন্যান্য শিল্পের কাঠামো এবং জনপ্রিয়তা স্থির করে দিচ্ছে। সাহিত্য ও কবিতার বিষয় কি হবে তা নির্ধারণ করে দিচ্ছে।বিভূতিভূষণের আরণ্যক বা শরতের শ্রীকান্ত পড়তে যতটুকু পরিশ্রম করতে হয়, তার বিপরীতে হুমায়ুন আহমেদের মেঘ বলে যাবো যাবো উপন্যাস অনেক সহজে পড়া যায়। ক্যাসিক্যাল সঙ্গীত অনুধাবন করতে যে সাধনার প্রয়োজন হয়, অন্যদিকে মিলা বা বন্য ফুয়াদের গান শুনতে কোন পরিশ্রমই করতে হয় না।এসব সস্তা এবং সহজলভ্য সঙ্গীত বা উপন্যাসের কারণে মূল্যবান বিষয়গুলো মার খাওযা শুরু করল। মেলায় হুমায়ুন আহমেদের বইয়ের বিক্রি ব্যাপক, কিন্তু ক্যাসিক্যাল উপন্যাস খুবই নগণ্য। মানুষের সংস্কৃতি হয়ে গেল সস্তা। যে সব সংস্কৃতি অর্জন করতে পরিশ্রম করতে হয়, নন্দনতাত্ত্বিক এবং শৈল্পিক মূল্য রয়েছে, তা পর্যদুস্ত হওয়া শুরু করল, সুন্দরকে গ্রহণ করার মানসিকতা ধীরে ধীরে হয়ে গেল নষ্ট। সবচেয়ে বড় কথা আমরা সহজ জিনিসে অভ্যস্ত হতে শুরু করলাম। অলস হতে থাকলাম, মনস্তাত্ত্বিক অলসতা। মাথা খাটানো, গভীর ভাবে চিন্তা করার অভ্যাস, অনুধাবন করা ইত্যাদি মানসিক পরিশ্রমের প্রতি অনীহা বাড়তে থাকল। অন্যের চিন্তার উপর নির্ভরশীল হতে থাকলাম, হয়ে পড়লাম অন্যের হাতের পুতুলে।
সারা পৃথিবীর প্রিন্ট মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে এখন তিনটি প্রতিষ্ঠান, যথাক্রমে রয়টার্স (যুক্তরাজ্য), এপি-অ্যাসোসিয়েট প্রেস (যুক্তরাষ্ট্র) এবং এএফপি-এজেন্স ফ্রেঞ্চ প্রেস (ফ্রান্স)। এই মনোপলি সিস্টেম চলে আসছে অনেক বছর যাবৎ। ১৫০ বছর আগে ঔপনিবেশিক শোষণের স্বার্থে তথ্য ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে তিনটা সংবাদ সংস্থা চালু হয়েছিল। এরা ছিল যুক্তরাজ্যের রয়টাস, ফ্রান্সের হাভাস এবং জার্মানীর উলফ। উলফ এবং হাভাসের কর্তৃত্ব হ্রাস পেলেও রয়টার্সের অব্যাহত কর্তৃত্ব এখনো রয়ে গেছে। বর্তমানে বিভিন্ন দেশের জাতীয় সংবাদ সংস্থা এবং সংবাদপত্রগুলো এদের উপর নির্ভরশীল। জাতীয় সংবাদপত্রগুলো আন্তর্জাতিক সংবাদ প্রচারের অধিকার পেলেও নিজেদের সংবাদ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রচারের অধিকার পায় না। এই ব্যবস্থার খুব একটা বিরুদ্ধাচারণ জাতীয় সংবাদপত্রগুলো করেনি। কারণ, এদের মাধ্যমেই জাতীয় সংবাপত্র স্বদেশী মোড়লিপনার অধিকার পায়। অর্থাৎ নিজের দেশে তারা হয়ে উঠতে পারে বিশ্ব সংবাদের একমাত্র পরিবেশক। যদি কোন কারণে দেশীয় সংবাদ প্রতিষ্ঠানের সাথে স্বার্থের সংঘাত হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক সংবাদের স্বদেশী মোড়লিপনা এরা হারিয়ে ফেলে। প্রধান তিন সংবাদ সংস্থার পুঁজিও বিশাল। উপনিবেশিক সময়কাল থেকেই তথ্য সাম্রাজ্যের সিংহ ভাগের মালিক রয়টার্স ইউরোপের ১০০ টি শীর্ষ কোম্পানির মধ্যে মধ্যে এর অবস্থান বিদ্যমান।
