আমার মতে বাঙ্গালীর নিজস্ব সম্পদ হল আলস্য। ন্যাকামি নয়, পাকামি নয়, ভাঁড়ামি নয়, চ্যাংড়ামি নয়, শুধুই কুড়েমি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই বলেছেন " বাঙালিরা কাজের লোক নহে, কিন্তু বিষয়ী লোক। অর্থাৎ, তাহারা সর্বদাই বলিয়া থাকে, ‘কাজ কী বাপু! ’ ভরসা করিয়া তাহারা বুদ্ধিকে ছাড়া দিতে পারে না; সমস্তই কোলের কাছে জমা করিয়া রাখে এবং যত-সব ক্ষুদ্র কাজে সমস্ত বুদ্ধি প্রয়োগ করিয়া "
কুড়েমি দুই ধরনের। কিছু না করা, এটা খুব শক্ত। আর দুনম্বর হল অপ্রয়োজনীয় কাজ করা, যার কোন মানে নেই সে কাজ করাটাই একধরনের কুড়েমি।
শিল্প, রুপ, প্রেম এসব তো কেজো জগতের কর্মফল নয়, বেকার জগতের অকর্মের ফসল। কেজো পৃথিবীতে এর কোন মানে আছে? নেই। কিন্তু এই অর্থহীনতাই তার সবচেয়ে বড় মুল্য। এর কোন মানে নেই বলেই এসব এত অমুল্য।
প্রমেন্দ্র মিত্রের মতে " কুড়েমি যদি নাই করলাম তাহলে মানুষ হবার দুর্লভ গৌরব কিসের? কাজ তো চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ নক্ষত্র, পশু পাখী সবাই করে। কুড়েমি করবার অধিকার শুধু একমাত্র মানুষেরই।কুড়ে লোক ফাঁকা মাঠ দেখলে দাড়ায় , খানিকবাদে শুয়ে পড়ে। কিন্তু কাজের লোক মাঠ দেখলেই আগে যায় মাপতে, তারপর কত পরিকল্পনা, দখল করার জন্য লাঠালাঠি, মামলা মোকদ্দমা ইত্যাদি ইত্যাদি। ফাঁকা মাঠ দেখলে শুয়ে পড়বার লোক যদি পৃথিবীতে বেশি থাকত তাহলে মাঠ খুঁড়ে পরিখা কাটার প্রয়োজন হত না। "
থমাস হবস এর মতে " Leisure is the mother of Philosophy." তারমানে এই নয় যে কুড়ে মাত্রই দার্শনিক। তবে দার্শনিকরা একটু কুড়ে হয়েই থাকে এই যা।
রবীন্দ্রনাথের মতে " অবসরের মধ্যেই সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ সাহিত্যের বিকাশ, কিন্তু তাই বলিয়া আলস্যের মধ্যে নহে। মানবের সহস্র কার্যের মধ্যে সাহিত্যও একটি কার্য। সুকুমার বিকশিত পুষ্প যেমন সমগ্র কঠিন ও বৃহৎ বৃক্ষের নিয়ত শ্রমশীল জীবনের লক্ষণ তেমনি সাহিত্যও মানবসমাজের জীবন স্বাস্থ্য ও উদ্যমেরই পরিচয় দেয়, যেখানে সকল জীবনের অভাব সেখানে যে সাহিত্য জন্মিবে ইহা আশা করা দুরাশা। বৃহৎ বটবৃক্ষ জন্মিতে ফাঁকা জমির আবশ্যক, কিন্তু মরুভূমির আবশ্যক এমন কথা কেহই বলিবে না। "
সবশেষে একটি গল্প বলে শেষ করছি...।
২০ বছরের স্বাস্থ্যবান এক ছেলে চোখের উপর টুপি টেনে দিবানিদ্রা দিচ্ছিল। এক কেজো লোকের তা সহ্য হল না। ছেলেটির চরম আলস্যে রেগে গিয়ে বললেন " জলজ্যান্ত স্বাস্থ্যবান ছেলে হয়ে এভাবে কুড়ের মত ঘুমাতে তোমার লজ্জা করে না? "
ছেলেটি চোখের টুপিটা তুলে বলল " না। কেন, আপনার আপত্তি কেন?"
ভদ্রলোক ঃ এই বয়সে তোমার পরিশ্রম করা উচিত, কাজকর্ম করা উচিত, পয়সা রোজগার করা উচিত।
ছেলেটিঃ তারপর?
ভদ্রলোকঃ রোজগার করে অন্য দশটা পুরুষের মত বিয়ে করা উচিত।
ছেলেটিঃ তারপর?
ভদ্রলোকঃ তারপর ছেলেপুলে হলে তাদের মানুষ করা উচিত।
ছেলেটিঃ তারপর?
ভদ্রলোকঃ তারপর বৃদ্ধ বয়সে রেস্ট করবে।
ছেলেটিঃ তো আমি তো এখনই তাই করছি।
বলে টুপিটা চোখের উপর টেনে নির্বিকার চিত্তে আবার দিবানিদ্রায় মগ্ন হল।
দারুন লজিক, শেষ জীবনে তো এই বিশ্রামই করতে হবে। মাঝখানে টাক্স রোজগার কর, সংসার কর... কি দরকার এত ঝক্কি ঝামেলার।