কিভাবে একটি জাতীকে পরাজিত করে , নিজের পদানত এবং দাস হিসেবে ব্যবহার করা যায়। অনেকে যুদ্ধের কথা বলবে। কিন্তু তাতে অনেক ঝামেলা, অনেক রক্তক্ষয়। তারচেয়ে ধিরে ধিরে কিছু পদক্ষেপ নিয়ে তা বাস্তবায়ন করলেই পুরো জাতীকে ধ্বংস করে তাদের নিজের পদানত করা যায়। আসুন পদ্ধতি গুলো নিয়ে আলোচনা করি।
প্রথমত, আপনার দরকার হবে অব্যর্থ দুটি অস্ত্র। মিডিয়া এবং একদল ওয়েল এডুকেটেড লোকজন যাদের এককথায় নাম দেয়া যায় “সুশীল সমাজ”। এইসব লোক বিভিন্ন জন বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ হবে, আর্ট, সাহিত্য, গান, কবিতা থেকে শুরু করে ব্যবসা, প্রকৌশল, অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞ হতে হবে, উচ্চ শিক্ষা অর্জিত হতে হবে। আপনার মিডিয়া ক্রামাগত এদের কথা, মতামত, জীবনধারা ফোকাস করতে থাকবে। কোন ঘটনা ঘটলেই তাদের বক্তব্য তুলে ধরবে বারবার , প্রতিবার, শতবার, যাতে সাধারন জনগণ তাদের জাতীর বিবেক, আশা ভরসার স্থল, নব জাগরণের অগ্রপথিক ভাবতে শুরু করে। অবশ্যই এসব লোকদের ভাল অভিনেতা হতে হবে। কারন প্রয়োজন অনুযায়ী এদের অভিনয়, মিথ্যা, ভন্ডামি দ্বারা আপনার প্রযোজিত নাটক মঞ্চস্ত করতে হবে। আর এক্ষেত্রে মিডিয়া পালন করবে প্রধান ভূমিকা। যে কোন ঘটনাকে আপনার সুবিধা অনুযায়ী দর্শকদের(জনগনের) সামনে উপস্থাপন করবে মিডিয়াই। সত্যকে গোপন করে, মিথ্যাকে ক্রমাগত সত্য বলে প্রচার করে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য প্রধান হাতিয়ার এই মিডিয়া। আপনার ধ্যান ধারণা, মতবাদ ক্রমাগত আস্তে আস্তে করে বিভিন্ন নাটক, ফিল্ম ইত্যাদি দ্বারা মানুষের মনে ঢুকিয়ে তা গ্রহণযোগ্য করার হাতিয়ার হচ্ছে এই মিডিয়া। আস্তে আস্তে তারা সেটা গ্রহন করতে থাকবে, আর একসময় এর উপরই নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। তবে এক্ষেত্রে আপনার প্রধান বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে জাতিটির নিজস্ব সংস্কৃতি, জাতীয়তা বোধ, তাদের যুবসমাজের চিন্তা ধারা, ধ্যান ধারণা। এসব কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন তা নিয়ে পরবর্তীতে আলোচনা করব। তবে এসব ক্ষেত্রেও মিডিয়া আপনাকে দারুণ সাহায্য করবে। তাই আপনার প্রথম অস্ত্র হবে মিডিয়া এবং সুশীল সমাজ।
প্রথমেই আসি মিডিয়ার ব্যাপারে। বর্তমান এই তথ্য বিষ্ফোরণের যুগে গণমাধ্যমের সহজ ও ব্যাপক বিস্তার এবং প্রযুুক্তিগত উন্নতির ফলে গণমাধ্যম আজ আমাদের কাছে অনেক বেশি স্বাভাবিক একাটি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আজ এমন একটি অবস্থানে আমরা আছি যেখানে গণমাধ্যম থাকা না থাকার প্রশ্নটি অচল। বাস্তব সত্য এই যে, গণমাধ্যম ছাড়া আমাদের জীবন অসম্ভব অর্থাৎ বলা চলে এটি আমাদের জীবনকে অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করছে।