এই শতকের প্রথমেই সংঘটিত হয়ে গেল দুটি দেশ দখলের ঘটনা। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পরপর জায়নবাদী ইহুদীরা প্যালেস্টাইন দখলের পর থেকে অসংখ্য আঞ্চলিক যুদ্ধের ঘটনা ঘটলেও দেশ দখলের মত ঘটনা সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু বাজার সংকট এবং খনিজ সম্পদের উপর একচেঠিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য ইরাক ও আফগানিস্তান যুক্তরাষ্ট্র এবং তার দোসররা দখল করে নেয়। আফগানিস্তানে হামলার ক্ষেত্রে অজুহাত ছিল, আল কায়েদা ওযার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলা এবং নিরপরাধ ৫ হাজার মার্কিনিকে হত্যা করেছে। ইরাকের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, তারা মারাত্মক রাসায়নিক অস্ত্রের নির্মাতা, যা মানব সভ্যতার জন্য ক্ষতিকর। যুক্তরাষ্ট্র প্রেরিত এসব তথ্যের সত্যতা প্রমাণের দায়িত্ব কাঁধে নেয় মিডিয়া। আফগানিস্তানে হামলার সময় ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ধ্বংসস্তুপের ইমেজ বারবার মার্কিন নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া প্রতিষ্ঠানে প্রচারিত হচ্ছিল। স্বজন হারানো আমেরিকানদের কান্নার বিপরীতে সাধারণ আফগানদের দেখানো হচ্ছিল বর্বর, দস্যু হিসেবে। বলা হচ্ছিল- এরা সন্ত্রাসী, জঙ্গীবাদের মূল হোতা। হাজার হাজার আফগানকে হত্যার পাশাপাশি পঙ্গুত্ব বরণ করতে বাধ্য করে আমেরিকান সৈন্যরা। ইরানী চলচ্চিত্রকার মোহসেন মাখমলবাফের কান্দাহার সিনেমাটি দেখলে আমেরিকানদের বর্বরতা ভয়ঙ্করভাবে স্পষ্ট হয়। সে সময় সিএনএন প্রধান ওয়াল্টার আইজ্যাকশন স্পষ্ট নির্দেশ দেন, বিধ্বস্থ আফগানিস্তানকে দেখানো সময় যেন বারবার মনে করিয়ে দেয়া হয়, এই দেশে এমন সন্ত্রাসীদের পালন করা হচ্ছে যারা ৫ হাজার নির্দোষ আমেরিকানকে হত্যা করেছে। একই সময় ১০ নং ডাউনিং স্ট্রীটে ডেকে নিয়ে আসা হয় সংবাদ মাধ্যমের পরিচালকদের। বলে দেয়া হয়, কোনভাবেই ওসামা বিন লাদেনের বক্তব্য প্রচার করা যাবে না। সম্প্রচার করা যাবে না আহত এবং নিহত আফগানদের ছবি। ১৯৮৫ সালে উইলিয়াম সি. অ্যাডাসের সম্পাদিত গবেষণায় দেখা গেছে, অন্যান্য দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগে মার্কিন টিভি সংবাদ নেটওয়ার্কের প্রচারের অনুপাত হচ্ছে : একজন পশ্চিম ইউরোপীয় মানুষের মৃত্যু, তিন জন পূর্ব ইউরোপীয়, নয়জন ল্যাটিন আমেরিকান, এগার জন মধ্য প্রাচ্যের এবং ১২ জন এশীয় মানুষের মৃত্যুর সমান। গণমাধ্যমের বহুজাতিক কোম্পানির প্রতি আনুগত্যের ধরন যে কি পরিমাণ তা এ ঘটনাটি দ্বারা স্পষ্ট হয়, নিউজ কর্পোরেশন মালিকানাধীন ফক্স টেলিভিশনের ফোরিডায় কর্মরত দু’জন সাংবাদিক জেইন আর্ক এবং স্টিভ উইলসন ‘মনসান্তো’র (জিএম বীজ, বিষ্পোরক এবং কীটনাশক উৎপাদিত বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান) বিষয়ে একটি অনুসন্ধানি প্রতিবেদনের জন্য চাকরিচ্যুত হন। সে সময় ফক্স টেলিভিশনের জেনারেল ম্যানেজার তাদের বলেন, “এই টেলিভিশন স্টেশনের জন্য তিন বিলিয়ন ডলার খরচ করেছি, আমরা সিদ্ধান্ত নেব কোনটা খবর। খবর সেটাই যেটা আমরা তোমাদের বলবো।”
