১.
আত্মীয়তার সূত্রে এক মুরুব্বীর বাসায় কয়েকদিন কাটিয়েছিলাম। মুরুব্বী আবার খানদানী জমিদার বংশের, দাদার তাঁর সত্যি সত্যিই বিরাট জমিদারী ছিলো; তাই নিজে জমিদার না হলেও কথায় কথায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পূর্বপুরুষের সেই বাহারী জমিদারীর প্রসঙ্গ তুলে আনায় যে মুরুব্বী সিদ্ধহস্ত ছিলেন, সেটা বুঝতে একদিনেরও কম সময় লেগেছে। তবে মুরুব্বীর এরকম বাহাদুরী ফলানোর পেছনে কারণ যে নেই তাও না; শুধু জমিদারীই যে তাঁরা হারিয়েছিলেন তা তো নয়, কোন কাজকর্ম না করে ঘরে বসে নবাবী চালে চলা আর তালুক বেচে খাওয়ার যে তরীকা তাঁদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিলো, তাতে এই প্রসঙ্গ তুলে গর্ব করার চেয়ে বেশী কিছু করার সাধ্যও তাঁর ছিলোনা।
যদিও আতিথ্য গ্রহনের পর এরকম বদনাম করাটা অভব্য আচরণে পড়ে, তাও লেখার খাতিরে লিখতেই হচ্ছে; যেক'দিন ছিলাম সেখানে, মুরুব্বীর সাথে যেখানে গিয়েছি, সেখানেই দেখেছি প্রত্যক্ষভাবে হোক, পরোক্ষভাবে হোক, তিনি যে জমিদার বংশের উঁচুজাতের লোক এবং তাঁকে যে আশপাশের সবার মান্যগণ্য করা উচিত, তা প্রকাশ না করে তিনি থাকতে পারতেননা। যেমন, ধরুন মাছ কিনতে গেলেন মুরুব্বী, হাতে একশো টাকা আছে মাত্র। কিনলে কেনা যাবে গুড়া মাছ কয়েক ভাগ, বা বড়জোর একটা নলা মাছ! এখন বাজারে গিয়ে চার-পাঁচশো টাকার মাছ দেখে সাধ আর সাধ্যের লড়াইয়ের সাথে সাথে মুরুব্বীকে মানসম্মানের লড়াইও করতে হবে; উপায় নেই, কারণ আশপাশে প্রচুর মানুষজন আছেন যারা তাঁকে জমিদারের নাতি বলে চেনেন।
সেজন্যই দেখতাম, হাতের মুঠিতে একশো টাকা গুঁজে ধরেই মুরুব্বী বাজারের সবচেয়ে বড় মাছের সামনে গিয়ে মাছওয়ালাকে জিজ্ঞেস করেন যে মাছের ওজন কতো। জমিদারের নাতির সামনে বিগলিত হাসিমুখে বিক্রেতা যখন বলে সাড়ে তিন সের, তখন তিনি মুখের পেশী নাড়িয়ে চাড়িয়ে খানিকটা অবজ্ঞার প্রকাশ দেখান (এই একটি কাজে এঁদের জুড়ি থাকেনা, অবজ্ঞা, উপহাস প্রকাশে)। মাছ তো কিনবেননা জানিই, তারপরও দেখি দাঁড়িপাল্লা দিয়ে মাছের ওজনও করাচ্ছেন, মাছের গায়ে টিপে-টুপে দেখছেন, কানকো তুলে মাছ তাজা কিনা তাও পরীক্ষা করছেন। সবশেষে হতাশমুখে "পাঁচ সের না হইলে কি বোয়াল মাছ খাই মজা আছে নিকি!!" বলতে বলতে গুড়া মাছের দিকে হাঁটা শুরু করলেন। যেতে যেতে আশপাশের লোকজনকে শুনিয়েই স্বগোতোক্তি করেন, "করম আলী তো সকালেই কাতল মাছ নিয়া গেছে, অখন আমি কিছু গুঁড়ামাছ নিয়া যাই।" মুরুব্বীর কথা শুনে যারা তাঁর ট্যাকের খোঁজ রাখেনা, তারা খানিকটা হতচকিত হয়; যারা ট্যাকের খবর রাখে তারা মুচকি মুচকি হাসে।