গণমাধ্যম যেমন নিয়ন্ত্রণ করছে গণমানুষের জীবন যাপন তেমনি গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করে এর মালিক। বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর জন্য এই কথাটি আরো বেশি প্রযোজ্য। এমনকি সরকারি টেলিভিশন তো বটেই বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোও আজ নিয়ন্ত্রিত হয় মালিকের অদৃশ্য হাতের ছোঁয়ায়। এসব জায়গায় এমন কোন সংবাদ বা অনুষ্ঠান প্রচার করা হয় না যা তার মালিকের বিপক্ষে যায়। এমনকি সাংবাদিকদেরও কাজ করতে হয় মালিকের চোখের ইশারায় যা রুদ্ধ করে দেয় সাংবাদিকদের স্বাধীনতার পথ অন্যকথায় তা হরণ করে গণমানুষের তথ্য অধিকার।
মিডিয়া বর্তমানে হয়ে দাঁড়িয়েছে এক কার্যকর অস্ত্র, সেই সুবাদেই এখন “মিডিয়া সন্ত্রাস” শব্দটা সবার পরিচিত। রাত কে দিন করতে, মিথ্যাকে সত্য করতে, অত্যাচারী মহামানব বানাতে, অত্যাচারিতকে অপরাধী হিসেবে তুলে ধরতে, অন্যায় কে জাস্টিফাই করতে এক অব্যর্থ কার্যকর অস্ত্র এই মিডিয়া। বর্তমান বিশ্বে মিডিয়ার এই সন্ত্রাস , এই হিপক্রেসি, এই অন্যায় আক্রমণ বেশী প্রয়োগ হয় ইসলামের বিরুদ্ধে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে সুইজারল্যান্ডের বাজিল নগরীতে অস্ট্রেলিয়ার দুর্ধর্ষ ইহুদী সাংবাদিক ড. থিওডর হার্জেলের নেতৃত্বে বিশ্ব ইহুদী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে তারা গোটা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করার সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র ও সুপরিকল্পিত নীলনকশা প্রণয়ন করে। তারা সকলে একমত হয় যে, বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করতে হ’লে প্রথমত দুনিয়ার সকল স্বর্ণভান্ডার আয়ত্ত করতে হবে এবং সূদী অর্থ ব্যবস্থার জাল বিস্তার করে পৃথিবীর সকল পুঁজি তাদের হস্তগত করতে হবে। এরপর তারা স্থির সিদ্ধান্ত নেয় যে, আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যম যেন তাদের একচ্ছত্র আধিপত্যে চলে আসে এবং মিডিয়ার সাহায্যে দুনিয়াবাসীর মগজধোলাই প্রক্রিয়া শুরু করে তারা তাদের কাংখিত লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পারে। সংবাদমাধ্যম তথা সকল প্রচার মাধ্যমের অসাধারণ গুরুত্ব, প্রভাব ও ভূমিকার কথা উল্লেখ করে ড. থিওডর বলে, ‘আমরা ইহুদীরা পুরো বিশ্বকে শোষণের পূর্বশর্ত হিসাবে পৃথিবীর সকল পুঁজি হস্তগত করাকে প্রধান কর্তব্য বলে মনে করি। তবে প্রচার মিডিয়া আমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে দ্বিতীয় প্রধান ভূমিকা পালন করবে। আমাদের শত্রুদের পক্ষ হতে এমন কোন শক্তিশালী সংবাদ প্রচার হতে দেব না, যার মাধ্যমে তাদের মতামত জনগণের কাছে পৌঁছতে পারে।’
ছোট একটা উদাহরণ দেই “নিউইয়র্কে কোনো কারনে এক লোকের হাতে একটা কুকুর মারা যায় । পশ্চিমা মিডিয়ায় নিউজ আসলো , আত্নরক্ষার সময় দুর্ভার্গক্রমে এক আমেরিকানের হাতে একটা কুকুর নিহত । পরে জানা গেল লোকটা আমেরিকান না । নিউজটা ইডিট করে দেয়া হল , এক বিদেশীর হাতে এক কুকুর খুন ! তারও পরে জানা গেল , লোকটা মুসলমান । এবার নিউজটা পুরোপুরি চেইঞ্জ হয়ে আসল এভাবে , এবার মুসলমান জঙ্গীদের হামলা থেকে রক্ষা পেলনা অবলা প্রানী কুকুরও !!” This is called media manipulation.