উপরোক্ত উদাহরণে স্পষ্ট হয়, বহুজাতিক পুঁজির অবাধ বাজার রক্ষাই হচ্ছে এসব মিডিয়া হাউসের মূল লক্ষ। ইতোপূর্বে ইরাক কিম্বা আফগান আগ্রাসনে তা আরো স্পষ্ট হয়েছে। ইরাকের বহুল কথিত মারাত্মক মারণাস্ত্রের হদিস তারা এখনো পায়নি। তালেবান অজুহাতের বিষয়টি বিশ্ব বিবেকের নিকটও ইতোমধ্যে পরিষ্কার হয়ে গেছে। তা হচ্ছে, কাস্পিয়ান বেসিনে অবস্থিত ১.২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম তেলের রিজার্ভ সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা। ইতহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, তালেবান সৃষ্টির নেপথ্যে প্রধান ভূমিকা ছিল আমেরিকানদের।
Hegemony হলো সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য বিস্তারের একটা ইন্ডাইরেক্ট ফর্ম যেখানে ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা রাষ্ট্রকতৃক তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোতে সরাসরী সামরিক শক্তি প্রয়েগ না করেও কিছু কৌশল অবলম্বন করে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। হাজার বছর পূর্বের সেই প্রিমেটিভ সোসাইটি থেকে শুরু করে বর্তমান পোষ্ট মডার্ন যুগের মধ্যবর্তী দাস প্রথা, রাজাবাদশা প্রথা, জমিদারী প্রথা ইত্যাদি যা বিভিন্ন জনগোষ্ঠিকে নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রচলিত ছিলো এর চাইতে সহস্রগুণ শক্তিশালী হলো বর্তমান Hegemony প্রথা। কারণ এখানে বোঝার উপাই নেই যে মানুষ নির্যাতিত হচ্ছে বা একশ্রেণী তাদের শোষণ করছে।
দাস প্রথা, রাজাবাদশা - জমীদারী শাষণ টিকে থাকতে পারেনি কারণ মানুষ একসময় বুঝতে শিখেছিলো যে এই পদ্ধতি সঠিক নয় এবং এই ব্যবস্থাগুলো শুধুমাত্র গুটিকয়েক ধনিক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষায় অনন্তকাল কাজ করে যাবে। মানুষ সংগঠিত হয়ে বিদ্রোহ করে এই সব প্রথার বিলুপ্তি ঘটিয়েছে। কিন্তু বর্তমান Hegemony প্রথায় এটা বোঝার উপয়ও নেই যে মানুষ একটি ধনীক শ্রেণী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বা নির্যাতিত হচ্ছে। কিছু কৌশল অবলম্বন করে গোটা বিশ্বে এমন একটা পরিস্থিতি তৌরী করে রাখা হয়েছে যে মানুষ বুঝতেও পারবে না যে তারা বিশেষ শ্রেণী দ্বারা নিয়ন্ত্রীত।
আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের শতকরা ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ সময় ব্যায় করি বিভিন্ন তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে। হোক সেটা ব্যক্তিগত আর অ-ব্যক্তিগত। এই যে এই লিখাটা পড়ছেন এটাও একধরনের তথ্য আদান প্রদান। এখন ৭০ ভাগ সময়টাই যদি আমাদের পূর্বনির্ধারীত ভুল জানানো হয় বা ভুল বোঝানো হয় এবং ভুল সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করা হয়, তখন আমাদের বোঝারও উপায় নেই যে আমরা ভুল জানছি।