এখানেই শেষ না, যেমন ধরুন বাজার থেকে ফিরতে ফিরতে পথেই হাতের ডানে বা বাঁয়ে জোলাবাড়ীর নারকেল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে নিজের সগর্ব অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে জোলার দুবাই বা নিউইয়র্কবাসী ছেলের পাঠানো টাকায় করা পাকা দোতলা বাড়ীটি, টিনশেড যদিও। মুরুব্বী ইচ্ছে করেই আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন সেদিকে, তারপর এই ক'বছর আগেও জোলারা অঘ্রান মাসে কিভাবে তাঁদের বাড়ীতে এসে একবেলা পেটপুরে খাওয়ার জন্য বাপে-পুতে লাইন ধরে বসে থাকতো সে গল্প একদম দাঁড়ি-কমাসহ বয়ান করবেন। অথবা, মফস্বলের হাটে গিয়ে দেখলেন আকন বাড়ীর ছেলে তার কটকটে লাল রঙের টয়োটায় সুখী সুখী চেহারায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে উঠছে, বেড়াতে যাচ্ছে। মুরুব্বী খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবেন যে ছোটলোকের পয়সা হলেও কেন রুচির পরিবর্তন হয়না! এই রঙের গাড়ী মানুষে কেনে! সেখান থেকে দাদার ঘোড়ার গাড়ী বা বজরার গল্প শুরু করাটা তাঁর জন্য তখন মুহূর্তের ব্যাপার মাত্র।
উপরে যে মুরুব্বীর কথা বললাম, তিনি একটা কমপ্লেক্সে ভুগছেন, এই কমপ্লেক্সের কথা আমরা সবাই কমবেশী জানি। একসময় নিজেদের অনেক ছিলো, এখন শুধু যে নেই তাই নয়, এখন অন্যদের অনেক হচ্ছে সেটাও তাঁকে দেখতে হচ্ছে। এই অন্যদের হচ্ছেটাকে তিনি সহজভাবে নিতে পারছেননা, পুরোনো স্মৃতি বা পূর্বপুরুষ সম্পর্কে শোনা কথা সেখানে বারবার হানা দিচ্ছে। সেই স্মৃতি রোমন্থনই অন্যের প্রতিপত্তি দেখে মনকে শান্ত করার একমাত্র ঔষধ তাঁর জন্য। অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম, এই কমপ্লেক্সটার কি নাম দেয়া যায়?
২.
পৃথিবী জুড়ে অধুনা সাড়াজাগানো ছবি স্লামডগ মিলিয়নিয়ার সম্পর্কে নানা খবর পড়তে পড়তে আবারও একইরকম আরেকটি কমপ্লেক্সের কথা মাথায় খেলছে। সেটা একদা সবকিছু হাতের মুঠোয় থাকা বৃটিশদের, এবং মূলতঃ বৃটিশদেরই কমপ্লেক্স।
একসময় বৃটিশ সাম্রাজ্যে সূর্যাস্ত হতোনা, আজ হয়। শুধু তাইনা, আমেরিকাকে বাঘ ভেবে বৃটিশ পান্ডবকে আজ "পুডল" হয়েও নাচতে হয়। যে প্রতাপে তারা জগত নিয়ন্ত্রণ করেছে কয়েক শতক জুড়ে, আজ সেই প্রতাপকে ছাড়িয়ে যেতে দেখছে তারা পৃথিবীজুড়ে, নানানভাবে নানান জায়গায়। সেই অভিজ্ঞতা থেকে জমিদারের নাতি ঐ মুরুব্বীর মতোই কমপ্লেক্সের তৈরী হবার একটা সম্ভাবনা দেখা দেয়, সেজন্যই হয়তো স্যুটপ্যান্ট পরে সমুদ্রপাড়ে হাঁটতে থাকা আনস্মার্ট জাপানীদের নিয়ে বা উন্নত জীবিকার জন্য মরিয়া চীনাদের নানান ডেসপারেট কাজকর্ম নিয়ে কৌতুক হাস্যরসে মেতে উঠে তাঁরা আলাদা মজা পান।
তাঁদের সেই মজার লিস্টিটেই নতুন যোগ হয়েছে ভারত, যে ভারত আগামী বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবার সবরকমের পোটেনশিয়াল রাখে, এবং তা প্রকাশও পাচ্ছে সময়ের সাথে সাথে। তাই নাকবোঁচাদের মতো ভারতীয়রাও কতটা রুচিহীন, নিন্মগোত্রের সেটাওতো দেখাতেই হয়! সেই মানসিকতা স্লামডগ মিলিয়নিয়ার বানাতে গিয়ে ড্যানি বয়েলের কাজ করেছে কিনা জানিনা, তবে যেরকম এক্সট্রিম পর্যায়ের দারিদ্র্য আর অনাচার দিয়ে ভারতকে উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে কেউ কমপ্লেক্স খুঁজলে আমি দোষ দিতে পারিনা।