সাম্প্রতিক সময়ে মিডিয়ার শক্তিমত্তা যে কী পরিমাণ ব্যাপক, তা একটু পর্যবেক্ষণেই দেখা যায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতে ঘুমানোর আগে পর্যন্ত একজন মানুষের দৈনন্দিন জীবনে তাকালে সমস্ত অধ্যায় জুড়ে মিডিয়ার প্রভাব স্পষ্ট হয়। দেখা যায়, বিছানা ছেড়ে বেড টি পানের সময় হকার দিনের সংবাদপত্র নিয়ে হাজির। অফিসে যাওয়ার জন্য পথে বেরুলে রাস্তার দু’পাশে সারি সারি বিলবোর্ড বা সাইনবোর্ড পণ্যের প্রলোভন নিয়ে চোখের সামনে স্বতস্ফূর্তভাবে বিরাজমান। অফিসে প্রবেশের পর দাপ্তরিক কাজে ইন্টারনেট ব্যবহার। সারাদিন কাজ করে যখন বাসায় ফিরে আসা হয়, তখন কান্তিকর জীবনের অবসাদ থেকে মুক্তি পেতে একটু লাবণ্য তো চাই। আর সেই লাবণ্যের সন্ধানে এবার টিভি’র সামনে বসে বিনোদনের সন্ধান করা। সংবাদপত্র, বিলবোর্ড বা সাইনবোর্ড, ইন্টারনেট এবং টিভি-এ প্রত্যেকটি বস্তুই মিডিয়ার অংশ। আর এ মিডিয়া জগত ক্রমশ আমাদের জীবনে প্রভাব বিস্তার করছে ব্যাপকভাবে। কখনো হয়তো সচেতনভাবে আবার কখনো অবচেতনরূপে
২৪ অক্টোবর ২০০৯, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সোয়াইন ফু সর্বত্র ছড়িয়ে যাওয়ার দরুণ সে দেশে ন্যাশনাল ইমারেজেন্সি ঘোষণা করে। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের ৫০টি রাজ্যের মধ্যে ৪৬ রাজ্যে এ রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। মৃতের সংখ্যা এক হাজার অতিক্রান্ত, তন্মধ্যে আবার ১ শ’ জন শিশু। ফলে পরিস্থিতি সত্যিকার অর্থেই ভয়াবহ। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অন্যান্য কারণে মৃতের হার কেমন? এ বিষয়টি একটু খতিয়ে দেখা যাক। এখানে, প্রতি বছর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে গড়ে ৬ লাখের উপর, ক্যান্সারে ৫ লাখ ৫৯ হাজার, ডায়াবেটিসে ৭২ হাজার, স্ট্রোকে ১ লাখ ৩৭ হাজার, সাধারণ ফু’তে ৫৬ হাজার। এছাড়া গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট, এইডস, আত্মহত্যা বা খুনের মাধ্যমেও মৃতের সংখ্যা নেহাত কম নয়। প্রশ্ন উঠছে, প্রায় এক বছরে মাত্র সহস্রাধিক লোক মারা যাওয়ার কারণে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ন্যাশনাল ইমারেজেন্সি জারির মাধ্যমে কার স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে? ইতিমধ্যে সনোফি অ্যাভেন্টিসসহ অন্যান্য বহুজাতিক কোম্পানির নিকট থেকে সরকার বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ভ্যাকসিন ক্রয় করেছে। সোয়াইন ফু ছড়িয়ে পড়ার প্রথম দিকে তা মোকাবেলা জন্য বাজেট ঘোষণা হয়েছিল ৪ শত কোটি ডলারের, বর্তমানে তা আরো বাড়ানো হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই ৫০ মিলিয়ন ডোজ সোয়াইন ফু ভ্যাকসিন এবং ডিসেম্বরের মধ্যে আরো ১৫০ মিলিয়ন ডোজের অর্ডার দেয়া হয়। সোয়াইন ফুতে নভেম্বরের প্রথম সপ্তা পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৪ লাখ ৪০ হাজার হলেও মৃতের সংখ্যা ৫ হাজার ৭০০ জন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮ সালে শুধুমাত্র হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ৭.২০ মিলিয়ন লোক, স্ট্রোক করে মারা যায় ৫.৭১ মিলিয়ন, শ্বাস কষ্টে ৪.১৮ মিলিয়ন, ডায়রিয়ায় ২.১৬ মিলিয়ন, যক্ষ্মায় ১.৪৬ মিলিয়ন, রোড অ্যাকসিডেন্টে ১.২৭ মিলিয়ন। ইতোমধ্যে কথিত এ রোগ নিয়ে বহুজাতিক কোম্পানি ব্যাপক মুনাফা আয় করে নিয়েছে। রোগের ভাইরাস যতটুকু প্রসারণ হয়েছে, তার থেকে অনেক বেশি মাত্রায় ছড়িয়েছে মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলো। ওষুধ কোম্পানির সাথে গাঁটছড়ার মাধ্যমে মিডিয়া কোম্পানিগুলো এ পরিস্থিতি তৈরি করে। বাংলাদেশেও প্রথম দিকে কথিত সোয়াইন ফু নিয়ে তথ্য মাধ্যম ব্যাপক শোরগোল তোলে, যদিও তাদের সে আয়োজন শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। পরে বাংলাদেশে যে চার জন সোয়াইন আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছিল, তাদের কেউ সুনির্দিষ্টভাবে সোয়াইন ফু’তে মারা যায়নি। বর্তমানে শুধু সোয়াইন ফু’র ক্ষেত্রে নয়, অন্যান্য বিষয়েও আলোচনা তৈরির মূল মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বহুজাতিক মিডিয়া প্রতিষ্ঠান। যে কারণে আজ থেকে প্রায় তিন দশক আগে মিডিয়া গবেষক বেন বাগডিকিয়ান বলেছিলেন, “জনগণ কতটা জানবে,কতটা শুনবে তা এক সময় ঠিক করে দিত রাজা ও পুরোহিতবৃন্দ, এখন নির্ধারণ করে গণ মাধ্যম. গণ মাধ্যম যা সম্প্রচার করে না জগতে তা সংঘটিত হয় না.গণ মাধ্যম এখন শুধু বাস্তবের প্রতিফলন নয়, বরং বাস্তবের উৎস। ৮০ এবং ৯০’র দশকেও অনেকের চিন্তা-সমালোচনা এবং পর্যালোচনায় বাগডিকিয়ানের এই ধারণার সমর্থন পাওয়া যায় এবং বাগডিকিয়ানের বক্তব্য নাকচ করে দেয়ার মত নয়।
সুতরাং, একটি জাতীর/রাষ্ট্রের জনগণ কি নিয়ে ভাববে, কি নিয়ে আলোচনা করবে, কি নিয়ে প্রতিবাদ করবে, কি প্রতিরোধ করবে তা গণমাধ্যম দ্বারা অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রিত হয়। অর্থাৎ গণমাধ্যমের কাজ হবে রাষ্ট্রের জনগণের চিন্তা, চেতনা, আচরন প্রভাবিত করা। এতে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে ঐ জাতিটির নিজস্ব সংস্কৃতি, জাতীয়তা বোধ, নৈতিকতা বোধ। কিভাবে গণমাধ্যম দ্বারা জাতিটির সংস্কৃতি এবং জাতীয়তা বোধ, নৈতিকতা বোধ ধ্বংস করবেন তা নিয়ে পরের পর্বে আলোচনা করব।