রাজাবাদশাদের সময় রাজ্যগুলো নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন ছিলো। তাদের নিয়ন্ত্রীত প্রতিটা অঞ্চলেই দলপতি সহ সৈন্য পাঠাতে হতো যেন কেউ রাজাদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে না পারে। কিন্তু এখন সৈন্য পাঠাতে হয়না। দেশে দেশে বিবিসি সিএনএন পাঠালেই চলে. ওয়াল্ড ব্যাংক আমাদের দেশে চালের দাম নির্ধারণ করে দেয়। বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বগুলো কতটা নগ্নভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় সেটা আর নাই বলি।
আমরা ভালো আছি। এই "আমরা" বলতে আপনারা কি বোঝেন? আপনি, আপনার মা-বাবা-ভাই-বোন- আত্নীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধব ইত্যাদি। খুজেঁ দেখবেন এদের মধ্যে কেউ রিকশাওয়ালা, কোন দিনমজুর, রাখাল, গার্মেন্ট ওয়ার্কার, পরিচ্ছন্নকর্মী কিংবা ভিক্ষুক নেই। বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকরীর সংখ্যা .৯৯%। আপনি আমি এদেশের জনগনের শতকরা ১% এর মধ্যেও পড়িনা। আর "আমরা" পড়ি বিশ্বের সেই ২০% এলিট শ্রেণীর মধ্যে যারা তিন বেলা বেটপুরে খেতে পারি। আর বাকি ৮০% মানুষের সাথে আমাদের নেই কোন যোগাযোগ নেই কোন খোজখবর। শুধু সিজনে সিজনে তাদের প্রতি আমাদের ভালোবাসা উথলে পড়ে। যেমন আমরা মাঝে মাঝে তাদের শীতবস্র বিতরণ করি, খাবার দেই, কোরবানির সময় দুই টুকরা গরুর মাংশ দেই। এইটুকুই। এটাই আমার সোনার বাংলা। ইন্ডিয়াতে ও একই অবস্থা। মোম্বাই, দিল্লি, কলকাতা এই শরহগুলাই কিন্তু প্রকৃত ইন্ডিয়া না। এক গবেষনায় দেখা গেছে ইন্ডিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো (শতকরা ৮৫ ভাগেরও বেশি) শুধুমাত্র শ্রেণী এবং ধর্মীয় বৈষম্যের কারণে (ব্রাম্মন, খত্রিয়, শুদ্র ইত্যাদি) বিশ্ব থেকে কয়েশ যুগ পিছিয়ে আছে। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ কন্টিনেন্টাল প্রায় সব দেশেরই একই অবস্থা।
Step03 : To shape future generations, control the schools:
আপনার আল্টিমেট লক্ষ্য হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দুর্বল করে ফেলা, শরীর মন এবং আত্মিক দিক থেকে দুর্বল এবং পরনির্ভরশীল করে ফেলা। কোন ভাবেই তাদের পাঠ্যপুস্তকে কোন ভাবেই সেই জাতীর প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরা যাবে না। তুলে ধরতে হবে ততটুকুই যতটুকু না জানালেই নয় এবং অবশ্যই মডিফাইড ইতিহাস যাতে আপনার ধ্যান ধারণা প্রচারে সুবিধে হয় এবং আপনার প্রতিপক্ষকে তাদের সামনে খারাপ ভাবে উপস্থাপন করতে সহায়ক হয়। কারন যদি একদমই না জানান তাহলে সেই বিষয়ে কিউরেসিটি থেকে যাবে যার ফলে পরবর্তীতে তারা কিউরিসিটি র প্রভাবে আসল ইতিহাস জেনে যেতে পারে। তাই জানাবেন আপনার মন মত ইতিহাস, পুরোপুরি সত্য নয়, মিথ্যে মিশিয়ে দিন, Create Delusion. যাতে তারা সবসময় কনফিউজড থাকে তাদের প্রকৃত ইতিহাস নিয়ে। এর ফলে পরবর্তীতে আপনি