উপরোক্ত কমপ্লেক্সের বিচারে ড্যানি বয়েল আর তাঁর ক্রুরা খানিকটা গ্রে এরিয়ায় আছেন বলে টেনেটুনে পার পাইয়ে দেয়া গেলেও (যদিও আমি তাতে একমত না), বৃটেনের এক ট্যাবলয়েড পত্রিকা দু'চারদিন আগে যা করলো তা কিন্তু কোনভাবেই পার পাচ্ছেনা। যে দরিদ্র বাচ্চা মেয়েটি (রুবিনা আলী) স্লামডগের নায়িকা লতিকার ছোটবেলার চরিত্রে অভিনয় করেছিলো, তার বাবাকে এরা একটি ভুয়া প্রলোভন দেখিয়েছে এই ট্যাবলয়েড। আরব ব্যবসায়ী সেজে তারা মেয়েটির বস্তিবাসী বাবাকে এই লোভ দেখিয়েছে যে মেয়েটিকে তারা ২ লাখ পাউন্ডে কিনে নেবে। ভারতীয় ছোটলোক বলেই হোক, অভাবে স্বভাব নষ্ট বলেই হোক -- মেয়ের বাবা নাকি রাজীও হয়েছেন। এ খবর জগতে সাড়াও ফেলেছে।
ভাবলাম, ট্যাবলয়েড ওয়ালাদের এই এক্সপেরিমেন্ট করার উদ্দেশ্য কি? দক্ষিণ এশিয়ার মানুষেরা কতটা লূজার লেভেলের দরিদ্র সেটা দেখানো? এই ঘটনা দিয়ে কি তারা আরেকবার সমগ্র বৃটেনবাসীকে নিশ্চিত করতে চাইলেন যে ভারতীয়দের এখনও তাদের পর্যায়ে আসতে অনেক দেরী? এই লোভী ফকিরের দল এখনও "অসভ্য" আরবদের কাছে সন্তান বিক্রী করে দেয় -- এটাই কি উপসংহারে টানতে চান ট্যাবলয়েড সাংবাদিক?
মজার ব্যাপার হলো, এই বস্তিবাসী শিশু অভিনেতাদের নিয়ে স্লামডগের বৃটিশ পরিচালক ড্যানি বয়েলের একটা ক্ষত কিন্তু রয়ে গেছে। কারণ, এ সত্যটা ফাঁস হয়ে গেছে যে, এই হতদরিদ্র শিশু অভিনেতাদেরকে বেতন দেবার বেলায় ঠিকই নিজের একটা পরিচয় প্রকাশ করে ফেলেছিলেন। শ্রমের ব্যাপারে যে তিনি জাতিভেদ সমর্থন করেন, সেটা প্রকাশ করে দিয়েছেন অদ্ভুত কিপ্টেমীর মাধ্যমে। তুমি মহারাজ তাজ হোটেলে বসে টেবিলের উপর ঠ্যাং উঠিয়ে এক সন্ধ্যায় ১৯৩৯ ল্যাবেলের যে মদ পান করো, তার অর্ধেক দামও শিশু অভিনেতাদের পারিশ্রমিক হিসাবে দাওনা, আবার বলো, তাদের বেতন ভারতের সাধারণ বেতনের তিনগুণ! তা পরিচালক আর অভিনেতার বেতনের অনুপাত কতো? সেই একই অনুপাতে কি ড্যানি বয়েল নিজের বেতন নিয়েছে? নাকি ভারতীয় আর বৃটিশ, জাতি আলাদা বলে বেতন আলাদা?মধ্যপ্রাচ্যের তৈলশেখেরা এখন চরম চিত্তচাঞ্চল্যের সাথেই ড্যানি বয়েলকে নিয়ে এককাতারে "জামাতে নামাজ" আদায় করবেন।
৩.
চীনা-জাপানীদের মতো ভারতীয়দেরও ছোটলোক হিসেবে প্রমাণ করতে যেভাবে জনাবেরা উঠে পড়ে লেগেছেন, তা দেখে আমার মনে যে বেসিক প্রশ্নটা সবসময় জেগেছে তা হলো, এসব করে এদের আদতে লাভটা হচ্ছে কি! আত্মতৃপ্তি?
তাদের কোন লাভ হোক বা না হোক, আমার একটা লাভ হয়েছে। জমিদারী হারানো উত্তরপুরুষদের পরশ্রীকাতরতাজনিত যে কমপ্লেক্স, তার একটা জুতসই নাম খুঁজছিলাম। একদম খাপেখাপ পেয়ে গেলাম, এটাকে "দ্য গ্রেট বৃটেন কমপ্লেক্স" নাম দেয়া যায়।