মিথ্যেটাই ইতিহাস হিসিবে তাদের কাছে দার করাতে পারবেন এবং তারা সানন্দে এটা গ্রহণ করবে কনফিউসান এড়ানোর জন্য। আপনার প্রতিপক্ষের ব্যাপারে তাদের মনে ঘৃণা তৈরি করতে হবে, বোঝাতে হবে যে তারা দেশ এবং জাতীর জন্য ক্ষতিকর, তাদের মনে ভয়ের সৃষ্টি করতে হবে প্রতিপক্ষের ব্যাপারে। ফলে পরবর্তীতে আপনি প্রতিপক্ষকে দমন করতে যত নিষ্ঠুর , অমানবিক, নৃশংস পন্থাই নেন না কেন তারা তা সমর্থন দিয়ে যাবে আকুন্ঠচিত্তে। Make them haters to your enemies. এক্ষেত্রে মিডিয়া হবে আপনার অব্যর্থ অস্ত্র ।
এবার আসি তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে। প্রত্যেক শিশুর প্রথম বিদ্যালয় হচ্ছে তার পরিবার বা ফ্যামলি। পরিবার থেকেই সে প্রথমে কথা বলা আচার আচরন ইত্যাদি শিখে, তার মস্তিস্ক চিন্তা চেতনা বিস্তৃত হতে থাকে পরিবারের মধ্যে থেকেই। তাই পারিবারিক বন্ধন যত গাড় হবে একজন শিশুর মানসিক বিকাশ তত ভালভাবে এবং দ্রুতগতিতে হবে আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে মা। তাই নেপলিয়ন বলেছিলেন “আমাকে শিক্ষিত মা দাও আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতী দেব” । তাই আপনাকে প্রথম আঘাত হানতে হবে পরিবার ব্যবস্থায়। নারী পুরুষ সমান অধিকার, সেলফডিপেন্ডেন্ট, নারীর সমধিকার , নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদির মোহে মোহাবিষ্ট করে মা কে নিয়ে আসতে হবে পরিবারের বাহিরে, বন্ধন করে দিতে হবে আলগা। বাবা মা দুজনেই ব্যাস্ত , সন্তান আছে অন্য কারো তত্ত্বাবধানে, এমন অবস্থায় শিশুর মানসিক বিকাশ যথাযথ হবে না। ছোট বেলাতেই তার মনে পারিবারিক বন্ধনের প্রভাব হালকা হতে থাকবে যাবে, সে নিজের মা এর কাছ থেকে যতটা আগ্রহ এবং ভালোবাসা নিয়ে শিখতো তা সে কখনোই অন্য আরেকজনের কাছ থেকে শিখবে না , বা অন্য কেউ ও এত যন্ত এবং নির্ভুল করে শিখাবে না। তাই এই ব্যস্ত সময়টাই শিশুর মনে প্রভাব ফেলবে, পরিবারের প্রতি আকর্ষণ ভালোবাসা ভালো করে গড়ে উঠবে না। শিশু হয়ে পরবে বহির্মুখী , অসহায়, ভিত। যাকে ভেঙ্গে ফেলা খুব সহজ। আবার নিজের চাহিদা মত তার মোড়ালিটি গড়ে দেয়া খুব সহজ। তাকে যা দেবেন তাই সে তখন গ্রহণ করবে কারন তার মোড়াল বেইস এত শক্তিশালী না। সে সহজেই হয়ে পড়বে নেশাসক্ত এবং মোহাবিষ্ট।
স্কুলের পাঠ চক্রে এবং পাঠ্যপুস্তকে কিছু বিষয় বেশী হাইলাইট করতে হবে যাতে শিশু অবচেতন মনেই তা গ্রহণ করে। তাকে নিজের বিবেকবোধ ব্যবহারে বাঁধা দিতে হবে, বোঝাতে হবে “natural aggression is wrong and docile submission is right”। এই বিষয়টা তার মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দিতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে যে কোন নৈতিকতার ভিত্তি যেমন ধর্ম, ধর্মগ্রন্থ , ধর্মীয় নিয়ম নীতি ইত্যাদি এসব প্রাচীন, অন্ধ মূর্খদের বিষয়। তাকে বোঝাতে হবে ধর্মীয় রীতিনীতি উন্নতির জন্য বাঁধা স্বরূপ। ধর্ম এবং ধর্মীয় রীতিনীতি সম্পর্কে তার মধ্যে অনীহা, বিতৃষ্ণা সৃষ্টি করতে হবে। তাকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে সে আপনার ধ্যান ধারণা কে বেশী মূল্যবান মনে করে। তাকে দেখাতে হবে উচ্ছল উদ্যাম , বাধাহীন, নিয়ম নীতি হীন , যা ইচ্ছে তা করার মত কপট স্বপ্ন , তাকে করতে হবে মোহাবিষ্ট । তাদের “দেশপ্রেম মানেই ভাল খারাপ বিবেচনা না করে আপনার কাজকে সমর্থন করা” এই মোহে মোহাবিষ্ট করে রাখতে হবে। সহনশীলতার দোহাই দিয়ে তাদের মধ্যে ধর্মীয় রীতিনীতি, সামাজিক নিয়ম নীতি ইত্যাদি অগ্রাহ্য করার শিক্ষা দিতে হবে। তাদের কে এত কিছু যখন দেবেন তখন খেয়াল রাখতে হবে তারা যাতে এসব বিষয় নিয়ে গভিরভাবে চিন্তার সময় সুযোগ না পায়।সময় সুযোগের অভাবে তারা এসব অন্ধের মত গ্রহণ করবে। তাদের দৈনন্দিন জীবন যাপন হতে হবে নিয়ন্ত্রিত। যখন শিশু ভাবতে শিখবে তখন তাকে পড়ালেখার অত্যাধিক চাপের মধ্যে রাখতে হবে যাতে সে ভাবার সময় না পায়। তার পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশে ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য তাকে করে ফেলতে হবে গৃহবন্ধী, যাতে সে অন্যদের সাথে মেশার খুব সুযোগ না পায়, পড়ালেখার বাহিরে তার ধ্যান ধারণা চিন্তা চেতনা করতে হবে একমুখী এবং নিয়ন্ত্রিত। কার্টুন, গেমস ইত্যাদি দিয়ে তার ভাবনার সময়টাকে যথাসম্ভব সঙ্কুচিত করতে হবে। গেমসের মাধ্যমে তাকে ভায়লেন্স সিনে ইউজ টু করতে হবে, কারন এদের মধ্যে অনেকে আপনার প্রতিপক্ষ ঘায়েল করার অস্ত্র হিসেবে কাজ করবে। কার্টুনের মাধ্যমে শিখাতে হবে কিভাবে সামাজিক ধর্মীয় রীতিনীতির বিরুদ্ধে যাওয়া যায়। প্রচলিত সব কিছুর বিপক্ষে যাওয়া মানেই ফ্রিডম, ফ্রি থিংকিং, এই ধারণা তাদের মাথায় গেঁড়ে দিতে হবে।
তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে যথাসম্ভব দূরে রাখার চেষ্টা করতে হবে, আপনার তৈরি সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট করতে হবে মিডিয়া ব্যবহার করে। যাতে সে আস্তে আস্তে আপনার তৈরি সংস্কৃতি কেই সেরা মনে করে এবং আনন্দের সাথে গ্রহণ করে। যখন তার মানসিক বিকাশের সময় তখন প্রচন্ড চাপে রাখতে হবে এবং যখন সে আস্তে আস্তে বড় হবে এবং চাপ নেয়ার ক্ষমতা অর্জন করতে থাকবে তখন পড়ালেখাটাকে করে দিতে একদম সহজ, যাতে সহজেই সে পরীক্ষায় সর্বোচ্চ স্থান লাভ করতে পারে। এর ফলে তার মধ্যে গড়ে উঠবে ফেইক কনফিডেন্স যা সামান্য ঝরেই ভেঙ্গে পড়বে। আর সর্বোচ্চ স্থান শুধু এক দুজন নয় অনেক জন কে দিতে হবে যাতে মেধার যাচাই সঠিক ভাবে না হয়। আর প্রশ্ন ফাঁস নকল ইত্যাদি দিয়ে কত সহজে অল্প পরিশ্রমে ডিগ্রি অর্জন করা যায় তা শেখাতে হবে। এখানেই হবে দুর্নীতির হাতে খড়ি। এই শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে তৈরি হবে এমন যুব সমাজ যারা গভীর চিন্তায় অক্ষম,নিজের উপর আস্থাহীন, পরনির্ভরশীল, ভিত, ভঙ্গুর এবং নিয়ন্ত্রিত।
Step04: To shape the political philosophy, infiltrate the government।
সরকারের প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে আপনার মতাদর্শের লোকজনের আধিক্য থাকতে হবে। যত প্রশাসনের যত উঁচু পর্যায়ে আপনার আদর্শের লোক থাকবে তত আপনার কাজ সহজ হতে থাকবে। যদি আপনার মতাদর্শের লোকের স্বল্পতা থাকে তবে প্রশাসনের বাকি পদ গুলোতে দুর্নীতিপরায়ন, অসৎ লোক যারা কিছু পাওয়ার বিনিময়ে যে কোন কিছু করতে প্রস্তুত এমন লোকদের রাখতে হবে। তারা দুর্নীতি করবে , অপরাধ করবে এবং তার সাক্ষ্য বা প্রমাণাদি থাকবে আপনার বা আপনার মতাদর্শের লোকদের হাতে, যাতে জরুরী সময়ে আপনার প্ল্যান অনুযায়ী তারা কাজ করতে বাধ্য হয়। এক্ষেত্রে আরেকটি কঠিন কাজ আপনাকে সম্পন্ন করত হবে। বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণ। বিচার বিভাগের প্রথম সারির পদগুলোতে অবশ্যই আপনার মতাদর্শের এবং নিয়ন্ত্রণাধীন লোক থাকতে হবে। তাহলে আইন এবং বিচার বিভাগ দুটোই আপনার কথায় চলবে।
প্রশাসনের কাঠামোতে আপনার মতাদর্শের এবং নিয়ন্ত্রিত লোক থাকলে তাদের মাধ্যমে আপনি সহজেই সামরিক কাঠামো কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করে। যেমন ঃ সামরিক বাজেট নিয়ন্ত্রণ , বিভিন্ন বাধ্য বাধকতা বা আইন জারী, অতিরিক্ত প্রতিশ্রুতি , নিজের মতাদর্শের সামরিক বাহিনী প্রধান নিয়োগ এবং অব্যর্থ অস্ত্র “দুর্নীতি” । সামরিক বাহিনীর নৈতিক ভিত্তি ক্রমান্বয়ে দুর্বল এবং ধ্বংস করে সামরিক বাহিনী কে অকার্যকর করে ফেলতে হবে। কারন একটি দুর্বল সামরিক কাঠামো সমৃদ্ধ দেশ একটি শিং বিহীন ষাঁড়ের সমতুল্য, নখদন্তহীন বাঘের সমতুল্য – অসহায় , প্রতিরক্ষা হীন।
Step 05 : To shape the economy, spend, spend, spend and tax, tax, tax:
প্রথমেই সকল নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদা সমূহের জন্য জনগণকে সরকারের উপর নির্ভরশীল করে ফেলতে হবে। হোক তা সরকারী বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কিন্তু নিয়ত্রন থাকতে হবে আপনার হাতে বা যে কোন সময় যে কোন ক্ষেত্রে আপনার হস্তক্ষেপের সুযোগ থাকতে হবে। মুদাস্ফিতি বাড়াতে হবে, দ্রব্যমুল্য হতে হবে সব সময় উর্ধগতির।নিরলস ভাবে জনগনের প্রয়োজনীয় প্রতিটি খাতে ট্যাক্স বা ভ্যাট প্রয়োগ করতে হবে। জনগণের গড় আয় থেকে ব্যায় যাতে সবসময় বেশী থাকে এমন ব্যবস্থা করতে হবে। ক্রয়ক্ষমতা বাড়ার সাথে সাথে দ্রব্যমূল্যের দামও বাড়াতে হবে। অর্থাৎ সোজা কথায় জনগণের পকেট কেটে তাকে ঋণগ্রস্থ করে রাখতে হবে। এই ঋণের কারনেই তার চিন্তা ভাবনা চলাফেরা কার্যকালাপ নিয়ন্ত্রণ করতে সফল হবেন আপনি। কারন কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে আপনার হাতে, রশি আপনার হাতে। এসব কিছুর সফল প্রয়োগ করেই আপনি পাবেন আপনার নিয়ন্ত্রণাধীন একটি পুতুল জাতী। যেমনি নাচাবেন তেমনি নাচবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:৫২